একজন ইভা রহমান ও বার্লিনে বাংলা সংস্কৃতি বিষয়ক আহাজারি

রেজওয়ান এর ছবি
লিখেছেন রেজওয়ান (তারিখ: সোম, ০৬/০৮/২০০৭ - ১২:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বার্লিনে আমার এক বছরের কিছু বেশী সময় অবস্থানের একটিই আক্ষেপ আছে, এখানকার বাংলা কমিউনিটি নিয়ে। আমি আসার কয়েকদিন পরেই একজন বাংলাদেশী একটি আমন্ত্রনপত্র ধরিয়ে বললেন আমার নাম ডিজে ওমুক আমার স্পেশাল বলিউড নাইট অনুষ্ঠানে আসবেন। পরে পড়ে বুঝলাম এটি একটি ডিসকো বার এবং এতে বলিউডীয় চটুল সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। বধুর চোখ রাঙানীতে রাত এগারোটায় ওই প্রগ্রামটিতে যাওয়া হলো না।

এর মাঝখানে রুক্সি এবং বাংলা ব্যান্ড এখানে এসে অনুষ্ঠান করেছে। সে সময় আমি ছিলাম বার্লিনের বাইরে। এবারে সুযোগ হলো ইভা রহমানের একটি অনুষ্ঠান দেখার। বধুর আপত্তি ছিল কিন্তু আমার আগ্রহে যাওয়া হল কিছু দেশী ভাইবোনদের সাথে সাক্ষাৎ হবে এই আশায়।

অনুষ্ঠানস্থল খুঁজে বের করতে অসুবিধা হলো না কারন কাছাকাছি যেতেই দেখলাম এক বাংলাদেশী দম্পতি যাচ্ছেন সেদিকে। বধুটি ঝলমলে শাড়ি পরা একটি প্র্যাম ঠেলছেন। বাবার কোলে একটি শিশু। হলভর্তি মানুষ এক মিলনমেলায় মিশে গেছেন। বাচ্চাদের কলকাকলীতে পূর্ণ । আমার চেনা লোকেরা সবাই কথনও আসেননি। তাই এককোনে বসলাম। দেখতে লাগলাম আমাদের দেশী ভাই-বোনদের। আমদের সবার কথা বলার স্টাইল, পোশাক আষাকের ধরন, ছেঁড়া কথোপকথন:

: আমি ছয় বছর আগে এসেছি- মাস্টার্স করেছি গ্রাফিক আর্টসে....(হেসে)না রেস্টুরেন্টে কাজ করি। আমার বউ ড্যানিস। না ও আসেনি।
: আমি ১৯৭৮ সালে এসেছি তখনতো আসা খুবই সহজ ছিল। পরে অনেক কষ্টে টিকে গেছি। আমি একটি রেস্টুরেন্টের মালিক।
: ছয়টা থেকা বইসা আছি অনুষ্ঠান কখন শুরু হইব?
: সাতটায় শুরু হওয়ার কথা এটিএন এ ঘোষনা হয়েছে..কিন্তু ইভা রহমান বলেছেন উনি ৮টার আগে শুরু করতে পারবেন না।
: ওনারা এখানে আমাদের অনুরোধে এসেছেন কোন টাকা পয়সা নিচ্ছেন না পারফর্মেন্সের জন্যে শুধু অনুষ্ঠানের খরচ আমরা দিচ্ছি।
: না আমরা হ্যান্ডস নিয়ে আসতে পারিনি.. ট্র্যাক দিয়ে গান করব।
: ওই যে মাহফুজ ভাই আসছেন চলেন যাই দেখা করে আসি।
: (ইভা রহমান) গতকাল এসেছি কালই চলে যাব সুইজারল্যান্ড কিছু গানের কাজ আছে।

ইভা দম্পতি আসার পর শুরু হলো অটোগ্রাফ ও ছবি তোলার ধুম। এটিএন এর কর্ণধার মাহফুজ সাহেবের গুণকীর্তন হলো অনেক। তিনি বক্তৃতা দিয়ে অনেক মুলো ঝুলিয়ে (রাজনীতিবিদ স্টাইল) শুরু করলেন অনুষ্ঠানটি। তারপর এক এটিএন তারকা (শাম্মি মনে হয়) মাহফুজ সাহেবের গুণকীর্তন করে গান শুরু করলেন সিডিতে বাজানো ট্র্যাকের সাথে। তার আধুনিক গানগুলো তবুও সুরেলা ছিল, শেষের দিকে লোকদের নাচতে বললেন গানের তালে তালে। অনেক করতালি পরলো।

তারপর আসলেন ইভা রহমান। তার একটি জনপ্রিয় গান দিয়ে শুরু করলেন। দ্বিতীয় গানের পর আর থাকা গেল না। সুরের সাহচর্য যেখানে কম এবং কিম্ভুতকিমাকার নৃত্যরত শ্রোতাদের মাঝে বসে থাকা যেখানে মন সায় দিচ্ছিল না সেখানে চলে যাওয়াই শ্রেয় মনে হলো। বুঝলাম বিশ্বময় মিউজিক ভিডিওর লোকেশন, চকমকে শাড়ী এবং ডেডিকেটেড টিভি চ্যানেল কেন প্রয়োজন তারকা হবার জন্যে।

সবচেয়ে চোখে যেটি লাগে যে বার্লিনে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড তেমন নেই। মাস দুয়েক আগে এমব্যাসীর এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিশুদের গাওয়া চরম বেসুরো জাতীয় সঙীত শুনে হল থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। এখানে এক সাংস্কৃতিক দম্পতি নাচের স্কুল করেছিলেন কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের অভাবে তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ বনে আছে বাংলাদেশ কালচারাল সেন্টার যারা মানসম্মত অনুষ্ঠান করে এবং নতুন প্রযন্মকে দেশীয় সংস্কৃতির আবর্তে রাখে।

বার্লিনে বাঙালির সংখ্যা তেমন বেশী নেই। আমার জানামতে বড়জোড় ৩০০-৪০০ পরিবার হবে এবং এছাড়া বেশ কিছু ছাত্র এবং রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী। কিন্তু অবিভক্ত বার্লিন শহরটি এত বড় যে এরা সমুদ্রে কয়েক ফোটা জলেরই মত (বার্লিনের লোকসংখ্যা ৩৫ লাখ)। রাস্তা ঘাটে বাংলাদেশী কেন কোন এশিয়ান মুখ দেখাই যায়না বললে চলে। এবং এরা যেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তেমন বিচিত্র এদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পেশা। তারপর রয়েছে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিয়ে একে অপরের রেষারেষি। যেমন আওয়ামী লীগেরই দুটি ভাগ আছে। এসবই হয়ত এরুপ হওয়ার কারন।

তাই মাঝে মধ্যে মনে হয় একটি দ্বীপে বসবাস করছি।


মন্তব্য

সৌরভ এর ছবি

হুমম।
হায় পরবাস!


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

সবজান্তা (অচল - বর্ত্মানে পাইপলাইনে) এর ছবি

বার্লিনেই দাউদ হায়দার থাকেন না ?

হাহাহাহা......

সংরক্ষণশীলতা সূত্র মেনে চলছে...... একদিকে দাউদ হায়দার আরেক দিকে ইভা রহমান। নীট ফল শূন্য।

সুন্দর একটি লেখা, ধন্যবাদ।

থার্ড আই এর ছবি

বধুর আপত্তি ছিল কিন্তু আমার আগ্রহে যাওয়া হল

সুরের সাহচর্য যেখানে কম এবং কিম্ভুতকিমাকার নৃত্যরত শ্রোতাদের মাঝে বসে থাকা যেখানে মন সায় দিচ্ছিল না সেখানে চলে যাওয়াই শ্রেয় মনে হলো। বুঝলাম বিশ্বময় মিউজিক ভিডিওর লোকেশন, চকমকে শাড়ী এবং ডেডিকেটেড টিভি চ্যানেল কেন প্রয়োজন তারকা হবার জন্যে।
-----------------------------
জল ভরো সুন্দরী কইন্যা, জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

রেজওয়ান এর ছবি
হাসান মোরশেদ এর ছবি

কমবেশী সবখানেই অবস্থা একই রকম ।

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

কিছুদিন এটিএন বাংলা দেখার সুযোগ ছিল। মিসেস রহমানের ককোফোনাস গানের যন্ত্রণায় চ্যানেল পাল্টাতাম বার বার। প্রথমে শুধু গান গাইলো, কেউ কিনে না। তারপর প্রচুর বিজ্ঞাপন, কেউ কেউ কিনলো। পরের বার আসলো, মিউজিক ভিডিও। নেক্সট - ১২টি দেশের ৫০টি লোকেশনে নির্মিত মিউজিক অ্যালবাম (ঐশ্বরিয়া রায়ের ৭টি দেশের রেকর্ড ভাঙা হলো)। ঐটাও পাবলিক খায় না। তারপরে - গানের সাথে কোরিওগ্রাফি নিয়ে অ্যালবান - 'নাচের সাথে গান, নাকি গানের সাথে নাচ? মন নাচেরে ----'। ওইটা ও ফেইলড। শেষে দেখলাম, উর্দূ গানের অ্যালবাম - 'একেলে না যা না'।
একটু পরপর - এ প্রজন্মের জনপ্রিয় শিল্পী ইভা রহমানের গান, মানেই মন নিয়ে গান, কালাকার এওয়ার্ড বিজয়ী - - - - হাবিজাবি।
পরে স্যাটেলাইটের কি একটা সমস্যায় এটিএন দেখা বন্ধ হলো। মিসেস রহমানও মুক্তি দিলেন।

_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'

ভাস্কর এর ছবি

বেসুরা গলায় গান গায় এইরম গায়ক-গায়িকা কম নাই দেশে...ইভা রহমানের প্রচারটা একটু বেশি। মাহফুজ সাহেবের ধৈর্য্য দেইখা আমি রীতিমতো মুগ্ধ! আধুনিক কালে এইরম জমিন্দার পাওনটা কষ্টকর...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

অচেনা এর ছবি

আগে আমি মনে করতাম ইভা রহমান মাহফুজ মিয়ার মেয়ে। একদিন আমার বউ বলল মাহফুজ ইভা রহমানের স্বামী। আমি বললাম আরে ধুর কি বল এ মেয়ে কেন এই চাষা টাইপের বুড়া হাবড়াকে বিয়ে করবে!

পরে আসল কাহিনী জানার পর, না জেনে তর্ক করার জন্য জাঝা খেলাম। অ্যাঁ

-------------------------------------------------
আমি ভালবাসি বিজ্ঞান
আমি ঘৃণা করি জামাত॥

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আমরা যখন এটিএন এ খ্যাপ মারতে যাইতাম তখন ইভা রহমান আর আরেক মাইয়া অপারেটর বা রিসিপশনিস্ট ছিলো বোধ হয়।সেই মাইয়ার (নামটা মনে নাই,পিংকি বা নিম্মি হইতে পারে।)চান্স বেশি বলে শুনেছিলাম,কিন্তু কেমনে যেন ইভা সেইডারে আউট করে দিল।

তখন এটিএন এর ডিরেক্টর বাপ্পী (পরবর্তীতে এনটিভির এম.ডি ও বর্তমানে জেলপ্রবাসী এনায়েতুর রহমান বাপ্পী)ভাইয়ের রুমে আড্ডায় এই সব নিয়া কথা হইতো।

বাপ্পী এনটিভির এম.ডি হইবার পরে ফালুর দেয়া হামার চালাইতেন। তখন অনেকেই হাসাহাসি করে বলতো,আহারে ইভা যদি আগে জানতো বাপ্পীর কপালে হামার আছে,তাইলে কি আর মাহফুজের কপালে শিকে ছিড়তো?

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

অচেনা এর ছবি

মাহফুজ নাকি মধু খাইয়া ভাগতে চাইছিল। সামহাউ ধরা খেয়ে গেছে।

[সোর্স: বিজ্ঞাপন লাইনে কাজ করা এই ব্যাপারে ঘাঘু বন্ধু]

-------------------------------------------------
আমি ভালবাসি বিজ্ঞান
আমি ঘৃণা করি জামাত॥

আরিফ জেবতিক এর ছবি

ঠিক জানেন।
বহুত পেজগি নাকি হইছিল তখন।

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

হাসিব এর ছবি

কিয়ার্কমু


আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে

সুমন চৌধুরী এর ছবি

এরকম ছড়াইয়া আছে সব জায়গায়। আমিও থাকি আরেক দ্বীপে....
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

অতিথি এর ছবি

রেজওয়ান ভাই বাইছা বাইছা এমন এক রিভিউ দিলেন পড়তে, পইড়া তো টাশকি খাইতে হইলো। হো হো হো।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

বুঝলাম বিশ্বময় মিউজিক ভিডিওর লোকেশন, চকমকে শাড়ী এবং ডেডিকেটেড টিভি চ্যানেল কেন প্রয়োজন তারকা হবার জন্যে।

-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সুমন চৌধুরী এর ছবি

সমস্যা হৈল এগুলা খাওয়ার লোকজন সংখ্যায় অনেক। বেশী গুতাইতে গেলে ডিসকোর্স দাড় করাইবো...যাহাকে আমরা বেসুরা কই সেগুলাই আসলে সুরে থাকে..দেঁতো হাসি
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

আড্ডাবাজ এর ছবি

মজা লাগল। ইভার অত্যাচারে এটিএন বাংলা দেখারও জো নেই। একি অত্যাচার। জোর করে চাপিয়ে দেয়া। গানের গ যদি গলায় থাকতো তাহলেও আপত্তি ছিল না। কি আর করা?

থার্ড আই এর ছবি

আপনারা যাই বলেন , আমার কিন্তু ইভা ম্যাডামের নাচ খুব ভালো লাগে। ইদানিং তিনি নাচের জন্য বম্বে থেকে ডান্স্যার ভাড়া করে নিয়ে আসেন।
------------------------
জল ভরো সুন্দরী কইন্যা, জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

সুমন চৌধুরী এর ছবি

অ্যা!



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।