অ্যামেরিকা ভ্রমণঃ নিউ ইয়র্কের পথে

সজল এর ছবি
লিখেছেন সজল (তারিখ: শুক্র, ২৪/০৬/২০১১ - ৯:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বেশিদিন এক জায়গায় থাকলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে, তাই সামার শুরু হতেই চাইছিলাম কোথাও ঘুরতে যেতে। টেক্সাসের ত্রিরত্ন মাহদী, মঈন আর নাফি নিউইয়র্ক, বোস্টন আর ওয়াশিংটন ঘুরতে যাচ্ছে শুনে ল্যাংবোটের মত জুটে গেলাম ওদের সাথে। প্রচন্ড জ্ঞানী(নিরাপত্তার অভাবে আঁতেল ব্যবহার করা গেলো না) মাহদী সবকিছুর পরিকল্পনা কয়েকমাস আগেই করে রেখেছে, এর চেয়ে আদর্শ ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। আমার শুধু কষ্ট করে নিউইয়র্কে ওদের হোটেল পর্যন্ত যেতে হবে নিজের “লিমিটেড রিসোর্স” বুদ্ধি খাঁটিয়ে।

আমার শহর থেকে নিউইয়র্ক যাওয়ার বেশ কিছু উপায় আছে। হন্টন, ড্রাইভ করা, বাসে চড়া আর উড়া। আমেরিকার ভিসা আর মাত্র চার বছরের আছে, তাই প্রথম অপশন বাদ। নিজের গাড়ী নেই (ড্রাইভিং ভালো পারি না এটা অবশ্যই কোন কারণ না) বলে দ্বিতীয় অপশনও বাদ। বাসে চড়ে বসলে হয়, উড়ার খরচের মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ, কিন্তু সময় লাগবে প্রায় পাঁচগুণেরও বেশি। সব মিলিয়ে এগারো ঘন্টা বাস জার্নি করবো কিনা এই নিয়ে সপ্তাহ খানেক ধরে চিন্তা-ভাবনা করতে করতে প্লেনের টিকেটের দাম বেড়ে গেল পঞ্চাশ শতাংশ। বার কয়েক এগারো ঘন্টা বাসে বসে থাকার ব্যাপারটা মনে মনে সিম্যুলেট করে বুঝলাম “কৃচ্ছ সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়”। চিন্তালব্ধ ফলাফল “আলসেদের পক্ষে কিপটা হওয়া অসম্ভব” ফেসবুকে স্ট্যাটাস আকারে দিয়ে প্লেনের টিকেটই কিনে ফেললাম।

আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আবিস্কার হচ্ছে জিপিএস সমেত ম্যাপ, অন্তত আমার মত দিক-কানা জিওগ্রাফিক মেমরীলেস মানুষের জন্য। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত বাসে যাব, তাই আগের দিন ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে গুগল ম্যাপে বাস স্টপের চারপাশে ভালোমত হেটে দেখলাম, কোন ভাবেই যেন বাস মিস না হয়। তারপর বাস ছাড়ার পনেরো মিনিট আগে হাজির হলাম বাস স্টপে, দেখতে দেখতে পনেরো মিনিট কেটেও গেলো মসৃণভাবে, শুধু বাসের দেখা নেই। ম্যাপের দিকে তাকালাম, বলছে “বাস এই মাত্র চলে গেছে”। বিদেশ-বিভুঁইয়ে এই জিপিএস এনেবলড ম্যাপের চেয়ে বেশি বিশ্বাস আমি কাউকেই করি না, তাই মোটামুটি হাত-পা ছেড়ে কান্নার যোগাড়। ট্যাক্সি ডাকার চিন্তা করতে করতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি বাস হাজির, যদিও দুই মিনিট লেইট। আমি ম্যাপ অ্যাপ্লিকেশনের দিকে তাকিয়ে বলি “এট টু ব্রুটাস!”

এয়ারপোর্টের ভিতর দিয়ে এগুচ্ছি সিকিউরিটি গেটের দিকে, মুভিতে দেখা কানে প্যাচানো ইয়ারপিস ওয়ালা এক এজেন্টে অমায়িক হেসে বলল, “হাউ আর ইউ ডুয়িং?”। সুশীল ব্যাপার, কিন্তু আমার মন কেন জানি কু ডেকে উঠলো। স্ক্যানারের ভেতর সব চালান দিয়ে নিজে এগুই গেটের দিকে, শরীরে ধাতব কিছু নেই, স্বভাবত গেট থাকে নীরব। এর আগে বার কয়েক ডোমেস্টিক ফ্লাইটে চড়েছি, প্রতিবার চেকিং এর সময় সিকিউরিটি অফিসার হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মত করে আমাকে ছেড়ে দিত, গায়ে হাত দিয়ে মানি লোকের মান-সম্মানকে হুমকীর মুখে না ফেলে। কিন্তু এবার দেখি ব্যাটা আমার ডান হাটুর নীচ থেকে চেক করা শুরু করলো, চেক করে কিছু না পেয়ে, ইয়ারপিসে হাত দিয়ে বলে “অল ক্লিয়ার”। বুঝলাম আগের সেই ভদ্রলোকই সম্ভবত আমাকে নির্বাচন করেছেন। পাশে কয়েকজনকে পুরা শরীর চেক করছে, এক ইয়োরূপিয়ান বৃদ্ধ দেখলাম সুরসুরিতে হাসি শুরু করে দিয়েছেন।

প্লেনের ক্রুরা খুবই প্রযুক্তি বিমুখ, প্লেনে উঠার পরই শুরু করে সাথে থাকা ইলেকট্রনিক ডিভাইস বন্ধ করে দেয়ার জন্য ঘ্যান-ঘ্যান। ফোন বন্ধ করে, এবার কিন্ডল বন্ধ করার জন্য পাওয়ার বাটন খুঁজি এবং প্রথম বারের মত আবিস্কার করি কিন্ডলে কোন পাওয়ার বাটন নেই। এবার? খুব করে নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যাবার অনুরোধ করে কিন্ডলটাকে রেখে দিলাম সামনে। এয়ার হোস্টেস আসে ড্রিংক্স নিয়ে। অনেক অনেক আগে, ডাইনোসরেরা যখন পৃথিবী দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে, এয়ার-হোস্টেসরা হতো চোখ ঘুরিয়ে দেয়ার মতো। কিন্তু সেই ডায়নোসরেরাও নেই, এয়ার-হোস্টেসদের সেই রমরমাও নেই। অ্যামেরিকান এয়ারলাইনসের হোস্টেসরা অনেকটা মা-দাদীদের মত বয়স্ক। যাই হোক, কী আর করা, হতাশা গোপন করে অরেঞ্জ জুস চাই। আর আমাকে পুরা অবাক করে দিয়ে পুরা একটা ক্যানই আমাকে দিয়ে দেয় ভদ্রমহিলা। অবাক হওয়ার কারণ জানতে হলে এইসব ডোমেস্টিক ফ্লাইটের কঞ্জুসী সম্পর্কে জানতে হবে। ডেল্টা এয়ারলাইন্সে একবার সিটের সামনে রাখা মনিটরে মুভি ছেড়ে দিয়ে, এয়ার হোস্টেসরা ইয়ারফোন বিক্রি করে বেড়ানো শুরু করলো, অর্থাৎ ফ্রি দেখে নিচ্ছ, সে ঠিক আছে, কিন্তু শুনতে চাইলে কড়ি ফেলো।

নিউইয়র্ক সিটির কিছুই চিনি না, তবে এবারো গুগল ম্যাপের ডিরেকশন ভরসা। সে ট্রেনে চড়তে বললে ট্রেনে চড়ে বসি, কুইনসের ঊডসাইড স্ট্রিটে নামতে বললে নামি। আর নামা মাত্র নাকে এসে লাগে শুটকী বা এই টাইপের কোন গন্ধ, মরচে ধরা লোহার ওভারব্রীজ বেয়ে নামতে নামতে চারপাশে তাকাই, কেমন জানি পোড়ো পোড়ো অবস্থা। আগের বার ম্যানহাটনেই শুধু গিয়েছিলাম, চোখ ধাঁধানো বিল্ডিং দেখতে দেখতে ঘাড়ে ব্যাথা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এবার এই অবস্থা দেখে মনে মনে বেশ একচোট হেসে নেই, আর বলতে থাকি, এইবার আসো দেখি ঢাকা শহরের পাশে দাড়াতে পারো কিনা।

অল্প হেটে পৌঁছাই আমাদের হোটেলে। প্রথম দেখা মঈনের সাথে, কানে ফোন লাগিয়ে বেশ বিগলিত ভাবে কথা বলে যাচ্ছে; ওই পাশের অনুমতি নিয়েই হয়তো আমার সাথে কুশল বিনিময়ের অবকাশ বের করে নেয়। তারপর করিডোরে দেখা মাহদীর সাথে, অতি-অবশ্যই সেও ফোন রেখে দিয়ে আমার সাথে মোলাকাত করে। তারপর বেজমেন্টের আমাদের রূমে আধো-অন্ধকারে আবিস্কার করি নাফিকে, মেঝেতে বসে কি জানি করছে। লাইট জ্বেলে কী দেখা গেলো তা বাকি দু’জনের সাথে মিলিয়ে নিলেই বুঝা যাবে।

সুতরাং অনুসিদ্ধান্তে আসি আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে বাজে আবিস্কার হচ্ছে সেলুলার ফোন।

[ভ্রমণকাহিনী লিখার ইচ্ছা ছিলো, তবে নিউইয়র্ক আসতে আসতেই তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় আপাতত এই পর্যন্ত।]


মন্তব্য

পড়াচোর () এর ছবি

গল্প তো শুরু হতেই শেষ হয়ে গেল ! আরো লিখুন প্লিজ। ভালো লেগেছে। হাসি

সজল এর ছবি

ধন্যবাদ পড়ার জন্য।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

আয়নামতি1 এর ছবি

এটা কী হলো! রেগে টং পোষ্ট পড়তে না পড়তেই ফুরিয়ে গেলো! আরো বেশি করে ডায়েট করেন খাইছে তবে আর তেল ফুরিয়ে লেখার মাঝপথেই ফুট্টুশ হবার ঝক্কি থাকবে না......অজুহাত বাদ দিয়ে বাকীটুকু জলদি দিয়ে ফেলুন দেখি দেঁতো হাসি

সজল এর ছবি

লিখা হয়ে গেলেই দিয়ে দিব হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

স্বপ্নাদিষ্ট এর ছবি

পরের অংশের অপেক্ষায় রইলাম!

সজল এর ছবি

কামিং...

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

guest_writer এর ছবি

ভাই এত জলদি তেল ফুরিয়ে গেলে কিন্তু কপালে খারাবি আছে!

দৈনিক ন্যূনতম ২০ মিনিট (বা আরও বেশি) দৌড়ানোর অভ্যাস করুন।

==================
আমি জানি না

সজল এর ছবি

জলদি ফুরাইল কই, ৫০০ মাইল যাওয়ার পরেও তেল না ফুরাইলে কেমনে হবে!

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

কৌস্তুভ এর ছবি

দারুণ, দারুণ! সিরিজ চালান!

কিন্ডল ৩য় জেনারেশন? ওটার নিচের বাটনটা টেনে ধরে ছেড়ে দিলে স্লীপ, আর ১ না ৩ সেকেন্ড ধরে রাখলে তো শাটডাউন হয়ে যায়।

মাহদী ছেলেটা আসলেই ঘ্যাম পোলা। ওরে এট্টা স্যালুট।

তারপর বেজমেন্টের আমাদের রূমে আধো-অন্ধকারে আবিস্কার করি নাফিকে, মেঝেতে বসে কি জানি করছে। লাইট জ্বেলে কী দেখা গেলো তা বাকি দু’জনের সাথে মিলিয়ে নিলেই বুঝা যাবে।

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

সজল এর ছবি

ঘুম পাড়াতে পেরেছিলাম, আরেকটু জাপটে ধরে রাখলে শ্বাসবন্ধ হয়ে মারা যেতো এই কমন সেন্সটাই মাথায় আসলো না মন খারাপ । স্যালুট পৌঁছায় দিবনে।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

কৌস্তুভ এর ছবি

ঘুম পাড়ানো, জাপটে ধরা, শ্বাস বন্ধ... আপনার ইঙ্গিত তো সুবিধার ঠেকে না জনাব! চিন্তিত

সজল এর ছবি

আমার কমেন্টটা একটু থ্রিলারধর্মী ছিলো বটে, কিন্তু আপনি এটাকে একবারে রগরগে বানিয়ে দিলেন। জনাব, আপনার বিবাহের সময়ে পার হয়ে যাচ্ছে বলে সন্দেহ করি এই ক্ষণে!

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

ফাহিম হাসান এর ছবি
ফাহিম হাসান এর ছবি

আপনার রসবোধ অসাধারণ !! হাততালি

সজল এর ছবি

আমারে বললে ঠিক আছে, কৌস্তুভরে বললে প্রতিবাদ জানাই চোখ টিপি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

কল্লোল_CSE03 এর ছবি

তুই যে ম্যাপের কথা ভাল বলেছিস, তাতে আমি যারপরনাই খুশি হাসি

সজল এর ছবি

রাত-বিরাতে হাটতে গিয়ে এতবার পথ হারাইছি, আইফোনের ম্যাপ না থাকলে খবরই ছিলো। যার নুন খাই, তার গুণতো গাইতেই হবে হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

চলুক।

সজল এর ছবি

আশা রাখি। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

পড়তে এসেছি এর ছবি

তারপর কী হল? লিখতে থাকুন। চমৎকার লেখার হাত আপনার। মিসিসিপির চেয়ে বড় করেই ভ্রমনটা লিখবেন এবার।

পড়তে এসেছি এর ছবি

তারপর? মিসিসিপি র চেয়ে বড় ভ্রমন গল্প হবে মনে হচ্ছে। চমৎকার লিখেন আপনি, মনে হল দেখতে পাচ্ছি সবকিছু।

সজল এর ছবি

ধন্যবাদ 'পড়তে এসেছি'। দেখা যাক কত বড় হয়।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

guest_writer এর ছবি

সজল ভাই,
লিখাটা হাওয়ায় মিঠাই হইল কেন-----------
জলদি এইটারে বুফে লাঞ্চ বানাই হালান চলুক

নির্ঝরা শ্রাবণ

সজল এর ছবি

হাওয়াই মিঠাই বানাইতে গিয়াই তেল শেষ... দেখি বুফের এন্তেজাম করতে হবে।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ধুর্মিয়া... মনে হইলো ঢাকার রাস্তার জ্যামের লাইভ আপডেট পড়তেছি... ছবি কো?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সজল এর ছবি

ইয়ে, মানে... । ঘুরাঘুরি শুরু হয় নাইতো (লেখায়) এখনো, পরের পর্বে ছবি সমেত দিব।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

তিথীডোর এর ছবি

অ্যামেরিকা ভ্রমণের সবগুলো পর্ব আবার পড়ে ফেললাম।
আপনার সেন্স অফ হিউমার সেইরকম! হো হো হো

ফেসবুকে রাতদিন হাতি-ঘোড়া মারা কমিয়ে আরেকটু নিয়মিত টুকটাক লিখতারেন না? রেগে টং

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।