জেগে ওঠো মা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৭/০৮/২০১১ - ৪:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগে রিকসায় করে এনে দিয়ে গেছে মেযেটাকে একটা ছেলে । ছেলেটা মেয়েটার কেউনা। রাস্তায় পড়ে ছিল মেয়েটা। শত শত পথচারির কারো সময় হয়নি রাস্তায় পড়ে থাকা মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে । যে যার মত করে কেটে পড়েছে। বাসটা চাপা দিয়ে চলে যাবার পর বিশ মিনিট পড়ে ছিল মেয়েটা রাস্তায়। কেউ ধরেনি। সবাই ভেবেছিল মরে গেছে। তাই হয়ত গায়ে পড়ে কেউ ঝামেলায় যেতে চায়নি। ঠিক এমন সময়ই ছেলেটা সে রাস্তাটা ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। পড়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে কাছে এগিয়ে যায় ছেলেটা। গিয়ে দেখে, মেয়েটা একটু একটু করে নড়ছে। পাশে বসে মেয়েটার ছোট বাচ্চটা কাঁদছে। শিশুটা অক্ষত আছে কিন্তু কি হয়েছে বোঝার মত বয়স ওর হয়নি। বয়স দুই এর মত হবে। এরপর পথচারী ছেলেটা তাড়াতাড়ি একটা রিকসা ডেকে মা আর বাচ্চাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগে নিয়ে যায়। যেতে যেতে মেয়েটা শুধু বলতে পেরেছিল, ওর বাসা তেজগাঁও কলোনী বাজার। তারপরেই জ্ঞান হারায় মেয়েটা।

গত বার’টা দিন মেয়েটা পড়ে আছে হাসপাতালের বেডে। গভীর কোমায় এখন সে। সেই যে অজ্ঞান হারিয়েছিল, তারপর আর জেগে ওঠেনি মেয়েটা। ছোট্ট শিশুটা সারাদিনই বেডে এপার থেকে ওপারে মায়ের শরীরটার উপরে ঘুরাঘুরি করে। মায়ের জ্ঞান ফিরে না। মাকে বার বার হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়। মার ঘুম ভাঙ্গেনা। শিশুটা কান্না করে। অনেক কাঁদে। তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়ে। হাসপাতালের আয়াগুলো যারা টাকা ছাড়া একটা পাও নড়েনা, মরা দেখতে দেখতে যাদের হৃদয় পাথর হয়ে গেছে, অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তাদের চোখ থেকেও। ওরা ফিডারে দুধ দেয় বাচ্চাটাকে। ও খায়না। খাবে কি করে? ও যে মায়ের বুকের দুধে অভ্যস্ত। মা’টাকে নল দিয়ে খাবার দেয়া হচ্ছে। এই খাবারে কি আর বুকে দুধ আসে? তারপরও একসময় মায়ের বুকটা খুলে দিতে হয় বাচ্চাটার জন্য। অসার হয়ে পড়ে থাকা মায়ের বুকটায় ঝাঁপিয়ে পড়ে অবুঝ সন্তান। কান্না থামে ওর। তারপর আবার মার শরীরটা ধাক্কা দিয়ে আকুতি জানায় মাকে জেগে উঠতে। তারপর একসময় আবার ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

এই কয়েকদিনে বাচ্চাটাকে বেশ ভালবেসে ফেলেছে হাসপাতানের ডাক্তার, নার্স আর আয়ারা। প্রথম প্রথম কারো কোলেই যেতে যেতে চাইত না। সারাক্ষন শুয়ে থাকা মায়ের পাশে বসে আপন মনে খেলত, ক্ষনে ক্ষনে কেঁদে উঠত আবার একটু পরেই ভুবন ভোলানো হাসিতে হাপাতালের সমস্ত বিষাদকে ঢেকে দিত। মা’র কোন সারা না পেয়ে আবার কেঁদে উঠত। এখন একটু একটু করে নার্স, আয়া আর ওয়ার্ড বয়দের চিনতে শিখছে। ওদের কোলে এখন আর কান্না করেনা। ভারী অভিমান হয়েছে মায়ের উপর। কিন্তু মায়ের সাথে অভিমান করে বেশীক্ষন থাকতে পারেনা। কান্না জুড়ে দেয় একসময়। তখন মার কাছ থেকে ঘুরিয়ে আনলে আবার চুপ হয়ে যায়। খেলতে থাকে আপন মনে। এতদিন হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি কারো সাথে শিশুটা। হাসপাতালের সবাই ওর নাম দিয়েছে রুপালী। রুপালী এখন সবার খুব প্রিয়। সবাইকে কাঁদায় আবার সবাইকে হাসায়। ওর রুপালী নামটা হয়েছে একটা বিশেষ কারনে। ওর মার পাশের বেডেই ওর সমান অন্য একটা শিশু মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে। এই দেশের চালকরা এতটুকু শিশুকেও রেহাই দেয়নি।

তেজগাঁও কলোনী বাজারে অনেক খোঁজাখুজির পর মেয়েটার বস্তির মধ্যে ঘরটা খুঁজে পেয়েছে সাংবাদিকরা। খুব বেশী লোক চেনেনা মেয়েটাকে। এই বস্তিতে সে নতুন এসেছে। মাত্র দু'মাস আগে। ছ,শ টাকায় ঘরটা ভাড়া নিয়েছে। রাস্তার ওপারে দুটো বাড়ীতে ঠিকা কাজ করে সে । আগে টঙ্গীতে একটা বস্তি থাকত। ওখানেও বাসাবাড়ীতে ঠিকা কাজ করত। মেয়েটার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। স্বামীটা শুধু টাকার জন্য মাঝে মাঝে আসতো। টাকা না দিলে মারধোর করত। এতদিন বাচ্চাটার মুখের দিকে চেয়ে আঁকড়ে পড়েছিল টঙ্গীর বস্তিটাতে। ভাবত স্বামীটা পাষন্ড হলেও বাচ্চাটার বাবা। কিন্তু এমন মার মরল এতদিন, ভাবল এভাবে মার খেলে এখানে থেকে মরে যেতে হবে। পালিয়ে এল মেয়েটা একদিন। এই বস্তিতে আসার পর দু'টো কাজও ম্যানেজ করো নিয়েছিল। থাকত বেশ নিরিবিলি। তাই প্রতিবেশীরা এরচেয়ে বেশী কিছু বলতে পারেনি। কোথাকার মেয়ে। কোথায় তার গ্রাম কিছুই বলতে পারেনি কেউ।

রুপালী এখন হাটাহাটি করে সারাটা ওয়ার্ড জুড়ে। কিন্তু কারো সাথে কোন কথা বলেনা। কেউ কিছু বললে শুধু মাথা নাড়ে। নাম জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকে। কিছু বলে না। কিছুক্ষন পরপর মাকে এসে ধাক্কা দেয়। ওর শিশু মনটাতে যে বড় অভিমান। মা ছাড়া কারো সাথেই কথা বলবেনা রুপালী। প্রতিক্ষায় থাকে এক শিশু মন। কখন জাগবে মা? আজ কতদিন হয়ে গেল মা রুপালীকে কোলে তুলে নেয়না। গল্প শোনায় না। ছড়া শোনায় না। কপালে চুমু খায়না। মা’টা কেমন যেন ভূলে গেছে? এই ছোট্ট শিশুটার চোখ দু’টো হয়ে উঠেছে কি করুন! গভীর আকুতির বহ্যিপ্রকাশ ঘটায় শিশুটি বারবার মা’কে ধাক্কা দিয়ে। শিশুটার মৌনতা ভাষা হয়ে স্পষ্ট হয় ওর চেহারায়। জেগে ওঠো মা। রুপালীর মৌনতা সবার আর্তি হয়ে ওঠে। জেগে ওঠো মা। মা তুমি না জাগলে তোমার সন্তান তোমাকে ক্ষমা করবেনা। আমরা এই বাংলাদেশকে ক্ষমা করবনা।

(দৈনিক প্রথম আলোতে ৯ আগষ্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে গল্পটি লেখা হয়েছে। মূল ঘটনা প্রায় অক্ষুন্ন রেখে এখানে গল্পাকারে উপস্থাপিত হলো।)

সাইফ জুয়েল


মন্তব্য

দ্রোহী এর ছবি

আপনার গল্পে সত্যিকারের বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠেনি। সত্যিকারের বাংলাদেশে দশ-পনের দিন পরে রুপালীর মায়ের খাবারের নল খুলে ফেলার কথা। টাকা পয়সার খবর নাই শুধু শুধু খাবারের নল লাগিয়ে রেখে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী? মন খারাপ

সাইফ জুয়েল এর ছবি

গল্পটা লিখতে গিয়ে নিজের কাছেই অনেক কষ্ট লাগছিল, তাই সম্ভবত সত্যিকারের বাংলাদেশের আরো কিছু রুঢ় চিত্র তুলে আনতে পারিনি। কষ্ট করে পরার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।

বন্দনা এর ছবি

আশা করতে দোষ কি আমার দেশের মানুষগুলো আসলেই কখন ও একদিন মানুষ হয়ে উঠবে।পত্রিকায় নিউজটা পড়েছিলাম।আপনার লিখাটা ভালো লাগলো সাইফ জুয়েল।

সাইফ জুয়েল এর ছবি

ধন্যবাদ বন্দনা দিদি। আশায় করেই তো মানুষ বাঁচে। আমাদেরও একদিন গর্ব করার মত অনেক কিছু থাকব ।

guest_writer এর ছবি

নিউজটা পড়েছি...তবে আপনি অনেক ইনফরমেশন দিলেন...সেদিন তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীর র ঘটনার নিউজটা পড়লাম...কোন গাড়ী নাকি থামছিলো না জলী এবং ক্যাথ্রিন র জন্যে...তার আগে একটা নিউজ পড়েছিলাম কোন এক সাংবাদিক মারা গেছে লাশটা পরেছিলো...এক বছরের বাচ্চাটা কোলের উপর কাদছিলো...কেউ কাছে আসছিলোনা...মানুষ জন এত্ত খারাপ হচ্ছে কেন দেশের?...একটা সড়ক দুর্ঘটনা হলে কেউ এগিয়ে আসেনা...আমি যদি রাস্তায় আধ্মরা বা পুরা মরে পরে থাকি কেউ ই আসবেনা?...কি হয়ে যাচ্ছি আমরা আসলে?...
nawarid nur saba

সাইফ জুয়েল এর ছবি

ধন্যবাদ সাবা। অন্ধকারের পরই হয়ত আলো আসবে। আমরা যদি ব্যক্তিগতভাবে সবাই আলোকিত হতে চেষ্টা করি তাহলে একদিন আবার পুরো দেশ, সমাজ আলোকিত হয়ে উঠবে। আসুন আমরা আলোর প্রতিক্ষায় থাকি।

guesr_writer rajkonya এর ছবি

গল্প হিসেবে সুন্দর। কিন্তু বাস্তব বড় জঘন্য।

সাইফ জুয়েল এর ছবি

আসলেই রাজকন্যা, বাস্তবতাটা আজকাল অনেক বেশী জঘন্য হয়ে গেছে। আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি। আমার আমরা মানুষ হবো একদিন।

তানিম এহসান এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।