নোবেল প্রাইজ

শঙ্কর's picture
Submitted by shankar [Guest] on Tue, 14/09/2010 - 8:13pm
Categories:

প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা। অন্যান্য দিনের মত সেদিনও সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফিরে বাড়ির দরজায় বেল বাজিয়েছি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা হাওয়াই চপ্পলের চটর-পটর ধ্বনি শুনেই মনে হল বৌ যেন আজ খুশীতে ডগমগ হয়ে নামছে। জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে শুনলাম, ‘জানো তো আজ দিয়া, ... না থাক তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে নাও। চা খেতে খেতে বলব।’

দিয়া, মানে আমার মেয়ে। বছর তিনেক বয়স। কিছুদিন হল প্লে-স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। রোজ তার নতুন নতুন খবর থাকে। কোনদিন নতুন একটা ছড়া শিখে এল, কোনদিন বা কাকে আঁচড়ে-কামড়ে দিয়ে এল। আজকেরটা মনে হয়ে বেশ ভালোর দিকেই। কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে চানের ঘরে ঢুকলাম।

আমাদের শোয়ার ঘর আর চানের ঘর ওপরে। সিঁড়ি দিয়ে খাবার টেবিলের দিকে যেতে যেতে দেখলাম, রান্নাঘরে গিন্নী চায়ের কাপে টুং-টাং করছে। ওখান থেকেই গল্পের ভূমিকা শুরু হল, ‘আজ দুপুরে দিয়াকে গল্প বলছিলাম।’

এই হয়েছে এক ঝামেলা। রোজ মেয়ের খাওয়ার সময় গল্প শোনা চাই। দুপুরে মায়ের পালা, রাতে আমার। কোন গল্প পুরো বলতে সে পারে না, কিন্তু এক গল্প দু-বার বললেই ধরে ফেলবে, ‘তারপর তো এটা হল, তাই না?’ মেয়ের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য পুরাণ-কাহিনী দিয়ে শুরু করেছিলাম। স্টক প্রায় খতম। এবার মহাভারত ধরব ভাবছি। নাহয় একটা পুরো কাশিদাসী কিনেই ফেলব। বৌ টুকটাক গল্পের বই কিনতে শুরু করেছে।

‘কি বলি, কি বলি। শেষকালে ঈশপের গল্প বলা শুরু করলাম। ঐ যে ওটাগো, ঐ যে কাক আর কলসীর গল্প। যেখানে কাকের খুব তেষ্টা পেয়েছিল। কিন্তু দেখল কলসীর জল অনেক নীচে। তাই সে রাস্তা থেকে পেবলস তুলে নিয়ে কলসীতে ফেলতে লাগল।’

ইংরিজী মিডিয়াম বৌ হলে এই মুশকিল। ঢিল বলতে পারবে না, পাথরের টুকরোও বলবে না – একদম পেবলস। যাক ভুলভাল মন্তব্য করে গল্পটা এখানে মাঠে মেরে দিলে কেলো হয়ে যাবে। আমি চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকলাম।

- গল্প শেষ করে যেই বলতে যাব, কাকের কি বুদ্ধি দেখেছিস?

মেয়ে আমার বলে কি জান? ‘মা, কাকটা এত বোকা কেন?’
আমি বললাম, ‘কেন? বোকামি কি করল?’
- কাকটা পেবলস না কুড়িয়ে একটা স্ট্র যোগাড় করলেই তো পারতো।

‘চিন্তা কর। আমরা সেই কবে ছোটবেলা থেকে কাকের বুদ্ধির গল্প শুনে এসেছি। এই বুড়ো বয়সে এসেও (ব্যাপার কঠিন দিকে এগোচ্ছে – গিন্নীর কথা অস্বীকার করলেও মুশকিল, আবার বুড়ো বয়স স্বীকার করাও রিস্কি। আমি খুব সাবধানে শুনতে লাগলাম।) কাকটাকে বোকা মনে হয়নি। মেয়ে আমার এক কথায় কাককে বোকা বানিয়ে দিল।’

আমরা দুজনেই আলোচনার মাধ্যমে মেনে নিলাম, মেয়ে শুধু কাককেই বোকা বলেনি, প্রকারান্তরে ঈশপ থেকে তার বাবা-মা (মানে আমরা) পর্‍্যন্ত সমস্ত মানবজাতির নির্বুদ্ধিতাকেই সে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মেয়ে যে আমাদের ভীষণ বুদ্ধিমতী, তার লেখাপড়ার দিকে যে আমাদের প্রচুর পরিমাণে নজর দেওয়া দরকার, সে ব্যাপারে আমরা দুজনেই একমত হলাম। তাকে ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ার বানাব, না ম্যানেজমেন্ট গুরু, নাকি আইটিতেই পাঠাব, এই নিয়ে গবেষণা করতে করতে সে রাতে আমরা ঘুমোতে গেলাম।

ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম, মেয়ে আমার নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। প্রচুর লোকজন বাড়িতে এসে তাকে সম্বর্ধনা দিচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সকালে চায়ের টেবিলে বসে প্রথমেই সোফাটার দিকে নজর গেল। কয়েক বছর আগে বিয়েতে পাওয়া। একটু পুরনো হয়ে গেছে। কাল রাতে স্বপ্নে অত সব ঝকঝকে লোকদের মধ্যে সোফাটা কেমন বেমানান লাগছিল (হলই না হয় স্বপ্ন), বোনাসটা পেলে বদলাতে হবে। ভোরের স্বপ্ন মিথ্যে হবে না নিশ্চয়ই।

তাড়াতাড়ি নাশতা করেই অফিসের দিকে দৌড় লাগিয়েছি। বিশ বছর পরে মেয়ে নোবেল প্রাইজ পাচ্ছে, সবাইকে জানাতে হবে না? কিন্তু তাড়াতাড়ি করলে কি হবে? তাদের মেয়েরাতো আর নোবেল প্রাইজ পাচ্ছে না। অফিসে পৌঁছে দেখি, ফাঁকা হলঘর। কোনায় কোনায় একটা-দুটো লাইট জ্বলছে। আমি লগ-ইন করে মেল চেক করতে লাগলাম। সাড়ে-দশটা নাগাদ অর্ণব এসে হাঁক পাড়ল, ‘শঙ্করদা, চা খেতে যাবেন না?’

যাবো না মানে!!! এই মুহূর্তটার জন্যে তখন থেকে মুখিয়ে আছি। বিশ-বছর পরের নোবেল-লরিয়েটের বাপ আমি। হুঁ হুঁ বাব্বা।

ক্যান্টিনে গিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জমিয়ে গল্পটা শুরু করেছি। যেইনা, মেয়ের কমেন্ট বলেছি, পরাগ বলে, ‘স্ট্র নিয়ে আসার কথা তো? আমার মেয়েও ওই একই কথা বলেছে।’ ওর মেয়েও আমার মেয়ের বয়সী।

তারপর ওরা আজকালকার ছেলেমেয়েদের কি ভীষণ এক্সপোজার বেড়েছে, জেনারেশন গ্যাপ এইসব নিয়ে আলোচনা চালাতে লাগলো। আর আমি মেয়ের নোবেল প্রাইজটা ফস্কে যাওয়ার দুঃখে মনমরা হয়ে বসে রইলাম।

সোফাটা আর বদলাতে হবে না।


Comments

ধুসর গোধূলি's picture

হে হে হে
ইংরেজী মিডিয়াম বউ! হো হো হো

নোবেল প্রাপ্তি থেকে সরে আসলে হবে? আমার তো মনে হচ্ছে কাকের স্ট্র সমাধান বের করা দু'জনে বাকি সবার সাথেই যৌথভাবে নোবেল পাবে। সোফাটা বদলেই ফেলেন। আমিও পয়সা জমাতে থাকি এখন থেকেই। দেঁতো হাসি



বিএসএফ—
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ

মর্ম's picture

হে ভবিষ্যত্‍ নোবেল লরিয়েটের পিতা,

আগাম অভিনন্দন!
বিষয় নিয়ে ঘাবড়ে যাওয়ার কারণ দেখিনা কোন, ঈশপ তাবত মা বাবা আর কাকজাতির বুদ্ধিকে যে মাত্‍ করতে শিখে নেয় এ বয়সেই, সে তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে নোবেল জিততেই পারে এককালে।

আপনি বরং বদলেই ফেলুন ও সোফা, নোবেল মিস হলেও গিন্নীর খুশি মিস হবেনা! চোখ টিপি
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

মূলত পাঠক's picture

খুব মজা পেলাম পড়ে। অনেক দিন আপনাকে দেখি নি, ছিলেন কোথায়?

অনন্ত [অতিথি]'s picture

দারুন লেগেছে গল্পটা। আর সাথে কিছু টার্ম, বিশেষ করে ইংরেজি মিডিয়াম বৌ!

বইখাতা's picture

মজার তো! হাসি

অতিথি লেখক's picture

আপনি এই সুযোগে আপনার মেয়ের নামে কাকের স্ট্র পেটেন্ট করিয়ে ফেলেন, তাইলে হয়তো এটা দিয়েই বাজিমাত হয়ে যাবে। লেখা উমদা হয়েছে হাসি

সজল

শাহেনশাহ সিমন's picture

হাহাহাহা চলুক
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

অতিথি লেখক's picture

খুবই মজার লেখা। নোবেল না হোক সোফাটা নিশ্চিত করতেই পারেন।

অমিত্রাক্ষর
অমিত্রাক্ষর@জিমেইল ডট কম

নাশতারান's picture

হো হো হো

আজকালকার বাচ্চাদের আসলেই অনেক বেশি বুদ্ধি।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

কৌস্তুভ's picture

চমৎকার গল্প। আপনার লেখা আগে পড়া হয় নি, এখন অনেকগুলো পড়লাম, প্রত্যেকটাই দারুণ!

অদ্রোহ's picture

ট্যাগে ঈশপ দেখে ভ্রু কুঁচকেছিলাম, শেষ প্যারাটা পড়ে ব্যাপারটা পষ্ট হল।

--------------------------------------------

আজি দুঃখের রাতে, সুখের স্রোতে ভাসাও তরণী
তোমার অভয় বাজে হৃদয় মাঝে হৃদয় হরণী।

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

দেবোত্তম দাশ's picture

সোফা কিনে ফেলুন তাড়াতাড়ি
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

তিথীডোর's picture

হো হো হো
তোফা!!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

বাউলিয়ানা's picture

হা হা হা...মজা পেলুম।

অতিথি লেখক's picture

ইন্ডিয়ান একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম, সেখানে কাক স্ট্র দিয়ে স্প্রাইট খায়। আপনার গল্প পড়ে আজ অনেকদিন পরে কাক আর সেই স্ট্র'র কথা মনে পড়ল।

সোফা আর বছর দশেক পরে কিনুন, কেননা এখন কিনলে বিশ বছর পরে সেটা পুরোনো হয়ে যাবে।

অনন্ত আত্মা

বোহেমিয়ান's picture

হাহা!! ব্যাপক!! আমার মাথায়ও কখনো স্ট্র এর কথা আসে নাই!
আজকাল্কার পুলাপান!!!

_________________________________________

_________________________________________
ওরে! কত কথা বলে রে!

দ্রোহী's picture

হা হা হা। দারুণ গল্প।


কাকস্য পরিবেদনা

অতিথি লেখক's picture

ইংরিজী মিডিয়াম বৌ হলে এই মুশকিল। ঢিল বলতে পারবে না, পাথরের টুকরোও বলবে না – একদম পেবলস।

দাদারে... এই দিক দিয়ে আমি সুখে আছি, আমরা দুজনেই খাস বাঙ্গাল! পেবলসে আমাদের আগ্রহ নেই, আমরা দুজনেই ঢিলা!!! তবে সুখের কথা হলো আমাদের এখনো গল্প শোনানোর মতো মানুষ নাই, তাই নোবেল পাবার স্বপ্নও নাই!

--- থাবা বাবা!

সুহান রিজওয়ান's picture

হাহাহা... দারুণ !!!

_________________________________________

সেরিওজা

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার's picture

হা হা হা! দেঁতো হাসি
ঈদের পরে সচলায়তনের সবচেয়ে মজার লেখা। দাঁত বের হয়ে গেল সব পড়তে গিয়ে। থেঙ্কু থেঙ্কু! দেঁতো হাসি

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

রিয়েল ডেমোন's picture

সোফাটা আর বদলাতে হবে না ইয়ে, মানে...

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.