ছুঁতে না পারা সেই বোধগুলো

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি
লিখেছেন সুলতানা পারভীন শিমুল (তারিখ: রবি, ০৯/০৩/২০০৮ - ১২:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বড় ফুপি বারবার করে খবর পাঠাচ্ছেন, রিমিন যেন সিলেট থেকে একটু বেড়িয়ে আসে। এই সময়ে ঘুরে আসলে ওর একটু ভাল লাগত। উনি ভেবেছেন, রিমিন খুব খারাপ একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। উনি আসলে ভুল ভাবছেন। সবাই তাই ভাবে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। ও আবার তার পুরোনো লাইফে ফিরে এসেছে। শুধু দু একজন পরশ্রীকাতর মানুষ ছাড়া ওই বিশ্রী ব্যাপারটা আর কেউ মনে করিয়ে দেয় না। সেদিন ডিপার্টমেন্টের সলিল স্যার ওকে ডেকে অনেকক্ষন কথা বললেন ওর সাথে। ঘটনাটা ভুলে ও যে খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে, তার জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন।

সেদিনের কথা ভাবল ও। তখন কলেজ বন্ধ। সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিলো। কখনো জোরে, কখনো আস্তে। তিনটার দিকে রেডি হয়ে বের হলো ও। বাসায় বসে বসে বোর হচ্ছিলো। যতটা না স্যারের বাসায় পড়তে যাওয়া, তারচে অনেক বেশি বন্ধুদের সাথে আড্ডা, একটু খোলা নিশ্বাস। বৃষ্টি ধরে এসেছে। ওখানে পৌঁছে দেখল, এর মধ্যেই লিজা, কাজল, সম্পা, মিলি ওরা চলে এসেছে। অনেক চেষ্টা করেও কাউকে জায়গা থেকে সরাতে পারল না ও। বাধ্য হয়েই স্যারের সবচেয়ে কাছের জায়গাটাতে বসতে হলো ওকে। মুশকিল ! স্যারের কাছাকাছি বসতে হলে নিদেনপক্ষে একটা ছাতা বা রেইনকোট দরকার। ওদের সবাই এই জায়গাটা অ্যাভয়েড করতে চায়। স্কুলেও ওদের এক হুজুর স্যার ছিলেন। তার মুখ ভর্তি থাকত পান। নিজে কখনো বই নিয়ে আসতেন না। সামনে বসা যে কোন একজনের বই তুলে নিয়ে পড়াতে শুরু করতেন। একবার ওর বই নিয়েছিলেন তিনি। বইয়ের ব্যাপারে আদেখলা রিমিন মহা আতংক নিয়ে আবিষ্কার করে, ওর ধর্ম বইয়ের দুটো পেইজ ছোট ছোট লাল ডট্ দিয়ে প্রিন্টেড হয়ে গেছে। সেই প্রথম, আর সেই শেষ। আর কখনো সামনের সিটে বসেনি রিমিন। আজ...

স্যারের বাসা থেকে বেরুলো যখন, তখনো রাস্তা ভেজা আর কাদামাখা। এখান থেকে ওরা লিজার বাসায় যাবে। খালাম্মা গাজরের হালুয়া করলে ওদেরও তাতে অলিখিত ভাগ থাকে। লিজাদের বাড়ির সামনে বড় একটা ড্রেন। ড্রেনের ওপাশে মাটি খানিকটা উঁচু করে রাখা, পিচ্ছিল। পার হওয়ার মত একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছে ওরা, যেন পিছলে না যায়। ওপাশে হঠাৎ উদয় হলো হুজুর টাইপ একটা ছেলে। ছেলেটা লিজাদের বাসায় আশ্রিত। অবসরে লিজা আর তার ছোট ভাইকে আরবি শেখায়। একটা নিরাপদ জায়গার দিকে দেখিয়ে সে বলে উঠল, ” আপনারা এখানে পা দেন, এখানে পা দেন, তাইলে পিছলাবেন না।”
পার হওয়া আর কি, পা আর দেন এর মধ্যেকার দূরত্ব ঘুচিয়ে ওরা হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের ওপর গড়িয়ে পড়ে। কাজল টিপ্পনি কাটে,” কি রে লিজা, তোদের হুজুর তো ভালই নছিহত দেয়!”

ওদের বাসা থেকে বের হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা। দূরে বাসা যাদের তাদেরকে আগে রিকশায় তুলে দিয়ে আরেকটা রিকশার খোঁজে এদিক ওদিক তাকাল রিমিন। একটু দূরে দাঁড়ানো একটা মাইক্রোবাস ছাড়া প্রায় নির্জন রাস্তায় আর কিছু চোখে পড়ল না ওর। ওর সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেল বোরখা পড়া একজন। বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকল ও। আজ বাসায় ঝাড়ি খেতে হবে ওর। মাইক্রোবাসটার কাছাকাছি গিয়ে বোরখা হঠাৎ টলে উঠে পড়ে গেল। দুটো ছেলে কোথ্থেকে যেন উদয় হলো। ব্যাপার কি দেখার জন্য রিমিনও এগিয়ে গেল। ” আপা, একটু দেখেন তো, হাজার হইলেও মহিলা মানুষ।” ওর দিকে তাকিয়ে বলে একটা ছেলে। সামনে গিয়ে মহিলার ওপর ঝুঁকে পড়ে রিমিন। সাথে সাথেই ওর নাকে মুখে চেপে বসে একটা রুমাল। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার গাঢ় হয়ে নেমে আসে ওর চোখে।

সেন্স ফিরে এলে নিজেকে আবিষ্কার করল ও চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায়। মুখও বাঁধা। ভ্যাঁপসা বদ্ধ অসমাপ্ত একটা ঘর। এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে কিছু পিলার, রড, খোয়া আর সিমেন্টের বস্তা। মাকড়সার ঘন জাল এখান থেকে ওখান থেকে ঝুলে আছে। এক কোণায় বসে তাস পেটাচ্ছে তিনজন। ওদের আলোচনা থেকে বোঝা গেল, ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে টাকার জন্য। রিমিনকে নয়, ওদের টার্গেট ছিল অন্য কেউ, এটা বুঝতে পেরে ছটফট করে উঠল ও। কিন্তু লোকগুলো পাত্তা দেয় না ওকে। ওদের ভুল ভাংতে সময় লাগে না। ভুল মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছে ওরা। রিমিনকে নিয়ে ওরা কি করবে, ডিসিশান নিতেই কেটে যায় দুটো দিন। অবশেষে ওকে ছেড়ে দেবে বলে ঠিক করে ওরা। চোখ বেঁধে অচেনা নির্জন একটা জায়গায় ফেলে রেখে যায় ওকে। কোনমতে বাসায় ফিরে আসে ও। খুশিতে উদ্বেল পুরো পরিবার।

পরদিন থেকে নতুন সমস্যা, খুশির পাশাপাশি বিষাদ নেমে আসে পরিবারে। জোয়ান মেয়ে, কিডন্যাপারদের কাছে ছিল দুই রাত। ওরা কি ওকে এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েছে নাকি? এরকম উচ্চারিত, অনুচ্চারিত হাজারটা সামাজিক প্রশ্ন শেল হয়ে বিঁধতে থাকে ওদেরকে। অবিশ্বাস, সন্দেহ আর করুণার দৃষ্টি যে কি পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণা দিতে পারে, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে।

দুঃস্বপ্নটা ওকে ঘিরে থাকে সপ্তাখানেক। এই কদিন কোথাও বেরুলো না ও। তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে থাকে রিমিন। হয়ে ওঠে আবারো আগের মতই উচ্ছল, হাসিখুশি। ওর এই অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতা আর সহজতায় থতমত খেয়ে যায় সন্দেহবাদীরা। সামনাসামনি কিছু বলার মত সুযোগই তৈরী হয়না ওদের। কিন্তু আড়ালে আবডালে চলতে থাকে নোংরা কথার চালাচালি। কোন ভাল ছেলে কি বিয়ে করবে মেয়েটাকে?

এসব কেন যেন স্পর্শ করে না রিমিনকে। ও তো নিজেকে জানে। তিক্ত এই ব্যাপারগুলোকে ওর জীবনের কোন অংশ মনে হয় না। ওর জীবন পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার মতই গতিশীল। মাঝখানের দুঃস্বপ্নটুকু ভুলে গিয়ে ওর মনের ভেতর আবারো জেগে ওঠে সজীব এবং সতেজ অনুভূতি। তারুণ্যের আভায় উদ্ভাসিত কোন তরুণীর মতই সে-ও অপেক্ষা করে থাকে একটা সত্যিকারের মানুষের জন্য। যে তার জীবনটাকে ভরিয়ে দেবে।

ভীষন অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কদিন থেকেই রিমিন কেমন যেন ফিল করছে। কোথাও কেউ নেই দৃষ্টির সীমানায়। তবুও কে যেন প্রচন্ড ভালবাসায় ওকে আগলে রাখছে। তার স্পর্শ ও অনুভব করে ওর চুলে, কপালে, গালে। প্রচন্ড ভাললাগা ওকে বিবশ করে দেয়। একা হলেই অনুভূতিটা তীব্র হয় ওর। ভীষনরকম। রিমিন যেন আর নিজের থাকে না। হয়ে যায় অন্য কারো। যে ওকে ভীষনভাবে বুঝতে পারে। যার প্রতিটি নিঃশ্বাসে শুধু রিমিন আর রিমিন এবং আরো আরো অনেক গভীর কিছু। রিমিন যেন ভীষন ভাবে প্রেমে পড়ে গেছে তার। প্রচন্ডভাবে চাইছে ও, ওর এই ফ্যান্টাসি সত্যি হয়ে উঠুক।
” আমার স্নায়ুর সকল ইচ্ছা দিয়ে
তোমাকে চাইছি হৃদয়ের কাছে পেতে
তোমাকে চাইছি মানবিক স্নেহে
প্রেমে, মানবিক মোহে
শরীরে ও পিপাসায়...”

* * * * *
পাঁচ বছর পর

বিয়ে হয়েছে রিমিনের। স্বামী একটা নামকরা এনজিওর বড় কর্মকর্তা। তিন বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে আছে ওদের। আপাতদৃষ্টিতে কোথাও কোন সমস্যা নেই। তারপরেও রিমিনের কোথায় যেন শূণ্যতা। নিজেকে ঠিক যেন নিজের মত করে পায় না ও। জাগতিক ভালবাসার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে সেই অপার্থিব ভাললাগার অনুভূতিটুকু। ও মাঝে মাঝেই সেটাকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। পারে না। তাহলে সংসারের চোরাবালিতে ওর স্বপ্ন কি শেষ? উত্তর শুধুই এক দীর্ঘশ্বাস...


মন্তব্য

অনিন্দিতা এর ছবি

দুঃখ ছাড়া হয়না মানুষ ,
এ কথাটি সত্যি নয়।
দুঃখের সাথে নেই পরিচয়
এমন তো মানুষ হয়।
.................
একটু সুখ সুখ গল্প লিখেন তো।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

এই কথাটা আমিও বিশ্বাস করতে চাই, দুঃখ ছাড়াও মানুষ হয়।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

বাইরে মেঘলা। খিচুড়ি রাঁধলাম, খুশি মনে খাবো ভেবে। দিলেন সব গেরায়! ধুর!

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আহারে...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- উক্ত ঘটনার এক বছর পর রিমিনের বিয়ে হলো। এই এক বছরেও রিমিন ফিগার আউট করতে পারেনি সেই আনদেখা-আনজানা ফিলিংসের উৎস! চোরাবারলিতে তলিয়ে যাবার আগে দায়িত্বটা তার নিজেরই কি ছিলো না!

বিয়ে-স্বামী-সংসার-অবশেষে কন্যা, এসবের গ্যাড়াকলে পড়েও পাঁচ বছর আগের সেই অনুভূতিকে আঁকড়ে ধরে রাখার মতো শক্তিশালী সবাই হয় না। সময় এবং শক্তিশালী সংসারের বেড় নাকি সবকিছুকেই জায়গামতো ফিটিং দিয়ে (শাহ্ সূফী সৈয়দ মুহাম্মদ ফিটার লীলেন ভাই হইতে কোট চোখ টিপি) শেষ করে দেয়!

বিঃদ্রঃ- লীলেন ভাই মাইন্ড খাইলে আমার কোনো দোষ নাই। লীলেন ভাইকে জাঝা
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

নিজের দায়িত্ব কি আর সবাই নিজে বোঝে রে ভাই !
আশায় আশায় থাকে কেউ যতœ করে বুঝিয়ে দেবে।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ধূপছায়া এর ছবি

ভালো লিখেছেন।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

একেবারে জটিল অনুভূতি
মাঝে মাঝে কিসের জন্য মন খারাপ হয় তা নিজেও জানে না মানুষ
ঠিক এরকম

পরিবর্তনশীল এর ছবি

তাহলে সংসারের চোরাবালিতে ওর স্বপ্ন কি শেষ? উত্তর শুধুই এক দীর্ঘশ্বাস...

ভালো লাগল
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

গল্প বাদ দেন।
এমনিতে মন ভালো হয়েছে?

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

স্বপ্নাহত এর ছবি

আপু আপনার সবগুলো গল্পের থিমই আমাদের জীবনের আশপাশ থেকেই নেয়া।কিন্তু সবগুলোই কেমন মন খারাপ করা।
এমনিতেই কত যন্ত্রনা আর ঝামেলার মদ্ধে থাকি।এত মন খারাপ লেখা তাই সবসময় পড়তে ইচ্ছে করেনা।আপনার মাশাল্লাহ যা হাত কষ্টগুলো যেমন সূক্ষভাবে তুলে ধরতে পারেন তেমনি জীবনের আনন্দময় ব্যাপারগুলোও বহুগুনে বাড়িয়ে দিতে পারবেন যদি সেরকম কিছু নিয়ে লিখেন।

নেক্সট টাইম আর মন খারাপ করতে চাইনা। হাসি না হলে আর খেলুম না...

=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=
বুকের মধ্যে আস্ত একটা নদী নিয়ে ঘুরি

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আইচ্ছা
দেহি কি করন যায়...
কেউ খেলা বাদ দিলে তো চিন্তার কথা।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অনিন্দিতা এর ছবি

অতএব আর দেরী নয়.....
সুখের তো গল্প হয়্ নাকি?

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

হা হা হা

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মাহবুব লীলেন এর ছবি

তারপর তাহারা সুখে দিনাতিপাত করিতে লাগিল
রূপকথা থেকে এই লাইনটা সব লেখার নিচে দিয়ে দিলেই তো সব গল্প সুখের গল্প হয়ে যায়

কত্তো সোজা............

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

তাই তো !
সহজ বুদ্ধি...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অমিত আহমেদ এর ছবি

বেশ

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ধন্যবাদ।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।