বিজয় দিবসের উচ্ছ্বাস

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি
লিখেছেন রকিবুল ইসলাম কমল [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৬/১২/২০১৩ - ১০:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার বিশ্বাস প্রতিটি মানুষের ছোট বেলাতেই কেউ না কেউ থাকে যে তার মনোজগতে প্রচণ্ড ভাবে প্রভাব ফেলে। কেউ না কেউ তার রুচির ধরনটা গড়ে দিতে থাকে— তার প্রাত্যহিক যাপিত জীবনের ভেতর থেকেই। যেমন আমার বেলায় ছিলো আমার ছোট মামা।

ছোট মামার যে কোন কাজে এসিস্ট্যান্ট হতে পারাটা ছিলো সে সময় আমার সব চেয়ে কাঙ্ক্ষিত কাজ। মামার এসিস্ট্যান্ট হয়েই বিজয় দিবসে নানুদের বাসার উঠান পুরোটা পতাকা দিয়ে সাজিয়েছি।

আরেকটু বড় হবার পর নিজেদের বাসার ছাদ সাজাতাম। আগে যেমন মামার এসিস্ট্যান্ট থাকতাম আমি। কিছুটা বড় হবার পর আমার এসিস্ট্যান্ট হিসেবে থাকতো আমার ছোট ভাই, রিয়েল।

আটা পানিতে জ্বাল দিয়ে আঠা বানাতাম। আম্মুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে হার্ডওয়ারের দোকান থেকে পাটের সুতলি কিনতাম। কাগজে ছাপা ২০০টি বাংলাদেশের পতাকা আর রঙ্গিন কাগজ কিনতাম আনিস কাকার দোকান থেকে। রডের সাথে বেধে ছাদের চারিদিকে বেড় দিতাম সুতলি দিয়ে তার পর আটার কাই দিয়ে কাগজের পতাকায় আঠা মাখিয়ে লাগিয়ে দিতাম সুতলিতে। দুটি পতাকার মাঝখানে একটি করে রঙ্গীন তিন কোনাকৃতির পতাকা থাকতো, যেগুলো রঙ্গিন কাগজ কেটে নিজের হাতে বানাতাম।

এসব কাজ শুরু করতাম রাত ১২টার পরে; আসে পাশের বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেলে। যেন এলাকার সবাই সকালে জেগে উঠে এত সুন্দর করে পতাকা দিয়ে সাজানো ছাদ দেখে অবাক হয়ে যায়।

ডিসেম্বরের কুয়াশা আর শীতের রাতে এতক্ষণ ধরে ছাদে থেকে ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলবো এই ভয়ে আম্মু বার বার তারা দিতেন নিচে এসে ঘুমানোর জন্য। তবে বুঝতে পারতাম পতাকা দিয়ে বাসা সাজানোটা তারও খুব ভালো লাগতো। ছাদের সিড়ি ঘরের উপরের একটি পিলারের বেড়িয়ে থাকা রডের গায়ে পতাকার এত বড় বাঁশটি দাঁড় করিয়ে বেধে দেয়ার সময় দুই ভাই মিলে না পারলে, আম্মু আর বড় বোনকেও ডাকতে হত সাহায্য করার জন্য। চাঁদের আলোয় আমরা পুরো পরিবার ছাদে এসে, সবাই মিলে লম্বা একটি বাঁশের মাথায় পতাকা বেধে, সেটিকে ছাদের সবচেয়ে উচু জায়গাটিতে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছি; এরকম একটি দৃশ্য সিনেমা বা নাটকের কোন রূপক দৃশ্য মনে হলেও এটি আমার জীবনে সত্যিকারের অম্লান স্মৃতি। (আব্বু প্রবাসে থাকাতে সবসময়ের মত বেশির ভাগ আনন্দময় স্মৃতি থেকে বঞ্চিত)।

বাংলাদেশের পতাকাটির একটু নিচে, বাঁশের গা থেকে অনেক গুলো কাগজের পতাকা লাগানো সুতলি দিয়ে ছাদের উপর একটি স্মৃতি সৌধের মত আকৃতি বানিয়ে আমার বিজয় দিবসের বাড়ি সাজানো শেষ হত।

১৬ই ডিসেম্বরে স্কুল ছুটি থাকার দরুন বেলা করে ঘুম থেকে উঠেই ছাদে যেতাম। দেখতাম আমাদের মত অন্যান্য বাসায়ও পতাকা টানিয়েছে। যে বাসায় আমাদের বয়েসি ছেলেপেলে ছিলো না, সেসব বাসায় ছোট পতাকা দিয়ে ব্যাপকভাবে সাজানো না থাকলেও অন্তত একটি বাঁশের মাথায় লাল সবুজের পতাকা উড়ত।

বড় হয়ে যাবার পর বিজয় দিবসে, পতাকা দিয়ে বাড়ি সাজানোর উচ্ছ্বাস কমে গেলো। রিয়েল যতদিন স্কুলে পড়ত তত দিন বিজয় দিবস এলেই বলতো, `ভাইয়া ছাদে পতাকা দিয়ে সাজাবে না?´ আমার খুব একটা আগ্রহ না দেখে ও নিজেই একা একা পতাকায় আঠা লাগাত। আমি গিয়ে শুধু বড় পতাকার বাঁশটা তুলে পিলারের সাথে বেধে দিতে সাহায্য করতাম।

এর পর কত বছর গেলো। ১৬ই ডিসেম্বর হয়ে গেল কেবল একটি ছুটির দিন। একটি দেশাত্মবোধক ফেইস বুক স্ট্যাটাস আর প্রোফাইল বা কাভার ফটো পরিবর্তন করে জাতীয় পতাকার ছবি দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো আমার বিজয় দিবস উদ্যাপন।

নিজের এবং পরিবারের অর্থনৈতিক নাজুক অবস্থা, অপেক্ষাকৃত দ্রুত সামাল দিয়ে একটি ভালো অবস্থানে নিয়ে যাবার আশায়, গত পাঁচ বছরে এক বার দেশ ছেড়ে বিদেশ এলাম; আরেকবার বিদেশ ছেড়ে দেশে গেলাম। গত বছর আবার চলে এসেছি বিদেশ। জীবনের জাঁতাকলে আমার ছেলেবেলার সেই উচ্ছাস মাখা বিজয় দিবস কবে হারিয়ে গিয়েছিল বুঝতেও পারিনি।

এবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম বারের মত অন্তত একটি স্বাধীনতার বিরোধী বর্বরের শাস্তি সম্পন্ন হয়েছে। এই খুনিটির সর্বোচচ শাস্তি চেয়ে বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুনের মত আমার ছোট ভাইও শাহবাগে দিন রাত পরে ছিলো। আর আমি সেখান থেকে হাজার মাইল দূরে থেকে, প্রতি মুহূর্ত দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়েও কখন বলতে পারিনি, ``শাহবাগে যাবার দরকার নেই; ঘরে থাক।´´

এবারের বিজয় দিবসে আমার ইচ্ছে করছে আমার পিচ্চি ভাগ্নে দুটিকে নিয়ে গভীর রাতে বাসার ছাদে পতাকা লাগাই। বিজয় দিবস নিয়ে আমার বুকের ভেতর আবার জেগে উঠা সেই ছোটবেলার উচ্ছ্বাসটুকু এই ছোট্ট দুটি প্রাণে ছড়িয়ে দেই।

কে জানে; আমি যখন এই সুদূর ওসলোতে বসে ওদের কথা ভেবে পোস্টটি লিখছি, তখন হয়ত ওরা বাংলাদেশে তাদের ছোট মামার সাথে ছাদে পতাকা টানাচ্ছে...


মন্তব্য

আয়নামতি এর ছবি

খুব নস্টালজিক লিখা! হয়ত কি, খোঁজ নিয়ে দেখেন আপনার পিচ্চিপাচ্চি ভাগ্নে দুটি ঠিকই আনন্দে তিড়িংবিড়িং করতে করতে পতাকায় ছেয়ে দিয়েছে বাড়ির ছাদ। বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

আপনাকেও বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

দীনহিন এর ছবি

এবারের বিজয় দিবসে আমার ইচ্ছে করছে আমার পিচ্চি ভাগ্নে দুটিকে নিয়ে গভীর রাতে বাসার ছাদে পতাকা লাগাই। বিজয় দিবস নিয়ে আমার বুকের ভেতর আবার জেগে উঠা সেই ছোটবেলার উচ্ছ্বাসটুকু এই ছোট্ট দুটি প্রাণে ছড়িয়ে দেই।

জানি না, কি করে এই অনুভূতিটুকু মিলে গেল। মনটা ছটফট করছে কিছু একটা করার জন্য, কিন্তু সেই দিন নেই, মানুষগুলো নেই, নেই সেই উত্তাপ, তবু শীতের রাতে বিজয় দিবসের হারিয়ে যাওয়া সেই উচ্ছ্বাস ফিরিয়ে আনার কি প্রাণান্তকর আকুতি! সত্যি হারিয়ে গেছে সেই দিনগুলি!

সচল পরিবারকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনাকেও বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আপনার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা।

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

অমি_বন্যা এর ছবি

এবারের এই বিজয় দিবসের চেতনা একটু ভিন্ন , অনেক বছরের লালিত স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাবার এক সম্ভাবনার হাতছানি। এই সপ্নমাখা বিজয় দিবসের উজ্জ্বল চেতনার অগ্নুস্ফুরিত লেলিহান শিখার বিপ্লবী শুভেচ্ছা আপনাকে। ভালো থাকুন

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা আপনাকেও।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এমন ছোটমামায় ছেয়ে যাক দেশ, বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

আপনাকেও বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

অতিথি লেখক এর ছবি

এভাবেই জাগ্রতহোক চেতনার, ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে। আপনার লেখাটা হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে কমল ভাই। বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

মাসুদ সজীব

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এবং বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

এক লহমা এর ছবি

সত্যানন্দর মত আমিও বলি "এমন ছোটমামায় ছেয়ে যাক দেশ, বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা"

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

আপনাকেও শুভেচ্ছা।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আমার ছেলের সাথে বসে শহীদ মিনার বানালাম, আর পতাকা টাঙালাম!

লেখা চমৎকার লেগেছে।

____________________________

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।