দেশবিদেশের উপকথা-সেফালাস ও প্রোক্রিস (গ্রীক)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: সোম, ১৫/০৮/২০১১ - ৪:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সেফালাস ছিলো পবনদেব ইয়োলাসের পৌত্র। পিতামহের মতই দিলদরিয়া ছিলো সে। আর উপরি হিসাবে সে ছিলো খুবই শিকারপ্রিয়। ভোররাতেই সে বনে বনে হরিণ শিকার করতে বেরোতো। আর পুব আকাশ থেকে ঊষাদেবী ইওস তাকে দেখতেন। আহা, কে এমন চমৎকার ছেলেটা? খবরও নিলেন, এ ছেলে পবনদেবের নাতি। জেনে দেবী আরো পুলকিত হলেন আর রোজই তাকে দেখতে লাগলেন আরো ভালো করে। দেখতে দেখতে একদিন দেবীমহাশয়া পড়ে গেলেন প্রেমে।

সেফালাসের বাবা-মা রাজারাণী। ছেলে বড় হচ্ছে, এবারে তাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে তারা অবসর নেবেন ঠিক করলেন। সেফালাসও দিব্যি ভালো ছেলের মতন রাজি হলো। বাবামা দেখেশুনে ভালো বংশের মেয়ে পেলেন বৌমা করে আনার জন্য। আথেন্সের রাজকুমারী প্রোক্রিসের বিয়ে হলো সেফালাসের সাথে। বিয়ের পরে বৌ নিয়ে সেফালাস তো নৌবহর সাজিয়ে বাড়ি ফিরলো। এদিকে বাড়ীতে বধূবরণের আয়োজন চলছে আর ওদিকে সেফালাসকে হরণ করে নিয়ে গেলেন ঊষাদেবী ইওস। মারাত্মক কান্ড!

দেবী তাকে রতনমানিক সাজানো ঘরে নিয়ে যান, হীরাপান্নার পদ্মওয়ালা সরোবরে কেলি করাতে চান, গান শোনান, নাচ দেখান, ভালো ভালো খাবার দেন, আরো অনেক রকমের ছলাকলা করেন, কিন্তু সেফালাস মুষড়ে থাকে, সে মোটেই এসব চায় না। আহারে, নতুন বৌটা তার! সে বাড়ীতে কী জানি করছে! মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য, ঐ নৌবহর আসতে যতদিন লাগে ততদিন বৌকে দেখেছে সে, কিন্তু তার মুখ হৃদয়ে খোদাই হয়ে গেছে ওর। প্রোক্রিসকে ছেড়ে থাকা সম্ভব না তার পক্ষে।

দিনের পর দিন সেফালাস খায় না দায় না, এসব দেখে হাল ছেড়ে দিলেন ইওস দেবী। বললেন, "ঠিক আছে, ফিরে যাও প্রোক্রিসের কাছে। কিন্তু তুমি যেমন তার নাম সার করে দিনরাত সেই নামই জপো, সে তোমার নাম সেভাবে জপে তো? এতদিন তুমি দূরে আছো, সে বোধহয় এতদিনে নতুন কাউকে পেয়ে তাকে নিয়ে আনন্দলীলা করছে।"

সেফালাস রেগে বললো, "না, কখনোই না। আমি যেমন তাকে ভালোবাসি, তাকে ছাড়া আর কাউকে না, সেও তেমনই আমাকেই শুধু ভালোবাসে।"

ইওস গলায় বিষ ঢেলে বলেন, "তাই নাকি? হলেই ভালো। যাও ফিরে, গিয়ে দ্যাখো।"

মুক্তি পেয়ে সেফালাস বাড়ীর দিকে চললো। আহ, কতদিন পরে খোলা হাওয়া, খোলা আকাশ। তার বুকের ভিতরে যে মুক্তিপ্রিয় মানুষটা থাকে, সে যেন এতদিন দমবন্ধ হয়ে মরছিলো। এখন শান্তি। বুক ভরে বাতাস টেনে নিয়ে সে উপত্যকা পার হয়ে এগোতে থাকে মহানন্দে।

দীর্ঘ পথ। চলতে চলতে একসময় সেফালাসের মনের মধ্যে সন্দেহের অঙ্কুর বের হয় সেই বীজটা থেকে, যেটা পুতে দিয়েছিলেন দেবী ইওস। প্রোক্রিস এখনো তাকে ভালোবাসে তো? নাকি এতদিন সেফালাস নেই দেখে আশা ছেড়ে দিয়ে নতুন কোনো লোককে সে বরণ করেছে হৃদয়ে?

সেফালাস ঠিক করলো সে পরীক্ষা করে দেখবে। সে খুব ভালোরকম ছদ্মবেশ নিলো, তারপরে চললো নিজের বাড়ির দিকে।

বাড়ী গিয়ে সে দেখলো সে বাড়ী তখন শোকাভিভূত। বাড়ীর সদ্যবিবাহ করে নতুন বৌ নিয়ে ফেরা ছেলে নিরুদ্দেশ, কোনো খবরও নেই সে কোথায়, বাড়ীর সবার মন খুবই খারাপ। ছদ্মবেশী সেফালাস গিয়ে নিজেকে সেফালাসের শিকারীবন্ধু পরিচয় দিয়ে ঢুকলো বাড়ীতে। প্রথমে তো সেফালাসের বাবা আর মায়ের সঙ্গে দেখা হলো, তারা জানতে চাইলেন সে সেফালাসের কোনো খবর সে জানে কিনা। সে জানালো যে কিছু জানে না, অনেকদিন বন্ধুর সাথে দেখা হয় নি, শুনেছিলো বন্ধু বিয়ে করে ফিরেছে, তাই দেখা করতে এসেছে। বন্ধু নিরুদ্দেশ শুনে সেও হতভম্ব। তারপরে ইত:স্তত করে সে জানালো কিছুদিন এ বাড়ীতে থাকতে চায়, অনেকদূরের পথ পাড়ি দিয়ে আসছে সে, আরো যেতে হবে অনেক পথ, কিছুদিনের বিশ্রাম চায় বন্ধুর বাড়ীতে।

রাজারাণী অতিথিপরায়ণ, রাজি হলেন সাগ্রহে। ছদ্মবেশী সেফালাস স্নান টান করে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিয়ে তাজা হয়ে উঠে বাগানে ঘুরতে গেল বিকালে। সেখানেই ফোয়ারার কাছে বৌয়ের সঙ্গে দেখা। প্রোক্রিসের একবেণীধরা বিষন্ন মূর্তি, শোকপরায়ণা মুখ দেখে সেফালাসের ইচ্ছে হলো তখনই ছদ্মবেশ খুলে ফেলে বৌকে জড়িয়ে ধরে। অতিকষ্টে সে ইচ্ছা দমন করলো সে। তার উপায় নেই, প্রোক্রিসের মন পরীক্ষা না করলে যে তার শান্তি নেই।

পরিচয় হলো, তারপরে কথাবার্তা বলতে শুরু করলো তারা। তারপরদিন আবার দেখা হলো, আরো কথা হলো। সেফালাস কথা কইতে কইতে খুব ভজাতে চেষ্টা করলো প্রোক্রিসকে, এইভাবে যে স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে তার কথা ভেবে কতদিন থাকা সম্ভব? হয়তো সেই স্বামী এখন আরেকজনকে বিয়ে করে সুখে ঘরকন্না করছে কোথাও। প্রোক্রিসেরও উচিত দেখেশুনে ভালো কোনো পুরুষকে নতুন স্বামীরূপে বরণ করা।

কিন্তু প্রোক্রিস টলে না, সে বলে, "আমি সেফালাসের জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করবো। সে ছাড়া আর কেউ নেই, ছিলো না, থাকবে না আমার হৃদয়ে। "

এইভাবে দিন যায়, সেফালাস ছদ্মবেশেই থাকে আর এইভাবে প্রোক্রিসকে নিত্য প্ররোচিত করে তার সাথে পালাতে, স্বামী নিরুদ্দেশে থাকা আর না থাকা একই। সে নিজে যে ওকে কত ভালোবাসবে, কত সুন্দর ঘরদোর দেবে, কাপড় গয়না দেবে, আরো কত কী দেবে, এসব বলে খুব শপথ করে। কিন্তু প্রোক্রিস রোজই সেই একই কথা বলে।

এইভাবে দিনের পর দিন, একই রকম। শেষে একদিন ছদ্মবেশী সেফালাস খুব জপাচ্ছে প্রোক্রিসকে, প্রোক্রিস বলে বসলো, " একদিক দিয়ে ঠিকই তো বলেছ তুমি! সে তো আমায় ছেড়ে আছে ঠিকই। আমি যদি তাকে ভুলি ক্ষতি কী? আমারও তো একটা জীবন আছে! তার উপর তোমার মত চমৎকার লোকের এত আগ্রহ আমাকে নিতে! চলো আমরা দু'জন পালাই।"

আর যায় কোথা! যেন সামনে বাজ পড়েছে! লাফিয়ে উঠে ছদ্মবেশ খুলে ফেলে সেফালাস! চিৎকার করে বলে, "ও! এই ছিলো তোমার মনে! আমি নিজেই সেফালাস, তোমাকে পরীক্ষা করছিলাম। উফ এত বিশ্বাসঘাতক তুমি? আমাকে ধরে নিয়ে গেছিলো দেবী ইওস, কত ছলকলাই করলো আমায় ভোলাতে, কিন্তু তোমার কথা ভেবে খাই নি দাই নি, দিনরাত তোমার নাম জপেছি। আর এখন? বাড়ীতে এসে দেখি এই! তুমি দিব্যি এক লাল্টুমার্কা ছেলের মিঠা মিঠা কথা শুনে পালিয়ে যেতে চাইছ তার সাথে! কী ভয়ঙ্কর! "

প্রোক্রিস একটি কথাও বললো না, চুপ করে শুধু তাকিয়ে রইলো সেফালসের দিকে। সেফালসের লাফানো দাপানো শেষ হলে তাকে মাথা নুইয়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেল প্রোক্রিস, বললো, "আমি চলে যাচ্ছি, আর সংসার করবো না। চন্দ্রদেবী আর্টেমিসের উপাসনা করবো আর বনে বনে শিকার করে জীবন কাটিয়ে দেবো।"

( আমার বিশ্বাস, প্রথম থেকেই সেফালাসকে চিনতে পেরেছিলো প্রোক্রিস, কিন্তু কিছু বলে নি, দেখছিল পাগলা লোকটা কী করে, কতখানি যায়। কিন্তু দিনের পর দিন ঘ্যান ঘ্যান চলছে দেখে একসময় সে নির্ঘাত ধৈর্য হারিয়ে এই কান্ডটি করলো। কাহাতক পারা যায়! )

প্রোক্রিস চলে যাবার পরে সেফালাস সম্বিৎ ফিরে পেলো, কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই, প্রোক্রিস নেই নেই নেই, কোথাও নেই। নিজের ভুলে তাকে হারালো সেফালাস।

অনুতপ্ত ও বিষন্ন সেফালাস সন্ধানে বেরোলো প্রোক্রিসের। বহু স্থান সন্ধান করে অনেক ঝঞ্ঝাট ঝামেলা সয়ে অবশেষে সন্ধান পেলো প্রোক্রিসের। পাহাড়ের চূড়ায় আর্টেমিসের পবিত্র পাথর, তার কাছেই একটা গুহা, সেখানে থাকে প্রোক্রিস। দেবীর উপাসনা করে আর দেবী তাকে তীরধনুক বর্শা এইসব দিয়েছেন, সেই দিয়ে শিকার করে আহার সংগ্রহ করে।

সেফালাস গিয়ে পায়ে পড়লো প্রোক্রিসের, ক্ষমা চায়, প্রোক্রিসকে ঘরে নিয়ে যেতে চায়। প্রোক্রিস ছিটকিয়ে সরে গিয়ে বলে, " আমার কাছে ক্ষমা চাও কেন? ক্ষমা চাও উপরের দেবতাদের কাছে। আর ঘর-সংসার আমার সইবে না, এত গন্ডগোল যেখানে, সেখানে ফিরে কী হবে? আমি এখানে ঢের ভালো আছি, তুমি ফিরে যাও।"

সেফালাস খুব মিনতি করে, বলে, "মানুষে ভুল করে না? একটি বার প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ আমাকে দেবে না তুমি? নিজেও তো মানুষ তুমি, মানুষের দুর্বলতার কথা ভুলে যাবে? আমি যাবো না, এই এখানে পড়ে রইলাম, দেখি কতদিন তুমি শক্ত হয়ে থাকো।"

যাই হোক, অনেক বিস্তারিত ব্যাপার ঘটলো, সে আর না বলি। শেষ অবধি পাগলটাকে রোখা যাবে না জেনে প্রোক্রিস ফিরতে রাজী হলো। তখন সেফালাসের আনন্দ দ্যাখে কে! সে প্রোক্রিসকে ঘাড়ে তুলে নাচতে নাচতে বললো, "আমরা একসাথে শিকার করতে যাবো বনে বনে, কেমন তাই তো?"

তারা ফিরে চললো একসাথে, এরপরে বেশ অনেক বছর খুব সুখী স্বামী স্ত্রী হিসাবে তারা জীবন কাটিয়েছিলো। একসাথে তারা বনে বনে শিকারও করতো। শিকার করতে গিয়েই শেষে---

না, সে অন্য গল্প, সে আরেকদিন হবে।

*******


মন্তব্য

মিলু এর ছবি

শুরুর কয়েকটা লাইনে জাস্ট চোখ বোলাচ্ছিলাম। শেষে আর চোখই সরাতে পারলাম না, দুই দিকে বাড়ি খেতে থাকা টেবিল টেনিস বল ফলো করার মত পড়েই গেলাম একটানা। গুরু গুরু

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ মিলু।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অপছন্দনীয় এর ছবি

একবার হলেও সহ্য করা যেতো, যতক্ষণ না বলবে তাকে ভুলে যেতে পারে ততক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকবে! ব্যাটা গরু কোথাকার! প্রোক্রিস আর্টেমিসের পূজারী যখন হয়েছে তখন গরুটার মাথায় একটা মুগুর ঝেড়ে দিলেই তো চলতো।

কাঁহাতক পারা যায়!

তুলিরেখা এর ছবি

ও মেয়ে জানতো ঠিক এইটে করাবার জন্যই উপরের তেনারা বসে আছেন, তাইলে সেই ছুতোতে নানারকম সৃষ্টিশীল পানিশমেন্টের আয়োজন করবে! ওর পিসিদের তো ওরকম করলো কিনা!
তাই সে ঐ জালে জড়ায় নি। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।