ধর্মনিষ্ঠতা এবং উন্মত্ততা এক নয়

অপ বাক এর ছবি
লিখেছেন অপ বাক (তারিখ: শনি, ১২/০৪/২০০৮ - ১:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সম্ভবত আমাদের মাননীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নিজেদের ভেতরেও ধার্মিক মানুষের ধর্মানুভুতিতে আঘাত করবার কোনো প্রচেষ্টা নেই। তারা নিয়তিবাদী অবস্থান গ্রহন করেছেন। তবে অপ্রিয় এবং কঠোর হলেও তাদের অন্তত বিরোধিতা এবং জরুরি বিধিমালা লঙ্ঘনের পরিস্থিতি তৈরি না করবার স্বার্থেই মসজিদভিত্তিক গণআন্দোলন এবং অহেতুক অসন্তোষ দমনেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কিংবা মানুষের ধর্মবোধ নিয়ে ব্যবসা দমনের বিধিমালা জারি করা প্রয়োজন। যদিও নির্বাচন কমিশনের ভাষ্যমতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল কখনই বাংলাদেশের সমস্ত জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই তারা পলিটিক্যাল পার্টি রিফর্ম প্রস্তাবে এমন একটা বিধি প্রণয়নের চেষ্টা করছে,
মানুষের ধর্মানুভুতি আহত হবে বলেই বায়তুল মোকাররমের নানা ঘটনায় সরকারের অবস্থান ছিলো ধার্মিক উন্মাদদের পক্ষে। তারা এই যে আস্ফালন করছে- শান্তিশৃণ্খলায় বিঘ্ন করছে- এটাতে সরকারের ভুমিকা বখে যাওয়া আদরের সন্তনকে মৃদু অসম্মতি জানানোর মতো। অথচ সরকারের অতিদ্রুতই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা উচিত। ধর্ম এবং মসজিদভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ আজকে থেকে।

ধর্ম মানুষের কোমল আশ্রয়, সাধকের প্রতি যে সামগ্রীক সম্ভ্রমবোধটা আমার ভেতরে যুক্তিহীন চলে আসে সেখানেও এই ধারণাটাই মূলত কাজ করে, যারা ধর্মের পথে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে, যারা পার্থিব চাওয়া পাওয়াকে তুচ্ছ করে অধরার সন্ধান করছে, তাদের জীবনে মানবীয় ক্ষুদ্রতা কিংবা হানাহানির চর্চা নেই।
ধার্মিক মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবার চেষ্টাটা রীতিমতো ক্লেশদায়ক হয়ে যাচ্ছে।

সমস্যাটা ধর্মের নয়, ধর্ম মানুষের নৈতিকতা আর মানুষের নিয়মানুবর্তিতার ইতিহাস ধারণ করে। ধর্ম মানুষকে নিজের জীবনে শৃঙ্খলা আনতে শেখায়। ধর্মের বিধিনিষেধ আদতে সামাজিক সাম্য এবং প্রতিসাম্যতাকেই নির্ধারণ করে। যদিও মানুষের লোভ-কাম-লালসার নিরাময় ধর্ম করতে পারে না কোনো অলৌকিক শক্তি বলে, যদিও মানুষকে নিয়তিবাদি হতে বাধ্য করে ধর্ম, যদিও ধর্ম বলেই দেয় মানুষে মানুষে অসাম্য আসলে ঐশ্বরিক বিধান, আমাদের নিয়মিত পরীক্ষাকেন্দ্রে মানুষের ভেতরে সম্পদের অসমতা তৈরির লক্ষ্যই হলো মানুষের দায়িত্ববোধ আর মানুষের মানবীয়তার চর্চার পথ তৈরি করে দেওয়া, আমার নিজস্ব সমস্যা আমি এই অলৌকিক শক্তির প্রাধান্য মানতে রাজি না। আমার কাছে মনে হয় না কোনো অলৌকিক শক্তি বলে সকল ব্যবধান দুর হয়ে যাবে। তাই দৃঢ় চাপ থাকলেও অলৌকিক শক্তির প্রতি আনুগত্য বোধটাই আসে না আমার।
ধর্ম মূলত কোনো সংঘাতের জন্য এককভাবে দায়ী নয়, বরং দায়ি আমাদের বিবেচনার ভুল. আমরা ধর্মকে রক্ষা করতে চাই- মূমুর্ষু রোগীর মতো তাকে পার্থিব জগতের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেই জীবনযাপন করতে চাই। সেখানে আমাদের বিশেষজ্ঞপ্রীতিও প্রবল হয়ে উঠে।
আমরা পরের মুখে ঝাল খেতে খেতে আসলে স্বাদ গন্ধ ভুলে যাই। তাই আল্লামা শায়েখ যে বিধান আমাদের সামনে নিয়ে আসেন সেটাই আমাদের সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। এবং আমরা অযথাই লম্ফঝম্প করি। এখানে ধর্মের বানির চেয়ে মুল বিবেচ্য হয়ে উঠে- কিংবা বুঝবার ভুল কিংবা ব্যবধান তৈরি হয় কারণ ধর্মের বানী গ্রহন করবার ধরণ। এটা আমি কিভাবে ধর্মের কিতাব পড়লাম সেটার উপরে নির্ভর করে না- আমি কি বুঝলাম এবং কিভাবে এই বুঝাটাকে প্রকাশ করলাম। ইট ডিপেন্ডস অন হাউ উই রিড ইট ইন বিট্যুইন লাইনস এন্ড হাউ উই ফর্মুলেট আওয়ার ওয়ার্ডস টু এক্সপ্লেইন আওয়ার আন্ডারস্ট্যান্ডিং।

এখানেই ব্যাখ্যা এবং অপব্যাখ্যার সুযোগটা থাকে। এবং এখানেই একজন কৌশলী হয়ে নিজের মনগড়া বক্তব্যকেও ধর্মীয় বানীর সাথে মিশিয়ে উপস্থাপন করতে পারে। এবং তখন আমাদের নিজেদের ভেতরেও বিভ্রান্তি বেড়ে যায়। আমরা সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।
জুম্মা বারে খুৎবা শুনাটা অবশ্যপালনীয় নিয়মের একটা। সে জন্যই যতই ব্যবসা থাকুক না কেনো, জুম্মার সময় জা'মে মসজিদ( যেখানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয় এবং যেটা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সেখানে শুক্রবারের খুৎবা হয়। এই খুৎবায় অনেক কিছুই থাকে- প্রশাসনিক গুরুত্ব হলো এখানেই রাষ্ট্রীয় বিধান এবং খলিফার নির্দেশ প্রচারের জন্য কম কষ্টে বেশী মানুষকে পাওয়া যায়।
তবে বায়তুল মোকাররমের অবস্থা এমন না। এখানে প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজের পড়ে মিছিলের জন্য লোক জমায়েত হয়। গত ৫ মাসে বায়তুল মোকাররম থেকে যতগুলো মিছিল বের হয়েছে তাদের কোনোটাকেই বাধা দেয় নি প্রশাসন। যদিও প্রকাশ্যে রাজনীতি কিংবা মিছিলের নিষেধাজ্ঞা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই উপস্থিত- তবে মাথায় কিসতি টুপি আসলেই বিরুদ্ধ রাজনীতির স্রোতের বিপরীতে তরতর করে টেনে নিয়ে যায় ধর্মভীতু মানুষের মিছিলকে।
সাম্প্রতিক সময়ের অস্থিরতার কারণ উত্তরাধিকার আইনে নারি পুরুষ সমতার কল্পিত বিধান। যদিও এটা নারি অধিকার অধ্যাদেশের অংশ নয় তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা এখানে গোপনে বা প্রকাশ্যে এমন কোনো বিধান আছে যেখানে বলা হয়েছে পিতার সম্পত্তিতে ছেলে মেয়ে উভয়ের সমান অধিকার থাকবে।
উত্তরাধিকার আইনে- অবশ্যই প্রাপ্য হিসেবে ছেলেদের সম্পদের অর্ধেক প্রাপ্য মেয়ের। বাবার সম্পদে মেয়েরা যে অংশটুকু পায় সেটা ছেলের প্রাপ্য সম্পত্তির অর্ধেক। কথা হলো এর তুলনায় বেশী দেওয়া সম্ভব কি না?
যদি মৃত্যুর পূর্বেই উকিল দিয়ে বন্টিত হয় সম্পদ তবে সেখানে কোনো সমস্যা নেই- কিন্তু যখন পিতার সম্পদের উত্তরাধিকারিরা ধর্মের বিধান দেখবে তখন স্বীকার করতে হবে মেয়েদের অধিকার আছে এবং এর ন্যুনতম মানটা নির্দিষ্ট। এর বেশী দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না কিন্তু কম দিলেই রোজ কেয়ামতে জবাবদিহি করতে হবে।

যদিও এই বিধি আদতে উপস্থাপিত হয় নি, কোনো আইনে রূপান্তরের তাগিদও নেই এ মুহূর্তে- এর পরেও বায়তুল মোকাররমে আজকে যা হয়ে গেলো তা কোনো ভাবেই মানুষের ধর্ম এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতার দায়িত্বপূর্ণ প্রকাশ হতে পারে না।
বায়তুল মোকাররম থেকে জুম্মার পরের মিছিলে যেভাবে যুদ্ধংদেহী মানুষেরা পুলিশের দিকে ডিল ছুড়লো- তাদের কাছে এটাকেই জিহাদ মনে হচ্ছে-
তথাকথিত কাফেরদের কোরান অবমাননার প্রচেষ্টার প্রতিবাদে এইসব বিশ্বাসীরা জঙ্গীমনোভাবসম্পন্ন। তবে দুঃখ লাগে এটা ভেবেই যে তাদের এত মনঃস্কামনা স্বত্ত্বেও তাদের এই আচরণ কোনোভাবেই জিহাদের পর্যায়ভুক্ত হবে না।
ধর্মের বিধান পালনের জন্য তারা সম্পদ নষ্ট করছে- এবং তারা অগ্নিসংযোগ করছে-
এমন বৈপিরিত্ব মেনে নেওয়া যায় না। প্রতিশোধের আগুণে পুড়তে থাকা ধার্মিক হৃদয়ের শুকনো খড়ের গাঁদায় আগুন লেগেছে, তাদের ভেতরে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুণ।
এমন প্রতিশোধস্পৃহার জন্ম কোথায় হয়- কাউকে না কাউকে বুঝাতে হয় তাদের এইসব মাতলামি পাগলামি আসলে ধর্মনিষ্ঠতা।

মূলত অনেক দিনের একটা দাবি ছিলো ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক অস্থিরতা দেখে আমার মনে হয়- আদতে বিশেষ অধ্যাদেশ করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিই নিষিদ্ধ করা পরয়োজন।


মন্তব্য

শিক্ষানবিস এর ছবি

টিভিতে দেখলাম, এক লোক পাঞ্জাবি উঁচিয়ে খালি বুক দেখাচ্ছে পুলিশদেরকে, যাতে তার বুকে গুলি করে জান্নাতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। কতোটা দৃঢ় বিশ্বাস।
কেবলমাত্র ভিডিও দেখলেই বোঝা যায়,এটা সভ্যতা নয়। এটা প্রগতিবিরোধী। এরকম চলতে থাকলে ধর্মের উল্টো স্রোতেই যাবে বিষয়টা, কারণ আমরা ধীরে ধীরে মানুষ থেকে আবার বানর হয়ে যাবো। স্পেস অডিসি মুভিতে একটা দৃশ্য দেখেছিলাম, লক্ষ লক্ষ বছর আগে মানুষের আদিপূরুষ বানরেরা কিভাবে প্রথম মারামারি শিখে। মারামারি শিখে প্রথমবারের মত তারা নিজেদের গোত্রেরই একজনকে খুন করে। অন্য কোন জন্তুর হাড় তারা হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছিল।
আজ টিভিতে যা দেখলাম, তা হল হাতের কাছে যা পেয়েছেন তা দিয়েই অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা। ঠিক বানরদের সেই হাতিয়ারের মত।

লেখাটিতে মূল সমস্যা অনেকটাই উঠে এসেছে। সময়োপযোগী লেখা।

অভিজিৎ এর ছবি

ধর্ম ই নৈতিকতার উৎস কিনা - এ নিয়ে সন্দেহ আমার বরাবরের। এই বিষয়ের উপর আমার একটা দীর্ঘ লেখা আছে। লেখাটা এবারের বই মেলায় প্রকাশিত 'স্বতন্ত্র ভাবনা' বইটাতে সংকলিত হয়েছে। অনলাইনে একটু পরিবর্তিত আকারে এবং ভিন্ন শিরোনামে রাখা আছে - 'অধার্মিকের ধর্মকথন : নৈতিকতা কি শুধুই বেহেস্তে যাওয়ার পাসপোর্ট?'।

লেখাটা সিলেট থেকে প্রকাশিত যুক্তি ম্যাগাজিনেও ঈষৎসংক্ষেপিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে। হয়ত পাঠকদের কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হবে।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

অতিথি লেখক এর ছবি

কিছুই বলার নেই সবই বলা হয়ে গেছে।
একমত ধর্মভিত্তিক রাজনীতিই নিষিদ্ধ করা উচিৎ।
সুন্দর উপস্থাপন
-নিরিবিলি

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমার তো সন্দেহ সরকার নিজেই লেজে খেলাচ্ছে ।
যদি প্রকৃতই সমবন্টনে আন্তরিক হতো, তাহলে এদেরকে কঠোরভাবে দমন করতো, ইসলামী আইনের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনার পরিবেশ তৈরী করতো ।
কোরানে একটা বন্টন দিয়ে দেয়া হয়েছে, পিতা চাইলে এর অধিক ও দিতে পারে । রাষ্ট্র ,সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় পিতার এই চাওয়াটাকে আইন করে দিতেই পারে ।
দ্বিতীয় বিয়ে করতে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে এমন আইন কোরানে নেই-কিন্তু রাষ্ট্র এই আইন করায় তো সেটা ইসলাম বিরোধী হয়ে গেলো না

xxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxx
...অথবা সময় ছিলো;আমারই অস্তিত্ব ছিলোনা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

কে যে কাকে খেলায়... সরকার এদেরকে নাকি এরা সরকারকে? ভেদ বুঝিনা... সরকারই আসলে কোনজনা?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।