নিজামীর গ্রেফতার এবং আমার ভাবনা

অপ বাক এর ছবি
লিখেছেন অপ বাক (তারিখ: রবি, ২৫/০৫/২০০৮ - ৭:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নিজামী গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি নিজে নিজেই। হঠাৎ করেই সরকার এমন একটা কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহন করলো কেনো? বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কারপন্থীদের বিষয়ে নমনীয় অবস্থানে ছিলো, জামায়াত সব সময়েই ক্ষমতাবানদের রক্ষিতা। তাই বর্তমান সময়ে জামায়াত কোনোভাবেই সরকার বিরোধী অবস্থান গ্রহন করে নি। এমন কি সাম্প্রতিক নারী নীতি বিষয়ক ইস্যুতেও জামায়াত দলীয়ভাবে মাঠে নামে নি। বরং তাদের ছদ্ম সংগঠনের আড়ালে কর্মীদের দিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করেছে।

জামায়াত মূলত সরকারের নীতির সমর্থক হিসেবেই বিরাজ করছে- এবং এইসব মিত্রতা ঝেড়ে ফেলবার কোনো আগ্রহ প্রথম থেকেই সরকারের নেই। সমস্ত হিসেব বদলে দিয়ে হঠাৎ করেই গ্যাটকো মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামীদের গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা এবং পলাতক দেখিয়ে গ্রেফতারের প্রচেষ্টা, এই উটকো স্বভাববিরুদ্ধ আচরণ কেনো করলো সরকার।

এই হিসেবেটা কিছুতেই মিলছে না আমার।

বিভিন্ন কারণেই বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেশ নমনীয় আচরণ করেছে তাদের সমর্থকদের প্রতি, কিছুটা পক্ষপাতিত্বও ছিলো এই আচরণে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে সদ্য জন্ম নেওয়া কোরেশী প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ডাকবার অর্থ তাদের একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। ফেরদৌস কোরেশী তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং এর পেছনের রাজনৈতিক শক্তির পকেটের দল।

একই ভাবে এই সংলাপে আমন্ত্রন জানানো হয়েছে ইবরাহিমের বাংলাদেশ কল্যান পার্টিকে। এই পার্টির কতিপয় নেতা ছাড়া আর কেউ আছে বলে মনে হয় না মাঠ পর্যায়ে তবে এরাও রাজনৈতিক দল হিসেবে সংলাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়, পাচ্ছে। এটাই আশ্চর্য!!!!

অনুমান করছি এটা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বর্তমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ এবং সংশোধনীগুলোর বৈধতা এবং নানাবিধ আইনি প্রক্রিয়াকে সমর্থন এবং নির্বাচনের সবুজ সংকেতের লক্ষ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একটা সমঝোতার প্রয়োজনে গৃহীত সিদ্ধান্ত।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা কিংবা সংলাপের প্রয়োজন নেই। যদি নির্বাচনী বিধি সংশোধন করতে হয় তবে সেটা নির্বাচন কমিশন উদ্যোগি হয়ে রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করতে পারে। এখানে প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টা পরিষদের অংশগ্রহনের কোনো প্রয়োজন ছিলো না। এর পরেও সরকার এটা করছে, স্বউদ্যোগেই করছে, এবং এই সংলাপ নিয়ে অনিশ্চয়তার মেঘ কাটছে না।

সংস্কারপন্থী হিসেবে যারা অবতীর্ণ হয়েছেন কিংবা হয়েছিলেন তারা মূলত সুবিধাবাদী শ্রেনী। বিএনপি- জামায়াত- জাতীয়পার্টি সুবিধালোভী শুয়োরদের খোয়ার ছিলো অনেক আগে থেকেই। নতুন করে এটা বলবার কিছু নেই, তবে দলীয়ভাবে একটা পরিচয় তৈরি হওয়ার পরে এই দলটির অনুগত কিছু কর্মী রয়েছে যারা সুবিধালোভী, তবে এখনও দলের সকল কার্যক্রমকে সমর্থন করে যাচ্ছেন। এদের সমর্থনের ভিত্তি নেহায়তে ভক্তিবাদআচ্ছন্ন হলেও তারা অনুগত কর্মী। বিএনপির আদর্শ বলে যদি কিছু থেকে থাকে তারা সেই আদর্শের অনুসারী। কিংবা খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়ার পেছনে মৃত জিয়ার ঝুলন্ত ছবির ভক্ত- পূজারি তারা।

এদের ভেতরে সুবিধাবাদী অংশের ভেতরেও মাত্রাগত ভাবে অধিকতর সুবিধাভোগীরা নতুন করে একটা সংস্কারপন্থী অংশ তৈরি করেছিলো। সরকারের ভেতরের চাপে কিংবা নিজেদের অপরাধ থেকে নিরাপত্তা চেয়েই তারা সংস্কারপন্থী ঘোরতর সংস্কারের দাবিদার হয়ে উঠেছিলেন।

এদের ধারনা ছিলো বিএনপির অনুগত কর্মীর অস্তিত্ব নেই যেমন অনুগত কর্মী রয়েছে আওয়ামী লিগের। তারা ধারণা করেছিলো খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়ার দেশত্যাগের বিষয়টা সময়ের ব্যাপার। এই সময়ে দলের নেতৃত্ব জবরদখল করলে বিএনপিকে কার্যত তারাই নিয়ন্ত্রন করবে। সরকারের বাসনাও এমনটাই ছিলো। তারা পাকিস্তানের অনুসরণে শীর্ষ দুই দলের প্রধান নেতাদের নির্বাসনে পাঠানোর কিংবা রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহনে বাধ্য করতে চেয়েছিলেন।

সেই হিসেবটা ঠিক ছিলো না, খালেদা জিয়া প্রথমে নমনীয় থাকলেও তারেক জিয়াকে হঠাৎ করেই গ্রেফতারের পর তার অনমনীয় আপোষহীনতা সামনে চলে আসলো। খালেদা জিয়ার নমনীয়তার একটা সীমা রয়েছে সেই সীমার বাইরে গেলে খালেদা জিয়া গোঁয়ার এবং আপোষহীন। বর্তমানের খালেদা জিয়া কোনোভাবেই কোনো প্রলোভনেই দেশত্যাগ করবেন না। খালেদা জিয়াকে আটক করা কিংবা রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানোর প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হবে না এটা এখন মোটামুটি নিশ্চিত বিষয়।

বিএনপির অনুগত কর্মীরাও সংস্কারপন্থী অংশের সাথে নেই। কতিপয় অধিকসুবিধালোভী কর্মী ব্যতিত আসলে সংস্কারপন্থিরা নেতাসর্বস্ব একটা ক্ষুদ্র অংশ। যারা কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে নি। সাইফুর রহমান এই সত্য উপলব্ধি করেই চিকিৎসার কারণে বাইরে যাওয়ার আগে সংস্কারবাদীদের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে চলে গেলেন।

শেখ হাসিনার বন্দীত্ব, তার চিকিৎসা নিয়ে অবহেলা এবং আওয়ামী লীগের সম্মিলিত গণ আন্দোলন সৃষ্টির প্রক্রিয়াটা আস্তে আস্তে তীব্র হচ্ছে। ঘরোয়া রাজনীতি সীমিত শিথিল কিছু শর্তে উমুক্ত হলেও মিছিল করার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আন্দোলন দমানো যাবে না। সাইফুর রহমানের বক্তব্যের পরে এটাও নিশ্চিত সংস্কারপন্থী বিএনপি বলে কোনো বিরোধী অংশ আপাতত সরকারের সমর্থনে নেই।

পারিবারিক গোলোযোগের কারণে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেওয়া প্রাক্তন উপদেষ্টা সফল, জাতীয় পার্টি বরং বর্তমানে সবচেয়ে সুবিধার অবস্থান ছিলো। তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতার কোনো আগ্রহ নেই। একই অবস্থা ইসলামী ঐক্যজোটের , তারা নারী নীতি নিয়ে তুলকালাম করলেও তাদের প্রতি প্রশ্রয়ের ভাবটা চাপা থাকে নি। তারাও এই প্রশ্রয়ের আঁচল ছেড়ে সরকার বিরোধী অবস্থান গ্রহন করতেন না। জামায়াতে ইসলামীর নিজামীকে গ্রেফতার না করলে জামায়াতে ইসলামীও এই সরকার বিরোধি অবস্থান গ্রহন করতো না।

যদি হঠাৎ করেই সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহন করে তবে সেটা তাদের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে, তাই মান্নান ভুঁইয়া আর নিজামীকে গ্রেফতারের আগেও সরকারের ভেতরে এই নিয়ে দ্বিধা কাজ করেছে। তারা সকল প্রস্তুতি গ্রহন করেও নিজামীকে তৎক্ষণাত গ্রেফতার করে নি, গ্রেফতার করে নি মান্নান ভুঁইয়াকে।

যদি মান্নান ভূঁইয়া কিংবা নিজামীকে গ্রেফতার করা না হতো তবে একটাই পরিস্থিতি তৈরি হতো রাজনৈতিক অঙ্গনে, সংক্ষিপ্ত ভাবে বললে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ যৌথ ভাবে তাদের স্ব স্ব নেত্রীর মুক্তির আন্দোলন শুরু করতো।

খালেদা জিয়া এবং খালেদাপন্থী হিসেবে পরিচিত হান্নান শাহ এবং দেলোয়ার হোসেনের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো তারা দুই নেত্রীর মুক্তির আন্দোলন শুরু করবে। বিএনপি যেহেতু অসংগঠিত এবং তাদের স্থানীয় পর্যায়ে সমর্থনে ভাটা পড়েছে তাই তারা এই ক্ষেত্রে অনুসারীর ভুমিকা নেবে এবং আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে বিএনপিও সেই একই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করবে।

নিজামী আর মান্নান ভুঁইয়াকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত যেমন তথাকথিত সংস্কারবাদীদের প্রতি একটা স্পষ্ট নির্দেশনার কাজ করলো তেমন ভাবেই একটা আওয়ামি বিরোধি মোর্চার গঠনেও সহায়ক ভুমিকা রাখলো। এই একটা সিদ্ধান্তেই চার দলীয় ঐক্যজোট আবার সক্রিয় হলো-

এখন বিএনপি এবং চার দলীয় ঐক্যজোটের শরিক দলগুলোর ভেতরে একটা বিপরীতমুখী অবস্থান রয়েছে। ইসলামী ঐক্য জোট এবং জাতীয় পার্টি সরকার বিরোধী আন্দোলনের বিরোধী। বিএনপি এবং জামায়াত নেতা-নেত্রীর মুক্তি চায়।
সরকারের সুবিধা হলো, বর্তমানের যে যুদ্ধাপরাধীদের বিরোধী জোয়ার সেখানে আওয়ামী লীগ, বিকল্প ধারা এবং চৌদ্দ দলীয় জোটের স্পষ্ট জামায়াত বিরোধী অবস্থান কখনই একটা রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি করবে না এই চার দলীয় জোট আর চৌদ্দ দলীয় জোটের ভেতরে।

ফলে সরকার বৃহত্তর কোনো আন্দোলনের মুখোমুখি পড়বে না । তারা গ্যাটকো মামলায় আটক নিজামী আর মান্নান ভুঁইয়াকে আটকে রেখে হয়তো যেটুকু রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করবে সেটা দিয়ে আগামি ২ মাস ভালোই কেটে যাবে তাদের দিন।

এর পরে ঘরোয়া রাজনীতি, নির্বাচন এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকা দেশে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার মুক্তিও ঘটবে। অন্তত হিসাব তাই বলে। শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়াকে আটকে রেখে দেশে নির্বাচন হবে না । তাদের মুক্তি সময়ের ব্যপার। এদের কোনো এলেবেলে মামলায় ফাঁসানোও যাবে না। কোনো দু্র্বল মামলায় এদের কারাবাস এবং অর্থদন্ড দিলে সেটা সাধারণ মানুষ এখন গ্রহন করবে না।

আমার নিজের মনে হয় নিজামীর গ্রেফতার শুধুমাত্র একটা কৌশলগত সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তে বিএনপি আওয়ামী লীগের ঐক্যবদ্ধ নেত্রীর মুক্তির দাবিতে মিছিলটা বেশ কিছুদিনের জন্য দমিয়ে রাখা সম্ভব হলো। সরকারের পোষা ভৃত্যদের কোনো অপরাধে জেল জরিমানা সরকার হতে দিবে না, নিজামীও বুক ফুলিয়ে জেলের বাইরে এসে গলায় ফুলের মালা পড়বে-


মন্তব্য

আলমগীর এর ছবি

ভাই
আপনার লাইনগুলো অতি দীর্ঘ। স্ক্রিনে পড়তে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি। একটু ভিন্ন করে ফরম্যাট করে দিতে পারেন? আমি আপনার লেখা যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে পড়ি।

অপ বাক এর ছবি

চেষ্টা করলাম তবে তেমনব পরিবর্তন আসলো না। সমস্যাটা বোধ হয় সেটিংসের । আমি যতই স্পেস দেই না কেনো এটা স্পেসগুলোকে গিলে ফেলে কোনো এক অজানা কৌশলে।

আলমগীর এর ছবি

(এখন পড়তে পারছি- ধন্যবাদ।)
আপনার শেষ লাইটাই সব বলে দিচ্ছে।
আমার বীক্ষণ বলি:

১. যখন হাসিনার বিদেশ যাত্রায় সমস্যা নেই বলে, ফেরার সময় তাকে বাঁধা দেয়া হলো, তখনই আমি ধরে নেই তত্বাবধায়করা জামাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। নিজামী খুনের আসামী হলেও বিদেশ যাত্রায় বিঘ্ন ঘটেনি। আর খালেদাকে জোর করে প্রবাসী করার চেষ্টা, অপরদিকে মিডিয়াতে সেটা অস্বীকার; আমার মনে হয় না মইনুলের একার বিষয় ছিল।

২. নিজামীকে গ্রেফতার একটা ধাঁধাঁ। এখন লোকজনকে বিশ্বাস করানো সহজ হবে যে তত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষ। মান্নান ভুইয়া প্রত্যাশামতো কাজ করতে পারেনি তাই গ্রেফতার হয়েছে। সাইফুরকে আবার কৌশলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

৩. নিজামীর গ্রেফতার নিয়ে পুলিশের প্রতি আপিল বিভাগের অসন্তুষ্টি লক্ষ্যণীয়। খালেদা বা হাসিনাকে যে প্রক্রিয়ায় আটক করা হয়েছে তা নিয়ে সুয়োমোটো দূরের কথা তাদের দায়ের করা বৈধতার মামলাও দায়সাড়াভাবে সাড়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি বলেই দিয়েছেন, ইসলামি আইনই সমাধান।

৪. সংলাপ উপদেষ্টাদের চামড়া বাঁচানোর একটা প্রচেষ্টা। যদি নির্বাচন হয়ই, এবং জামাত নির্বাচিতদের বিরোধী দলে পড়ে যায়, বা সহজ কথায় আলীগ জিতে তবে তা খুব বিপদের কারণ হবে। শুধু জলিলের উপর যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে তার কারণে উপদেষ্টাদের গায়ের খোল খুলে নেবার মতো লোকের অভাব হবে না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।