বিচার বিভাগীর বিপত্তি- জনপ্রিয় রোকন উদ দৌলা বলেছেন ২০২১এর আগে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সম্ভব না-

অপ বাক এর ছবি
লিখেছেন অপ বাক (তারিখ: রবি, ২১/১০/২০০৭ - ৬:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অপরাধীকে শনাক্ত করে তাকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান আদালতের কাজ নয়, আদালতের কাজ ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা- আদতে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা শব্দটাকে আমার ভীষণ জটিল মনে হয়। কোনটা ন্যায়- কোনটা অন্যায় এমন সিদ্ধান্ত আদালত কিভাবে দিবে? কিংবা আদালত প্রতিষ্ঠিত প্রতিটা ন্যায় এবং অন্যায় আদতে প্রচলিত সামাজিক অনুশাসননির্ভর একটা বিষয়, আরও একটা জটিলতা আছে- অনেক সময়ই আদালত অন্য একটা আদালতে প্রতিষ্ঠিত ন্যায়ের সংজ্ঞাকে সঠিক মনে করে বিষয়ের উপযুক্ততা বিচার করে একটা রায় প্রদান করেন- এখানেও সংজ্ঞায়িত করবার প্রক্রিয়াটা সব সময় সঠিক বলে বিবেচিত হতে হবে এমন কোনো নির্ণয়ের সুযোগ আপাতত নেই। বরং আমাদের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার উপরে আস্থা স্থাপন করতে হবে।

প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরির কিংবা অনাস্থা সৃষ্টি হবার নানাবিধ কারণ এবং উপলক্ষ্য তৈরি করেছেন বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্ট মানুষেরা। অহেতুক হয়রানি, কিংবা ভুল রায় দেওয়া কিংবা প্রভাবিত হয়ে রায় বদল করা কিংবা আদালতের বাইরে মীমাংসা করবার মতো ঘটনাও ঘটেছে অনেক- এর সাথে আরও বড় সমস্যা হয়েছে কতিপয় বিচারকের ঘুষ গ্রহন করে ঘুষদাতাদের সপক্ষে মতামত এবং রায় প্রদানের ঘটনা- নানাবিধ কারণে যদিও বলা হয় বাঙ্গালীকে হাইকোর্ট চেনাতে হয় না তবে অকারণে এখন আর বুদ্ধিমান মানুষ আদালটের দারস্থ না হয়ে বিকল্প উপায়ে সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন- আরও আছে নানাবিধ বিধি বিষয়ক জটিলতা- সব মিলিয়ে আদালতের উপরে কিংবা প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার উপরে মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা এবং আস্থার অভাব দেখা দিয়েছিলো।

তবে আদালত বিভিন্ন কারণে প্রভাবিত হলেও বস্তুত বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের কার্যকরণ আদতে আদালটের উপরে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের সুযোগ কমানো- যদিও আদালতে কর্মরত মানুষেরা সবাই মানুষ হিসেবেই সমান ভাবে অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠতে পারেন- তাদের রায় প্রদানে মানবীয় বিবেচনা এবং আবেগ প্রভাব বিস্তার করতে পারে এর পরও আদালতের এজলাসে বসে একজন বিচারক প্রচলিত বিধি মতে ন্যায় প্রদান করবেন এমনটাই সবার প্রত্যাশিত।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সিদ্ধান্তে উল্লসিত ছিলাম আমরা সবাই- আদালতের বিচারকদের যোগ্য এবং ন্যায় বিচার প্রদানে সক্ষম ভেবে আনন্দিত ছিলাম-যদিও বিচারকদের ঘুষ গ্রহন প্রসঙ্গ এবং বিচারকদের তত্ত্বাবধান এবং নজরদারীর বিষয়টা উপেক্ষিত ছিলো এরপরও বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পরে উদ্ভুত সমস্যা নিয়ে ভাবা যাবে এমনটাই ভাবনা ছিলো আমার। যদি প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা কাউকে ন্যায় দিতে ব্যর্থ হয় কিংবা আদালতের রায়ে যদি বাদী কিংবা বিবাদী সন্তুষ্ট না হয় তবে উচ্চ আদালতের দারস্থ হওয়ার বিধানও আছে- কিন্তু যদি স্বয়ং উচ্চ আদালতের রায় কারো অপছন্দ হয় কিংবা যদি উচ্চ আদালতের রায় কারো বিবেচনায় অন্যায় মনে হয় তাহলে সে কি করতে পারে? অন্য কোনো আদালত নেই তার কাছে যেখানে সে সুবিচারের প্রত্যাশায় যাবে- সমস্যাগুলো নিয়ে বিবেচনার সময় সুযোগ সব সময় আছে- একটা ন্যায়পাল নিয়োগ করে তাকে সকল বিধি বিধান পর্যালোচনার সুযোগ দেওয়া কিংবা এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করা যা স্বয়ং সংবিধানের বিভিন্ন বিধানকে পর্যালোচনা করে বাতিল করবার ক্ষমতা রাখবে কিংবা এমন একদল পেশাদার মানুষ কিংবা বিচারক নিয়োগ যারা সবার আস্থাভাজন হতে পারেন- যাদের উপরে মানুষ শেষ ভরসা রাখবে- এমন অনেক রকম সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা জাগিয়েছিলো বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সিদ্ধান্ত।

আমাদের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় বাদী কিংবা ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ আদালতের শরণাপন্ন হন- তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ দাখিল করেন এবং পুলিশ অভিযুক্তকে আদালতের নির্দেশে কিংবা পুলিশ স্বউদ্যোগে অপরাধীকে আদালতে নিয়ে আসে- এবং প্রয়োজনে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা চালাতে পারে আদালতে- অভিযুক্তের পক্ষে এবং ক্ষতিগ্রস্থের পক্ষে উকিলেরা সাক্ষ্য প্রমাণ ও জেরা করে ঘটনার প্রকৃত বয়ান বিচারকের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করেন- অবশেষে এক সময় মামলার শুনানী শেষ হয়- ধারাবাহিক জেরা এবং তদন্ত প্রতিবেদন- আদালতের বিভিন্ন প্রক্রিয়া বিবেচনা করে অবশেষে বিচারক প্রচলিত বিধি মতে একটা সিদ্ধান্ত জানান- এখানে যদি অপরাধীর অপরাধ সংশ্লিষ্ঠতা সরাসরি প্রমাণিত না হয় তবে আদালত তাকে অভিযুক্ত না করে বেকসুর খালাস দিয়ে দিতে পারেন- আবার ইচ্ছা করলেই দুর্বল প্রমাণ থাকা স্বত্ত্বেও তাকে শাস্তি প্রদান করতে পারেন- এই পর্যায়ে বিচারকের ক্ষমতা ইশ্বরতুল্য- তিনি ইচ্ছা করলেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারেন- এবং এখানেই বিচারকের অসহায়ত্ব এবং বিচারকের অপরাধ প্রবন হয়ে উঠবার সম্ভবনাটা শুরু হয়।

আমাডের বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের কাজটা আদালতের সিদ্ধান্তে শুরু হয়েছে তবে এখনও সর্বাঙ্গীন কাঠামোটা নির্দিষ্ট না। এক বন্ধুর কাছে শুনলাম যে বিচার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত এবং কোনো এক জেলা শহরের ম্যাজিস্ট্রেট- সে বললো পৃথিবীর স্বাধীন বিচার বিভাগের ২৫টারও বেশী রকমফের আছে- আমার মূল প্রশ্ন অবশ্য ছিলো তার কাছে বিচারক কিংবা আদালত রায় দিতে পারে এবং এই রায়ের যথাযোগ্য সম্মান প্রদান করা হচ্ছে কিনা কিংবা বিধান মতো রায় কিংবা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হলো কিনা এটা যাচাই করবে কিভাবে বিচার বিভাগ? ফৌজদারী কার্যবিধি কিংবা দেওয়ানী কার্যবিধিতে আদালতের দেওয়া রায়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ন্যায় বিচার পেলো কিনা এটা যাচাই করবে কিভাবে আদালত- আমার মনে হয়েছিলো পুলিশ এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীকে আদালতের সরাসরি তত্ত্বাবধানে রাখা হবে- এ বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত আসে নি এখনও-

তবে বন্ধুর ভাষ্যে যা পেলান সেটা আরও ভয়ংকর- আসলে পদবী এবং কার্যবিধি সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্তই এখনও গৃহীত হয় নি- প্রশাসনিক কাঠামোতে বিচার বিভাগ এখন সচিবালয়ের অন্তর্ভুক্ত- এবং প্রতি বছর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে বিভিন্ন জেলা আদালতের ম্যজিস্ট্রেট এবং বিচারক নিয়োগ হচ্ছে এদের কার্যধারা কিরকম হবে কিংবা স্বধীন বিচার বিভাগ যা সচিবালয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপের বাইরে চলে যেতে পারে কিংবা একটা স্বাধীন বিচার বিভাগ যাদের বেতন ও অন্যান্য ভাতাদি- পদোন্নতি এবং পদাবনতি সবই একটা আলাদা বিভাগ নিয়ন্ত্রন করবে এমন সিদ্ধান্টে প্রচলিত বিচার বিভাগের কর্মচারীদের কিভাবে আত্ত্ীকৃত করা হবে এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নীতিমালা এখনও তৈরি হয় নি- বরং ১৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নবগঠিত স্বাধীন বিচার বিভাগে-

তবে পেশা এবং পদবীতুল্যতার বিষয়টা এখনও নির্ধারিত নয়- নির্ধারিত নয় বেতন আসবে কোথা থেকে- আজ ম্যাজিস্ট্রেটদের সভা হয়েছে সেখানে তারা নানাবিধ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে- আগামীকালের দৈনিক হাতে না আসা পর্যন্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা কঠিন-
তবে টিভি পর্দায় পরিচিত মুখদের দেখে ভালো লাগলো- জরুরী অবস্থা অবসানে তারা কঠোর কর্মসুচী গ্রহনে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছে এটাও ভালো লাগলো- একটা সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরাসরি সরকার এবং আদালটের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন এমন বলবো না- তবে তারা তাদের পেশাগত দায়িত্ব যা পূর্বে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হিসেবে আদালতের বিচার কার্য পরিচালনার কাজ ছিলো সেখান থেকে অব্যাহতি নেওয়ার মতো চরম সিদ্ধান্ত গ্রহনের হুমকি দিয়েছেন যখন তখন বেশ আশ্চর্য লাগলো-

অবশ্য অনেক রকম সরকারী নীতিমালা আমার অজানা- যারা সরকারী কর্মকর্তা তাদের নিজস্ব চাকুরি নীতিমালায় বিরোধিতার এবং পদবী সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের নির্দিষ্ট কোনো প্রেশক্রিপশন থাকতেই পারে-

মিডিয়ার কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠা ম্যাজিস্ট্রেট রোকনউদদৌলা বেশ জোর দিয়েই বলেছেন বিচার বিভাগ আগামি ১৪ বছরেও স্বাধীন হবে না- আরও অনেক রকম কথাই তিনি বলেছেন- তিনি তাদের নির্দিষ্ট পেশাজীবি শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব করে কিছু বলতেই পারেন- তার এই আচরণ সরকারী কর্মবিধির সরাসরী বিরোধী কিনা এটা সরকার বিবেচনা করবে- তবে আমার কাছে রোকন উদ দৌলার দাবী বেশ অযৌক্তিক মনে হয়েছে কারণ তারা কোনো নীতিমালা এখনও পর্যন্ত পেশ করতে পারেন নি- এই বিষয়ক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিলো তাও প্রায় ৬ বছর হলো- এই ছয় বছরে তারা একটা নীতিমালা কিংবা আত্তীকরণ কোনো প্রক্রিয়া বা ফর্মূলা সরকারকে পেশ করতে পারেন নি- এখন যখন বিচার বিভাগ পৃথক হচ্ছে তখন দল বেধে সভা করে আগামি ২০২১ সালের আগে বিচার বিভাগ পৃথকীকরন করা যাবে সংক্রান্ত বক্তব্য আমাকে বিরক্ত করেছে-

তাদের অযোগ্যতা কিংবা ব্যর্থতা কিংবা তাদের আশাবাদ কখনই নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হবে না- এবং আমাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিভাবে গ্রহন করা হবে নবগঠিত স্বাধীন বিচার বিভাগে- তাদের পদবী এবং বেতন স্কেল এবং নানাবিধ ভাতা ও সুবিধা কিভাবে প্রদান করা হবে- এবং আরও শটেক বিধি বিধান তৈরি করে তারা গত ৬ বছরেই প্রদান করতে পারতেন এ বিষয়ে গঠিত কমিশনের কাছে- হঠাৎ করেই ১লা নভেম্বরের আগে সভা ডেকে একটা আত্তীকরণ ফর্মূলা প্রদান করার বিষয়টা হয়তো সঠিক তবে এখান থেকে আন্দোলনের ডাক দেওয়াটা কতটুকু যৌক্তিক-

নিজেরা বিচার বিভাগে কর্মরত থেকে যদি নিজেরাই আদালটের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অপরাগ হন তবে তাদের আইনানুগত্য বিষয়ে একটা প্রশ্ন সামনে চলে আসেই- এবং গত ৬ বছরে তারা কত ঘোড়ার ঘাস কেটেছেন- কেনো তারা একটা ঐক্যবদ্ধ প্রস্তাবনা তুলে ধরতে পারেন নি এই ব্যর্থতার জন্য নব গঠিত বিচার বিভাগের বিরোধিতা করাটা কতটুকু যৌক্তিক এই প্রশ্নটা সামনে রেখেই আসলে আলোচনা সমাপ্ত করতে হচ্ছে।


মন্তব্য

রাতের অতিথি এর ছবি

"যদি স্বয়ং উচ্চ আদালতের রায় কারো অপছন্দ হয় কিংবা যদি উচ্চ আদালতের রায় কারো বিবেচনায় অন্যায় মনে হয় তাহলে সে কি করতে পারে?"

কিছুই করার নেই। ন্যায়পাল নিয়োগ করে লাভ নেই। এরপর ন্যায়পালের উপর কি সুপ্রীম ন্যায়পাল নিয়োগ করবেন? চরম শাস্তির বেলায় প্রেসিডেণ্ট ক্ষমা করার (বা ফাঁসির আদেশ যাবজ্জীবন কারাবাসে রূপান্তরিত করার) সুযোগ পেয়ে থাকেন।

তবে বিচার বিভাগীয় দুর্নীতি দমনের জন্য সংসদীয় কমিটি ও যথোপযুক্ত পদ্ধতি/কানুন রাখতে হবে। যেসব বিচারকদের নামে ঘুষ খাবার অভিযোগ আছে তাদের অনতিবিলম্বে তদন্ত করতে হবে।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আল্লাহই একমাত্র বিচারক । চোখ টিপি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।