যোগজাকার্তার পথে পথে

রেজওয়ান এর ছবি
লিখেছেন রেজওয়ান (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৯/০৪/২০১০ - ১১:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

উপর থেকে বড়বুদুরের ছবি

ইন্দোনেশিয়া আসার পর বিভিন্ন পোস্টার ও লিফলেটে একটি অপূর্ব ঐতিহাসিক স্থাপনার ছবি দেখে আমি খুব অভিভূত ছিলাম - সেটি হচ্ছে জাভা দ্বীপের বড়বুদুর বৌদ্ধ মন্দির। ১৭০০০ এরও বেশী দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়ার সৌন্দর্য্য জাকার্তার বাইরে না গেলে বোঝা যায় না - কিন্তু সময় ও সুযোগের অভাবে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী বান্দুং, বোগর এবং একটু দুরে পেলা বুহান রাতু ছাড়া কোথাও যাওয়া হয়নি। দেশ থেকে আব্বা এসেছিলেন এবং সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হল এবার দুরে কোথাও যাব। ঠিক হল যোগজাকার্তা যাব এবং বড়বুদুর দেখার আকাঙ্খাটি পূরণ হল অবশেষে।

যোগজাকার্তা ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী থেকে মাত্র ৪৪৩ কিলোমিটার দুরে (ইউরোপ হলে ৪-৫ ঘন্টার গাড়িভ্রমণ)। কিন্তু যাতায়াতের উপায়গুলো শুনে চোখ কপালে উঠে যাবার যোগাড়। গাড়িতে লাগবে ১২ ঘন্টা - যদি যানজট অনুকূলে থাকে। ট্রেনে যাওয়া সহজ উপায় - সেটাতে ৮ ঘন্টা লাগবে। আর নাহলে তো বিমান আছেই। ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে ভ্রমণের অন্যতম কার্যকরী উপায় স্থানীয় কিছু এয়ারলাইন্স। তবে তাদের ভাল সেফটি রেকর্ড আছে এমন শুনিনি, বিশেষ করে আদম পরিবহনের গোত্তা মারার পর থেকে। আমাদের ত্রাতা হয়ে আসলো কম খরুচে আন্তর্জাতিক পরিবহন এয়ার এশিয়া - তাদের অন্তত বিমানগুলো নতুন। দেখা গেল তাদের এক প্রমোশন রেটে বিমান ভাড়া ট্রেন ভাড়ার প্রায় সমান (জনপ্রতি ৫০ ডলার)। তাই সময় বাঁচাতে (৫০ মিনিটের ফ্লাইট) এয়ার এশিয়ার কাঁধে ভর করলাম সবাই।

যোগজাকার্তা ট্যুরিস্ট ম্যাপযোগজাকার্তা ট্যুরিস্ট ম্যাপজাভা দ্বীপের মধ্যভাগের অন্যতম সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রদেশ যোগজাকার্তার (সংক্ষেপে যোগজা) পত্তন হয় ১৭৫৫ সালে। বর্তমানে এটি ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে ছোট প্রদেশ যার রাজধানী একই নামে। ১৭৫৫ সালে মাতারাম সাম্রাজ্যের রাজকুমার মান্কুবুমি তার সুলতানাতের রাজধানী হিসেবে একে ঘোষণা করেন। বর্তমানেও এটি সুলতান কর্তৃক শাসিত - ইন্দোনেশিয়ার একমাত্র প্রদেশ এটি যা এরকম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। জাভা দ্বীপের শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে একে ধরা হয়। ১৯৪৬ সালে নব ঘোষিত ইন্দোনেশিয়া রিপাবলিকের রাজধানী এখানে স্থানান্তরিত হয় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত - যে পর্যন্ত ডাচরা ইন্দোনেশিয়া পুনর্দখল করে রেখেছিল।

যোগজাকার্তা - আদিসুতজিপতো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরযোগজাকার্তা যেই দিক দিয়ে জাকার্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা - সেটি হচ্ছে ৩৩ বর্গ কি.মি.র শহরে মাত্র ৫ লাখ লোকের বসবাস। বেশ ছিমছাম, গুছানো একটি শহর যা পর্যটকে পূর্ণ থাকে। এটি বিশ্ববিদ্যালয় শহরও বটে - এখানে বেশ কটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে সমগ্র ইন্দোনেশিয়া থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসে।

হোটেলে ওঠার কিছু পরেই বের হয়ে গেলাম বিচের দিকে - ৭ সিটের গাড়ি ভাড়া করা ছিল (২৪ ঘন্টায় ৫০ ডলার)। কিন্তু পথে সুলতানের প্রাসাদ (ক্রাতোন) দেখে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শুনেছিলাম যে বীচে তাজা সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায় কিনতে যা আপনার সামনেই গ্রীল করে দেবে। ওখানে গিয়ে দেখি একটি যায়গায় কিছু মাছ বিক্রি হচ্ছে - কিন্তু চারিদিকে খুব অন্ধকার। আর দুরে রেস্টুরেন্ট আছে কিন্তু সেখানের পরিবেশ ভাল লাগল না। অত:পর শহরের দিকে ফেরত আসলাম এবং পথে একটি সিফুড রেস্টুরেন্টে রাতের ভোজ সারলাম।

বড়বুদুরপরদিন ভোরে আমাদের বড়বুদুর মিশন শুরু হলো। নবম শতাব্দিতে নির্মিত এই বৌদ্ধমন্দিরটি (বর্তমানে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। চৌদ্দ শতাব্দীতে মুসলমানদের কাছে পতনের পূর্বে জাভা দ্বীপ হিন্দু এবং বৌদ্ধ শাসিত ছিল।

বড়বুদুরের একাংশবড়বুদুর স্থাপনাটি একাধারে গৌতম বুদ্ধের সম্মানে একটি মন্দির এবং বৌদ্ধদের একটি তীর্থস্থান। এই তীর্থযাত্রার শুরু হত মন্দিরের নীচ থেকে বৃত্তাকার পথে ঘুরে ঘুরে কামধাতু, রুপধাতু এবং অরুপধাতু - বৌদ্ধধর্মের এই তিনটি আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করত। এই যাত্রা পথে তাদের সহায় হত ২৬৭২টি গল্প চিত্রায়িত রিলিফ প্যানেল -যা এখনও বিদ্যমান।

২৬৭২টি রিলিফ প্যানেলের একটিএটি মালয় শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের অধীনে শৈলেন্দ্ররাজবংশের দ্বারা নির্মিত। এটি তৈরি করতে ৭৫ বছর লেগেছে এবং ৮২৫ সালে শেষ হয়।

চৌদ্দশত সালের পর অনেক জাভাবাসী মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলে এই মন্দিরটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয় এবং পরবর্তী শতকগুলোতে আগ্নেয়গিরির ছাইভস্ম এবং জঙ্গল দ্বারা ঢেকে যায়। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ শাসকরা এটি খুঁজে বের করে এবং পরে ডাচ শাসকরা এর সংস্কার শুরু করে এবং বিশ্বে পরিচিতি পায় এটি। এখনও বছরে একবার এখানে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান হয়।

মন্দিরে পর্যটকদের ভীড়মন্দিরটিকে ভালভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে দেখা গেল। আর বিদেশী ট্যুরিস্টদের জন্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশ্রামাগার, চলন প্রতিবন্ধীদের জন্যে হুইল চেয়ার ইত্যাদি। অবশ্য থাকবে না কেন - স্থানীয় পর্যটকদের চেয়ে বিদেশীদের কাছ থেকে দশগুণ টিকেটের দাম নেয়া হয়।

সামনে থেকে এটি দেখা অবশ্যই একটি বিস্ময় ছিল। আর সেই তীর্থযাত্রার স্থান দিয়ে ঘুরে ঘুরে উপরে যাওয়া। সেই রিলিফগুলো সম্পর্কে জার্মান, জাপানী, ইংরেজী ইত্যাদি ভাষায় চারদিকে গাইডদের অবিশ্রান্ত বর্ণনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া অন্যরকম আবহ এনে দেয়।

এই ছিদ্রযুক্ত স্তূপের ভেতরে বৌদ্ধমুর্তি আছে।অবশেষে উপরে উঠলাম - সেখানে মূল বেদী বা স্তূপে একটি উন্মুক্ত বৌদ্ধ মূর্তি আছে। পুরো মন্দিরে পাঁচশরও বেশী এরকম স্তূপ ছিল যার ভেতরে একটি করে বৌদ্ধমূর্তি ছিল। তবে এখন ৩০০টিরও অধিক ভাঙ্গা এবং অনেকগুলো চুরি গেছে যখন এটি পরিত্যক্ত ছিল তখন।

দুরে মেরাপি পাহাড়আমরা দুরে দেখতে পেলাম পুলিশ পাহারায় অনেকগুলো ট্যুরিস্ট বাস আসছে। তখন দেখলাম বিদেশী পর্যটকদের মধ্যে তোড়জোড় শুরু হলো। তারা একে অপরকে বলতে লাগল যে ওই আসছে। তখন মনে পড়ে গেল যে আমি একটি আর্টিকেলে পড়েছিলাম - ইন্দোনেশিয়াবাসীরা দল বেধে এটি দেখতে আসে - তখন অন্য পর্যটকদের জন্যে কঠিন হয়ে যায় ঠিকমত দেখা। তাই তারা সকাল সকাল আসার চেষ্টা করে ভীড় এড়ানোর জন্যে।

রোদের তাপ চড়া হতে শুরু করলে আমরা নীচের দিকে নামা শুরু করলাম।

(চলবে .. পরবর্তী আকর্ষণ যোগজাকার্তার প্রামবানান হিন্দু মন্দির - এটিও নবম শতাব্দীর)

ছবির সূত্র:
১) প্রথমটি এখান থেকে
২) ট্যুরিস্ট ম্যাপ উইকিপিডিয়া থেকে
বাকিগুলো আমার তোলা


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

অসামান্য শিল্পকর্ম।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

গৌতম এর ছবি

গোটা ইন্দোনেশিয়ার যে বিষয়টা আমার খুব ভালো লাগে সেটা হচ্ছে তারা ঐতিহ্যের অনুসারী। পূর্বতন ধর্মের বলে ঐতিহ্যটাকে তারা মুছে দেয় নি, বরং সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত রূপে সেটাকে গ্রহণ করেছে।

পরবর্তী আকর্ষণগুলোর জন্য অপেক্ষারত।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

হরফ এর ছবি

আপনাকে খুব খুব হিংসে করলাম হাসি কবে যে দেখতে পাবো বরবুদুর আর আংগোরভাট জানি না (হতাশার ইমো)। আমার মতো কেউ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চাইলে সুযোগ করে নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কালেকশন দেখতে পারেন, মাথা ঘোরানো সব মূ্র্তি-টূর্তি আছে (নবক-দশম শতকের) এখানে।

________________________
"ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে"

ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

মজা লাগল। আরো ছবি দিয়েন। তাহলে আরো উপভোগ্য হবে এক্সপিরিয়েন্সটা।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

গতকালই পড়েছিলাম, মন্তব্য করা হয়নি। ভালো লেগেছে রেজোয়ান ভাই। একটা বিষয় পরিস্কার হলোনা-- ইন্দোনেশীয়রা দল বেঁধে আসলে অন্য ভিজিটরদের সমস্যা কী?

রেজওয়ান এর ছবি

পশ্চিমাদের এক বুলেটিন বোর্ডে আর্টিকেলটি পড়ে আমারও সেরকম প্রশ্নের উদয় হয়েছিল যে এটি আসলে তাদের কোন শুচিবাই কি না।

মন্দিরের প্যাসেজগুলো খুব সরু এবং ইন্দোনেশিয়ানরা খুব হল্লা করে - লাইন মানে না ইত্যাদি কাজেই ওই সরু যায়গায় সবাই মিলে শান্তিতে দেখা এবং গাইডের কথা শোনায় ঝামেলা হয় বোধহয়। এই সতর্কবাণীর আসল উদ্দেশ্য মনে হয় ভীড় এড়ানো।

আমরা গাইড নেইনি - আর অধিক লোক দেখেই আমরা চিরকাল অভ্যস্ত - তাই তাদের প্রতিক্রিয়া অন্যরকম লেগেছে।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার তোলা ছবি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম।আপনার লেখা পড়ে বরবুদুর যেতে ইচ্ছে করছে।

মিতু
রিফাত জাহান মিতু

সাবিহ ওমর এর ছবি

আচ্ছা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম কবে, কিভাবে প্রবেশ করে?

রেজওয়ান এর ছবি

৮ম শতাব্দীতে ইসলাম ধর্মের পত্তন এই অঞ্চলে হলেও ১২ শতকের পর থেকে ইসলাম ধর্মে রুপান্তর শুরু হয়। ১৫ শতাব্দীতে মালাক্কা সুলতানাত ইসলামের আওতায় আসে। এটি পড়ে দেখতে পারেন

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

ধুসর গোধূলি এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ লাগল। একদিন এসব যাওয়গায় আমিও যেতে পারব আশা করি...

কৌস্তুভ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।