বাংলাদেশ: আশায় নতুন জীবনের বসতি - অখণ্ড

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: শুক্র, ০৯/০১/২০০৯ - ১২:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনুবাদকের কথা

১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে এক দল সাংবাদিক এসেছিলেন। নতুন দেশের জনগণ একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও গণহত্যার প্রভাব কিভাবে কাটিয়ে উঠছে, তা দেখাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। সফর শেষে দেশে ফিরে গিয়ে উইলিয়াম এস এলিস এ নিয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিনের সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়। সেই ২৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনেরই বাংলা ভাবানুবাদ এটি। সাথে ভিয়েতনাম যুদ্ধের আলোকচিত্রী ডিক ডুরেন্সের তোলা ছবিগুলোও আছে।

ন্যাট জিওর এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদন সম্পর্কে আমি প্রথম জানতে পারি সহব্লগার বিপ্লব রহমানের একটি লেখা থেকে। লেখার সাথে তিনি ন্যাট জিওর মূল প্রতিবেদনের স্ক্যান করা পৃষ্ঠাগুলো জুড়ে দেন। সেখান থেকেই অনুবাদ করছি। বিপ্লব রহমান সে লেখার মাধ্যমে অনুবাদের উন্মুক্ত আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমিই রাজি হয়ে গেলাম। রাজী না হওয়ার কোন কারণই ছিল না। এমন একটা লেখা অনুবাদ করতে পারাটাও গর্বের।

বিপ্লব রহমান ন্যাট জিওর মূল ইংরেজি লেখাটি সংগ্রহ করেছিলেন প্রয়াত ব্যবসায়ী আহমেদ উল্লাহ্‌'র ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে। আহমেদ উল্লাহ‌ পরিবার এতোদিন ধরে এটি সংরক্ষণ করে না রাখলে সচলায়তন পর্যন্ত লেখাটা আসতেই পারতো না। বিপ্লব রহমান বছর চারেক আগে সেখান থেকে সিডি আকারে লেখাটি সংগ্রহ করেছিলেন। তাই প্রয়াত আহমেদ উল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতা। বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এম. এম. আর. জালাল সবসময়ই এর সংরক্ষণ, অনুবাদ ও পুনঃপ্রকাশে উৎসাহ জুগিয়েছেন। তার প্রতিও অশেষ কৃতজ্ঞতা।

লেখার শিরোনাম আমি দেইনি। ইংরেজি শিরোনাম ছিল "Bangladesh: Hope Nourishes a New Nation"। বিপ্লব রহমানের ব্লগে আরেক সহব্লগার আলমগীর বাংলা শিরোনাম হিসেবে "বাংলাদেশ: আশায় নতুন জীবনের বসতি" প্রস্তাব করেন। শিরোনামটা পছন্দ হয়েছে। তাই এটাই রেখে দিলাম।

প্রয়াত মুহম্মদ জুবায়ের এর ভাবানুবাদ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিষ্ঠুর সময় তা হতে দেয়নি। তিনি অকালেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আজ অনুবাদ করতে গিয়ে তার কথাই মনে হচ্ছে। এই সামান্য অনুবাদ প্রয়াস তাই মুহম্মদ জুবায়েরকে উৎসর্গ করলাম।

*****

যেখানে ভয়ের বসতি: ১৯৭১ সালের গৃহযুদ্ধ বাংলাদেশীদেরকে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। এখন তারা যুদ্ধ ও গণহত্যার প্রভাব কাটিয়ে উঠার পথে আছে। ছবির এই গ্রাম্য মেয়েটি ক্ষেত থেকে তামাক সংগ্রহ করছে। আগন্তুকদের দেখে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে, হাত দিয়ে অন্য কাজ করতে থাকায় দাঁত দিয়েই কামড়ে ধরে আছে তার শালটিবিশাল প্রান্তরে আড়াই লক্ষ মানুষ উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিলো। অবশেষে তাদের নেতা ক্লান্ত শরীরে এসে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন। তিনি প্রথমে কি বলবেন তা সবাই জানতো। তারা যেন উত্তর দেয়ার জন্যও প্রস্তুত ছিলো।

নেতা চিৎকার করে বললেন, "জয় বাংলা"। সাথে সাথে লক্ষ মানুষের লক্ষ কণ্ঠ থেকে প্রত্যুত্তর এলো। মুখে মুখে প্রতিধ্বনিত হলো, "জয় বাংলা"। প্রতিধ্বনিগুলো যেন বজ্রের গর্জনে রূপ নিলো।

তারা এই নেতাকে "বঙ্গবন্ধু" ডাকে। বঙ্গবন্ধুর সাথে তার জনতার এই বাক্য বিনিময়কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের এক সমবেত সঙ্গীত বলা যায়। সেই সঙ্গীত, যার গায়েনেরা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়েছে, তারপরও মাথা নত করেনি; অবশেষে পৃথিবীতে একটি নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। জয় বাংলার ধ্বনি মিলিয়ে যেতে না যেতেই বঙ্গবন্ধু সবার উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,
"আপনাদের কি আগামী দুই, এমনকি তিন বছরেও আমার কাছে আর কিছু না চাইবার ইচ্ছা আছে?"

হ্যাঁ, সবাই চিৎকার করে উঠল। ক্ষুধা আর রোগ-শোকে অনেকের চিৎকার করার শক্তিটুকুও ছিল না। তারপরও নিজেদের ইচ্ছাটুকু পুরোপুরি প্রকাশ করার জন্য তারা এটুকু করল।

বঙ্গবন্ধু হলেন শেখ মুজিবুর রহমান, এই দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জাতির জনক। দেশটির আয়তন প্রায় উইসকনসিনের সমান, সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ছোট্ট রাষ্ট্রটি একসময় পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিতি পেতো। আজ তারা স্বাধীন। আজ তারা নেতৃত্ব আর অনুপ্রেরণার আশায় এই শেখ মুজিবুর রহমানের দিকেই চেয়ে আছে। ক্ষুধার তাড়নায় বেঁচে থাকার সংগ্রামটাই তাদের জন্য এখন মুখ্য, এমন অবস্থাতেও তারা নেতার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। কোন র‌্যালিতে শেখ মুজিব উপস্থিত হওয়া মানেই অতীন্দ্রিয় এক কনসার্ট শুরু হয়ে যাওয়া। ময়মনসিংহ শহরের এক র‌্যালিতে আমি এটাই লক্ষ্য করলাম। দুর্ভিক্ষের প্রকোপে তার অনুসারীরা মরতে বসেছে, তারপরও নেতার মধ্য দিয়ে তারা স্বাধীনতার স্বাদ খুঁজে পাচ্ছে।

ঐ দিনই, র‌্যালিতে যাওয়ার আগে শেখ মুজিব ময়মনসিংহের কয়েক মাইল দক্ষিণে টর্নেডোর আঘাতে বিধ্বস্ত এক গ্রাম পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। আমিও তার সাথে ছিলাম। গিয়ে দেখেছিলাম, টর্নেডো প্রায় আধ ডজন গ্রামকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। কয়েক শত মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। তাদের বাঁশ আর ছনে তৈরী বাড়িগুলো ঘণ্টায় ১৫০ মাইল বেগের ঝড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে, এর সাথে আছে কলেরার আতংক। এপ্রিলের তীব্র গরমে মৃত পশুগুলোর শরীর গলে পড়ছে।

প্রধানমন্ত্রী ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হাটছিলেন, তার চেহারায় দুঃখ আর ১৮ ঘণ্টার একটানা খাটুনির ছাপ সুস্পষ্ট। এই অবস্থাতেও তার আগমন বার্তা ছড়িয়ে পড়ার পর পুরো গ্রাম যেন জেগে উঠলো। হাজার হাজার গ্রামবাসী জড়ো হয়ে গেল।

একটা আম গাছের গুড়ির উপর দাড়িয়ে আমি তাদের দিকে তাকালাম, আমি দেখলাম, আমি এমন কিছু মানুষকে একসাথে দেখলাম যাদের মধ্যে এক ধরণের একমুখীনতার প্রবণতা খুব প্রকট ছিল। সেই মিলনমেলায় ছিল: লুঙ্গি পরিহিত পুরুষেরা- যাদের হাতে এদেশের সোনার ফসল ফলে, বাচ্চা কোলে রমণীরা, ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল যাদের ফিকফিকে হাসিতে ছিল কেবলই উচ্ছ্বাস।

হঠাৎ করে এতো লোক জড়ো হয়ে যাওয়াটা বাংলাদেশে বেশ স্বাভাবিক। কারণ, এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১,৩০০ জন। পৃথিবীর সব মানুষকে যদি যুক্তরাষ্ট্রের পরস্পরসংলগ্ন ৪৮টি অঙ্গরাজ্যে বাস করতে দেয়া হয় তারপরও সেখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব এত বেশি হবে না।

শেখ মুজিব তাদেরকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। চাপাচাপি করে যারা যথেষ্ট কাছে আসতে পারছিলো তারাই কেবল তার কথাগুলো শুনতে পারছিলো। কিন্তু এক্ষেত্রেও শেখ মুজিব আগের মতো রইলেন, কোন প্রতিশ্রুতি দিলেন না। জানালেন, যে ক্ষত নিয়ে দেশের জন্ম হয়েছে তা শুকোনোর আগে কোন প্রতিশ্রুতিই দেয়া সম্ভব না। এর পাশাপাশি "জয় বাংলা" শ্লোগান চলল। এখানকার আর একটি ঘটনাই উল্লেখ করার মতো- এক বৃদ্ধা তার হাত আর হাটুতে ভর করে বাতাসের তোড়ে উত্তপ্ত মাটিতে ছড়িয়ে পড়া চাল কুড়োচ্ছিলেন, একটি একটি করে। তাই দেখে প্রধানমন্ত্রীর দলের এক সদস্য বললেন, "আল্লাহ তাদের শক্তি দান করুন!"

গণহত্যা শেষে একটি জাতির উত্থান

শ্লোগান দিয়ে বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে কোন লাভ হয়েছে কি-না জানি না। শুধু জানি, পৃথিবীর ১৪৭তম স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ঠিকই নিজের পায়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এদেশের মানুষ যেন নতুনভাবে জীবন সংগ্রাম শুরু করেছে। ১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা চিন্তা করলে একে সত্যিই অলৌকিক বলে ভুল হয়।

বাংলাদেশীদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রভাব সুস্পষ্ট। শহর বলি আর গ্রামই বলি, সর্বত্র একই অবস্থা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র আর দেশের প্রতিটি স্থানেই পুনর্গঠনের কাজ চলছে। কিন্তু আরোগ্য লাভের এই প্রচেষ্টাও বোধ করি খুব কষ্টকর।

শেখ মুজিবের সরকার বলছে, দেশে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০ লক্ষ বাঙালি নিহত হয়েছে। সংখ্যাটি হয়তো অতিরঞ্জিত, কিন্তু সে সময় ঢাকাসহ এই বিস্তীর্ণ নদীমাতৃক দেশের প্রতিটি প্রান্তে যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে গণহত্যার খুব কাছাকাছি।

যতদিনে যুদ্ধ শেষ হয়েছে, ততদিনে পঁচে যাওয়া লাশের মাংস খেয়ে খেয়ে শকুনেরা আরও মোটাতাজা হয়ে উঠেছে। এতোই মোটা হয়েছে যে, তারা আর আগের মতো স্বচ্ছন্দে উড়তে পারে না। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের যেন কোন প্রাণশক্তিই অবশিষ্ট নেই। থাকবে কি করে, জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রাণশক্তির পুরোটাই যে বাঙালিরা যুদ্ধের ময়দানে ঢেলে দিয়ে এসেছে। সরকার ভিক্ষুকে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছে। প্রয়োজনের খাতিরে তাকে বিশ্বব্যাপী ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়াতে হয়েছে। আর এভাবেই ইতিহাসের বৃহত্তম ত্রাণ কর্মসূচীর সূচনা ঘটেছে।

স্ক্যান্ডিনেভীয় এক দেশ থেকে ত্রাণ হিসেবে আসা একটি চালান এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মত। তারা ভাল বুঝেই গরম কাপড় পাঠিয়েছে। ইউরোপে এই কাপড়গুলো স্কি করার জন্য ব্যবহৃত হয়। নাতিশীতোষ্ণ এক দেশে কি-না এলো স্কি-ক্লোদিং। ঢাকার এক ত্রাণকর্মী আমাকে বললেন, "অনেকেরই বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন ধারণা নেই। অনেকে মনে করে, হিমালয়ের কাছেপিঠে কোথাও হবে। আবার অনেকে ভাবে, দক্ষিণ দিকে থাইল্যান্ডের প্রতিবেশী হবে হয়তো।"

এক নদীবিধৌত উর্বর সমভূমি

ভালোবাসার হাত: শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়েছে এক অনুসারীর মাথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সে মাথায় ভালবাসার হাত রাখলেন। বাঙালিরা ৫২ বছর বয়স্ক এই রাজনীতিবিদকে তাদের জাতির জনক হিসেবে সম্মান করে। শেখ মুজিব ১৯৪০-এর দশকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মুসলিম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন। এরপর পাকিস্তানে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করার পর বাংলার বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবী জানায়। এ বিষয়ে কোন সমঝোতায় পৌঁছান সম্ভব হয়নি। উল্টো পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান সৈন্যদেরকে বাংলা আক্রমণ করতে বলে, শেখ মুজিবকে বন্দী করা হয়। এরপরে নয় মাসব্যাপী যে গণহত্যা চলে সে সময় দেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ভূমিকা পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।রাজধানী ঢাকা থেকে পূর্ব দিকে যাওয়ার পথেই বাংলাদেশের রূপ দেখলাম। ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক স্থানেই বিশাল এলাকা জুড়ে সরষের চাষ লক্ষ্য করা যায়। এবারের যাত্রাপথে সেই দিগন্ত বিস্তৃত সরষের ক্ষেত আবারও নজর কাড়লো। এই অঞ্চল এক সময় ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত বঙ্গ প্রদেশের এক বিরাট অংশ গঠন করে ছিল। প্রায় পুরো অঞ্চলটাই সমতল এবং উর্বর, মোট আয়তন ৫৫,০০০ বর্গমাইল। মৌসুম এলে বন্যার নোংরা পানিতে এর অনেকটাই ডুবে যায়। পাঁচটি বড় বড় নদী ও তাদের শাখাপ্রশাখার কারণেই এখানে প্রায় নিয়মিত বন্যা হয়।

ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে মেঘনার তীরে পৌঁছলাম। এখানে ফেরী পার হতে হবে। এর আগেও দুটি ফেরী পার হতে হয়েছে। এই মেঘনা বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যে অনন্য, আশপাশের মানুষের উপর এর প্রভাবও লক্ষ্য করার মতো। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলিত স্রোত মেঘনা নামে পরিচিত। মেঘনার মাধ্যমেই ঐ দুই নদী বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে।

নদী তীরে বিভিন্ন রকমের কাজ চলছে। এক মহিলা হাটু পানিতে দাঁড়িয়ে তার বাচ্চাকে গোসল করাচ্ছে, ঠাণ্ডা পানির প্রভাবে নাকি বাচ্চার কালা জ্বর কেটে যাবে। এক ধারে জেলেরা তাদের জাল গুটিয়ে আনার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছে। এত ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যেও মুখে গান লেগে আছে। আরেকটু গভীর পানিতে কেউ একজন নিজের ষাঁড়টিকে ঘষে-মেজে গোসল করাচ্ছে। ষাঁড়ের মধ্যে কোন অবাধ্যতা নেই, নিজেকে সঁপে দিয়েছে যেন।

বাংলাদেশে নদীপথের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৫,০০০ মাইল। এই সুদীর্ঘ পথ নির্মাণকারী নদীগুলোতে নৌকারও অভাব নেই। এর মধ্যে মেঘনাকে আবার ব্যস্ততম নদীগুলোর কাতারে ফেলা যায়। আমার সামনে দিয়েই শয়ে শয়ে সাম্পান আকৃতির নৌকা আর বজরা চলে গেল। এই নৌকা আর বজরাগুলোতে আবার বাঁশের বেড়া দেয়া আছে। সকালের মৃদু আলোর ছটায় বাঁশগুলোকে সোনালী দেখাচ্ছিল।

একসময় ঐ পার থেকে ফেরী এসে পৌঁছুল। থেমে যাওয়ার আগে এপারের মাটিতে ধাক্কা খেল। ফেরী থেকে নামার জন্য একটা কাঠের তক্তা বসানো হচ্ছিল। এর মধ্যেই এপারের লোকগুলো- যারা পার হওয়ার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল- হুড়মুড় করে ফেরীর কাছে চলে এল। ফেরী থেকে সব যানবাহন নামানো হচ্ছে এমন সময় এক ট্রাক চালক ঝামেলা বাঁধিয়ে বসলেন। তিনি পথ আটকে ফেরীঘাটের এক ডাবওয়ালার কাছ থেকে ডাব কেনা শুরু করে দিলেন। পেছনের হর্ন আর চিৎকার-চেঁচামেচি অগ্রাহ্য করেই তিনি ধীরে-সুস্থে ডাবের পানিটুকু শেষ করলেন। তারপর পেছনে তাকিয়ে এমন একটা ভাব ধরলেন যেন তিনি এই মাত্র সবার কথা শুনতে পেয়েছেন। তার মাথা নিচু করার ভঙ্গি দেখে অন্তত তাই মনে হল। অবশেষে ট্রাকে উঠে আবার চালাতে শুরু করলেন।

আমি ছিলাম শেষ ব্যক্তি। এরই মধ্যে ফেরীতে তার সাধ্যের অতিরিক্ত যানবাহন উঠে গেছে। আমার গাড়ি রাখার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা আছে বলে মনে হলো না। কিন্তু ফেরীঘাটের এক লোক এই বলে আস্বস্ত করলো যে, গত কয়েক বছরের মধ্যে এই ফেরী থেকে কোন গাড়ি হারায়নি। অগত্যা যাত্রা শুরু করলাম। খুব পুরনো ইঞ্জিন আমাদের ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে চললো। এই ধাক্কাতেও নদীতে কম ঢেউ উঠেনি।

পার হওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, এখানকার অধিকাংশ ছোট আকারের নৌকাতেই কর্মচারী দুইজন। একজন বৃদ্ধ লোক আর একটি ছোট ছেলে। বৃদ্ধ লোকটি সাধারণত ছাতার নিচে বসে থেকে সবকিছু পরিচালনা করে। পরবর্তীতে আমি এমনই এক বৃদ্ধের সাথে কথা বলি। তিনি বললেন,

"আমি এতোই বৃদ্ধ যে, বৈঠা চালাতে পারি না, দাঁড় বাইতে পারি না, এমনকি পালও লাগাতে পারি না। কিন্তু এই ছেলে- আমার বড় ছেলের ছেলে- এখনও শক্ত-সমর্থ আছে। যুদ্ধে পাক সেনারা তার বাবাকে মেরে ফেলেছে। সে আমার সাথে থেকে কাজ শিখে। একদিন এই নৌকা তার হবে। তাই আমি তাকে কাজ শেখাই আর নিজে কিছুটা বিশ্রাম করি।"

বাঙালি পুরুষেরা সাধারণত একটু খাটো হয়, চামড়ার রং খানিকটা কালো। আকারে ছোট হলে কি হবে, একেকজন দেও-দানোর সমান কাজ করতে পারে। এদের কায়িক শ্রম দেখে বিস্মিতই হতে হয়। একজন রিকশাওয়ালা সর্বোচ্চ চারজনকে নিয়ে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় রিকশা চালিয়ে যেতে পারে। ঘামে তাদের পুরো শরীর ভিজে যায়, তারপরও পা থামে না। শ্রমিকেরা দিনে ১২ ঘণ্টা একটানা কাজ করে যেতে পারে। দালান শ্রমিকেরা মাথায় করে ইট ও অন্যান্য সামগ্রী বয়ে বেড়ায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, তাদের কাজ আর শেষ হয় না। পাটকলে স্বয়ংক্রিয় তাঁতগুলো একটানা শব্দ করে যায়। এই শব্দে পাটকলের সব শ্রমিকেরই কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকে কানের এই ক্ষতি স্বীকার করেও এসব পাটকলে সারা জীবন কাজ করে যায়।

এদেশের অধিকাংশ মানুষই কৃষক। কৃষকেরাও কম পরীশ্রম করে না। সারাদিন উবু হয়ে ফসল বুনে। হাল দেয়ার পর ক্ষেত ভেজা থাকে। এই ভেজা ক্ষেতেই তাদের সারাদিন কেটে যায়। এত পরীশ্রম করেও তারা সর্বোচ্চ নিজের ও নিজ পরিবারের অন্যান্যদের জন্য আহারের সংস্থান করতে পারে।

এমনকি সবচেয়ে অনুকূল সময়েও বাঙালিদের জীবন কষ্টে কাটে। মানুষের মাথাপিছু আয় বছরে মাত্র ৮০ মার্কিন ডলার। বর্তমানে অবস্থা তো আরও খারাপ। তবে অবস্থা খারাপ হলেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার পর বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে তার পথ বেছে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। আর এখন তাদের জন্য বেছে নেয়ার মত পথ একটিই আছে, সে পথ উত্থানের পথ।

যুদ্ধের ডামাডোলে দেউলিয়া জাতি

স্বাধীনতার প্রথম কয়েক মাস বাংলাদেশকে মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির ঝক্কি সামলাতে হয়েছে। কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। যে অর্থনীতির জাতীয় প্রগতিকে ত্বরান্বিত করার কথা সেই অর্থনীতিই যেন দেশকে শূলে চড়িয়েছে। যুদ্ধে কয়েক ডজন পাটকল এবং অন্যান্য কারখানা ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিলেটের চা-বাগানের ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশী। এই বাগান থেকে বছরে ৬৮ মিলিয়ন পাউন্ড চা তৈরী হতো। এই পুরো ব্যবসাটাই ধ্বসে গেছে।

যুদ্ধের অগ্রবাহিনী: ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অগ্রবাহিনী গঠন করেছে জেলেরা। ছবিতে জেলেরা মেঘনা নদীতে মাছ ধরছে। সাধারণত গ্রামের বাজারে মাছ, সব্জি ও চালের আধিক্য থাকে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কৃষকেরা অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। তাই আপাতত কিছুদিন বাংলাদেশকে তার ৭৫ মিলিয়ন মানুষের জন্য খাদ্য আমদানি করতে হবে।যুদ্ধশেষে দেশের বৈদেশিক এক্সচেঞ্জে অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫০০,০০০ মার্কিন ডলার। এ অঞ্চলের সব বড় বড় ব্যবসার মালিকই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীরা। যুদ্ধের ফলাফল বুঝতে পেরে তারা আগেভাগেই নগদ অর্থের সিংহভাগ পাকিস্তানে সরিয়ে নিয়েছে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার বেশ ক'বছর আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বুঝতে পারছিল যে, তারা ভয়ানক অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। যেমন, পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ের অর্ধেকেরও বেশী আসতো পূর্ব পাকিস্তানের পাট এবং অন্যান্য পণ্য থেকে। অথচ দেশের মোট জনসংখ্যার তিন পঞ্চমাংশ পূর্ব পাকিস্তানে বাস করা সত্ত্বেও এই অংশের জন্য জাতীয় বাজেটের শতকরা মাত্র ৪০ ভাগ বরাদ্দ থাকতো।

এস এ করিম বলেছেন, "নিকট ভবিষ্যতে আমাদের পক্ষে জীবনযাত্রার উচ্চ মানে পৌঁছুনো অসম্ভব। কারণ জনসংখ্যার তুলনায় এদেশের আয়তন খুব কম। কিন্তু একটি গ্রহণযোগ্য মানে পৌঁছুতে আমাদের খুব বেশী সময় লাগার কোন কারণই নেই।"

বাংলাদেশ অচিরেই ভারতের সাথে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা লাভজনক ব্যবসা আবার শুরু করতে যাচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলোকে পুনরায় দাঁড় করাতে পারলেই রপ্তানি আয় বাড়তে শুরু করবে। এরই মধ্যে নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল ৩০,০০০ শ্রমিক নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এখানে পাটের আঁশ থেকে বার্ল্যাপ তৈরী করা হয়। বার্ল্যাপই পাট থেকে তৈরী প্রধান পণ্য।

সীমিত আয়ে বাধ্যতামূলক কৃচ্ছ্রসাধন

জনাব করিম নবগঠিত সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক সচিব হিসেবে কাজ করছেন। অন্য সব বাঙালির মতই তার মাসিক বেতন মাত্র ২,০০০ টাকা, অর্থাৎ প্রায় ২৭৫ মার্কিন ডলার। তার অফিসের দরজায় পর্দার পরিবর্তে কম্বলের মত এক টুকরো কাপড় ঝোলানো। ভেতরে একটি সিলিং ফ্যান ঘুরছে। (এদেশের প্রায় সব সরকারী অফিসেই সিলিং ফ্যান আছে। এজন্য বাংলাদেশের সচিবালয়ে বোধহয় পেপারওয়েটের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই।) আর ঘরের একটিমাত্র বৈদ্যুতিক বাল্ব খুব ক্ষীণ কমলা রঙের আলো ছড়াচ্ছে।

স্বাধীনতার আগে জনাব করিম যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানী দূতাবাসের কর্মকর্তা হিসেবে কিছুদিন ওয়াশিংটনে ছিলেন। আমি বললাম তার এক বন্ধু আমার মাধ্যমে তার জন্য একটি উপহার পাঠিয়েছেন। উপহারটি মূলত তার ছোট্ট ছেলের জন্য। ওয়াশিংটনেই তার ছেলের জন্ম হয়েছিল। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর থেকেই সে ওয়াশিংটনের একটি জিনিস পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।

তিনি হেসে আমার কাছ থেকে উপহারটি নিলেন: দুই বোতল "পিনাট বাটার"। এক বোতল ক্রাঞ্চি আর অন্য বোতল মসৃণ।
আনন্দের হট্টগোল: একজন মাত্র ট্রাফিক পুলিশের বাঁশির শব্দ ছাপিয়ে উঠছে রিকশার বেল ও গাড়ির হর্নের একটানা শব্দ। ছবিটি রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম বাজার এলাকা নওয়াবপুর রোড থেকে তোলা। ট্রাফিক পুলিশের সাদা পোশাক আর ইংরেজি ট্রাফিক চিহ্ন ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনকেই নির্দেশ করছে। গত ২৫ বছরের পশ্চিম পাকিস্তানী শাসনের চিহ্ন খুব অল্পই টিকে আছে। ১৬ই ডিসেম্বর এদেশের স্কুল ও রাস্তা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক ও দেশীয় বিহারীদের ভাষা উর্দু উঠে গেছে। ১৬ই ডিসেম্বর এদেশের বিজয় দিবস।
অপরদিকে দেশের দুই বড় সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম ও চালনায় উপহার হিসেবে একের পর এক শিপমেন্ট আসছিলো। খাদ্যশস্য ও অন্যান্য খাবারে গুদামগুলো ভরে যাচ্ছিলো। রাস্তায় যানজট বেড়ে গিয়েছিল। বন্দর ও খাবার বণ্টনের স্থানগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত যান চলাচলের কারণেই এই যানজটের সৃষ্টি হয়েছিলো। বাংলাদেশে তখন প্রায় এক মিলিয়ন টন খাদ্যদ্রব্য জমা ছিল। পরিস্থিতি বিচার করে টনি হেগেন তাই বলতে পেরেছিলেন, যুদ্ধের পর তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্টি হওয়া সংকট কেটে গেছে।

জ্বালানি সংকট: এক মজুর ভীড়ের মধ্যে শুকনো কাঠ নিয়ে যাচ্ছে।১৯৭২ এর বসন্ত পর্যন্ত হেগেনই বাংলাদেশে জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মসূচীর প্রধান ছিলেন। খানিকটা খাটো ও মোটা করে, হাতে সবসময় চুরুট ধরানো থাকতো। তিনি জাতিতে সুইস। স্থূল কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন, ক্ষুধার্তদের খাদ্য দানে কোন রকম বিলম্ব তার সহ্য হয় না। এ বছরের মার্চে বাংলাদেশে খাদ্যের মজুত ছিল সর্বনিম্ন। এর আগের কয়েক দশকেও কোনদিন এমন অবস্থা হয়নি। সেই সংকটপূর্ণ অবস্থায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, "দেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে।"

তার এই ঘোষণায় আশাতীত সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। এক মাসেরও কম সময়ে অবস্থা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে স্বয়ং হেগেনই বলেছেন, "আমাদের এখন যে পরিমাণ খাদ্য মজুত আছে তা দিয়ে আগামী পাঁচ-ছয় মাস স্বচ্ছন্দে চলে যাবে। এই বছরটা কোনভাবে পার করতে পারলে, আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে অবস্থা অনেক ভাল হবে।" তার ঢাকার অফিসে বসে আমি এই কথাগুলোই শুনলাম।

কিন্তু হেগেন এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, কেবল ধনী দেশের উদ্বৃত্ত খাবার গরীব দেশে স্থানান্তর করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, "আমরা যদি আসলেই এই জাতিকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করতে চাই, তাহলে প্রথমেই দানের প্রথাগত ধারণা ত্যাগ করতে হবে। এখানে নগদ অর্থের প্রয়োজনীয়তা যত বেশী কম্বল বা শিশু খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা তত বেশী না।"

এই কথার মাধ্যমে তিনি অবশ্যই বোঝাতে চেয়েছেন, ধ্বংস হয়ে যাওয়া সেতু পালং শাক দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা যাবে না। কিংবা আরামদায়ক পশমি কাপড়ের মজুত দিয়ে দেশের মুদ্রার মান ফিরিয়ে আনা যাবে না। যুদ্ধের আগে এখানকার অর্থনীতি যেমন ছিল বর্তমানে আবার সে অবস্থায় ফিরে যেতে সরকারী হিসেব মতে প্রায় ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন।

এ বছর জাতিসংঘ ছাড়া বাংলাদেশে ৫০টিরও বেশী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করেছে। সবাই হয়তো একসাথে করেনি, এক সংস্থা এক সময়ে তো অন্য সংস্থা অন্য সময়ে। কলকাতার বিখ্যাত মাদার তেরেসা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। "আংকল এরিক্‌স চিলড্রেন্‌স হেল্প" এর পক্ষ থেকে এল ই ওয়ালহেগেন-ও এসেছিলেন। রাশিয়ানরা বিশাল বিশাল হেলিকপ্টারে করে এসেছে, লালাভ চেহারার নিউজিল্যান্ডীয়রা সি-১৩০ এ করে চলে এসেছে। এই সি-১৩০ তাদের সরকারের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া, বিমানের ক্রুরা সব খাকি শর্টস পরা। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট সার্বভৌম ভূখণ্ড মাল্টাও একটি বিমান সরবরাহ করেছে। মাল্টা মূলত রোমভিত্তিক "সোভারেন মিলিটারি অ্যান্ড হসপিট্যালার অর্ডার" হিসেবে টিকে আছে।

নৃশংসতার ছাপ এখনও মুছে যায়নি: বাঙালি রমণীদের চোখ থেকে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ বাঙালিদের চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য পাকিস্তানীরা আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী নেতৃবৃন্দ ও হিন্দু সম্প্রদায়। কারণ এদেরকেই তারা স্বাধীনতার ইন্ধনদাতা মনে করতো। শাখারীপট্টির হিন্দু কলোনির ৩০,০০০ অধিবাসীর মধ্যে ৮,০০০ ই মারা যায়। কলোনীর এই মহিলাটি কলসী কাঁখে পানি আনতে যাচ্ছে। সেও জীবিতদের একজন।কেয়ার (CARE) যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কয়েক মিলিয়ন বাড়িঘরকে নতুন বাড়িঘর দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছে। পুনর্বাসনের জন্য তারা নতুন বাড়িঘর নির্মাণ করেছে। রেড ক্রসের সাথে সংযুক্ত মেডিক্যাল টিমগুলো অসুস্থদের সেবা করে যাচ্ছে। কিন্তু, সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের নীল-সাদা এমব্লেম আশার প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছে। ৬০০-রও বেশী ট্রাক আর দুই ডজন "মিনি-বাকার" এর গায়ে শোভা পাচ্ছে জাতিসংঘের এই প্রতীক। এই মিনি-বাকারগুলোর ধারণক্ষমতা ৩,১০০ টন। এগুলো নদীপথে পরিবহনের জন্য নৌকায় খাদ্য ও মালামাল সরবরাহ করে।

এক ইঞ্জিনের ছোটখাট বিমানেও জাতিসংঘের প্রতীক আঁকা আছে। সেদিন বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনের জন্য ঢাকায় জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষ ও সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে থেকে আমিও এরকম একটা বিমান দেখলাম।

বাংলা ১৩৭৯ সাল শুরু হয়েছে। নববর্ষকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য মন্দ্রস্বর গাওয়া হলো, দুই শাশ্বত আনন্দকে বরণ করে নিল সবাই। এ এমন এক আনন্দ, যুদ্ধ বা ক্ষুধা কোনকিছুই যার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। বৃষ্টি ও ভালোবাসার গান গাওয়া হলো এভাবে, "The dark clouds of the monsoon are like your dark hair falling."

সারা দিনে অনেক ধরণের গান শোনা হলো, অনেকগুলো সঙ্গীতানুষ্ঠানই উপভোগ করলাম। পানির স্তুতি বর্ণনা করে গাওয়া একটি গান উল্লেখ করার মতো, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাওয়া হয়েছিল। গানের কথা অনেকটা এরকম ছিল, "of the rivers and the rains and the floods that nourish the soil."

মৌসুমী বৃষ্টিতে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলই বিশাল হ্রদে পরিণত হয়। বন্যার পানিতে মাটি আরও উর্বর হয়ে উঠে। বন্যা শেষে জেগে ওঠা মাটি একটি নতুন ঋতুর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকে। এই দেশে চাষ করার মতো মোট ২৬ মিলিয়ন একর জমি আছে। এর মধ্যে ২২ মিলিয়ন একরেই ধান চাষ করা হয়। তিন বছর মেয়াদী চাষে এদেশে মোট ১১ মিলিয়ন টন ফসল উৎপাদিত হয়। কিন্তু ৭৫ মিলিয়ন লোকের আহার সংস্থানের জন্য ১৩ মিলিয়ন টন খাদ্য প্রয়োজন। এখনও তাই দুই মিলিয়ন টন ঘাটতি রয়েছে।
নৃশংসতার ছাপ এখনও মুছে যায়নি: লোকসংস্কৃতিতে। রিকশার সিটে আঁকা ছবিতে এখনও ফুটে উঠছে সেই বর্বরতা। পাকিস্তানীরা হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণকে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মে সবচেয়ে বড় অসম্মান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৩ বছর বয়সী এক মেয়েকে পাকিস্তানীরা কয়েক মাস সেনা ক্যাম্পে বন্দী করে রাখে। যুদ্ধ শেষে মেয়েটির বাবা তাকে এক নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে তার গর্ভপাত ঘটানোর পর তার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এখন সে কারিগরি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এদেশের অধিকাংশ নারীই যেখানে ঘরের কাজ করে সেখানে সে কাজ শিখে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।

বৃদ্ধ বয়সে নিশ্চয়তার আশায় অধিক সন্তান গ্রহণ

জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে প্রতি ৩০ বছরে এদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তাই সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার ধারণা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য একটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। বর্তমানে ঢাকায় জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের যে অশিক্ষিত কৃষক মৌলিক চাহিদা থেকেই বঞ্চিত, তার পক্ষে এটা মেনে নেয়া খুব কঠিন। গড়পড়তা বাঙালিদের অবস্থাও তাই।

"এখানে সবাই অর্থনৈতিক কারণেই বেশী সন্তান চায়, অন্তত অর্থনৈতিক কারণকে অধিক সন্তান গ্রহণের একটি প্রধান কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।"- ঢাকার কলেরা গবেষণা কেন্দ্রে কর্মরত "ইউনাইটেড স্টেট্‌স পাবলিক হেল্‌থ সার্ভিস"-এর এক এপিডেমিওলজি বিশেষজ্ঞ এভাবেই কথাগুলো বললেন। আরেকটু ভেঙে বললে বিষয়টা এরকম দাঁড়ায়,

"এদেশের মানুষেরা চায়, তারা বুড়ো হয়ে গেলে তাদের পুত্ররাই তাদের দেখাশোনা করবে। কিন্তু পুত্র সন্তান হবার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগ। আর কারও যদি পুত্র সন্তান হয়ও, তারপরও সে পুত্রের সাবালক হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগ। সুতরাং হিসাব বলছে, শেষ বয়স পর্যন্ত অন্তত দুইটি পুত্র সন্তানের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার জন্য তাদের অন্তত আটটি সন্তান নিতে হয়।"

autoএই সহজ সরল মুসলিমেরা: যুদ্ধের ভীতি থেকে বাঁচতে গ্রামে চলে গিয়েছিল। এই সময়ে ঢাকা শহরে লুটপাট চলেছে। যুদ্ধ শেষে তারা আবার তাদের শহরে ফিরে এসেছে। ফিরে আসার পরপরই তাদের ঘরে নতুন বউ এসেছে। আলতোভাবে থুতনি স্পর্শ করে নতুন বউ দেখছে একজন, বরণ করে নিচ্ছে সবাই। পারিবারিকভাবে বিয়ের ব্যবস্থা করার চিরন্তন প্রথা ভেঙে এই বিয়ে হচ্ছে। কলকাতায় গিয়ে ছেলেটি মেয়েটিকে দেখে, সেখানেই প্রেম, ফিরে এসে বিয়ে। কলকাতা হচ্ছে ভারতীয় বাঙালিদের আবাসস্থল। ব্রিটিশ রাজত্বের সময় এই শহর ছিল বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী, সেই প্রদেশে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত ছিল।



কষ্টকর কাজের শেষে মধুর সঙ্গীত

বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশী মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করে। কিন্তু, সম্প্রতি গ্রাম থেকে অনেক পরিবার বড় বড় শহরগুলোতে চলে আসছে। এর মধ্যে ঢাকায় আসার হার সবচেয়ে বেশী।

ঢাকার স্থাপত্য কখনই এতো মনোমুগ্ধকর ছিল না যে, গ্রাম ছেড়ে মানুষ গণহারে এখানে আসতে শুরু করবে। আর এখনকার অবস্থাতো আরও খারাপ। বস্তিতে ভরা ঢাকা শহরের রূপ বর্তমানে মোটেই আকর্ষণ করার মত নয়। তারপরও এখানে সুখের অভাব নেই, এখানে যেন সুখের গুপ্তধন আছে। সেই গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া সোজা কথা নয়। সমুদ্র সৈকতে ঝিনুকের অক্ষত খোলস কুড়িয়ে পাওয়া যতটা কষ্টকর, ঢাকা শহরের এই গুপ্তধন খুঁজে পাওয়া যেন ততটাই কষ্টকর।

এলিফ্যান্ট রোডের এক বাদ্যযন্ত্র নির্মাতার উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। পুরো সকালটাই সেই কারিগরের দোকানে কাটিয়েছিলাম। আঠা ও ভাল কাঠের গন্ধে বাতাস ছিল ভারী। দুই মাস ধরে এই দোকানদার দুই তারের একটি ম্যান্ডোলিন বানাবার চেষ্টা করছেন- যার নাম "দোতারা"। এইমাত্র নির্মাণকাজ শেষ হল। দোতারা দিয়ে মধুর সুর বেরোনর পর তার সুখ যেন আর ধরে না। আনন্দের আতিশয্যে পুরো দুই ঘণ্টা খুশীর বাজনা বাজিয়ে চললেন।

পুরান ঢাকায়ও গিয়েছিলাম। ইসলামপুরের যানজট আর মানুষের ভিড়ের কথা আর কি বলব। প্রতিদিন যেন জট বেড়েই চলেছে। আমার আসলে প্রথমেই ভুল হয়েছিল, ইসলামপুর গিয়েছিলাম গাড়ি নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অসংখ্য রিকশা এসে আমাদের ছেঁকে ধরল। বের হওয়ারও উপায় নেই। বেকার বসে থেকে রিকশার বেলের শব্দ শুনতে হচ্ছিল। এক ঝাঁক লিলিপুট কোন দানবের উপর চড়াও হয়ে খেলাচ্ছলে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকলে যে অবস্থা হয়, অনেকটা সেরকম আর কি।

ঢাকা শহরে ৩০,০০০ এরও বেশী রিকশা ও পেডিক্যাব আছে। এগুলোর চালক অধিকাংশই তরুণ, বয়স ১৫ বা এর একটু বেশী হবে। এই ছোট্ট জীবনে তাদের যে পরিমাণ শারীরিক কষ্ট করতে হয়েছে, তাদের দ্বিগুণ বয়েসী লোকেরাও জীবনে এত কষ্ট করেনি। তাদেরকে খুব কমই হাসতে দেখা যায়। কারণ একটানা খাটুনির ছাপটা তাদের মুখমণ্ডলেই ফুটে উঠে।

অধিকাংশ রিকশা ও পেডিক্যাবেই রঙ-বেরঙের ছবি আঁকা থাকে, অনেক রকমের ছবি- গ্রামের দৃশ্য থেকে শুরু করে দুর্বোধ্য রূপকথার ছবি সবই দেখা যায়। কিন্তু সবচেয়ে বেশী ছবি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, স্বাধীনতার জন্য এই দেশকে যে কড়া মূল্য দিতে হয়েছে সর্বত্রই তার ছাপ। এরকমই একটি ছবিতে দেখলাম, এক মহিলাকে ধর্ষণ করছে পাকিস্তানী সৈন্যরা, পাশে এক লোককে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে- একই সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গণহত্যা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া ও সাধারণ মানুষের উপর বোমাবর্ষণের দৃশ্য।

বর্ষপঞ্জিতেও এ ধরণের অনেক ছবি দেখা যায়। সংবাদপত্রগুলো নিয়মিতই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার হতাহতের খবর ছাপিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে একজন উচ্চপদস্থ বিদেশী কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফরে আছেন, এটা প্রায় নিশ্চিত যে তাকে একটি গণকবর দেখতে নিয়ে যাওয়া হবে। গণকবরটি এখনও সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত আছে। বিদ্যালয়গুলোতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হচ্ছে- সবাই যার যার ছবিতে যুদ্ধকালীন নৃশংসতা ফুটিয়ে তুলছে। একের পর এক কবিতা রচিত হচ্ছে। কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে কেবল "এক সাগর রক্ত" আর "যন্ত্রণাক্লিষ্ট আর্তনাদ" এর কথা।

বাংলাদেশ তার অপরিমেয় ভোগান্তির স্মৃতি মুছে ফেলতে চায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক আমাকে বললেন, "কয়েক শতাব্দী ধরে বাঙালিরা আহত হয়ে আসছে, তাই আমরা কিছুক্ষণ আর্তনাদ করতেই পারি।"

এই নতুন জাতির এক সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, অনেক আগে এ স্থানে "বঙ্গ" নামে একটি রাজ্য ছিল। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে "বঙ্গ" শব্দটির উল্লেখ আছে। সেই রাজ্যের অধিবাসীরা ছিল খাটো, তাদের কোঁকড়া চুল ছিল। এই আদিবাসীদের সাথে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে আসা মঙ্গোলয়েড এবং উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা আর্যদের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। গঙ্গার স্রোত অনুসরণ করেই তারা বঙ্গে এসেছিল বলে ধারণা করা হয়।

মুসলিমদের বঙ্গ অধিকারের পরের ইতিহাস অপেক্ষাকৃত ভালভাবে জানা যায়। ১২০০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমরা বঙ্গ দখল করে নিয়েছিল। সেই সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই অঞ্চলের ইতিহাস হল ঝড়-ঝঞ্জা আর রক্তপাতের ইতিহাস। আজ বাঙালিরা হারানোর বেদনায় যেভাবে আর্তনাদ করছে, কয়েক শতাব্দী পূর্বে বিদ্রোহী বাঙালিদেরকে যখন হাতির পদতলে পিষ্ট করে মারা হয়েছিল তখনও বোধকরি তারা এভাবেই আর্তনাদ করেছিল।

autoআমরা সংখ্যায় কম ছিলাম: কিন্তু আমাদের চেতনায় ছিল স্বদেশ; মুক্তিবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করা যুবকেরা বলল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সচক্ষে তাদের অধ্যাপকদের নিহত হতে, তাদের ছাত্রাবাস তছনছ হতে এবং তাদের বইগুলো পুড়ে যেতে দেখেছে। তারা ভারতে পালিয়ে গেছে। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে এসে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে, সেতু ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করেছে, পাক-সেনাদের অ্যামবুশ করেছে। যুদ্ধ শেষে তারা আবার পড়াশোনা শুরু করেছে। কিন্তু চারিদিকে কেবল হতাশা, পাশ করা ছাত্রদের জন্য এই গ্রামপ্রধান দেশে যে পর্যাপ্ত চাকরির ব্যবস্থা নেই।

ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দুরা অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধা পেয়েছিল

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশরা এদেশে এসেছিল। তখন থেকেই তাদের দুই শত বছরের শোষণের সূচনা ঘটে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিজস্ব সেনা ও নৌ বাহিনী ছিল। সামরিক বাহিনীর সহায়তায় তাদের শোষণের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এই শোষণ সম্পর্কে অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ লেখক হোরাস ওয়ালপোল লিখেছেন,
"স্পেনীয়রা পেরুতে যা করেছিল এখানে আমরা তার চেয়েও বেশী করেছি। হত্যা, রাজাদের সিহাসনচ্যুত করা, লুণ্ঠন, জবরদখল- কোনকিছুই আমরা বাকি রাখিনি। বাংলার যে দুর্ভিক্ষে ৩০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল তা সম্বন্ধে যারা জানেন তাদের কেউ বোধকরি আমার এই কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের একপেশে আইনই কিন্তু সেই দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে কাজ করেছিল।"

ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দুরা ছিল সরকারী ব্যবস্থাপক ও খাজনা আদায়কারী, মুসলিমদের পেশা ছিল অপেক্ষাকৃত নিম্ন মানের। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীন হয় তখন স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল যে, দুই জাতির মধ্যে ঐক্যের কোন সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ এই পুরো অঞ্চল নিয়ে একটিমাত্র রাষ্ট্র গঠন করার কোন উপায় ছিল না। তাই ১৫ই আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারত ছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র আর পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ৬ নম্বরে।

দুটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলিমদের আলাদা করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মুসলিমরা এমন দুটি অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, যে দুটির মধ্যে দূরত্ব ১,০০০ মাইলেরও বেশী। অগত্যা বিশাল দূরত্বে অবস্থিত এই দুই অঞ্চল নিয়েই পাকিস্তান গঠিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের এই দুই অংশের মধ্যে দূরত্ব ছাড়াও অন্য পার্থক্য ছিল।

দুই অঞ্চলের মানুষের ভাষা ছিল আলাদা। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীরা ছিল অপেক্ষাকৃত লম্বা ও ফর্সা, পাঞ্জাবীরা যেমন হয়ে থাকে আর কি। তাদের অত্যন্ত কেতাদুরস্ত ভাবটা প্রকাশ পেত হাতের লাঠি ও হাঁটার ভঙ্গিতে; অনেকটা ইংল্যান্ডের স্যান্ডহার্স্ট শহরের অধিবাসীদের মত।

আবেগপ্রবণ বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষাকে জীবন দিয়ে ভালবাসতো। তারা নিজেদের মাতৃভূমিকে বলত "সোনার বাংলা"। এই নদীমাতৃক দেশের দিগন্তবিস্তৃত ধান ক্ষেত মুগ্ধ করত তাদের, বর্ষণমুখর দিনে চামেলির সুবাস পরিশুদ্ধ করত তাদের আত্মাকে।

আয়তনে পশ্চিম পাকিস্তান বড় হলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ বাস করত পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৪৮ সাল থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। অথচ এই বিভক্ত রাষ্ট্রের শতকরা পাঁচ ভাগেরও কম মানুষ উর্দুতে কথা বলত।

auto

ভোরবেলায় গানের পাখি: নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গেয়ে নতুন বাংলা বছরকে বরণ করে নিচ্ছে এক ছাত্রী। এবার ১৫ই এপ্রিল বর্ষবরণ পালিত হচ্ছে।

মুক্তির আশায় কারাগারে দিনযাপন

বাঙালিদের মধ্যে যারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের এই প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছিল তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান অন্যতম। বিদ্রোহের কারণে তাকে মোট ১৩ বছর বিভিন্ন কারাগারে বন্দী থাকতে হয়েছিল। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ফিরে এসে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন,
"আমার সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে... আমার সোনার বাংলা আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ... কারাগার কক্ষে প্রতিটি সেকেন্ড আমি মৃত্যুর প্রহর গুনতাম... আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু আমার মধ্যে এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না যে, বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি পাবে।"

যত দিন যেতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের শাসন ততই নিষ্ঠুর ও অসহনীয় হয়ে উঠে। রাজধানী থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট, সামরিক বাহিনীগুলোর সদর দপ্তর- সবই ছিল পশ্চিম অংশে।

সবচেয়ে বড় কথা, পূর্ব অংশের ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগেও পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা সাড়া দেয়নি। উদাহরণ হিসেবে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের কথা বলা যায়। ১৯৭০ এর নভেম্বরে বৃহস্পতিবারের এক রাতে এদেশে ভয়াবহ সাইক্লোন এবং উপকূলীয় ঝড় আঘাত হানে। একে আধুনিক যুগের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। ঘূর্ণিঝড়ে ৬০০,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এর আগে বাংলার এই অঞ্চলে এমন প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় খুব কমই দেখা গেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কারণ ও প্রভাব সম্পর্কে অনেক কিছুই স্পষ্ট করে বলা যায় না, বোঝা যায় না অনেক কিছুই। কিন্তু এই ঘূর্ণিঝড় যে স্বাধীনতার এক বিরাট চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই দুর্যোগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের কোন ভাবান্তর না দেখেই বাঙালিরা বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিল।

auto

নিরাশ্রয় আবাদভূমিতে আশ্রয় জোগায় ঢাকা: মৌসুমী বন্যার পানিতে আবাদভূমি ডুবে গেলেও ঢাকা তার সুউচ্চ দালানগুলোকে রক্ষা করে। বন্যার পানির স্তর তার নাগাল পায় না। প্রতি তিন মাসে এদেশের জনসংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ করে বাড়ছে। এই বর্ধিষ্ণু মানুষের প্রধান চাহিদাই চাষের জমি।

জনগণের অতিবিশ্বাসই মুজিবের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়

শেখ মুজিব রাগান্বিত স্বরেই তার অফিসে আমাকে এ কথাগুলো বলেছিলেন, "সবাই আমাদের ব্যবহার করে অর্থ কামিয়ে নিয়েছে- ব্রিটিশ, পশ্চিম পাকিস্তানী সবাই।" তিনি আরও বলেছিলেন, "তারা আমাদেরকে উপনিবেশ হিসেবে বিবেচনা করেছে এবং বাজার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা আমাদেরকে শোষণ করেছে, ব্রিটিশরা ২০০ বছর আর পশ্চিম পাকিস্তানীরা ২৪ বছর, কিন্তু দমিয়ে রাখতে পারেনি। আমরা ভুগেছি- আমার দেশের সবাই কষ্ট ভোগ করেছে- কিন্তু আমরা এখন মুক্ত, এবং আমি তোমাকে বলছি যে, বাংলাদেশের একটি ভবিষ্যৎ আছে। আমরা সবকিছু কাটিয়ে উঠব।"

প্রধানমন্ত্রী কাপে চা ঢাললেন, জুতো জোড়া খুলে বসলেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত আসছে, তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, নিত্যদিনের ব্যস্ততায় তার জীবন "কারাগারের থেকেও কঠিন" হয়ে পড়েছে। এরপর আমি ময়মনসিংহের সভায় যোগ দিয়েছিলাম কি-না জিজ্ঞেস করলেন; জানতে চাইলেন, তার উপর জনগণের অবিচল আস্থা লক্ষ্য করেছি কি-না। যখন বললাম, লক্ষ্য করেছি, তখন তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, "তাহলে তো তুমি জানই, কাজ চালিয়ে যাওয়াটা আমার জন্য কত জরুরী।"

সফল সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে জরুরী আইন জারি করা হয়েছিল। পরবর্তী ১২ বছরের নির্বাচনগুলো ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। অবশেষে ১৯৭০ সালে যখন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের জনগণ জাতীয় পরিষদের ৩১৩ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি-ই আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দেয়। আওয়ামী লীগ নিশ্চিত বিজয় অর্জন করে। সেই আওয়ামী লীগের প্রধান অবশ্যই শেখ মুজিবুর রহমান।

এহেন অবস্থায় সামরিক সরকার আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশন পিছিয়ে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গা হয়। মুজিব জনগণকে বলেন, "প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল।" ১৮ দিন পর ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায়। পরবর্তী নয় মাস বাংলাদেশে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে।

"আমরাই প্রথম পাকিস্তানী সেনা ট্যাংক থেকে গোলাটি ছিনিয়ে নিয়েছিলাম"- "দ্য পিপ্‌ল" এর সম্পাদক আবিদুর রহমান আমাকে বললেন। উল্লেখ্য এটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত তিনটি দৈনিক পত্রিকার একটি। তিনি আরও বললেন, "এটা সেই প্রথম রাত অর্থাৎ ২৫শে মার্চের ঘটনা। তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোন সংবাদ ছাপতে নিষেধ করেছিল, আমরা তা অমান্য করেছিলাম।" তিনি তার পত্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অফিস সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেননি। পাথরের টুকরোগুলো দিনের পর দিন সেভাবেই পড়ে ছিল। কর্কশ আর ভীতিকর শব্দের কাছে যখন মোরগের ডাকও ক্ষীণ মনে হচ্ছিল তখনও অফিসটিতে কোন পরিবর্তন আসেনি।

দেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে ভারতে বাংলাদেশী শরণার্থীর সংখ্যা দাড়ায় ১ কোটিতে। আর বাংলাদেশের ভিতর আরও ১ কোটি বাঙালি নিজ বাসভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়।

এর সাথে আরও একটি আন্দোলন চলছিল: হাজার হাজার তরুণ গোপন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভিড় করেছিল। সেখানে বাঙালিত্বের নম্রতা ঝেড়ে ফেলে তারা মারণাস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহার করতে শিখেছিল। শত্রুর হাত থেকে স্বদেশকে মুক্ত করতে তাদের খুব বেশী সময় লাগেনি। অনেকে তাদেরকে "নাইট্‌স অফ দ লং নাইফ" তথা নিমেষে শত্রুনিধনের বিশেষজ্ঞ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারেন।

auto

বোনের কোলে ভাই: গ্রামের এই ছোট্ট মেয়েটি তার ছোট ছোট ভাই-বোনের দেখাশোনা করে, কারণ তার মা রান্না ও সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকে। তার গলায় একটি তাবিজ ঝুলছে যাতে কোরানের আয়াত খচিত আছে। অনেকে রোগশোক থেকে বাঁচার জন্য তাবিজ ব্যবহার করে। বিয়ের পর এই মেয়েটি যদি বিধবা হয় বা তালাকের কারণে বাপের বাড়ি ফিরে আসে তখন ভাইয়েরাই তার দেখাশোনা করবে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিল

বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের ঠুনকো প্রতিরোধ পাকিস্তানী সামরিক হামলার মুখে খুব বেশী সুবিধা করতে পারেনি। ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত অবস্থা এমনই ছিল। ডিসেম্বরে ভারত যুদ্ধে যোগ দেয়। এরপর পাকিস্তানীদের বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করতে মাত্র ১৩ দিন লেগেছিল।

"ভারতীয় সেনাবাহিনী সাহায্য না করলে আমাদের এই কাজ করতে হয়ত আরও দুই বা তিন বছর লাগত, কিন্তু একদিন না একদিন আমরা অবশ্যই সফল হতাম।" মোহাম্মদ হাবিবুল আলম নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ২১ বছর বয়সী ছাত্র আমাকে এই কথাগুলোই বলল। ঘোড়ার নালের মত ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের জমকালো গোঁফটা তাকে বেশ মানিয়েছে। আমরা ঢাকাস্থ ইন্টার-কন্টিনেন্টাল হোটেলের চতুর্থ তলার একটি কক্ষে বসে আলাপ করছিলাম। উল্লেখ্য, মুক্তিবাহিনীতে থাকার সময় আলম এই হোটেলেই ২৮ পাউন্ড প্লাস্টিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।

"অনেক পাক সেনা মদ্যপান ও গুপ্তচরদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য এই হোটেলে আসত।" এটুকু বলার পর আলম তাদের সেই অভিযানের পরিকল্পনা হাতে-কলমে দেখাতে শুরু করল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম।

আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলাম এবং সামনের দরজা দিয়ে আবার প্রবেশ করলাম। লবিতে আসার পর ডেস্কের এক কর্মচারী আলমকে অভিবাদন জানাল। অভিবাদনে সাড়া দেয়ার পর সে বলল, "মানুষ যখন হোটেলে আসে তখন তাদের হাতে ব্যাগ থাকে। আমরা এই ব্যাগকেই কাজে লাগালাম- অর্থাৎ ব্যাগে করেই এই হোটেলে বিস্ফোরক আনা হয়েছিল।" তারপর আমাকে নিচতলার পুরুষ টয়লেটে নিয়ে গেল। টয়লেটের একটি লকারেই তারা বিস্ফোরকের প্যাকেট স্থাপন করেছিল। সে স্থানটিই সচক্ষে দেখলাম।

"বিস্ফোরণে এই পুরো জায়গাটাই উড়ে গিয়েছিল।" হাতের ইশারায় আলম বিস্ফোরণের ভঙ্গিটাও দেখিয়ে দিল। এরপর হলওয়ে পেরিয়ে আমরা কফির দোকানের দিকে গেলাম। এক কুলি দৌড়িয়ে এসে তার সাথে হাত মেলাল। সে আবার বলে চলল, "বোমাটি বিস্ফোরিত হওয়ার কথা ছিল ১৫ মিনিট পর। আমি তাই বেশ দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। হাতে একটি ক্যামেরা ছিল, বিস্ফোরণের ছবি তোলার জন্য।"

আমরা চা হাতে গল্প করছিলাম। এক ওয়েটার এসে আলমকে চিনতে পেরে বলল, টাকা লাগবে না। আমি আলমকে প্রশ্ন করলাম, "তুমি এই সবগুলো লোকের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলে, তারপরও ওরা এতো বন্ধুভাবাপন্ন কেন?" সে উত্তরে বলল, "কারণ ওরা সবাই মুক্তিবাহিনী ছিল।"

autoনিরাশার মাঝে দিনযাপন: ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক স্কুলের মাঠে তৈরী বিহারী ক্যাম্পে বসবাসকারী ১৮,০০০ বিহারীর জীবনে যেন আর কোন আশা নেই। খাদ্যস্বল্পতা, পানি দূষণ ও অসুস্থ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এখানকার প্রধান সমস্যা। কোন দেশই তাদের চায় না, আর বাঙালিরা তাদের চাকরি ও ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়েছে। সরকার প্রতিজ্ঞা করেছে, যারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব মেনে নেবে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু তিক্ততার অবসান ঘটেনি, তাই যারা এখনও বাঙালিদের রক্তে হাত রঞ্জিত করার মত মনোভাব পোষণ করে তাদের ভবিষ্যৎ খুবই অনিশ্চিত।

এখানে এমন তরুণ খুব কমই দেখেছি যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। আবদুল আলী নামে ১৬ বছরের এক কিশোরের সাথে পরিচয় হল, যুদ্ধে সে তার দুই পা-ই হারিয়েছে। আহমেদ খান নামে এক স্কুল শিক্ষককে দেখলাম। সে যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর একজন কমান্ডার ছিল, তার অধীনে ১০০০ মানুষ যুদ্ধ করেছিল।

সে-ই আমাকে বলল, "আমি আমার ছাত্রদেরকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি অ্যাকশনে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। তারা আমাদের বাবা-মা, ভাই-বোনদেরকে যে অত্যাচার করেছে; হ্যাঁ, বিশেষত বোনদের সাথে তারা যা করেছে তা দেখার পর, তাদের বিরুদ্ধে হাত তোলা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল না।"

বাংলার বোনদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেককেই সেনানিবাসে বন্দী করে রাখা হয়েছে, মাসের পর মাস তাদের উপর অত্যাচার চলেছে। এদের অনেকের বয়স ছিল মাত্র ১১ বা ১২। সরকারী পরিসংখ্যান মতে এদেশের ২ লক্ষ নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এই সংখ্যা কিছুটা অতিরঞ্জিতও হতে পারে, কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে, হাজার হাজার বাঙালি নারীকে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।

সরকারী আদেশের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত নারীদেরকে "বীরাঙ্গনা" উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। কিন্তু গর্ভবতী কিশোরীদেরকে তো এই বীরাঙ্গনা উপাধি রক্ষা করতে পারেনি। কঠোর সামাজিক বিধির কারণে কট্টর মুসলিম পরিবারগুলোতে তাদের জায়গা হয়নি। এদের অনেকেই নিজের চুল পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

"খুব কম মেয়েই তাদের এই সন্তান বাঁচিয়ে রাখতে চায়। এজন্য যারা গর্ভপাত করতে চেয়েছে তাদেরকে আমরা সাহায্য করেছি।" "কেন্দ্রীয় নারী পুনর্বাসন সংস্থা"-র সচিব সাহেরা আহমেদ আমাকে আরও বললেন, "এছাড়া দেশে বর্তমানে পাঁচ-ছয়টির মত আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে যারা এই নবজাতকদের লালন-পালনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে।"

এক সময় শেখ মুজিব দেশের সবার উদ্দেশ্যে একটি অনুরোধপত্র প্রকাশ করেছিলেন, এর মাধ্যমে তিনি তরুণদের অনুরোধ করেছিলেন এই বীরাঙ্গনাদেরকে বিয়ে করতে। অনুরোধপত্রটির ৯,০০০ জবাবও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু শেষে এসে সব ভেস্তে যায়। কারণ পুরুষদের প্রায় সবাই যৌতুক চাইছিল। একজন একটি সম্পূর্ণ নতুন গাড়ির দাবী জানিয়েছিল, আরেকজন নিজের কবিতা প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের যে টাকা দিতে হয়, তা দাবী করে বসেছিল।

autoযুদ্ধ এদের অলস করেছে: কর্ণফুলী রেয়ন ও চন্দ্রঘোনার রাসায়নিক কারখানার শ্রমিকরা আবার কাজ শুরু করার অপেক্ষায় আছে। অধিকাংশ কারখানার মালিকই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীরা, তারা যুদ্ধ শেষে টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রহমান সব কারখানাকে জাতীয়করণ করেছেন। কিন্তু মূলধন ও কাঁচামালের অভাবে অনেকগুলোই কাজ শুরু করতে পারছে না।

বাংলাদেশে থাকার সময় আমি সবসময়ই চেষ্টা করেছি হতাশা ঝেড়ে ফেলতে। এদেশে যারা আসছেন তাদের সবাইকেই হতাশা ঘিরে ধরে, তাই ঝেড়ে ফেলার কাজটি আমার জন্য সহজ ছিল না। হতাশা থেকে বাঁচতেই সবুজ পাহাড়ের দেশে পালিয়ে গিয়েছিলাম। এই পাহাড়গুলোতে একসময় বাঘ, চিতা ও বুনো হাতির দল ঘুরে বেড়াতো।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান। এই অংশে ভারত ও বার্মা উভয় দেশের সাথেই এদেশের সীমান্ত আছে। ঢাকা থেকে ১৭৫ মাইল গাড়ি চালিয়ে তবেই এখানে এসে পৌঁছলাম। প্রায় এক দিন লেগেছে। কারণ রাস্তার লেন মাত্র একটি, সেই লেনেও আবার পথচারী ও গবাদি পশুর আনাগোনা। সূর্যাস্তের সময় বঙ্গোপসাগর যখন ছোপ ছোপ রক্তিম আভায় ছেয়ে গেল, তখনই আমরা পূর্বদিকের পাহাড় অভিমুখে যাত্রা করলাম।

রাস্তার দু পাশে ক্রান্তীয় গাছগাছালির ঝোপ, তার মাঝে থেকে থেকে কিছু সেগুন গাছ সবকিছু ছাড়িয়ে উঠে গেছে। কলা ও আম গাছগুলো ফলের ভারে ন্যুব্জ হয়ে আছে। এক জায়গায় দেখলাম, বনের গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে- এক বুড়ো হাতি মালিকের আদেশ মোতাবেক বিশাল বিশাল গাছের গুড়ি পার্শ্ববর্তী নদীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

autoস্বাভাবিক জীবনের গর্জন: আদমজী পাটকলের ১০০০ তাঁতকল একটানা গর্জন করে যাচ্ছে। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল। পৃথিবীর মোট পাটের অর্ধেকই এদেশে উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশ তাই বৈদেশিক মুদ্রার জন্য এর উপর খুব বেশী নির্ভর করে। অবশ্য সিনথেটিক্স-এর জয়জয়কার পাটের ভবিষ্যতের প্রতি হুমকিস্বরূপ।

পার্বত্য অঞ্চলের ২৫০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে কাপ্তাই হ্রদের অবস্থান। কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেয়ার মাধ্যমে এই বিশাল জলাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। এটিই দেশের প্রধান জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎস হিসেবে কাজ করে। জলাশয়টি একই সাথে বেশ মনোরম। এর আশেপাশে বেশ কিছু পার্বত্য গোষ্ঠী বাস করে যাদের জীবনধারা খুবই আদিম ধরণের। এখানে আসলে মনে হয় অতীতে চলে গেছি।

উদাহরণ হিসেবে মুরং গোষ্ঠীর কথা বলা যায়।
আমি এক বন্ধুকে নিয়ে ভাড়া করা নৌকায় চড়ে এখানে পৌঁছলাম। নৌকার ইঞ্জিনের শব্দ শুনে দুটি ছেলে পাহাড় বেয়ে দৌড়ে নিচে নামল। দুজনেরই পরনে ছিল বিশেষ ধরণের আঁটসাঁট পাজামা, কোমর থেকে শুরু করে হাটুর নিচ পর্যন্ত চলে গেছে। তাদের মুখে ছিল বালকসুলভ কৌতুহলের সচকিত হাসি, হাসতে না চাইতেই যেন এটুকু বেরিয়ে আসছে।

তারা আমাদেরকে নৌকা ভিড়াতে সাহায্য করল এবং পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। একে তো পাহাড়ী রাস্তা, তার উপর জট পাকানো বাঁশ আর বিভিন্ন ধরণের হালকা ও আগাছাসমৃদ্ধ গাছপালার বাহার। এরা দুই দিক থেকে সরু রাস্তাটিকে একেবারে জেঁকে ধরেছে। এসব দেখে বিশ্বাস করতে মোটেই কষ্ট হয় না যে, একসময় এই বন দুর্ভেদ্য ছিল এবং এখানটাতেই হিংস্র চিতারা শুয়ে শুয়ে হরিণের জন্য অপেক্ষা করত।

মুরং তামাক- আগুন থেকে এক অন্যরকম ধূয়া

অবশেষে একটি খোলা জায়গায় এসে পৌঁছলাম। পুরো স্থান জুড়ে অনেকগুলো বাঁশের তৈরী কুঁড়ে ঘর, এর সাথে আছে ছনের ঘর- যেগুলো খুটির উপর দাঁড়িয়ে আছে। এক লোককে দেখলাম ছায়ায় বসে পাইপের তামাক টানছে, আর একটু পরপরই থুত ফেলছে। তার পাশে বসে এক বৃদ্ধা পুরু লাঠি দিয়ে গমের আস্ত আস্ত দানা গুড়ো করছে। আমি লোকটির সাথে ছায়ায় বসলাম, তার কাছ থেকে এক পাইপ ভর্তি স্থানীয় তামাকও গ্রহণ করলাম। স্থানীয়ভাবে তৈরী এই তামাক পাতা আগুন পেলে খুব দ্রুত জ্বলে উঠে।

autoমুরংরা হ্রদে মাঝেমধ্যে মাছও ধরে। কৃষিকাজ করে সেই আদ্যিকালের জ্বালাও-পোড়াও পদ্ধতিতে। হ্যাঁ, কৃষি জমি তৈরীর জন্য তারা বনের অনেকটা অংশই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। পাহাড়ের গায়ে পোড়া ছাইভস্ম বৃষ্টির পানিতে ভিজে যে সমৃদ্ধ মাটি তৈরী করে তাতেই বীজ বুনে। আত্মায় বিশ্বাস করলেও তাদের কোন সুসংজ্ঞায়িত ধর্ম নেই। তারা বিশ্বাস করে, তাদের কাছে যে ঐশী গ্রন্থ আসার কথা ছিল, তা কলাপাতায় লেখা হয়েছিল। কলাপাতাগুলো গরু খেয়ে ফেলায় তাদের আর ধর্মগ্রন্থ পাওয়া হয়নি।

হৃদয় রামেজু রোয়াজা নামে ৪৫ বছর বয়সের এক সুদর্শন পুরুষ এসে নিজেকে গোষ্ঠীপ্রধান হিসেবে পরিচয় দিলেন। তিনিই বললেন, গত বছরের ঝামেলার সময় তার গোষ্ঠীর অনেকেই পাকিস্তানীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল। তার কথামতে তিনি পাহাড়েই ছিলেন, কিন্তু লুকিয়ে। এখন অন্যরাও ফিরে এসেছে। যারা বেঁচে আছে তারা আবার নতুন করে জীবন শুরু করেছে, কয়েক শ বছর ধরে তাদের জীবন যেভাবে চলছিল এখনও সেভাবেই চলছে।

বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকটি শহর এবং প্রায় ৭০,০০০ গ্রামের মধ্যে চট্টগ্রামের মত নির্মল পরিবেশ আর কোথাও নেই। এর পিছন দিকে পার্বত্যভূমি আর পায়ের কাছে বঙ্গোপসাগর। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটি ত্রিপুরা রাজ্যের অধীনে একটি সামান্য জেলে গ্রাম ছিল। সেই জেলে গ্রামকে আজও "কুয়াশা ও পানি থেকে উত্থিত সৌন্দর্য্য" হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ষোড়শ শতকে পর্তুগীজ নাবিকরা এখানে বানিজ্য করতে আসে এবং অঞ্চলটিকে "পোরতু গ্রাঁদি" (Porto Grande) ডাকা শুরু করে।

বর্তমানে চট্টগ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ এবং এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী ও ব্যস্ততম বন্দর হিসেবে বিবেচিত হয়। বিদেশ থেকে জাহাজযোগে এখানেই ত্রাণ সামগ্রী আসে। বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ব্যবস্থাপনাও এই শহরকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়।

এই বসন্তে চার্লস কাইজার আমাকে বললেন, "আমরা কেবল আগামী এক মাসেই এখানে ৩০০,০০০ টন খাদ্যশস্য আসবে বলে আশা করছি। সম্প্রতি মাত্র ৯ দিনে ১৮,০০০ টন ত্রাণ সামগ্রী বন্দরে নামিয়েছি। আমার তো মনে হয় এটা কোন না কোন রেকর্ড করে ফেলেছে।"

বিভিন্নভাবে সাহায্য আসছে

কাইজার চট্টগ্রামে কমর্রত জাতিসংঘের বন্দর কর্মকর্তা। তিনি তার সহকর্মীদের নিয়ে সপ্তাহে ৭ দিনই একটানা কাজ করে চলেছেন। যে বিপুল পরিমাণ খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী আসছে তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য এই একটানা খাটুনি ছাড়া কোন উপায় নেই। তিনিই আমাকে বললেন, "আমি এর আগেও বিপর্যস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরনের কাজ করেছি- যেমন ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র বা দক্ষিণ ভিয়েতনামে। কিন্তু কোথাও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি।"

ত্রাণ হিসেবে সব ধরণের জিনিসপত্রই আসছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মাছ ধরার জাল তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় ২,৮০৭ কার্টন নাইলনের সুতা। কিন্তু অনেক সময়ই বাঙালিদের জন্য অনুপযুক্ত জিনিসপত্র চলে আসছে। যেমন, স্কি করার পোশাক বা বৈদ্যুতিক কম্বল। অনেক সময় বন্দরে আসার আগেই ত্রাণসামগ্রী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দান হিসেবে আসা কিছু গুঁড়ো দুধ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেগুলো মানুষের হজমের জন্য উপযুক্ত নয়।

বেঁচে থাকার তাগিদে বাংলাদেশীরা এসব পাঁচমিশালী উপহারকেই আঁকড়ে ধরেছে। বৈদ্যুতিক কম্বল বা এ ধরণের কিছুই বাদ যায়নি।

পোতাশ্রয়ে ঝূকিপূর্ণ অবস্থার কারণে চট্টগ্রামের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এজন্য ত্রাণ সামগ্রী আনা কমিয়ে দিতে হয়েছে। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম ও চালনায় অন্তত ৩০টি জাহাজ সমুদ্রের একেবারে তলায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই জহাজগুলোই রাস্তা সংকুচিত করে দিয়েছে। অনেক জাহাজ মালিক এজন্য বন্দরের এক মাইল দূরেই থাকতে চান, বেশী কাছে আসতে চান না। জাহাজগুলোর ধ্বংসাবশেষই তাদের ভীতির কারণ।

বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘকে উদ্ধারকার্য শুরু করার অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু এর জন্য যে ৬০ লক্ষ ডলার দরকার তা জাতিসংঘের নেই। তাই উপায়ান্তর না দেখে এদেশের সরকার বন্দর পরিষ্কারের জন্য রাশিয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। বন্দরে তাই হরহামেশাই সোভিয়েত নৌবাহিনীর জাহাজ চোখে পড়ে।

বাংলাদেশের সব জায়গায়ই রুশদের দেখা যায়। ঢাকায় তাদের দূতাবাসে কর্মরত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশী। তাই মাঝেমধ্যেই গ্রামেগঞ্জে এমন অনেক সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কর্মীর দেখা মিলে, যারা গ্রামের মানুষের সাথে শুদ্ধ বাংলায় অনর্গল কথা বলতে পারে। ঢাকার টেলিভিশনে রাশিয়ায় নির্মীত প্রচুর চলচ্চিত্র দেখা যায়, আর এখানকার পত্রিকাগুলোও সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সোভিয়েত সংবাদ সংস্থা "তুস" কর্তৃক প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদনের সাহায্য নেয়।

তারপরও আমেরিকানদের প্রতি সাধারণ বাংলাদেশীদের এক অকপট মমত্ববোধ আছে। আমাকে অনেকেই বলেছে, "তোমাদের সরকার যদিও যুদ্ধে আমাদের পক্ষে অবস্থান নেয়নি, তারপরও আমরা জানি, তোমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আমাদের পক্ষেই ছিল।" আর যুদ্ধের পর মার্কিন সরকারের অবস্থানও এক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয়। যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে মোট ২৫০,০০০,০০০ ডলার মূল্যের ত্রাণ সামগ্রী প্রদান করেছে, যেখানে রাশিয়া দিয়েছে ৯৪,০০০,০০০ ডলার মূল্যের ত্রাণ সামগ্রী। ভারতের দেয়া ত্রাণ সামগ্রীর মোট আর্থিক মূল্য অবশ্য ২৮০,০০০,০০০ ডলার যা সবচেয়ে বেশী।

মুজিব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তার সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করবে এবং সংবিধানে চারটি মূলনীতির প্রতিফলন ঘটাবে- যেগুলো হচ্ছে, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। সংবিধানের খসড়া ইতিমধ্যেই তৈরী করা হয়ে গেছে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের সংসদীয় রূপ ভারতের মত করে তৈরী করার ব্যাপারেও মুজিব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে এরই মধ্যে কমনওয়েল্‌থের সদস্য করে নেয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী সবসময়ই ধর্মনিরপেক্ষতার উপর জোড় দেন। এভাবে জোড় দেয়ার মাধ্যমে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করতে চান। উল্লেখ্য, এদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৮ ভাগ হিন্দু এবং তারা যাতে সব ধরণের সরকারী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী বদ্ধপরিকর। বর্তমানে মন্ত্রীপরিষদের একজন সদস্য হিন্দু। বাকি তিনটি নীতির মধ্যে সমাজতন্ত্রের প্রতিফলন তিনি কিভাবে ঘটান, তার উপরই দেশের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে।

মুজিব যদিও দেশের অধিকাংশ বড় বড় শিল্প কারখানার জাতীয়করণ করতে চান, তথাপি আওয়ামী লীগ মূলত মধ্যবিত্ত। প্রগতিশীল বামপন্থীরা সমাজতন্ত্রের প্রতি আওয়ামী লীগের ভাবভঙ্গিকে বেশ সন্দেহের চোখে দেখছে। এর মধ্যে ছাত্র সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে।

"আওয়ামী লীগ প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় না।" ঢাকা থেকে প্রকাশিত সমালোচনামুখর ইংরেজি পত্রিকা "হলিডে"-র সম্পাদক ও মালিক এনায়েতুল্লাহ খান এভাবেই বললেন। তিনি আরও বললেন, "তারা অনেকগুলো কারখানার জাতীয়করণ করেছে এটা ঠিক, কিন্তু সেগুলো কিভাবে পরিচালনা করা হবে তা নিয়ে তাদের কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেই।"

autoইট ভাঙার কাজ: এদেশে কোন পাথর নেই, প্রাকৃতিক জ্বালানিও কম। তাই ইট তৈরী করার জন্য তেল আমদানী করতে হয়। এই ইট হাতে ভেঙেই রাস্তা ও দালানের কাজে লাগানো হয়। মির্জাপুরের কাছে এক শ্রমিক দৈনিক ৪০ সেন্টে কাজ করছে, এক যুদ্ধবিধ্বস্ত সেতুর পাশে।

সবাই সরকারের কর্মকাণ্ড গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে

খানের পত্রিকা সবসময়ই সরকারকে আঘাত করে। কিন্তু ঢাকার প্রেস ক্লাবে আমরা যখন আলোচনা করছিলাম তখন তিনি স্বীকার করলেন যে, দেশের এই ক্রান্তিকালে একমাত্র শেখ মুজিবই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেন, আর কেউ না। এছাড়া তিনি বলেছেন, সামাজিক সংস্কার বিষয়ে সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেগুলো রাখতে না পারলে বাংলাদেশে এক দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে।

এ সম্পর্কে তার কথা হল, "ভূমিহীন কৃষকেরা এখন তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন। শেখ মুজিব যেহেতু যুদ্ধের সময় সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, সেহেতু তিনি আর কখনই অস্ত্রের মুখে নতি স্বীকার করবেন না। উপরন্তু এখন তো বলা যায়, তার নিজেরই একটি অস্ত্র আছে।"

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র দেয়া হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে মুজিব সবাইকে অস্ত্র জমা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু অনেকেই সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। তাই অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকায় খুব বেশী না হলেও গ্রামাঞ্চলে এটি এক বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

"আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আগে এখানে আর কিছুই করা সম্ভব না।" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২৬ বছর বয়সী ছাত্র মাহবুবউল্লাহ এমনটি বলল। তার মুখে আরও শুনলাম, "আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি।"

এই ছাত্র তার নাম হিসেবে শুধু "মাহবুবউল্লাহ" শব্দটিই ব্যবহার করে। সে ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের এক মিছিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে সে বলল, "এর এক মাস পরই আমাকে বিমান বন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়। সামরিক আদালতে বিচারের পর ১৫ বার চাবুক মারা হয় এবং পরবর্তীতে ১ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।"

সেও বলল, বর্তমানে দেশ পরিচালনার জন্য শেখ মুজিবের চেয়ে উপযুক্ত আর কোন নেতা নেই। এখন ছাত্র না হলেও মাহবুবউল্লাহ অধিকাংশ সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটায়। বন্ধুদের সাথে রাজনীতি বিষয়ক আলাপ করেই তার দিন কেটে যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০,০০০ যার মধ্যে ৩,০০০ ছাত্রী রয়েছে। বর্তমানে এই সব শিক্ষার্থীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে রাজনীতি।

চিকিৎসাবিজ্ঞান ও আইন ছাড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও অনেকগুলো বিষয়ে পাঠদান করা হয়। এর মধ্যে বানিজ্য অনুষদ উল্লেখযোগ্য। কিছু সংশয়বাদী অবশ্য এ ধরণের পড়াশোনা অন্য চোখে দেখছেন:

এই সরকারের একজন মার্কিন উপদেষ্টা আমাকে বললেন, "এদেশের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নিয়ে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। আপনি যদি ঢাকার রাস্তায় পড়ে থাকা কোন কলার খোসায় পা দিয়ে পিছলে যান, তাহলে আপনাকে যারা সাহায্য করতে আসবে তাদের প্রতি তিনজনের মধ্যে দুইজনই দেখবেন বেকার অর্থনীতিবিদ। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে এদেশে বানিজ্য অনুষদের স্নাতকের তুলনায় রাস্তা পরিষ্কার করার লোক বেশী প্রয়োজন।"

তার উপর, যুদ্ধের পর ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য দায়িত্বশীল পদের জন্য প্রশিক্ষিত বাঙালির সংখ্যা ছিল খুব কম। কারণ, আগে এই অধিকাংশ কাজই পশ্চিম পাকিস্তানীরা করত, তারা না হলেও অনেক ক্ষেত্রে বিহারীরা করত।

autoঅচেনারাই এদের রক্ষা করছে: খুলনার এক শিশু ইউনিসেফ থেকে পাঠানো দানাদার সয়া দুধ খাচ্ছে। এই আমিষ সমৃদ্ধ খাবারটি অধিকাংশ সময়ই পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়, মাঝেমাঝে রুটির সাথে রান্না করেও খাওয়া হয়।

অভিশপ্ত বিহারীদের জীবনধারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে

বিহারীরা মুসলিম। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হিন্দু আধিপত্য থেকে বাঁচার জন্য তারা ভারত ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল। তারা উর্দূতে কথা বলে এবং অধিকাংশই বাঙালি জীবনাচারকে ঘৃণা করে। যুদ্ধের সময় তাদের অনেকেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রায় ১ লক্ষ বিহারীর অধিকাংশই বাংলাদেশে রয়ে গেছে। এরা বাঙালিদের নিষ্ঠুর প্রতিশোধের শিকার হচ্ছে। অনেকেই পুষ্টিহীনতা ও বিভিন্ন রোগশোকে মারা যাচ্ছে।

আমি ঢাকার উপশহর মোহাম্মদপুরে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রায় ৫টি ক্যাম্পে মোট ৩০,০০০ এরও বেশী বিহারী বাস করছে। ক্যাম্পগুলোর মধ্যে একটি, পূর্বে স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হত। ২ একর আয়তনের এই ক্যাম্পটিতেই ১৮,০০০ নারী-পুরুষ ও শিশু মানবেতর জীবন যাপন করছে। এই অন্ধকুঠুরীতে বসবাস যেন তাদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন।

আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ৩০০ তাবু সরবরাহ করেছে, যাদের ভাগ্য খুব ভাল তারাই কেবল তাবুগুলো পেয়েছে। অন্যদের অবস্থা আরও শোচনীয়। অনেকে কয়েকটি খুটির উপর প্লাস্টিক বা বার্ল্যাপ দিয়ে থাকার জায়গা করে নিয়েছে। অনেকে আবার ঢেউ তোলা টিন দিয়ে মোটামুটি আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করেছে।

ডঃ রেজা নামক এক কমবয়সী বিহারী চিকিৎসক আমাকে বলল, "আমরা যেকোন স্থানে যেতে রাজি আছি, কারণ কোনকিছুই এর থেকে খারাপ হতে পারে না।"

কিন্তু কেউই বিহারীদের নিতে রাজি হয়নি- এমনকি পাকিস্তানীরাও না। শেখ মুজিব বলেছেন, বিহারীরা চাইলে বাঙালি সমাজের সাথে মিশে যেতে পারে, এ ব্যাপারে তারা স্বাধীন। কিন্তু ডঃ রেজা এই কথাকে উপহাস করে বলল,

"আমরা এখানেই নিরাপদ নই, আর বাইরে কিভাবে নিরাপদ বোধ করব? আজ সকালেই তারা ক্যাম্পে ঢুকে জোর করে একটি মেয়েকে নিয়ে গেছে। ফিরিয়ে দেয়ার আগে প্রচণ্ড মারধোর করা হয়েছে। এ ধরণের অপহরণ সবসময়ই চলছে। আমি অবশ্যই আমার হাসপাতালে ফিরে যেতে চাই, কিন্তু ভয়ে যেতে পারছি না।"

তাই হাসপাতাল বাদ দিয়ে সে ক্যাম্পেই অসুস্থদের সেবার দায়িত্ব নিয়েছে, যদিও তার হাতে খুব বেশী ঔষধ ও চিকিৎসার অন্যান্য সরঞ্জাম নেই। এগুলো যথেষ্ট নয়, ক্যাম্পে মৃত্যুর হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৫০০ ক্যালরি খাবার পাচ্ছে। পুরো ক্যাম্পের একটি টয়লেটও ঠিক নেই। পানির একমাত্র উৎস দুটি পাম্প, যেগুলো দিয়ে এখন চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ে।

ক্যাম্পে ঘোরার সময় আমার পেছনে সবসময়ই বাচ্চাদের একটি ছোটখাট দল ছিল। বাচ্চাগুলোর ঘুমঘুম চোখে নিদারুণ কষ্টের ছাপ সুস্পষ্ট। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ক্ষুধার্তদের চোখ যেমন কাঁচের মত স্বচ্ছ দেখায়, অনেকটা সেরকম দেখাচ্ছিল।

এক প্রাক্তন "অপরাধী" গ্রাম মাতিয়ে রেখেছে

হতাশা থেকে বাঁচার জন্য আবারও ঘুরতে বের হলাম। এবারের গন্তব্য একটি গ্রাম, নাম বলিয়ারপুর, ঢাকা থেকে গাড়ি চালিয়ে যেতে ২০ মিনিট লাগে। গ্রামে মোট বাড়ির সংখ্যা ৬০০, সামান্য বেশীও হতে পারে। বন্যার পানি থেকে বাঁচার জন্য সবগুলো বাড়ি একটি উঁচু জমিতে তৈরী করা হয়েছে। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দূরত্ব খুব কম। বাড়িগুলোকে ঘিরে আছে ধান ও শাকসব্জির ক্ষেত।

বলিয়ারপুরের প্রায় সবাই কৃষক। আমি সেখানে গিয়েছিলাম সকালে। গিয়ে দেখি সবাই ক্ষেতে কাজ করছে। আবদুল খালেক অবশ্য কিছু করছিল না।

সে তার অতীত জীবন নিয়ে গর্ব করে বলল, "জীবনে অনেক অপরাধ করেছি- আহ, কে জানে কত জনের কত ক্ষতি করেছিলাম- কিন্তু সেসময় এমনকি পুলিশরাও আমাকে সম্মান করত। একবার তারা আমাকে আটক করতে এসেছিল। আটক না করে উল্টো পুরস্কৃত করল, হ্যাঁ, আমাকে একটা পদকও দেয়া হয়েছিল।"

গ্রামের যেখানেই গিয়েছি সেখানেই তাকে দেখে সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। তাকে দেখার পর রুটি তৈরী করতে থাকা মহিলাদের মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখলাম। গ্রামের মসজিদে জড়ো হওয়া ছোট ছোট মেয়েদের মুখেও সেই হাসি দেখলাম। তারা প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে কোরান পড়ার জন্য এই মসজিদে আসে।

autoক্ষুধার্তদের উচ্চ কলরব: অলিভ ও হাওয়ার্ড হক্‌সকে ঘিরে ধরেছে শিশু ও মায়েরা। ইউনিসেফের রেশন বিতরণ করছেন এই দুজন মিশনারি। এক মা শাড়ির আঁচলে রেশন নিচ্ছেন। এটি হচ্ছে এযাবৎকালে হাতে নেয়া সর্ববৃহৎ ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প। এরই মধ্যে ৭০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়ে গেছে। ৩০টি দেশ এবং ৫০টিরও বেশী বেসরকারি সংস্থা বাঙালিদেরকে গত দুই বছরের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও যুদ্ধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করছে।

ঐদিনই গ্রাম থেকে ফিরে জাতিসংঘের এক প্লেনে করে যশোর যাচ্ছিলাম। প্লেনে অনেক চেষ্টা করেছিলাম অসংখ্য গ্রামের মধ্য থেকে বলিয়ারপুর খুঁজে বের করতে। অবশ্যই পারিনি। এদেশের সব গ্রাম অনেকটা একই রকম, এগুলো যেন বিস্তীর্ণ ভূমিতে আটকে থাকা একেকটি পেরেক।

যশোর থেকে জিপে চড়ে খুলনা গেলাম। এই দুই স্থানের দূরত্ব ৪০ মাইল। গাড়ি চলার সড়কটি সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে গিয়ে শেষ হয়েছে। খুলনার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদী। ভৈরবের তীরেই এক স্থানে একটি সাদা রঙের বাড়ি দেখলাম, বাড়ির সাথে একটি সুদৃশ্য বারান্দাও রয়েছে। এই বাড়ি ঘিরেই এক বিশাল কম্পাউন্ড গড়ে উঠেছে যার মধ্যে আছে, একটি চ্যাপেল ও একটি স্কুল।

গত ২০ বছরের প্রায় পুরোটা সময় ধরেই হাওয়ার্ড এবং অলিভ হক্‌স এই বাড়িতে থাকেন। তারা "অ্যাসেম্বলিস অফ গড চার্চ" এর মিশনারি। দুজনেই বাংলা বলতে পারেন- দুষ্ট ছেলেরা যখন আম পাকল কি-না তা দেখার জন্য কম্পাউন্ডের দালান বেয়ে ওঠার চেষ্টা করে তখন তাদেরকে বেশ ধমকের সুরেই বাংলা বলতে দেখা যায়।

অন্যান্য সময়ে হাজার হাজার শিশুর কোলাহলে এই কম্পাউন্ড মুখর হয়ে উঠে, তারা রীতিমত আগ্রাসন চালায়। এদের সবাইকেই সুন্দরভাবে গ্রহণ করা হয়। সপ্তাহে দুই দিন হক্‌সরা শিশুদের মাঝে ইউনিসেফ থেকে আসা দানাদার সয়া-দুধ বিতরণ করেন। এটি খুব মিষ্টি, সুগন্ধী ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার। কোলের বাচ্চা আছে যেসব মায়ের তারা, গর্ভবতী মহিলা এবং ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা এই রেশন পেয়ে থাকে।

মিসেস হক্‌স আমাকে বললেন, "সকালেই তারা এসে পড়বে।" তিনি ও তার স্বামী আমাকে সেই রাত তাদের বাড়িতেই কাটিয়ে যেতে বললেন। খুলনায় আমার এক রাতই থাকার কথা। মিসেস হক্‌স আরও বললেন, "ভোরবেলায় আমাদের মোরগ ডেকে ওঠার আগেই দেখবেন তারা সবাই ঐখানে জড়ো হয়ে গেছে।"

সূর্য ওঠার আগেই সব রেশন শেষ হয়ে গেল

পরদিন সকাল চারটার মধ্যেই কম্পাউন্ডের সদর দরজার বাইরে প্রায় এক হাজার শিশু জড়ো হয়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু করল। ৩০ মিনিট পর সংখ্যাটি বেড়ে দ্বিগুণ হল। তাদের হাতে ছিল কৌটা, কড়াই, কাগজের কাপ, গ্লাস এবং আরও অনেক কিছু। যে যা পেয়েছে তা-ই নিয়ে এসেছে, সেটা রেশন রাখার মত যথেষ্ট বড় হলেই হল।

বিতরণ টেবিলের সামনে তারা খুব দ্রুত রেশন নিয়ে পরের জনের জন্য জায়গা করে দিচ্ছিল। সবার শেষে ৪ বছর বয়সের একটি মেয়ে আসল, অন্য কিছু না থাকায় নিজের জামাতেই রেশনটুকু নিয়ে চলে গেল। খুব ভোরেই বিতরণ শেষ হয়ে গিয়েছিল।

সূর্য কিন্তু দেরি করে ওঠেনি, এদেশের উদীয়মান সূর্য খুব কম সময়ই দিগ্‌বলয়ে পড়ে থাকতে চায়। দেখতে না দেখতেই রক্তাভ লাল রঙের পর্দা জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। তারপরই সে এল- পূর্ণ গোলকটি তার সম্পূর্ণ রূপ নিয়ে উদ্ভাসিত হল, সাদা আলোর ছটায় ভরিয়ে দিল আকাশটাকে।

autoবাংলার ঐতিহ্য, বাংলার ভবিষ্যৎ: বাংলার মাটি কৃষকের ডাকে সবসময়ই সাড়া দেয়, বলিয়ারপুরের কাছে এমনই এক কৃষককে দেখলাম। বাঙালিদের জীবন হাজারও সমস্যায় জর্জরিত। তারপরও স্বাধীনতার অবিশ্বাস্য প্রেরণাকে পুঁজি করে আশায় নতুন জীবনের বসতি গড়ে উঠছে।

(সমাপ্ত)

আগের পর্বগুলো: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | শেষ পর্ব


মন্তব্য

ইফতেখার এর ছবি

অমূল্য এই লেখাগুলো সচলে ই-বুক হিসেবে দেয়া যায় না?

ফারুক হাসান এর ছবি

শিক্ষানবিস, আপনাকে অভিনন্দন, এত বড় কাজটি দারুণভাবে শেষ করার জন্য।

চলুক

-----------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী,
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

তানভীর আহম্মেদ এর ছবি

যারা সচলায়তনের সদস্য না, তাদের পক্ষে যেহেতু লেখাটি প্রিয়তে নেওয়া সম্ভব না, তাই অমূল্য এই লেখাটি pdf ফাইল আকারে দেওয়া গেলে খুবই ভালো হতো। অনুবাদককে ধন্যবাদ।

তারেক অণু এর ছবি
শেহাব- এর ছবি

আমি এই সংখ্যাটি গত সপ্তাহে কিনলাম। শুভাশীষদার জন্য স্ক্যান করছিলাম। যাক আর লাগবে না।

Md Mushfiqul Alam এর ছবি

অসাধারন।

তাসনীম এর ছবি

লেখাটা ছড়িয়ে যাক সবখানে।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

অরিত্র অরিত্র এর ছবি

অনেক অনেক ভাল হয়েছে অনুবাদ।এই লেখা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক। হাততালি

এস. এম. এ হাবীব এর ছবি

চরম বাস্তব একটি অনুবাদ। এটি সংরক্ষণ করা উচিত।

পাঠক এর ছবি

অনেক ভালো কাজ করেলেন ভাই

সুমন  এর ছবি

অসাধারন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।