বাংলা নতুন বছর এসে গেলো প্রায়। সেই উপলক্ষেই একটা অনেক পুরোনো লেখা আপনাদের জন্য নিয়ে এলাম, আশা করি প'ড়ে ভালো লাগবে কারোর কারোর। সিনেমা বিষয়ক লেখা লিখবো আরো, তবে আজ একটু অন্য পথে হাঁটা যাক। আগাম 'শুভ নববর্ষ' জানিয়ে শুরু করি।
সে এমন কিছু বহুযুগ আগের কথা নয়। আমাদের ছোটোবেলার কথা। যদিও পথ-ঘাট গাঁ-গঞ্জ যেভাবে পাইকারি হারে নাম বদলে ভোল পাল্টে ফেলছে তাতে সেসব এখন অন্য যুগের কথা বলেই মনে হয়। দাক্ষিণাত্যের লোকেদের আগে বলতাম 'মাদ্রাজি', এখন 'মাদ্রাজ' বললেই লোকে তেড়ে মারতে আসে। কলকাতার রাস্তাঘাটও তখন এতো দেশনেতাদের স্মৃতিবিজড়িত ছিলো না। আমরা থাকতাম উত্তর কলকাতায়, ঠিকানা বলতাম কর্নওয়ালিশ স্ট্রীট। ভিস্তিওয়ালা আর বেলকুঁড়ি আসতো না ঠিকই, তবে বুড়ির চুল, সস্তার আইসক্রিম আর ছোট্টো ছোট্টো বনকুল নিয়ে হজমিওয়ালা হাজির হতো নিয়মিত। আর ছিলো বোম্বাই মিঠাই, ঘোর মিষ্টি আর চ্যাটচ্যাটে আঠালো, বাঁশে জড়ানো এক বিচিত্র খাদ্যবস্তু, যার দর্শনসুখটাই বোধ হয় ছিলো মুখ্য। এমন চমৎকার পাখা, ফুল, হাতঘড়ি, টিয়াপাখি বানিয়ে দিতো তা দিয়ে যে প্রাণে ধরে খেতে পারতাম না। 'মুম্বাই মিঠাই' নামটা ঠিক জমে না বলেই বোধ হয় জিনিসটা উঠে গেলো।
আমাদের সেই বাল্যকালে নববর্ষটা ছিলো বেশ অন্যরকম। হালখাতা আজও হয়, মূল অনুষ্ঠানটা মোটামুটি অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। তবে তার সাথে জড়িত উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাঁটা পড়েছে অনেকখানি। তখন চৈত্রমাস পড়তেই বড়ো গয়নার দোকানগুলোর নিমন্ত্রণ পত্র পৌছে যেতো বাড়ি বাড়ি। ছোটো দোকানিরা বেশির ভাগ মৌখিকই সেরে দিতেন, চিঠি ছাপানোর খরচটা ছিলো অনেকের সাধ্যাতীত। তাতে অবশ্য কিছু এসে যেতো না, আমরা ছোটোরা ঠিকই মনে রাখতাম কোথায় কোথায় যেতে হবে। দূরের বড়ো দোকানগুলোয় যাওয়া হতো গুরুজন বয়স্ক পুরুষদের সাথে। আর কাছে-পিঠের দোকাুংলো থাকতো মা-কাকিমাদের দায়িত্বে, দূরেরগুলোয় যেতে গিয়ে সেগুলোতে যাতে বাদ না পড়ে যাই সেজন্য যথেষ্ট পরিকল্পনা করতে হতো আগাম। খাবারের মধ্যে নানা রকম মিষ্টি, কচুরি, সিঙাড়া ছাড়াও জুটতো শরবৎ। নরম পানীয় ব্যাপারটা ছিলো দুর্লভতর, তাই ফিরে এসে কার কটা জুটলো তাই নিয়ে রীতিমতো আলোচনা হতো হর্ষোল্লাস ও দীর্ঘশ্বাস সহযোগে। অনেক দোকানি আবার অক্ষয় তৃতীয়াতে হালখাতা করতো, তাদের মোটেও সুবিধার ঠেকতো না আমাদের। ঐ দিন স্কুল থাকতো, আর উৎসবের পরিবেশও অবশিষ্ট থাকতো না বলে মায়েরা নিজেরাই সেরে আসতেন সেই পাট। অযথা এই ফস্কে যাওয়ার ব্যাপারটা বরদাস্ত হতো না মোটেও।
নতুন বছরের সূচনার এই শুভলগ্নে নতুন দোকানও চালু হতো কিছু। ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙালি চিরকালই অনাগ্রহী, তা সে কবি যতোই 'বাণিজ্যেতে যাবোই' ব'লে অস্থির হোন না কেন। আত্মীয় বা প্রতিবেশীর পরিবারে যে ছেলেটির পড়াশুনায় তেমন মাথা নেই বা মুরুব্বি ধরেও যে চাকরী জোটাতে পারলো না, এদিক ওদিক ধারকর্জ ক'রে সে একটা দোকান খুলে বসতো। এই রকম কিছু উদ্বোধনের নেমন্তন্নও জুটে যেতো নতুন বছরে। শিবুদা আমাদের কীরকম যেন আত্মীয় হতো, থাকতো পাশের পাড়াতেই। খুব ভিতু আর নিরীহ গোছের ছেলে, পড়াশুনা ব্যাপারটা যে ওর মাথায় ঢুকতো না সেই লজ্জায় মাটিতে মিশে থাকতো প্রায়। তাই গুরুজনদের সামনে কুশল জিজ্ঞাসার উত্তরটুকু ছাড়া মুখ খুলতো না, মিশতো কেবল ছোটোদের সাথেই। আমার অবশ্য শিবুদাকে কিছু বোকা-টোকা মনে হতো না, হয়তো সেজন্যেই আমাকে মাঝেমাঝে শোনাতো ওর সাদামাটা স্বপ্নগুলোর কথা। বিশেষ কিছু নয়, পড়াশুনা যখন হলোই না তখন ও একটা দোকান দেওয়ার ইচ্ছা ওর। সংসারে যে সব খুঁটিনাটি জিনিস লাগে তার একটা লিস্টিও বানিয়েছিলো, সেগুলো সব পাওয়া যাবে সেই দোকানে। ছুঁচ-সুতো, সেফটি পিন, চিরুনি, দেশলাই, পেরেক, মোমবাতি, আলতা-সঁিদুর, রুমাল, খাম, দড়িদড়া, আয়না, পান-মশলা, চুলের ফিতে, এই সব হাবিজাবি।এগুলো মা-জেঠিমাদের যখন-তখন দরকার পড়ে, হাতের গোড়ায় পেলে কী সুবিধেটাই না হবে! যেন মাতৃকুলের সমস্যা মেটাতেই ওর ব্যবসা করা জরুরি। এ ব্যবসার পণ্যসামগ্রীতে আমাদের আগ্রহের বস্তু বেশি ছিলো না ব'লে আমরাও কয়েকটা জিনিস জুড়ে দিয়েছিলাম, যেমন ঘুড়ি, মাঞ্জা, ক্যাম্বিস বল, লাট্টু এই সব। শিবুদার ভালোমানুষিতে আমাদের কোনো সন্দেহ ছিলো না, তাই দোকান খোলা হ'লে ওগুলো যে থাকবেই সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম আমরা। কয়েক বছর ঘুরে গেলে যখন বড়োরা নিঃসন্দেহ হয়ে গেলেন যে ওর দ্বারা চাকরি জোটানো হবে না, তখন সবাই মত দিলেন দোকানের ব্যাপারে। ততোদিনে শিবুদার পরিকল্পনাটায় আরও পরিবর্ধন হয়েছে। দোকানের কল্পিত ভান্ডারে আমদানি হয়েছে আরও অনেক নতুন জিনিসের, যেমন আমার অনুরোধে স্প্রিং ছুরি আর দূরবীন, কৃতিত্ব বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের। কিন্তু শিবুদার এ হেন ব্যবসাবুদ্ধি ও বিশদ পরিকল্পনার কোনো কদরই হলো না বয়স্ক মহলে। অর্থের জোগানদার হিতৈষীরা এই উদ্যোগটাকে মূর্খামি ব'লে গোড়াতেই বাতিল ক'রে দিলেন, এবং তারপর তিন-চারটি মতের মধ্যে থেকে থালা-বাসনের দোকান দেওয়া স্থির হলো। পিতল-কাঁসার বাসন তখন ভালোই চলতো, শুধু রোজকার ব্যবহারেই নয়, উৎসবে উপহার হিসেবেও। অতএব পরবর্তী পয়লা বৈশাখেই ব্যবসার শুভারম্ভ হলো। আর্থিক সঙ্গতি অনুসারে বড়ো রাস্তার উপরে নয়, গলির মধ্যে খোলা হলো শিবুদার 'কমলা বাসন ভান্ডার'। উদ্বোধনী সাজসজ্জা আমরা সবাই মিলে আমপাতা, শোলার ফুল, গাঁদার মালা দিয়ে করেছিলাম, সমাগত অতিথিদের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখি নি, এবং সেই বাবদ সে বছর অনেকগুলো হালখাতার নিমন্ত্রণ থেকে বাদও পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শিবুদার হতোদ্যম বা অনভিজ্ঞতার কারণেই হোক বা স্টেইনলেস স্টিলের আবির্ভাবে, কমলা বাসন ভান্ডার লালবাতি জ্বালাতে এক বছরও নিলো না। পরাজিত সৈনিক শ্রী শিবপদ মিত্র অবশ্য তারপরেও আমাদের ছোটোদের মধ্যে তার সেই পুরোনো স্বপ্নের ঝোলা খুলতো। বড়ো বড়ো চোখে বিস্ময় ভ'রে বলতো আগামী নববর্ষে সে নিশ্চয়ই সেই টুকিটাকির দোকানটা খুলবে যা মেটাবে পাড়ার মা-মাসিমাদের সমস্ত দরকারের ফরমায়েশ।
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। আজ এতকাল পরে দেশ থেকে বহুদূরে অফিস-ফেরতা সন্ধ্যেবেলা যখন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে মস্ত ঝোলায় হরেক রকম টুকিটাকি সওদা কিনে ফিরি, তখন মনে হয়, এই নববর্ষে যদি শিবুদা তার দোকানটা খুলতে পারতো, তাহলে নিশ্চয়ই খুব খারাপ চলতো না। আর আমরাও একটা হালখাতার নেমন্তন্ন পেয়ে যেতাম সেই উপলক্ষ্যে।
Comments
লেখাটা ভাল লাগল। আহারে শিবুদা। এখন উনি কী করছেন, কিছু জানেন নাকি?
লেখাটা অনেক কিছু মনে করিয়ে দিলো। 'হালখাতা'র স্মৃতি। কত কিছু যে বদলে গেছে এই গত কয়েক বছরে, কত কিছু যে হারিয়ে গেছে জীবন থেকে, হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম তা।
ধন্যবাদ, প্রহরী ভাই।
হালখাতা আজ আর হয় কি না কে জানে, হলেও সেইরকম জোরেসোরে যে হয় না বলাই বাহুল্য, বিশেষতঃ নাগরিক অঞ্চলে। হালখাতার প্রধান আকর্ষণ যে সব খাবার, যেমন বালুসাই, দরবেশ, গজা, মিহিদানার লাড্ডু, সেগুলো হাতে িদলে আজকের বাচ্চারা নাক সঁিটকে চলে যাবে। প্যাটিস আর পেপসি দিয়ে হালখাতা যাদের বাজেটে কুলোবে সেই সব ব্যবসায়ীরা বাংলা নববর্ষ পালন করে না (না কি "মনায় না" বলবো?)। তাছাড়া হালখাতার অর্থনীতি যে ধারের খাতার বার্ষিক হিসাব মেলানো ঘিরে, তাই তো এখন অর্থ হারিয়েছে, সব ধারবাকি এখন ক্রেডিট কার্ডের মারফত হয় যে!
শিবুদা কাল্পনিক চরিত্র, কিন্তু তার দুঃখ যে আপনার মনে বেজেছে তা জেনে গর্ববোধ হলো। আনন্দও হলো প্রচুর।
উপসস, ক্যাটেগরীতে যে 'গল্প' লেখা ছিল, একদম চোখ এড়িয়ে গেছে। 'স্মৃতিচারণ' দেখেছিলাম, তাই ভেবেছিলাম সত্য কাহিনী। তবে চরিত্রটা আসলেই ফুটিয়েছেন ভালো।
গ্রামাঞ্চলে এখনো ছোট পরিসরে হালখাতা হয় শুনেছি, তবে আর কতদিন হবে, সেটাও একটা প্রশ্ন।
আহা দেখেন নি বেশ করেছেন, তাতেই তো ঐ রকম প্রশংসা জুটলো।
আবারও ধন্যবাদ।
চমৎকার লাগলো!!!!
অনেক ধন্যবাদ।
আমারো চমৎকার লেগেছে।
ধন্যবাদ আপনাকে, তাহসিন গালিব।
অতীতকে ভাংগলে যে দারুচিনি গন্ধ বেরোয় , তাই অনুভব করছি।
শিবুদার স্বপ্নগুলো চারপাশের আবহমানকালের নির্যাস। এই সাদাসিধা শুভ্র স্বপ্নগুলো যতদিন সজীব থাকে, সমাজের ধূসরতা আমাদের গ্রাস করে না।
সুন্দর লেখা।
নদী
স্মৃতিমেদুর ক'রে দেয়, এমন লেখা লিখতে বা পড়তে আমিও পছন্দ করি। আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো খুবই, লেখা সার্থক তবে।
ছোটো ছোটো স্বপ্নের আয়ু আজকাল ফুরিয়েছে। কর্পোরেটাইজেশনের পৃথিবীতে শিবুদার হিতৈষী গুরুজনেরা আর নেই, এখন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের অনুমোদন চাই নতুন স্বপ্নের বাস্তবায়ণে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নজরুল ভাই, ইমোটিকন ক্যাম্নে দ্যায়? কল্পনা কইরা ন্যান, এক গাল হাসি থ্যাংকু-ভাব মাখা।
গল্পের লেখনী খুবই পাকাপোক্ত, পড়তে আরাম হলো।
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
ধন্যবাদ, চাচা নেহরু যাই বলুন, আরাম দিয়ে আমিও আরাম পেলাম।
খুব মনমেদুর করা লেখা, অনেক অভিনন্দন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো, থাংকু।
আঁকা, রিভিউ, অনুবাদ, কবিতা, ছড়া, এবারে গল্প!
ভাবছি, আপনার ঝোলায় আর কী কী আছে ?
হা হা, এর উত্তর ছড়ায় দিয়েছি না? সেই জ্যাক অফ অল ট্রেডস? কোনোটাতেই মাস্টারি করা হলো না যার ফলে
অনেক ধন্যবাদ এমন প্রশংসার জন্য। আজ ছড়া পোস্ট করবো।
Post new comment