| লেখা ও লেখক কিংবা পাঠকের দীর্ঘশ্বাস |

রণদীপম বসু এর ছবি
লিখেছেন রণদীপম বসু (তারিখ: রবি, ০৪/০৮/২০১৩ - ১১:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ফেসবুকের চ্যাটবক্সে ঢুকে একজন প্রশ্ন করলেন, আপনার প্রিয় লেখক কে ? নির্দ্বিধায় উত্তর দিলাম, আমার কোন প্রিয় লেখক নেই। তার মানে ! হয়তো আমার উত্তর তাঁর পছন্দ হয়নি, কিংবা এর অর্থটা ঠিকমতো ধরতে পারেন নি তিনি। বললাম, আমি তো কোনো পীরবাদে বিশ্বাসী নই। ঠিক বুঝলাম না, আপনি কি ঠাট্টা করছেন ! হতে পারে তাঁর প্রশ্নের সাপেক্ষে আমার উত্তরটা টুইস্ট হয়ে যাচ্ছে ভেবে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করছেন। তাঁর এই বিস্ময়কে পাশ কাটিয়ে এবার আমিই প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা, লেখক বলতে আপনি কী বোঝেন ? এবার আর তাৎক্ষণিক উত্তর এলো না। কে জানে, এমন অদ্ভুত প্রশ্নে তিনি হতাশ হলেন কিনা। একটা বাচ্চা ছেলেরও যে উত্তরটা অজানা থাকার কথা নয়, সেরকম একটা অপরিপক্ক প্রশ্নে হয়তো অপমানও বোধ করতে পারেন। তাঁর আগ্রহ চুপসে গেলেও আমার বক্তব্যটা কিন্তু পরিষ্কার করার দরকার ছিলো। হঠাৎ আবার তাঁর আবির্ভাব। তবে এবার মনে হয় আমাকে টুইস্ট করতেই বললেন, হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী ?
.
এরকম ক্ষেত্রে যা হয়, একজন ব্যক্তি সম্পর্কে আরেকজনের মূল্যায়ন চাওয়ার পেছনে দুটো প্রবণতা কাজ করে। এখানে যেমন হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন জানতে চাওয়া হয়েছে। জানি না তিনি হুমায়ুন-ভক্ত না সমালোচক। হয় তিনি হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে প্রকৃতই সম্ভাব্য কিছু জানতে বা বুঝতে আগ্রহী, নয়তো এ সম্পর্কিত তাঁর নিজস্ব মূল্যায়নের সাপেক্ষে আমার জবাবের আলোকে তিনি আমাকে বা আমার দৃষ্টিভঙ্গির মূল্যায়ন করতে নেমেছেন। কিন্তু আমার জানা নেই তিনি আসলে কোনটা চাচ্ছেন। ধরেই নিলাম তিনি আমাকেই মূল্যায়নে ব্রতী হয়েছেন। হুমায়ুন আহমেদ উপলক্ষ মাত্র। সেক্ষেত্রে আমার বক্তব্যটাও স্পষ্ট হয়ে যাওয়া জরুরি বৈকি। কোন্ বক্তব্য ? ওই যে, আমার কোন প্রিয় লেখক নেই।
.
এক্ষেত্রে প্রথমেই যে অনিবার্য প্রশ্নটা চলে আসে তা হলো, লেখকসত্তা বলে আদৌ এরকম কোন সত্তার তাৎপর্যময় অস্তিত্ব আছে কিনা। যিনি লেখালেখির মাধ্যমে লেখ্যরূপ সাহিত্য বা সাহিত্য জাতীয় কিছু রচনা করেন সাধারণত আমরা তাঁকেই লেখক বলি। একইভাবে আমরা কবি বা শিল্পীসত্তার কথাও বিভিন্নভাবে বলে থাকি। কিন্তু কিভাবে এই সত্তার বিষয়টা আমরা নিশ্চিত হই বা ধারণা করি ? ব্যক্তির কৃত সৃষ্টিকর্মের অস্তিত্বকে প্রমাণ হিসেবে মেনেই এর সাপেক্ষে আমরা তাঁর মধ্যে একরকম অনির্বচনীয় কোন সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু তাঁরা যা সৃষ্টি করেন তার বস্তুগত প্রক্রিয়ার সাথে একজন ডাক্তার বা প্রকৌশলীর কর্মকাণ্ডের খুব একটা পার্থক্য আছে কি ? অথচ আমরা কিন্তু ডাক্তারসত্তা, প্রকৌশলীসত্তা, ব্যাংকারসত্তা, ব্যবসায়ীসত্তা, সাংবাদিকসত্তা বা আমলাসত্তা নামে এরকম কোন পেশাভিত্তিক স্বতন্ত্র সত্তার কথা স্বীকার করি না কখনো। কেন তা করি না ? কারণ, একজন ডাক্তার বা প্রকৌশলী বা অন্য পেশার যে-কেউ একইসাথে একজন শিল্পী বা লেখকও হতে পারেন। আবার একজন কবির পক্ষে আমলা বা ব্যাংকার বা যেকোনো পেশাজীবী হতে বাধা নেই। অর্থাৎ এই লেখক, শিল্পী বা কবিসত্তার সাথে অন্যান্য পেশাভিত্তিক কর্মকাণ্ডের নিশ্চয়ই একটা তাৎপর্যময় পার্থক্য রয়ে গেছে। কী সেটা ? বিষয়ের জটিল প্রপঞ্চে প্রবেশ না করেও খুব সহজ কথায় বলতে পারি, এটা একটা গুণবাচক সত্তা যার বৈশিষ্ট্য হলো কোন বিষয়কে বিশিষ্টময় করে তোলা।
.
দর্শনশাস্ত্রে একটা প্রচলিত সংজ্ঞা আছে এরকম- গুণ দ্রব্য আশ্রিত। অর্থাৎ দ্রব্যের আশ্রয় ছাড়া গুণের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। এখানে কবিত্ব যদি গুণ হয়, যাকে আশ্রয় করে এই সত্তা প্রকাশিত তিনি হচ্ছেন কবি। তাই কবিত্ব কোন পেশা হয় না। আবার সাংবাদিকতা একটি পেশা, কিন্তু গুণ নয়। একজন সাংবাদিকের মধ্যে কবিত্ব গুণটি বর্তমান থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। যার মধ্যে এই কবিত্ব রয়েছে, তিনি সম্ভব হলে বিশুদ্ধ কাব্যচর্চার মধ্যে দিয়ে এই গুণের বিকাশ ঘটাতে পারেন। অথবা তাঁর যে পেশাভিত্তিক কাজ সাংবাদিকতা, সেখানেও তাঁর এই কবিত্ব গুণের প্রকাশ ঘটতে পারে। ফলে তাঁর সাংবাদিকতার কাজটি কবিত্ব গুণের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছোঁয়ায় বিশিষ্ট হয়ে ওঠতে পারে। একইভাবে একজন প্রকৌশলীর পেশাদারী সৃষ্টিকর্মটিও তাঁর ভেতরের শিল্পীসত্তার ছোঁয়ায় আকর্ষণীয় শিল্পমণ্ডিত হয়ে ওঠতে পারে। এভাবে যেকোন কাজের মধ্যেই মানুষের ভেতরের গুণসত্তাটির প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে ওঠলেই কাজটির স্বাতন্ত্র্য ও অসাধারণত্ব প্রকাশিত হয়। এবং আমরা তখন তাঁদেরকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত করে স্বীকৃতি দিতেও কার্পণ্য করি না মহান সাংবাদিক, অসাধারণ স্থপতি, বিশিষ্ট ব্যাংকার বা অনন্যসাধারণ আমলা ইত্যাদি ইত্যাদি আখ্যায়। একই পেশায় থেকেও ভেতরে ধারণ করা গুণসত্তার সফল ব্যবহারের কারণেই তাঁরা সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ ও স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। এই যে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠার সফল প্রক্রিয়া, এটাকেই আমরা বলি সৃজনশীলতা।
.
কিন্তু খেয়াল করার বিষয় হলো, আমরা কিন্তু তাঁদেরকে তাঁদের ওই গুণসত্তার বিশুদ্ধ স্বীকৃতিটা দিতে পারি না। পারি না তাঁদেরকে কবি, লেখক বা শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করতে। আসলে তা সম্ভবও নয়। কারণ গুণ তার প্রকাশের মাধ্যমকে গুণান্বিত করে বলে ওই মাধ্যমই বিশিষ্ট স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হয়। নীল রঙ একটি গুণ, তা যে-মাধ্যমকে আশ্রয় করে তাকে নীলাভ করে। এতে গুণ নয়, মাধ্যমের পরিচয়ই বিশিষ্ট হয়। যেমন নীল দরজা, নীল গাড়ি ইত্যাদি। এখানে মূল পরিচয়টা মাধ্যমেরই। অর্থাৎ দরজা, গাড়ি ইত্যাদির। আর দরজা বা গাড়ির নীল রঙ হচ্ছে বিশিষ্টতা। কিন্তু গুণ যখন তার স্বগুণ মাধ্যমকে আশ্রয় করে বিশিষ্ট হয় তখনই তাকে বলা যায় বিশুদ্ধ মাধ্যম। যেমন কাব্যত্ব যখন তার স্বগুণ মাধ্যম কাব্যকে বিশিষ্টরূপে গুণান্বিত করে, তখনই তার স্রষ্টাকে আমরা সফল কবি বলে আখ্যায়িত করি। কিন্তু খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখবো যে, কাব্যত্ব গুণটা আসলে আশ্রয় করছে তার মাধ্যম কাব্যকে, কবিকে নয়। কবি হচ্ছেন সফল কারক মাত্র। দ্রব্য হিসেবে এই কবিতা বা কাব্য-মাধ্যম না থাকলে কাব্যত্ব গুণ কিন্তু অস্তিত্বহীনই থাকতো। কাব্যের মধ্যে এই সঠিক কাব্যত্ব গুণ প্রয়োগের কাজটাকে যিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেন তিনিই আসলে কবি। কবির এই ক্ষমতাই হলো কবিত্ব। যাকে আমরা ইতঃপূর্বে আশ্রয়ভেদে কবির গুণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। আবার এই কবিত্ব ক্ষমতাকে যিনি কাব্য ছাড়া অন্য কোন নির্দেশক মাধ্যমে সফল প্রয়োগ ঘটান তাঁর পরিচয় তখন কবি না হয়ে হয়ে যায় অন্যকিছু। হতে পারেন তিনি একজন পূর্বোল্লিখিত সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক বা পেশাভিত্তিক এরকম কিছু।
.
কিন্তু সব গুণ আবার সব মাধ্যমে খাপ খায় না বা আশ্রয়ও করতে পারে না। যেমন মানবতা বা মানবিকত্ব এক ধরনের গুণ বা গুণসত্তা। যদিও মানবিকতা কোন মৌলিক গুণ নয়, বেশ কিছু গুণের সমবেত ফলাফল। তবু প্রসঙ্গের খাতিরে মোটাদাগে তাকে একটি স্বতন্ত্র গুণ হিসেবে বিবেচনা করলেও এই গুণকে আমরা দরজা বা গাড়ির বিশিষ্টতা তৈরির জন্য ব্যবহার করতে পারি না নিশ্চয়ই। এখানে কোনভাবেই বলা সঠিক হবে না যে এটা মানবিক দরজা বা অমানবিক গাড়ি ইত্যাদি। খুবই হাস্যকর হয়ে যাবে। অর্থাৎ গুণ যাকে আশ্রয় করে থাকবে তারও একটা নির্দেশ্যতা রয়েছে। মানবিকতার বিশুদ্ধ আশ্রয় মাধ্যম হলো মানব বা মানুষ। এই গুণের পরিপূর্ণ আশ্রয় হলেই একজন মানুষ পুরোপুরি মানবিক মানুষ হয়ে ওঠেন। আবার সফল কারক হিসেবে মানবিক সত্তাধারী একজন মানুষ এই মানবিকতা গুণটিকে অন্য কোনো নির্দেশক মাধ্যমেও সফল প্রয়োগ করে মাধ্যমটিকে বিশিষ্ট করে তুলতে পারেন। যেমন সংবাদপত্র একটি মাধ্যম। কিন্তু এই বস্তুগত মাধ্যমরূপী সংবাদপত্রে কোন মানবিক গুণ আশ্রয় করতে পারে না। যা পারে তা হলো মানবিক সত্তাধারী এক বা একাধিক সাংবাদিক বা সম্পাদকের মানবিক গুণাবলি সম্বলিত কাজের নমুনাকে ধারণ করতে। এই নমুনা হলো সংবাদ বা ব্যাপকার্থে সংবাদচিত্র। যে সংবাদচিত্র আবার বিশিষ্টতা অর্জন করতে পারে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক বা সম্পাদকের নিজের মধ্যে ধারণ করা বিভিন্ন গুণের প্রকাশ হিসেবে। কিন্তু গুণ না থাকলে গুণের প্রকাশ ঘটবে কী করে ? তবে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি এই ভেবে যে, গুণের ধরন ভিন্ন হতে পারে, তবে জগতে গুণহীন বস্তু বলে কিছু নেই। দর্শনের ভাষায় সকল অস্তিত্বশীল দ্রব্যই গুণসম্পন্ন। এই গুণসম্পন্নতাকেই শেষপর্যন্ত বস্তুটির স্বভাব বলে আমরা স্বীকার করে নিই। প্রতিটা দ্রব্যেরই নির্দিষ্ট স্বভাব রয়েছে। যেমন বল গোলাকার, চাকা চক্রাকার, পানি শীতল, আগুন উত্তপ্ত। এখানে বলের স্বভাব গোলত্ব। এই গোলত্ব বা গোলাকৃতি স্বভাব না থাকলে বস্তুটি হয়তো অন্যকিছু হতে পারে, কিন্তু বল হবে না। অনুরূপভাবে চাকার স্বভাব চক্রত্ব, পানির স্বভাব শীতলতা, আগুনের স্বভাব তপ্ততা বা উষ্ণতা। অর্থাৎ যে গুণ যে বস্তুর সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়িত সেটাই ওই বস্তুর স্বভাব। একইভাবে সংবাদপত্রেরও নির্দিষ্ট স্বভাব রয়েছে, তা হলো সংবাদ ধারণ করা। আবার সে সংবাদের স্বভাব হলো তাকে যে গুণ দিয়ে বিশিষ্ট করা হয়েছে তা। কী গুণ দিয়ে বিশিষ্ট করা হবে তা নির্ভর করছে এর সাথে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক বা সম্পাদকের কারক বৈশিষ্ট্যের উপর। তাকেই বলে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা ব্যাপকার্থে আদর্শ। এই লক্ষ্য বা আদর্শের একটি কারণও রয়েছে। তা কি মানবতার পক্ষে না বিপক্ষে হবে, অন্যায়ের শাসন না শোষণ করবে ইত্যাদি, এটা নির্ভর করে সেই কারক বৈশিষ্ট্যের উপর।
.
যেহেতু গুণ হচ্ছে একটি বিমূর্ত অবস্থা, তাই যতক্ষণ না তা দ্রব্য বা মাধ্যমে আশ্রিত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রকাশ ঘটে না। অর্থাৎ দ্রব্যের প্রকাশিত অস্তিত্ব থেকেই তার মধ্যকার গুণের অস্তিত্ব বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা ধারণা পাই। এবং তাকেই বলা যায় জ্ঞানের উন্মেষ বা প্রকাশ। দ্রব্য বা বস্তুর সাথে জৈব ইন্দ্রিয়ের লৌকিক সংযোগ বা সন্নিকর্ষের মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় তাই জ্ঞান বা অনুভব। এই মূর্ত অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের মাধ্যমেই আমরা বস্তুটির অধিগত গুণের উপলব্ধি পাই। এক্ষেত্রে এটাও উল্লেখ্য যে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাথে কিন্তু প্রথমেই কোন দ্রব্যে আশ্রিত গুণের সংযোগ ঘটে না। সংযোগ ঘটে ঐ দ্রব্যটির এবং দ্রব্যটির মাধ্যমেই পরবর্তীতে দ্রব্যস্থিত গুণের উপলব্ধি আমরা অর্জন করি। আর এভাবেই চোখের সামনে সংবাদপত্রটি মেলে ধরলেই আমাদের উপলব্ধিতে চলে আসে এটির আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কী হতে পারে। অর্থাৎ সংবাদপত্রটি তার মূর্ত অবস্থা দিয়ে আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে তার অভ্যন্তরস্থ গুণের অবস্থা বা বৈশিষ্ট্য। মানে এর পেছনের কুশীলবদের মানবিক গুণাবলীর সুলুক-সন্ধান পেয়ে যাই আমরা এটি থেকেই। সহজ সরল লোকায়ত বাংলায় যাকে বলে ফলের চরিত্রই গাছের পরিচয়। আর পোশাকি ভাষায় একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে বললে- কর্মই কর্তার পরিচয়।
.
গুণ বলতে ব্যাপকার্থে বিশেষণীয় অবস্থা অর্থাৎ দোষ, গুণ, সংখ্যা, অবস্থা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়কে বুঝতে হবে। দোষও একটা গুণ, তবে তা নেতিবাচক গুণ। যিনি কোন কাজ করেন অর্থাৎ ক্রিয়া সম্পাদনকারী কর্তার এরকম বহু গুণ বা পরিচয় থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের ইন্দ্রিয় কর্তার প্রকাশিত কর্মকেই চিহ্নিত করতে পারে। অতএব তিনি যেটুকু কর্ম করলেন সেটুকুই তার প্রকাশিত পরিচয়। আর অন্য কোন পরিচয় থাকলেও তা বিমূর্ত বলেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, অর্থাৎ লৌকিক দৃষ্টিতে অস্তিত্বহীন। অস্তিত্বহীন বিষয়ের কোন বিশিষ্টতা থাকতে পারে না। যুক্তিহীন অনুমান বা কাল্পনিক বিশিষ্টতার কোন বস্তুনিষ্ঠতা নেই, তাই মূল্যও নেই। অতএব কারো কর্ম আমাদের সাথে তাঁর যেটুকু পরিচয় ঘটিয়ে দেয় সেটুকুই কর্তার পরিচয়। একজন লেখকের পরিচয়ও সেরকমই। তার সৃষ্টি যেটুকু পরিচয় প্রকাশ করে সেটুকুই তার লেখক পরিচয়। অন্য কথায় লেখক তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে নিজের যেটুকু পরিচয় আমাদের কাছে প্রকাশ করেন সেটুকুই তার লেখক পরিচয়। এর অতিরিক্ত তাঁর ব্যক্তিসত্তার অন্য কোন গুণাবলী যৌক্তিকভাবেই লেখকসত্তার অধিগত নয়। ফলে এই লেখক পরিচয় নিশ্চয়ই তাঁর ব্যক্তি পরিচয়ের সাপেক্ষে অসম্পূর্ণ বা অপূর্ণাঙ্গ। এবং এই লেখক পরিচয়ই লেখকের উদ্দিষ্ট, অর্থাৎ এ পরিচয়ের মধ্যে দিয়েই তিনি তাঁর পরিকল্পিত লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা আদর্শ রূপায়িত করেন। এটাই তাঁর লেখক চরিত্র। ব্যক্তি চরিত্রের যেকোনো প্রণোদনায় লেখক চরিত্র প্রভাবিত হতে পারে বটে, তবে লেখক চরিত্র আর ব্যক্তি চরিত্র কোনভাবেই অভিন্ন বা সমার্থক নয়। এরপরও আমরা যখন লেখক চরিত্রের মধ্যেই লেখকের ব্যক্তি চরিত্র বা পরিচয়কে মহিমান্বিত করে তোলার চেষ্টা করি, সমস্যার সৃষ্টি হয় সেখানেই। কিভাবে ? আমাদের আলোচনার লক্ষ্যবিন্দুও আসলে এটাই।
.
জগত পরিবর্তনশীল। তবে এই পরিবর্তনশীলতারও কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতি রয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে নিষ্প্রাণ বা অজৈব বস্তুর পরিবর্তনশীলতা অতি ধীর গতির। অজৈব বা জড়বস্তুর এই পরিবর্তনশীলতা মূলত বস্তুগত ক্ষয়িষ্ণুতা বা ক্ষয়প্রাপ্তিরই ধারাবাহিকতা। কিন্তু এর তাৎপর্যময় বৈশিষ্ট্য হলো, ক্ষয়প্রাপ্তির এই ধারায় বস্তুটির বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত তার মৌলিক স্বভাবের কোন হেরফের ঘটে না। একটি পাথর বা ইট বৃষ্টি বাতাস বা অন্যকোন বস্তুগত ঘর্ষণ বা বিভিন্ন কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে বিলীন হবার আগ পর্যন্ত এটি পাথর বা ইটের মৌলিক স্বভাবই ধরে রাখে। অন্যদিকে জীব বা জৈববস্তুর পরিবর্তন হয় জৈববৈশিষ্ট্যের আলোকে তুলনামূলক দ্রুত গতিতে। এর শারীরিক পরিবর্তনের প্রভাবশালী নিয়ামক হিসেবে রোগ-জরা তো আছেই, এমনকি পরিবেশ পরিস্থিতি স্থান কাল পাত্র ভেদে এই পরিবর্তন তার কর্মকাণ্ডকেও প্রভাবিত করে থাকে। যেমন মানুষ। তার শারীরিক পরিবর্তনের প্রভাবে মানসিক জগতেও ঘটে যেতে পারে আমূল পরিবর্তন। এছাড়া সামাজিক, রাষ্ট্রীক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ইত্যাদির অভিক্ষেপ তাঁর চিন্তা চেতনায়ও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দুঃখ, আনন্দ, ক্ষোভ, মোহ, ত্যাগ, ভোগ প্রভৃতি বিকারের মাধ্যমে তার দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। এতে করে জাগতিক বিষয়াবলির সাথে তাঁর ইন্দ্রিয় সন্নিকর্ষতা পাল্টে দিতে পারে তাঁর সংবেদনশীল প্রণোদনাকেও। ফলে ব্যক্তিরূপী একজন লেখকের আজকের মতাদর্শ আগামীকাল একরকমই থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এই বিবর্তনের কারণেই আজকের পছন্দই আগামীকাল অভিন্নরূপে থাকবে তারও গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। তাই একজন লেখকের সৃষ্টি লেখকের মতোই সতত পরিবর্তনশীল। তবে এখানেও কথা আছে। কোন সন্দেহ নেই যে লেখক এখানে জীব বা জৈবপ্রাণী। কিন্তু তার সৃষ্টিটা ঠিকই জড়বস্তু। ফলে লেখক আর তাঁর সৃষ্টবস্তুর স্বভাবের মধ্যেও পার্থক্য সৃষ্টিকারী কিছু বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হয়।
.
লেখক যখন একটি লেখার কাজ সম্পন্ন করে ফেলেন, তখন ওই লেখাটার একটা বস্তুগত স্থায়িত্বই শুধু নয়, এর বিষয়-বক্তব্যের আবেদনেও একটা সমকালীক স্থায়ী রূপ তৈরি হয়। কেননা সৃষ্টির পর সৃষ্টবস্তু স্রষ্টা থেকে পৃথক হয়ে একটা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তায় পরিণত হয়। সময়ের প্রেক্ষাপটে ওই লেখকের শারীরিক মানসিক বুদ্ধিবৃত্তিক তথা সার্বিক বৈশিষ্ট্য স্বভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেলেও তার আগের সেই লেখাটির স্থিতিশীল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কোন ব্যত্যয় ঘটে না। লেখকের পরবর্তীকালের লেখায় বিষয় বৈচিত্র্য তথা আবেদন বা আদর্শগত চেতনার একশ আশি ডিগ্রীর মোচরেও তাঁর পূর্ববর্তী সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ন হয় না একটুও। এভাবে লেখকসৃষ্ট প্রতিটি রচনাই সৃষ্টির পর পরই সেই যে স্রষ্টা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তাতে আর স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে রচনাটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্থায়িত্বে উজ্জ্বল থাকে। যেমন একজন লেখক যে মুহূর্তে মানবতারিরোধী যুদ্ধাপরাধের যথোপযুক্ত বিচারের স্বপক্ষ চেতনায় একটি লেখা সৃষ্টি করলেন, ওই লেখাটির চেতনাও একই বৈশিষ্ট্য ধারণ করলো। পরবর্তীকালে এই লেখকই হয়তো তাঁর আগের অবস্থান পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ বিপরীত চেতনাবাহী আরেকটি লেখা লিখলেন। কেননা তাঁর মনোজগতের পরিবর্তন তাঁর সৃষ্টিতে কোন না কোনভাবে প্রকাশ ঘটবেই। এই দুটো লেখার মধ্যে যে পরস্পরবিরোধী আবেদন তৈরি হলো পাঠক হিসেবে তার কোনটিকে গ্রহণ করবো আমরা ? এটা নির্ভর করবে পাঠকের মানসিক ও চেতনাগত অবস্থানের উপর। এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, রচনা হিসেবে দুটোরই অস্তিত্ব ও আবেদন কিন্তু লেখা দুটোর স্বাধীন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী স্ব স্ব অস্তিত্বে অক্ষুণ্ন রয়েছে। অন্যদিকে লেখক ব্যক্তিটি কিন্তু অতীত লেখক ও বর্তমান লেখক হিসেবে ভিন্নতর দুটো অস্তিত্বে এখন বর্তমান নন। তা সম্ভবও নয়। লেখক একজনই থাকলেন যিনি তাঁর সর্বশেষ চেতনাটি ধারণ করে আছেন। ফলে এখানে লেখক ও পাঠকের মধ্যে চেতনাগত একটি দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। আর তখনই এই দ্বান্দ্বিকতায় প্রেক্ষিতে সেই অনিবার্য প্রশ্নটিও সামনে এসে দাঁড়ায়- তাহলে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ, লেখা না লেখক ?
.
একজন সতর্ক ও সচেতন পাঠক কিন্তু অনায়াসে তাঁর চেতনার সাপেক্ষে এই পরস্পরবিরোধী দুটো লেখার যে-কোন একটিকে বর্জন বা গ্রহণ করবেন। এখানে আর লেখক নয়, গ্রহণ বা বর্জনের জন্য তখন লেখাটিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু যে পাঠক তাঁর মনের মতো কথায় ভরপুর লেখায় আবিষ্ট হয়ে একসময় খোদ লেখককেই প্রিয় ব্যক্তির তালিকায় বসিয়ে দেন চোখ বন্ধ করে, তাঁর কাছে শেষপর্যন্ত আর লেখা নয়, লেখকই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। সেই পাঠকরা হয়তো ভুলে যান বা ভাবতে অভ্যস্ত থাকেন না যে, আমরা কেউ জগতের পরিবর্তনশীলতার অনিবার্য প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে নই। যেহেতু একজন লেখকের পরিবর্তনশীলতার প্রভাব তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়ে সীমিত আকারে হলেও নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠিকে প্রভাবিত করছে, তাই তাঁর প্রভাবকে আমলে না নিয়ে উপায় নেই।
.
উল্লেখ্য, লেখকের বা পাঠকের এই পরিবর্তনশীলতা দু’ভাবে হতে পারে। একটা হলো চেতনাগত অবস্থানের পরিবর্তন অর্থাৎ পূর্বের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও আদর্শের বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়া। এটা একটা মাত্রাগত পরিবর্তন। অন্যটি হলো একই অভিন্ন আদর্শ ও চেতনাগত অবস্থানে থেকে নিজেকে পরিশীলনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে উৎকর্ষ অবস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া বা নিজেকে আপডেট করে নেয়া। এটি গুণগত পরিবর্তন। একটু গভীরে তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে, এই দুটো পরিবর্তন বা অবস্থানের মধ্যে আসলে মেরুগত ব্যবধান লুকিয়ে আছে। লেখক চরিত্র খুব ভঙ্গুর, কলমের এক খোঁচাতেই যা গুড়ো হয়ে যেতে পারে। তাই লেখকের ক্ষেত্রে যদি আদর্শ বা চেতনাগত অবস্থানের মাত্রিক পরিবর্তনটাই ঘটে যায়, সেটা যে আসলেই খুব সংবেদনশীল একটা বিষয় বা ঘটনা তা উপলব্ধির জন্য পাঠককে অতি অবশ্যই সচেতন থাকতে হয়, তা পাঠকের নিজস্ব চেতনার পক্ষেই হোক বা বিপক্ষেই হোক।
.
যে পাঠকের কাছে লেখক নয় লেখাটাই গুরুত্বপূর্ণ, তিনিই আসলে সচেতন পাঠক। এবং একজন সচেতন পাঠকই কেবল কোন লেখা গ্রহণ বা বর্জনের ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু যে পাঠকের কাছে লেখার চাইতেও লেখকই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় সে পাঠকের আবিষ্ট মনন-চোখ আসলে গ্রহণ-বর্জনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে প্রিয় লেখক কর্তৃক উৎসারিত সবকিছুই এ ধরনের পাঠকের কাছে অবর্জনীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। অর্থাৎ তাঁরা একধরনের অন্ধ ভক্তিবাদের ফাঁদে আটকে যান। এই পাঠকদেরই বলা হয় ভক্ত পাঠক। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস যেমন আসলে কোন বিশ্বাসই নয়, অন্ধভক্তও প্রকৃতপক্ষে ভক্ত হয় না। কারণ তাদের কোন বিবেচনাবোধ থাকে না। এবং এই ভক্তিবাদ বা পীরবাদ থেকেই অতঃপর জন্ম নেয় স্তুতিবাদ। আর অন্ধভক্তরাই রূপ নেয় স্তাবকগোষ্ঠিতে।
.
ভক্তি থাকা হয়তো ভালো, কিন্তু ভক্তিবাদে আচ্ছন্ন হলে স্বচ্ছ দৃষ্টি ঘোলা হয়ে মানুষ তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ নিজেকে বোঝা তো দূরের কথা, নিজেদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতেই তাঁরা পুরোপুরি পরনির্ভরশীল অক্ষম হয়ে পড়ে। নিজের উদ্দিষ্ট পথ আর নিজে নিজে খুঁজে নেয়া সম্ভব হয় না। সব ধরনের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে এরা সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হিসেবে ছুটে যায় স্ব স্ব পীর বা গুরুর কাছেই। পীর যা বলেন যা করেন যা দেখান, বিনা প্রশ্নে তাই হয়ে ওঠে তাঁদের কাছে অনুসরণীয় অনুকরণীয় পালনীয় দৃষ্টান্ত। যুক্তিবোধ রহিত এসব ভক্তের চোখে তাই পীরই একমাত্র আশ্রয়, বিকল্পহীন অবলম্বন। ফলে স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়ে এই একনিষ্ঠ ভক্তরা শেষতক অর্থহীন স্তুতিবাদে নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। অন্য অনেক কিছুর মতোই লেখককে এরকম পীর বানিয়ে ফেলাটাও হয়তো বুদ্ধিমান পাঠকের লক্ষণ নয়।
.
আর তাই আমার সেই বুদ্ধিমান প্রশ্নকর্তা বন্ধুটিকে উত্তর দিতে হয়েছিলো এভাবে যে, দেশে-বিদেশে এমন বহু লেখকই রয়েছেন যাঁদের বহু রচনাই মেধাবী পাঠকদের জন্য অবশ্য-পাঠ্য নিঃসন্দেহে। কিন্তু বিরল ব্যতিক্রম বাদে বৈচিত্র্য-পিয়াসী একজন পাঠকের পক্ষে সব লেখকের সব লেখা পড়ে ফেলা তো অসম্ভব বটেই, এমনকি একজন লেখকের সমস্ত রচনাই যে পড়তে হবে এমন বাধ্যবাধকতাও কোন পাঠকের নেই। আর একজন লেখকের সমস্ত রচনাই যে যথাযোগ্য চেতনায় উজ্জ্বল বা সাহিত্যমানে শিল্পোত্তীর্ণ হবে এমন কথাও নেই। তাই একান্তই পড়া হয়ে থাকলে সুনির্দিষ্ট কোন রচনা বা লেখা নিয়ে নিজের মাপে একটা মূল্যায়ন দাঁড় করানো সম্ভব হলেও জলজ্যান্ত কোন লেখক সম্পর্কে চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে যথাযোগ্য মূল্যায়ন করার মতো এতোটা এলেমদার যে হয়ে ওঠতে পারি নি, পাঠক হিসেবে এই দীর্ঘশ্বাস অস্বীকার করি কী করে ! নিশ্চিতভাবে তা আমারই সীমাবদ্ধতা বৈ কি।

(২০-০৬-২০১২)


মন্তব্য

আয়নামতি এর ছবি

প্রশ্নকর্তাকে উত্তম জাঝা! তার কারণেই তো এই আজাইরা লেখাটির জন্ম হলো নাকি? দেঁতো হাসি
আপনি লুক্টা বেজাই রকমের পেজগি রণদা খাইছে সাধারণ একটা প্রশ্নের কী হাল করলেন।
প্রশ্নকর্তার বর্তমান অবস্হা জানার কৌতুহল হচ্ছে প্রবল। তিনি কি পাষাণে মাথা ঠুকছে নাকি?
খোঁজ নিবেন পারলে দেঁতো হাসি

রণদীপম বসু এর ছবি

প্রশ্নকর্তা তো উত্তর হিসেবে একেবারে শেষ প্যারাটাই ফেরৎ পেয়েছন। আর মাঝখানের আজাইরা অংশটা তো আপনাদের জন্য ! হা হা হা !
তাই প্রশ্নকর্তার তবিয়তে সমস্যা হওয়ার কথা না, কেবল তবিয়ত শেষপর্যন্ত আপনাদের ঠিক থাকে কিনা সেটাই ভাবছি !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

আয়নামতি এর ছবি

বহাল তবিয়তেই আছি রণদা হাসি

রণদীপম বসু এর ছবি

ধন্যবাদ ! আশ্বস্ত হলাম।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা।

ব্যাতিক্রমহীনভাবে একজন লেখক অতি অবশ্যই একজন পাঠকও বটে। সেক্ষেত্রে একটা সঙ্কট এসে দাঁড়ায় যে, তিনিনিজে কোন শ্রেণির পাঠক। অর্থাৎ আরোপক্রিয়া তার ক্ষেত্রে কতটা খাটে।এখানে মনে হয় এ বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। লেখকের পূর্বতন লেখা থেকে তিনি যদি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যান। অর্থাৎ তার পরবর্তী লেখা যদি সেরকম কিছুই আমাদের সামনে হাজির করে তাহলে পাঠক হিসেবেও তাকে বিভ্রান্ত বলেই ধরে নিতে হবে।
বিষয়টি আমার কাছে এরকম মনে হয়, উদাহরণ হিসেবে, একজন মানবতাবাদি লেখক যখন ঘুরে যান সম্পূর্ণ বিপরীতে তখন তার পূর্বতন পর্যায়টিকেই আরোপিত মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। গ্রহণ বা বর্জনের বিষয়ে আসছি না। সেটা পাঠকের স্বাধীনতা। কিন্তু লেখক হিসেবে কারো আদর্শিক দিকবদল ঘটলে তাতে তার মুখোশ চরিত্রটাই প্রকাশিত হয়। সেটা সচেতন বা অসচেতন যে কোনোটাই হতে পারে। ভক্ত পাঠক থেকেই বিভ্রান্ত লেখকের জন্ম হয়। যদিও কেউ কেউ আছে যারা সচেতনভাবে বিভ্রান্ত। সঙ্কট হচ্ছে আমাদের অধিকাংশ পাঠকই ভক্ত পাঠক পর্যায়ের। আপাত সচেতন অনেকেই আদতে এই গোষ্ঠীভুক্ত।

লেখকের সমস্ত লেখার ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন সম্ভব বলে মনে করি।

এরকম একটি লেখার জন্যে ধন্যবাদ।

স্বয়ম

রণদীপম বসু এর ছবি

একজন ব্যক্তির মধ্যে অনেকগুলো সত্তার সহাবস্থান স্বীকার করা গেলে লেখক নিজে একজন পাঠকও তা মেনে নিতে কোন সমস্যা দেখি না। তবে একই ব্যক্তির মধ্যে লেখক ও পাঠক সত্তার ঐক্যটা এখানেই যে, যেকোনো দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থানটা তার মধ্যে লেখক ও পাঠক হিসেবে ভিন্ন হবে না। অতএব সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরির সম্ভাব্যতা থাকার কথা নয়। তাই আমাদের বর্তমান পর্যালোচনাটাকে যথাযথ উপলব্ধির সুবিধার্থে লেখক ও পাঠক হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি-সত্তার অবস্থিতির বিবেচনাটাই অনুকূল হবে।

আর লেখকের সমস্ত লেখার ভিত্তিতে মূল্যায়ন সম্ভব কি অসম্ভব তা মনে হয় বর্তমান আলোচনার বিবেচ্য বিষয় করার আগে দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে লেখকের পরস্পর বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন লেখাগুলোর সমন্বিত মূল্যায়ন আদৌ সম্ভব কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। আমার পোস্টেই একটা উদাহরণ টেনেছিলাম যে, সময়ের পরিক্রমায় চলতে চলতে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের পক্ষ ও বিপক্ষ দুটো অবস্থানই যদি একই লেখকের ভিন্ন ভিন্ন লেখায় প্রতিফলিত হয়, তখন সেখানে লেখকের প্রকৃত অবস্থান কোনটা এবং একজন পাঠক কোন্ দৃষ্টিভঙ্গিটা গ্রহণ করবেন ? সর্বশেষ অবস্থানটাই লেখকের অবস্থান নিঃসন্দেহে। আর সচেতন পাঠক তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেকোনো একটাকে গ্রহণ করবেন তাঁর নিজস্ব মুক্ত দৃষ্টি দিয়ে। এখানেই একজন পাঠকের অবস্থান নির্ণিত হবে তিনি কি মুক্ত পাঠক, না কি ভক্ত পাঠক সেটার নিরীখে।

আমার আলোচনাটায় কিন্তু এই বিষয়টাকেই তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। কতোটা আনতে পারলাম সেটাই এখানে বিবেচ্য। আদৌ পারলাম কি ?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অতিথি লেখক এর ছবি

পেরেছেন বলেইতো নিজের ভাবনাটাও জুড়ে দিলাম। আসলে লেখাটা পড়ে নিজের ভাবনার সাথে মিলিযে নেয়া আর কি। তাই একটু জোরে জোরে ভাবলাম, মানে মন্তব্য করলাম। পরস্পরবিরোধ লেখার লেখকের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের ক্ষেত্রটাতেই মনে হয় ব্যাক্তি লেখক গুরুত্ব পেয়ে যান। যেমন ধরা যাক, গোলাম আযমের লেখা ইতিহাস বা স্মৃতিকথা। বা বর্তমানে তার ৯০ বছরের হানিমুনের সময়কালে সে যদি কিছু লেখে। তা হলে তা বিবেচনার আগে তার ব্যাক্তি পরিচয়টাকে গুরুত্ব দেয়াটা জরুরি হয়ে পড়বে বলে মনে হয়।
অর্থাৎ আমি বলছি, ধুর্ত লেখকের কথা। সেক্ষেত্রে কী হবে বা হয়? মজার বিষয় হচ্ছে একজন ধূর্ত লেখক যা যা করেন একজন ভ্রান্ত লেখকও তাই তাই করেন। আর ধূর্ত লেখক হতে হলে সচেতন পাঠক হতে হয় বলে মনে হয়। তা না হলে ইঞ্জিনিয়ারিংটা ঠিকমত করা যায় না। আর ভক্ত পাঠক জন্ম দেয় ভ্রান্ত লেখকের, যে অসচেতনভাবে ভ্রান্তি ছড়ায়। ঠিক বল্লাম কি? আপাতত ঠিক মনে হচ্ছে। এবারো জোরে জোরে ভাবলাম। লেখাতে সহমততো আগেই জানিয়েছি।

স্বয়ম

রণদীপম বসু এর ছবি

অবশ্যই মতামত দেবেন ! নইলে লেখক হিসেবে লেখাটার বাস্তবতা যাচাই করবো কী করে !

এখানে আরেকটা পয়েন্ট দিলেন আপনি এখন। সে প্রেক্ষিতে বক্তব্য হলো, একজন নিজেকে ব্যক্তি থেকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এক জিনিস, আর একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি (ইতি বা নেতি যে অর্থেই হোক) তার পরিচিতির সাপেক্ষে কিছু লেখা, দুটো ভিন্ন জিনিস। গোআ রাজাকার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। এখন লিখলেও লেখক হিসেবে তার সত্তাটা ধর্তব্যের মধ্যে আসবে কি ? একইভাবে বঙ্গবন্ধুর আত্মজৈবনিক অসমাপ্ত আত্মজীবনী দিয়ে কিন্তু একজন লেখককে নয় বরং একজন অবিসংবাদিত নেতাকেই পাই আমরা !
বিষয়টা কি বোঝাতে পারলাম ?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

চরম উদাস এর ছবি

চলুক
বাপরে, বিশাল লেখা। কিন্ত একদমে পড়ে ফেললাম। দর্শন ভালো পাই। প্রিয় লেখক কে এই প্রশ্নে আমিও বিরক্ত হই। একই লেখকের কোন লেখা পড়ে হয়ত তার চিন্তাভাবনার গভীরতা দেখে মুগ্ধ হয়ে পরে আবার তারই কোন লেখায় তাকে আর সবার মতই সীমাবদ্ধ মানুষ মনে হয়।

রণদীপম বসু এর ছবি

একজন লেখক কিন্তু অনিবার্যভাবেই একজন সীমাবদ্ধ মানুষই। তবে লেখক হিসেবে সততটা নির্ভর করছে তিনি তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে কতোটা সততা রক্ষা করছেন। একইসাথে আবার তার সামাজিক, মানবিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা কতোটা প্রতিফলিত হচ্ছে সেটাও বিবেচনার বিষয় বৈ কি !

আর একজন পাঠকের কাছে লেখক-প্রিয়তা সম্পূর্ণই ভিন্ন জিনিস। এটা নির্ভর করছে পাঠকের নিজস্ব চাহিদা কোন্ লেখক কতোটা দক্ষ ও পরিশীলিতভাবে পূরণ করতে পারছেন তার উপর।
অতএব পাঠক হিসেবে আমাদের চাওয়ার সীমাটাও সেই নিরীখে নির্ধারণ করা উচিৎ যে, একজন লেখক তাঁর সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগের পরেও শেষপর্যন্ত তিনি একজন সীমাবদ্ধ মানুষই। হা হা হা !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

জটিলস্য লেখা। তবে শেষ প্যারাটায় সহমত। চলুক

রণদীপম বসু এর ছবি

এর একটাই সারমর্ম যে, লেখক হিসেবে আমি পুরোপুরি ফ্লপ ! কারণ পাঠককে পুষ্টিকর খাবার তরল করে খাওয়াতে নিদারণভাবে ব্যর্থ হয়েছি !! মন খারাপ

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

রণদীপম বসু এর ছবি

চলুক

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক
"... ভক্তিবাদে আচ্ছন্ন হলে স্বচ্ছ দৃষ্টি ঘোলা হয়ে মানুষ তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে ..."
পুরাই একমত।
- একলহমা

রণদীপম বসু এর ছবি

চিন্তিত

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

মন মাঝি এর ছবি

জটিলস্য জটিল! অ্যাঁ হাততালি

****************************************

রণদীপম বসু এর ছবি

খাইছে

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অতিথি লেখক এর ছবি

বিশাল পেজকি লাগানো লেখা অ্যাঁ
ইসরাত

রণদীপম বসু এর ছবি

বিষয়টা অতি সহজই ছিলো ! কিন্তু নিজের হটকারি অজ্ঞতায় ভাব লাগাতে গিয়ে পেজগি লাগিয়ে দিলাম !!
এজন্যেই মুরব্বিরা বলতেন, যা জানো না তা নিয়ে পাকনামি করতে যাও কেন বাপু !! মন খারাপ

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

চলুক

রণদীপম বসু এর ছবি

আপনাকেও চলুক
তো প্রোফেসর সাহেবের নামটা কেন যে একবারও ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারি না ! তার আগেই হিজিবিজি লেগে যায় ! হা হা হা !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

চলুক চলুক চলুক চলুক চলুক

রণদীপম বসু এর ছবি

বালক বেলায় এক বুইড়া আঙুল দিয়া ব্যাঙ দেখানো নিয়াই কতো যে কাইজ্যা-ফ্যাসাদ-কিলাকিলি করেছি ! বুইড়াকালে এসে এখন সেই বুইড়া-আঙুলের মিছিল ! কেমনে কী ! হা হা হা !! চলুক

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অতিথি লেখক এর ছবি

ওরে বাপসরে! এতো বিশাল কঠিন ব্যাপার! আমি তো পিচ্চি, অনেক কিছুই মাথায় ঢুকে নাই। তবুও ধন্যবাদ, এরকম একটা লেখার জন্য। আমি অবশ্য কোনো লেখকের একটা লেখা পড়েই মনে হয়, প্রিয় অপ্রিয় বানিয়ে ফেলি!

-এস এম নিয়াজ মাওলা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।