শোকের সাথে ছাড়াছাড়ি...

তিথীডোর এর ছবি
লিখেছেন তিথীডোর (তারিখ: রবি, ০৬/০৬/২০২১ - ১:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নানাভাইকে দেখতে যাচ্ছি...

২০১৬র শেষাংশে কর্মসুত্রে রাজধানীতে সেট হবার পর থেকে আবাল্যের শহর চিটাগঙে গমনের হার ছিল অতি নিয়মিত। কাজের চাপ ও পরবর্তীতে সাক্ষী হতচ্ছাড়ার সাথে গাঁটছড়া বাঁধার পর থেকে ক্রমে ক্রমে চট্টগ্রাম হয়ে উঠলো কদাচিৎ ছুটিছাটায় যাবার জায়গা। ছ'মাসে, ন'মাসে একবার, দুই রাত কি একবেলার জন্য।
সময় কই!

নানা-নানি উৎসুক হয়ে থাকতেন। রুপচাঁদা মাছ, যা অতীব পছন্দের খাবার, ডিপফ্রিজে তুলে রাখতেন এলে খাওয়াবেন বলে। অসময়ের অন্যান্য সুখাদ্য, কলাটা- মুলোটা তো বটেই।
এরপর শুরু হলো করোনার প্রকোপ, ক্লান্তিকর এবং আকন্ঠ দুঃশ্চিন্তায় দিনাতিপাতের দুঃসহ দিনরাত্রি৷ কোভিডে প্রতিবেশী এবং স্বজন হারালাম, নিজেও ভুগলাম বিস্তর।
এখনো দু'ধাপ সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে টের পাই ফুসফুসে সে নেতিবাচক জলছাপ মেরে গেছে দীর্ঘদিনের জন্য।

নিরাপত্তার খাতিরে শহরত্যাগের দরজায় তালা পড়ে গেলো অনির্দিষ্টকালের জন্য। পুরো এক বছর পর জানুয়ারির গোড়ায় অস্থির হয়ে এক শুক্কুরবারে আধবেলার জন্য ছুট্টে গেলাম চাঁটগায়। অফিসের ছুটি পাইনি।
জেদ চেপে গিয়েছিল, সকালে নেমে দুপুরের ফ্লাইটেই ফিরব, তবু যাবো!
ভাগ্যিস, ভাগ্যিস গিয়েছিলাম।
জীবিত নানাভাইয়ার সাথে ওইই শেষ দেখা!

আজ যার সাথে দেখা হয় কিংবা বাকিজীবন হবে, তিনি নিথর। আজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমাদের জন্য যথেষ্ট আশ্রয় রেখে গিয়ে নিজে ছোট্ট একটু জায়গা নিয়ে শুয়ে আছেন। সেটাই দেখতে যাচ্ছি৷
ঢাকা থেকে কুমিল্লা-- অল্প একটু রাস্তাই তো!
তবু পথ যেন ফুরায় না...

সচলে লিখছি বছর দশেক হয়ে গেলো। বেশ ক'বছর আগে নানাভাইয়াকে নিয়ে লিখেছিলাম একবার। লগ না ঘেঁটে লেখার বিষয়বস্তু মনে করতে চাইলে দেখলাম একসময়ের বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তি প্রতারণা করে বসছে।
অবশ্য বয়স কম হয়নি, রগচটা মেজাজ যেমন ক্রমশ শীতল হয়ে এসেছে, মেমোরিও ভোঁতা হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক!

কিন্তু একটা স্মৃতি, একটা মুহূর্ত জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে ভাসে, তাকে কিছুতেই সরাতে পারি না।
নানাভাই শুয়ে আছেন, প্রথম জানাজা হয়ে গেছে, দ্বিতীয় জানাজার জন্য একটু পরেই নিয়ে যাওয়া হবে। শেষবারের মতো বলা হলো দেখে নেওয়ার জন্য। হাসিমুখে ঘুমিয়ে থাকা একটা মুখ, অথচ পাথরের মতো শক্ত!
সবাই দেখার পর আমি খাটিয়ার হাতল ধরে বললাম-- একটু দাঁড়ান, আমি নানাভাইকে শেষবারের মতো আদর করে দিই।
যে প্রশান্ত কপালে অসংখ্যবার আমি তর্ক করে ভাঁজ ফেলেছি, সেখানে গাল ছুঁইয়ে দেখি বরফের মতো ঠাণ্ডা!
অথচ আজীবন তাঁর কাছ থেকে কতো উষ্ণতাই না পেয়েছি৷

আমার নানাভাই আশি উর্ধ্ব বয়সে মারা গেছেন। সন্তান, সম্মান, স্বাচ্ছন্দ্য -- কোন দিক থেকে অপ্রাপ্তির কিছু তাঁর ছিল না। নিজে ভোগেন নি, রোগশোকে বিছানায় পড়ে থেকে কাউকে ভোগান নি৷
কেউ যখন সান্ত্বনা দিতে এসে বলে অনেক হায়াত পেয়েছিলেন, পরিপূর্ণ বয়সে চলে গেছেন... অস্থির লাগে!
আমার অতি প্রিয়জন, যার কোন রিপ্লেসমেন্ট নেই, সে চলে গেছে৷
যদি বয়স নব্বই হতো, কিংবা আরো বেশি-- তাও কি এই কষ্ট একই রকমের হতো না?

চলে যাওয়ার আগে কোন একসময় নানাভাই নাকি বলেছিলেন, আমাকে মাটি দিয়েই চলে যেও না। দু-একদিন কাছে থেকো। লকডাউনের মধ্যে, সব সামাজিক দূরত্ব ভুলে সবাই মিলে তাই তিনদিন ছিলাম গ্রামের বাড়িতে।
ফিরে আসার পর হঠাৎ হঠাৎই বুড়োর কথা মনে পড়ে৷
সেহেরি, ইফতার, আজান-- বিশেষত এসব সময়ে। আজান পড়েছে, নানাভাই তড়িঘড়ি করে মসজিদে যাওয়ার জন্য ওজু করছেন না, ইফতারের সময় হয়েছে, নানাভাইয়ার প্লেটের পাশে কাঁচা ছোলা সাজানো নেই-- এসব দৃশ্যকল্প থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন!

আমি সারাজীবনে নানাভাইয়ার কাছ থেকে একবার না শুনেছি, এইচএসসির পর যখন চারুকলায় পড়তে চাইলাম৷ That was a big fat NO from all end. অই একবার-ই। কিছু চেয়েছি, পাইনি-- জীবনে সেটা হয় নি।
তিথী ছিল তাঁর নয়নের মণি, সবচেয়ে আদরের, সবচেয়ে স্পেশাল!

নানা কাজে- অকাজে দিনভর ছায়াসংগী সেলফোন। খুব সাম্প্রতিক সময়ের একটা ছবি সেভ করে রাখা সেই ফোনের গ্যালারিতে।
বারবার সেই ছবিটা দেখি।
জুম করে হাতদুটো দেখি।
কতবার এই হাতদুটো আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছে, মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিয়েছে! হেরেছি, পারিনি জিততে, তাও মায়া করেছে!
ছোট্টবেলায় স্কুলে গেছি এই হাত ধরে, ফিরেছিও। বিবিএ'র পর এইচএসবিসিতে ইন্টার্নিশিপ এর জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেসি, হাত ধরে গেছে সাথে৷
কিছুতেই বারণ শোনে না, যাবেই। আমি চটেমটে অস্থির, বুড়ো নির্বিকার!

বিয়ে করলাম। দুপুরে আনুষ্ঠানিকতা সেরে রাতে যুগলে রওনা হলাম চিটাগাং এ, বুড়োকে সালাম করতে।
বাবুর্চি আনিয়ে, আস্ত ছাগলের রোস্ট বানিয়ে বসে আছে। হাতে কড়কড়ে নোটের বান্ডিল, সালামি।
প্রথম নাতজামাই এসেছে, সে কী অভ্যর্থনা!

এখন আর কোথাও নেই। যতবার ডাকি, যেভাবেই ডাকি, ফেরানোর পথ নেই!
'কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে..
তাহার শরীর থেকে শ্বাস ঝরে গেছে বলে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ,
কোথাও সে নাই আর — পাব নাকো তারে কোনো পৃথিবী নিঙাড়ি?'

নাচতেক বোল্গার, গোঁয়ার নাতনীর জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার বুড়ো চলে যাবার পর টের পেয়েছি এদেশে মৃত্যুও আসলে একটা উৎসব। সত্যিকার অর্থে শোক অনুভব করে খুবই নগণ্য সংখ্যক মানুষ, যাদের সত্যিকার অর্থেই স্বজন হারিয়েছে।
বাকিদের বিয়োগব্যথার মূল উৎস সামাজিকতা রক্ষা অথবা আচার পালন।
লোকজন বাধ্য হয়ে কিংবা হুদাই এসে ভিড় জমায়, অস্বস্তিকর ভাবে গায়ে মাথায় হাত দিয়ে সান্ত্বনা জানানোর চেষ্টা অথবা ভান করে, অসংখ্য ব্যক্তিগত, অপ্রয়োজনীয় এবং সেই মুহূর্তে অশোভন প্রশ্নাবলির মাধ্যমে শোকাতুর পরিবারকে জর্জরিত করে।

নানাভাইকে যখন নিয়ে যাওয়া হবে, আমার খালারা সর্বস্বহারা স্বরে বিলাপরত, সেই মুহূর্তে খাটিয়ার খুব কাছে দাঁড়িয়ে এক আত্মীয়া ভিডিওকলে বলছিল-- না না, লাশের মুখ একটুও কালো হয়নি!
আমি তখন কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। রাতের তখন প্রায় নটা, সকাল থেকে উপোস, কথা বলার শক্তি নেই আর৷
রুচিতে কুলালে বলতাম-- মুখ কালো হলে তুই কী করতি রে হারামজাদি?

সত্যানন্দ_তিথীডোরের বৈবাহিক জীবনের বয়স প্রায় চার। নানুমণি নানাভাইয়ের বিবাহিত জীবন ছিল ৫৭ বছরের।
মাঝে মাঝে বোঝার চেষ্টা করি, নানুর কেমন লাগে?
যার যায়, সেই শুধু জানে!

ঝুম বর্ষার দিন শুরু হয়েছে। আমাদের ফ্ল্যাট ১৪ তলায়, বহুদূর দেখা যায়। দখিনমুখী বলে বিষ্টির ঝাপটা এসে ব্যালকনি ভাসিয়ে দিয়ে যায় মাঝে মাঝে।
হঠাৎ হঠাৎ রাতে এরকম ঝেঁপে নামা বিষ্টির শব্দে ঘুম ভেংগে উঠে বসে থাকি৷
অনেক দূরে, অন্ধকার একটা জায়গায় শুয়ে আমার নানাভাই ভিজছেন। ওখানে তো ছাদ নেই!
আমাকে সারাজীবন ঢেকে রেখেছেন যিনি, তাঁকে খোলা আকাশের নিচে রেখে এসে ক্যামনে ঘুমাই!

বড় হবার সবচেয়ে দুঃখজনক অংশ, যারা বড় করেছেন তাদের হারিয়ে ফেলার কষ্ট!
'এই কষ্টের সবটুকুই অনতিক্রম্য নিয়তি।
এই বিষণ্ণতা, এই শূন্যতাই শ্বাশত, ন হন্যতে'।

তবু অফিস করি, ইন্সটায় বই সাজিয়ে ছবি দেই, অনলাইন পেইজগুলোতে রং-বেরঙের শাড়ি দেখি, হাসি কাঁদি, ভালবাসি, ফাহিম হামবাগকে ভুলে রবি ঠাকুর আওড়াই...

'তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে...'


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

কিছু বলে যাব কিনা বুঝতে পারলাম না। এসব প্রসঙ্গে কথা বেশী আগায় না আমার কোন কারণে।

ইন্সটায় কী কী বই সাজিয়ে ছবি দিলেন বলেন।

..................................................................
#Banshibir.

তিথীডোর এর ছবি

অনেক অনেক!
জুইত করতে পারিনি গিয়ে, তারপরও বইমেলায় গিয়ে কেনা হয়েছে অনেক বই। বাচ্চাদের লাইব্রেরির জন্য একদিন বাতিঘরে গিয়ে নিজে এক বস্তাও তুলে নিয়ে এসেছি৷

সামরান হুদার বই পড়ছি খুঁজে খুঁজে। অতঃপর অন্তপুরে পড়ে মুগ্ধ হবার পর বাজারভ্রমণ, স্বাদ সঞ্চয়িতা, পুবালি পিঞ্জিরা।
পইড়েন, ভাল লাগার কথা। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

এক লহমা এর ছবি

এই লেখায় কিছু বলার থাকে না।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তিথীডোর এর ছবি

হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

Moinul Hoq Chowdhury  এর ছবি

কাঁদায়ে দিলা, তিথি।

তিথীডোর এর ছবি

আমি চেয়েছিলাম এই ব্লগটা বাসার কারো চোখে না পড়ুক, খামোখা কষ্ট বাড়বে।

পড়ার জন্য ধন্যবাদ খালু৷

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এই দেড় বছরে কত প্রিয়জনকে যে হারালাম। লেখাটা পড়তে পড়তে হারিয়ে ফেলা প্রিয়মুখগুলোর ছায়া দেখা দিচ্ছিল

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

তিথীডোর এর ছবি

আমি অনেক কাছের জনকে হারিয়েছি। প্রিয়জন হারালাম এই প্রথম।

আপনার হারিয়ে ফেলা প্রিয়জনদের জন্য ভালবাসা।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সোহেল ইমাম এর ছবি

একটু দাঁড়ান, আমি নানাভাইকে শেষবারের মতো আদর করে দিই।

মনে পড়লো খুব প্রিয় এক বন্ধুর মৃত্যুর কথা। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলো কিন্তু হুট করে মরে যাবার কথা ছিলোনা। হাসপাতাল থেকে আনবার সময় হাসপাতালের খাতায় আমিই ওকে ছাড়িয়ে আনলাম। ওর নামের সাথেই আমার নাম লেখা হলো। হাসপাতালেল লোকটা জিজ্ঞেস করলো কে হয়। বললাম, বন্ধু। অন্য বন্ধুরাও ছিলো আশে পাশে, আত্মীয়স্বজনরাও। এক সময় বাড়ি এনে বারান্দায় শুইয়ে দেওয়া হলো। বাড়িতে লোক গমগম করছিলো কিন্তু কেন জানিনা কয়েক মুহূর্ত পাওয়া গেলো যখন বারান্দায় বন্ধুর নিথর দেহটা ছাড়া আর কেউ নেই। আমি মুখের চাদর সরিয়ে ওর কপালে হাত রাখি। এভাবে আদর করিনি কোন দিন। হৈ হল্লা ছিলো অনেক, অনেক গালিগালাজ চলতো এভাবে আদর করিনি ওকে আজ করলাম। জানি এর পর এই নিথর দেহটার কাছাকাছি আর আসবোনা আমি, দূরে দূরেই থাকলাম দাফন পর্যন্ত। কিন্তু নিথর দেহটা থেকে পালানো সহজ স্মৃতিটা নাছোড়বান্দা আঁকড়েই থাকে। আজও আছে। তিথিডোর অনেক দিনের পুরনো কান্নার একটা ঝুলি আবার খুলে দিলেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তিথীডোর এর ছবি

কিছু বলার নেই।

বন্ধু হারালে মেনে নেওয়া যায়। এভাবে মরে গেলে কেমন করে মেনে নেবে মানুষ!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।