ঈদ অনুভূতি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ৩১/০৮/২০১১ - ৮:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এইচএসসি পর্যন্ত নিজেকে খুব ভাগ্যবান ভাবতাম, ছোট থেকেই প্রতিটা ঈদে এত আনন্দ ছিল, এত ভাল লাগত, কিন্তু এর পরে আজও তেমন আনন্দ পাই না। আগেও যে খুব মজার কিছু করতাম তা নয়, কিন্তু তখন সবই এত বেশি ভাল লাগত, সব কিছুর জন্যই একটা প্যালপিটেশন ছিল। এখন যেন কোনও কিছুতেই আনন্দ নেই।

যখন প্রাইমারীতে পড়ি তখনকার ঈদের প্রধান আনন্দ ছিল ঈদের নামাজের পর, সালামী কালেক্ট করে বাসায় না জানিয়ে কলোনীর সব বাচ্চাদের বিশাল ব্যাটালিঅনের সাথে কাঁটা তার দেয়া প্রায় ৭ ফুট উঁচু দেয়াল টপকে পাশের কলোনীর শেষ প্রান্তের মেলায় যাওয়া আর খেলনা কেনা। সবসময়ই ঈদের নতুন জামাটা ছিড়ে যেত ওই কাঁটা তারের খোঁচায়, এছাড়া বাসায় ধরা পড়ার আর কোনও উপায় ছিলনা, কিন্তু ভাগ্য খারাপ, প্রতিবারই ধরা পড়তাম আর ধোলাই খেতাম সাথে নতুন জামা ছিড়ে যাওয়ার দুঃখতো ছিলই।

হাই স্কুল থেকে ঈদের দিনের আনন্দ কমতে থাকে কিন্তু ঈদের আগের রাতের আনন্দ বাড়তে থাকে দ্বিগুন হারে। চাঁদ ওঠার পরপরই শুরু হত খেলা, বরফ পানি নয়তো টিলোস্প্রেস। সারা বছর দিনের আলোয় খেলতাম, মাগরীবের আযানের সাথে সাথে ঘরে ঢুকতাম আর সেদিন হত তার উল্টোটা। যদিও বাবা সবসময় ঝামেলা করতো কিন্তু ইফতারের পর বাবা মসজিদে চলে যেতেই বেরিয়ে পড়তাম, সবাই মিলে ঈদের চাঁদ খোঁজা, তারপর শুরু হত আলো আধারিতে খেলা। সে খেলার মজাই আলাদা, মনে মনে ভয় বাবা এসেই খুঁজবে, ডাকবে ঘরে যেতে, কিন্তু ঘরে যেতে একটুও মন চাবেনা, সেই ভয় নিয়েই খেলতে থাকতাম আর খেলা শেষে ঘরে গিয়ে কঠিন মার। তবুও কত ভাল লাগত সে সময়গুলো।

তখন সারা বছর ভোরে ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট লাগলেও ঈদের দিন খুব ভোরে উঠে গোসল করতেও কত ভালো লাগত! আগে লাক্স সাবান ছিল সাদা আর নেভী ব্লু রঙ্গের মোড়কে, ঈদের ভোরের গোসলের কথা মনে পড়লে এখনও সেই লাক্স সাবানের গন্ধ পাই।

আরেকটু বড় হলে খেলা বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু নতুন একটা আইটেম ছিল, কলোনীর বড় আপু আর ভাইয়ারা দল বেঁধে কাছের ফুলের বাগানে হামলা করত, ছোট ছিলাম তাই বাগানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম, আপা ভেতরে ঢুকত, যে যত পারে ফুল ছিড়ে আনত আর গার্ডের ধাওয়া খেয়ে সবাই মিলে সেই যে দৌড়, একদৌড়ে বাসায়। দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবতাম, যদি গার্ডের হাতে ধরা পড়ি তাহলে আর কাল ঈদ করতে হবেনা, আর দৌড়ের বেগ বেড়ে যেত।

কলেজে ঈদের আনন্দ ছিল ভিন্ন। দূরে বা আগে যাইনি এমন কোথাও ঘুরতে যাওয়া। এখানে যাওয়া যাবেনা, ওখানে যাওয়া যাবেনা, একা যাবেনা এমন কড়া নিষেধে থাকতাম সারা বছর, কিন্তু ঈদের দিন কোনও নিষেধ শুনবোনা বলে রাখতাম। তখনকার মজাটা যত না নতুন জায়গা দেখার তার চেয়ে বেশি বোধয় ভয় আর উটকো ঝামেলায় পড়ার মধ্যেই ছিল। প্রতিবারই হয় ট্যাক্সি ড্রাইভার ভুল পথে নিয়ে যেত আর আমরা এতগুলো মেয়ে একা! এখন কি হবে! এই ভয়েই শেষ নয়তো কারো নতুন স্যান্ডেলে পায়ে ফোস্কা পরে হাঁটতে পারছেনা কিন্তু হাঁটতে হবে অনেক পথ নয়তো গন্তব্যে পৌঁছার সাথে সাথেই সন্ধ্যা, বেড়ানো আর হলনা, এমনসব ঝামেলা নিয়ে নিজেদের কিচির মিচিরের মধ্যেই কত আনন্দ ছিল, এখন এসি গাড়িতে ঘুরেও সে মজা পাইনা।

ঈদের সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল নতুন জামা, এখনও পড়ি, আগে একটা পড়তাম এখন হয়তো একাধিক কিন্তু উত্তেজনা নেই। কখনও ঈদে নতুন পোষাক নেয়াটাই ঝামেলার মনে হয়। এটা কি শুধুই বয়সের কারনে? অনেক বছর ধরে ভেবে আসছি কেন ঈদে আর আনন্দ পাইনা, বড় হয়েগেলে ঈদে আনন্দ হয়না এটা মেনে নিতে পারিনা এখনও, মনেহয় ঈদ এমন একটা বিশেষ ব্যাপার যা সবসময় আনন্দদায়ক থাকবে।

দু চার বছর আগেও শুধু আমারই ঈদে আনন্দ নেই আর সবার আনন্দ আছে এই ভেবে ঈদের আগের দিন থেকে রাগে গা জ্বলে যেত, ধাড়ি ধাড়ি মানুষগুলোকে যখন মুখে আল্লাদি হাসি নিয়ে সাজুগুজু করে ঘুরে বেড়াতে দেখতাম তখন মনে হত, এরা ভাবছে খুব আনন্দ পাচ্ছে আসলে না, আনন্দ কি এরা হয়তো জানেনা নয়তো ভুলে গেছে। আবার ভাবতাম সমস্যা কি শুধু আমার মনেই?

তারপর অনেকদিন সেই রাগটাও আর হয়না, কিছুই মনে হতনা। কিন্তু এবার কেনযেন মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠছে, মনে হচ্ছে কারনটা খুঁজে বের করতেই হবে নয়তো এই ঈদে আনন্দ পেতেই হবে, এমন একটা কিছু করতেই হবে।

কিন্তু কি করব? পরিচিত অনেকেই আছে যাদের ফোন করলেই শুধু বলবে বাসায় আয় বাসায় আস, কিন্তু কারো বাসায় গিয়ে বসে কিছুক্ষন সৌজন্য আলাপ কখনই ভাল লাগে না। সন্ধ্যায় রিক্সায় ঘোরা যায় কিন্তু কাকে বলব সাথে থাকতে, যেই শুনে এমন কথা সেই বলে ধ্যাত, এখন কি আর রিক্সায় ঘুরতে ভাল লাগে!

কি করি? টিভি দেখা ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগেই। রেষ্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে আসাতেও কোনও আনন্দ পাই না। অনেক ফ্রেন্ড মিলে আড্ডা দিতে শখ হয় যেমনতা দিতাম হলে থাকতে। কিন্তু সবাই এক শহরে থাকিনা, তাছাড়া প্রায় সবাই বিয়ে করে বাচ্চা নিয়ে সংসার গুছিয়ে বসেছে, এখন আর কাউকে এমন আড্ডায় আশা করাটাও পাপ।

ধূসর পেঁচা


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

সচলে স্বাগতম

ঈদে কিছু না করাই সবচেয়ে ভালো... এই দুতিনটা দিন নিশ্চিত নির্ভাবনায় থাকাটাই সবচেয়ে আনন্দের হাসি
ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি মনে পড়লো...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নিবিড় এর ছবি

নজরুল ভাই প্রতি ঈদের দিন নিয়ম করে সচল পড়েন নাকি চিন্তিত
পিছনের পোস্ট খুজে দেখি কমপক্ষে দুইটা ঈদে আমি কিছু করার না থাকায় বসে বসে সচলে পোস্ট লিখছি আর সেইসব পোস্টে প্রথম মন্তব্যকারী হের নজরুল ইসলাম হাসি

ধূসর পেঁচা এর ছবি

ধন্যবাদ, আসলেই সেই ছোট বেলার ঈদের মজা আর নেই, কিন্তু মেনে নিতে পারছিনা বড় হলে ঈদে মজা থাকবেনা, কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা ঈদ মানে নতুন জামা, ঘোরাঘুরি, সালামী, খাওয়া দাওয়া প্রভৃতির ফ্রেমে আটকে গেছি, মনে হচ্ছে একটা উপায় নিশ্চই আছে কিন্তু কি তা এখনও জানিনা।

বাচ্চাদের যেমন অলিখিত নিয়ম আছে গন্তব্য থাকুক আর না থাকুক তারা এদিক সেদিক ঘোরা ঘুরি করে মজা পাবেই, প্রাপ্ত বয়স্করা যেমন কোরবানীর ঈদে কোরবানী দিবেই, মায়েরা যেমন সেমাই রাঁধবেই তেমনি যদি বড়দের জন্যেও বিশেষ কোনও নিয়ম অথবা সামাজিক ঐতিহ্য থাকত! এটা হতে পারে সংস্কার মূলক অথবা বিনোদন মূলক খেলাধূলা, অথবা এমন কিছু যেন সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কিছু করার সুযোগ থাকে, যেন ঈদের দিনটা কেটে যায় তুমুল ব্যাস্ততা অথচ ক্লান্তি হীনভাবে, যেন কেউ উদাস হওয়ার, স্বার্থপর হওয়ার সুযোগ না পায়, যেন প্রত্যেকেই ঈদের পরদিন ভাবতে পারে নাহ্‌ গতকাল ছিল একটা স্বার্থক আর আনন্দময় দিন।

কেন যেন মনেহয় বয়সের সাথে সাথে আমাদের বিনোদনের ধরন বদলে যাওয়ার রীতিটা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত এসে থেমে গেছে, আমরা পরের ধাপের মানুষদের জন্য কোনও বিনোদন পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে পাইনি বলে ধরেই নিয়েছি ঈদ আমাদের জন্য না, বাচ্চাদের জন্য।

এমন একটা কিছুর প্রচলন যদি করা যায় তাহলে খারাপ কি? ১২ বছর আগেও এদেশের মানুষের FnF করে বা Lowest call rate এ কথা বলার অভ্যাস ছিলনা, এখন অভ্যাস হয়েছে, ঐতিহ্যও হয়ে যাবে। কিন্তু এমন কি কাজ বা আনুষ্ঠানিকতার প্রচলন করা যায় তাই ভেবে পাচ্ছিনা।

নীরব পাঠক এর ছবি

হুমম... কথা সত্য , মন খারাপ
ঈদ এখন আর "ঈদ" লাগেনা...সব প্লাস্টিক হয়ে গেছে..এখনই এমন লাগে ভবিষ্যতে বাচ্চা কাচ্চা তো "টেফলন ঈদ" পাইবো ইয়ে, মানে...

বন্দনা এর ছবি

আসলেই আজকাল ঈদের আর সেই পুরানো আমেজটা খুঁজে পাইনা। মন খারাপ

মর্ম এর ছবি

আসলেই ঈদ বোধ হয় এখন আর নেই! না কি আছে?

ঈদের দিন সকালে আম্মুর তাড়ায় ঘুম ভাঙ্গা, গোসল, সবাই মিলে নামাজে ছোটা, কোনমতে জামাত পেয়ে হাঁফ ছাড়া, আত্মীয়দের বাসায় যাওয়া, ছোট ছোট আনন্দের ক্ষণ, একটু স্মৃতিচারণ, বাসায় সবার একসাথে সময় কাটানো- কিছু কিছু জিনিস বদলায়নি এখনো।

তবে আমরা বদলে যাচ্ছি, হয়ত ঈদও বদলে যাচ্ছে দিনে দিনে। এখনও যতটুকু আছে, কদিন পরই হয়ত আর থাকবে না।

ঈদ মোবারক, ভাল থাকুন, নিয়মিত লিখুন।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

ধূসর পেঁচা এর ছবি

ধন্যবাদ, ঈদ মোবারক।

 তাপস শর্মা  এর ছবি

চলুক

সব কিছুই কেমন বদলে যাচ্ছে দ্রুত ।

----------------------------------------------------------------
ঈদ এর শুভেচ্ছা রইলো ভাই । পবিত্র ঈদ । খুশির ঈদ ।

কোলাকুলি

নিটোল. এর ছবি

আহারে! ছোটবেলার সেই ঈদ!

The Reader এর ছবি

কোলাকুলি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

আনন্দের মৃত্যু নেই, আমরাই বদলে গেছি ভীষণরকম!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ধূসর পেঁচা এর ছবি

ঠিক

ত্রিনিত্রি এর ছবি

ঈদ বদলায়নি, আমরাই বদলে গেছি! তবে এখনো আমার ঈদ মজার, ২০ রো্যার পর থেকে অস্থির হয়ে থাকি। যদিও শপিং এ যাই না, বিরক্ত লাগে ভীড়। তবে ঈদে হুল্লোড় করে বাড়ী আসি আর তারপর এমনি এমনি ঘুরে বেড়াই। এটাই মজা। রাস্তায় বাচ্চাদের আনন্দ দেখলে খুবই ভালো লাগে।

অনেক ভালো লাগলো।

ধূসর পেঁচা এর ছবি

হ্যাঁ, বাচ্চাদের আনন্দ দেখলে খুব ভাল লাগে।
ধন্যবাদ।

নিবিড় এর ছবি

কালকে ঈদের দিন খ্রাপ কাটে নাই। বহুদিন পর ঈদের দিন ভালমত ঘোরাঘুরি হল আর সন্ধ্যার পর একটা দারুণ আড্ডা হাসি
সচলে স্বাগতম হাসি

ধূসর পেঁচা এর ছবি

ঈদ আনন্দ মোবারক হোক।
ধন্যবাদ।

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

শৈশব-কৈশোর পিছু ডেকে গেল......... মন খারাপ

আসলে একেবারে আনন্দহীন ভাবি না। সমাজে যেহেতু এখনও পরিবার প্রথা টিকে আছে, সো কিছু পারিবারিক রীতি-আচার-অনুষ্ঠান একেবারে নিরস এটা কিন্তু বলা যাবে না। আনন্দকে খুঁজে নিতে হবে, হয়তো সময়ের সাথে আনন্দের রূপটা পাল্টে যাবে............


_____________________
Give Her Freedom!

নজমুল আলবাব এর ছবি

যায় দিন ভালো, আসে দিন...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।