স্মৃতিচারণ: 'জানি আর কোনোদিন দেখা হবে না'

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: শুক্র, ১৬/১১/২০০৭ - ৭:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাতাসেই বলি, ভালবাসি ভালবাসি

১.
আর কোনোদিন দেখা হবে না, এ কথা মনে হওয়ামাত্র বুকের ভেতর একটা মোচড় টের পাই। দম আটকে যাওয়া কষ্টের মোচড়। এই প্রথম বুঝতে পারি তাদের প্রতি আমার সুপ্ত গভীর ভালবাসার টান। অথচ কতটাই বা দেখা হয়েছে তাদের সাথে। সৌজন্য বিনিময় ছাড়া গভীর কোনো আলোচনায়ও যাইনি কোনোদিন। কোনো সংকটে, সমস্যায় সাহায্য করার সম্পর্কও ছিল না। তবু চিরবিদায়ের সংবাদ জানতে পেরে স্তব্ধ হয়ে যাই। সব কাজকর্ম থেকে হাত-পা গুটিয়ে জড় পদার্থের মত ম্লানমুখে বসে থাকি। নিজের সাথে নিজের সংলাপের সার-সংক্ষেপ তৈরি করে বুঝতে পারি, স্বল্পদেখা মানুষজনের প্রতিও আমাদের হৃদয়ে লুকানো থাকে গভীর ভালোবাসা। দৈনন্দিন ব্যস্ততায় নিজের কাছেই সেটা অজানা থেকে যায়। আর মুখ ফুটে সেই ভালবাসার কথা বলা হয় না। শিষ্টতার মুখোশ খুলে মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে বলা হয় না, 'হেই মানুষ। আমি তোমাকে ভালবাসি। যখন কারো মুখে তোমার প্রশংসা শুনি, তখন মনে হয় এ আমার প্রশংসা। যখন তোমার নতুন কোনো কৃতিত্বের খবর পাই তখন মনে হয় এ আমারই অর্জন। আনন্দে, গর্বে আবার বুক ভরে ওঠে। আমি তোমাকে ভালবাসি মানুষ। প্রাণের গভীর থেকে ভালবাসি।'

কেন আমরা অকপটে ভালবাসার মানুষকে ভালবাসার কথা বলতে পারি না?

২.
সব সম্পর্ক ও যোগাযোগের উর্ধ্বে চলে গেছেন কবি ও সুনামগঞ্জের রোমান্টিক শহর-পিতা মমিনুল মউজ্দ্দীন। চলে গেছেন ছোট'পা তাহেরা চৌধুরী। আর কবিতাপ্রিয় এই দম্পতির সন্তান, কাহলিল জিব্রান। প্রিয় কবি-দার্শনিকের নামে সন্তানের নাম রেখেছিলেন তারা। মউজ্দ্দীন হাছন রাজার প্রপৌত্র ছিলেন, হাছনকে ভালবাসতেন, আয়োজন করতেন হাছন উতসব। ছোট'পাও হাছনের প্রতি ভালবাসার ধারাবাহিকতায় ঘর বেঁধেছিলেন মউজদ্দীনের সাথে। সেই তারা সন্তানের নাম রেখেছিলেন কাহলিল জিব্রান। এ কথা মনে হওয়ার সাথে সাথে হাছন ও জিব্রানের চিন্তা-দর্শনের সাযুজ্যটা আমার চোখে পড়ে। আমার ইচ্ছা হয় হাছনের গানের বই আর জিব্রানের কবিতার বই পাশাপাশি খুলে রেখে পড়তে।

৩.
কবিদের প্রতি বাঙালির একরকম প্রশ্রয়ের ভালবাসা থাকে। কিন্তু তাদের হাতে দায়িত্ব দিতে বাঙালি ভরসা কমই পায়। নির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার খবর আমরা জানি কাজী নজরুল ইসলামের, এমনকি নির্মলেন্দু গুণের। মমিনুল মউজদ্দীন এদের কারো মতো ততো খ্যাত কোনো কবি নন। সম্ভবত: প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা তার তিনের বেশি নয়। কিন্তু তিনি জনপ্রিয় কবি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তিন তিনবার নির্বাচনে জিতেছেন তিনি শুধু মানুষের ভালোবাসায়। সুনামগঞ্জের মানুষ তাদের এলাকার রাজনীতি নিয়ে খুব সচেতন। সেখানে দেনা-পাওনা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা যাচাই-বাছাইয়ের পর মানুষ ভোট দেয়। মউজদ্দীনও আর দশটা রাজনীতিবিদের মত বাকপটু, ধুরন্ধর, কৌশলী, ক্ষমতালিপ্সু, মাস্তানদের গডফাদার ধরনের ছিলেন না। এলাকার শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা, ঢাকায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া তরুণ শিল্পী, সাংবাদিক, চাকুরিজীবিরা নির্বাচনের সময় নিজের দায়িত্ব মনে করে সুনামগঞ্জে চলে যেত মউজ্দ্দীনের নির্বাচনী প্রচারণা করতে। নিজের থেকে অন্যদের উত্সাহ আর পরিকল্পনাই বেশি থাকতো তাকে জিতিয়ে আনার জন্য। অনেকেই তার মধ্যে হাছন রাজার ছায়া দেখতে পেতেন। মানুষকে তিনি ভালবাসতেন নিজের মত করেই, কিন্তু তার চারপাশের মানুষের অসম্ভব ভালবাসা তিনি পেয়েছেন। ভালবাসা পেয়েছেন তার কলেজ জীবনের প্রেমিকা স্ত্রীর কাছ থেকেও। কবিকে ভালবেসেই ঘর বেঁধেছিলেন ছোট'পা। আরেকটা নির্বাচনে জয়লাভ করার চেয়ে মউজদ্দীনের আরেকটা কবিতার বই বের হোক, এটাই চাইতেন ছোট'পা।

৪.
কবি হিসেবে হয়তো মউজদ্দীনকে খুব বেশিদিন মনে রাখবে না বাংলাদেশ। কিন্তু রূপকথার মতো এই তথ্যটা বেঁচে থাকবে, যে এইদেশে এক শহর-পিতা ছিলেন যিনি পূর্ণিমা রাতে নাগরিকদের চাঁদ দেখার সুযোগ করে দেয়ার জন্য শহরের রাস্তার বাতিগুলো নিভিয়ে দিতেন। যত সহজ শোনাচ্ছে তত সহজ নয় এই কাজ করা। অন্য যেকেউ এ কাজ করতে গেলে পাগল বলে ঢিল ছুঁড়বে নাগরিকেরা। কিন্তু মউজদ্দীনের শহরের লোকজনের প্রবল আস্থা ও ভালবাসা ছিল তার প্রতি। তিনিও ভালবাসতেন তার এলাকার মানুষকে।
একবার সেলিমের (গায়ক সেলিম চৌধুরী; মউজদ্দীন সেলিমের দুলাভাই, তাহেরা'পা সেলিমের ছোট আপা) বাসায় বেরিয়ে যাওয়ার মুখে তিনি আটকালেন। রাজনীতিবিদ হলেও তার গলা কখনও চড়তো না, আর ভীষণ মিতভাষি ছিলেন। বললেন, 'তোমরা যারা ঢাকা শহর চালাও, তারা চাও না আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষরা অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হই'। জানতে চাইলাম সমস্যটা কি। তিনি বললেন, ঢাকা এসে তিনি মন্ত্রী-সচিবদের দরজায় ধর্না দিচ্ছেন একটা পরিকল্পনা নিয়ে। সেই পরিকল্পনা হচ্ছে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার মাঝ দিয়ে একটা সড়ক বানানোর। বর্ষার সময় সেখানে নৌকায় ধীর গতির একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকে। শুকনার সময় হাওরের মধ্য দিয়ে অস্থায়ী রাস্তায় যোগাযোগ আরো কঠিন। বাংলাদেশের অন্যতম দুর্গত দুর্গম অঞ্চল সেটা। তিনি তার এলাকার প্রকৌশলীদের নিয়ে বসে যাবতীয় পরিকল্পনা করে প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। কিন্তু তার এই প্রকল্প নিতে চায় না ই.আর.ডি. বা সরকার।
দুলাভাই হিসেবে আমার সাথে ঠাট্টারই সম্পর্ক। আমি বললাম, আপনি কবি, হাওরের প্রকৃতি নিয়ে মুগ্ধচোখে কবিতা লিখবেন তা না, এর বুক চিড়ে রাস্তা বানানোর পরিকল্পনা কষছেন। এতো অন্যায়।
তিনি কিছুটা রুষ্ট হন। বলেন, ঢাকায় বসে তোমরা প্রকৃতি, হাওড় এসবের সাফাই গাইবে। কিন্তু মানুষগুলোর মৌলিক চাহিদা তোমাদের কাছে কিছুই না। এ মানুষগুলো যেসব পণ্য উতপাদন করে সেগুলো তারা সুনামগঞ্জ শহরে বিক্রি করতে আসতে পারবে না? এই ব্যবস্থাটুকু তোমরা করে দিবে না আমাদেরকে।
আমি আরো ঠাট্টা করি, বলি, আপনি তাজা সব্জি খাবেন এই আশায় হাওড়ের বুকটা চিড়ে ফেলতে পারেন না।
তিনি জানতে চান, তাহলে যোগাযোগের কী হবে। কেউ এই প্রকল্প হাতে নিতে চায় না। বলে ফান্ড পাওয়া যাবে না। বান্দরবান-রাঙামাটির জনশূন্য পাহাড়ে পাহাড়ে রাস্তা হচ্ছে, আর আমাদের এলাকায় রাস্তা হলেই দোষ। কেবল আমাদের ক্ষেত্রেই প্রকৃতির দোহাই। তুমি একটা বুদ্ধি দাও। কীভাবে এগুলে ফান্ড পাওয়া যাবে।
তার সাথে ড্রইংরুমে তার এলাকার কিছু লোক বসে আছে। তারা জানে আমি সচিবালয়ে কাজ করি। তারা ক্রুদ্ধ হওয়ার আগে আমি তার সাথে আরেক দফা ঠাট্টা করে সেখান থেকে পালাই, 'শুনেন আপনি কবি। আপনার সমাধান হতে হবে কাব্যিক । প্রকৃতির সাথে মিল রেখে। আপনি একটা ডুবন্ত রাস্তার পরিকল্পনা তৈরি করেন। যে রাস্তা বর্ষায় ডুবে যাবে। শীতের পানি শুকালে ভেসে উঠবে। হাওরের জলের সাথে তার বিরোধ থাকবে না। সেই রাস্তায় আপনি শীতের দিনে চালাবেন চাকাওয়ালা গাড়ি। বর্ষায় চালাবেন দ্রুত গতির স্পিডবোট। স্পিডবোটের নীচে চাকা লাগিয়ে তৈরি হবে এসব উভচর গাড়ি। বর্ষা আসলেই চাকা খুলে তারা হাওরের জলে ভাসতে থাকবে জীবনানন্দের পাতিহাঁসের মত'।

৫.
মউজদ্দীন আমার এই পরামর্শ শোনেননি। কিন্তু আমি জানি কবি হিসেবে তিনি বুঝেছিলেন, ঠাট্টা হিসেবে বললেও আমার কথা তার মনেরই কথা। কিন্তু একে বাস্তবে রূপ দিতে সারা জীবন চলে যাবে। কয়েকদিন পর দেখি একই ড্রইংরুমে তিনি তার এলাকার কিছু শিল্পকলার ছাত্র নিয়ে কাগজে আঁকাআঁকি করছেন। আমাকে ধরলেন, এদিকে আসো, একটা পরামর্শ দিয়ে যাও। কি করছেন জানতে চাইলে বললেন, সুনামগঞ্জ শহরে একটা তোরণ বানাতে চান তিনি, সম্ভবত: হাছন রাজার নামে। আমাকে ড্রইংটা দেখালেন। আর্ট কলেজের কোনো এক ছাত্রের আঁকা (অভিজিত চৌধুরীর হতে পারে। তবে ধ্রুব এষের নয়।)
আমি বললাম, আমার কথা তো আপনি শুনবেন না। পরামর্শ দিয়ে লাভ কি।
তিনি বললেন আগে শুনি, তারপর দেখা যাক।
আমি বললাম, হাছন রাজার গান হচ্ছে সুনামগঞ্জের সম্পদ। কিন্তু তার মূর্তি করাটা সম্ভব নয় বুঝতে পারি। কিন্তু এই বিয়েবাড়ির গেইটের মত একি এঁকে নিয়ে এসেছেন আপনি। গানের কোনো যন্ত্র দিয়ে তোরণ তৈরি করেন। দোতারা বা একতারা। তবলাও রাখতে পারেন। রাস্তার একপাশের বড় করে ইট-সিমেন্টের একটা দোতারা বানান। আরেকপাশে ডুগি-বাঁয়া। দোতারাটা যদি দুই-তিনতলা ভবনের সমান উঁচু করে করেন তবে একতলা সমান একটা ঘর করেন নীচে। সেখানে একটা প্রদর্শনী কক্ষ বানান আর ছোট্ট একটা বিক্রয়কেন্দ্র রাখেন। সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী জিনিস বইপত্র, গানের ক্যাসেট বিক্রি হবে সেখানে। তোরণও হলো, ঐতিহ্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতাও হলো আর বিক্রি-বাটা করে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের খরচও কিছুটা উঠে যাবে হয়তো।
আমার প্রস্তাব তার মনে ধরেছিলো। এরকম একটা তোরণ তিনি শহরে তৈরি করেছিলেন। যদিও অর্থের অভাবে অথবা আমার আইডিয়া শিল্পী পর্যন্ত ঠিকঠাক না পৌঁছানোর কারণে সেরকম হয়নি তোরণটি। কিন্তু সুনামগঞ্জ শহর নিয়ে তার ভাবনা, তার কাজ করার ধরন এবং তরুণদের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা এগুলো তাকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে অনন্য একটা বৈশিষ্ট্য দিয়েছিলো। সুনামগঞ্জের প্রত্যেক তরুণই মনে করতো মউজদ্দীন তার সবচাইতে কাছের মানুষ।

৬.
ধ্রুব এষ, অভিজিত্ চৌধুরী, সাংবাদিক পীর হাবিব সহ সুনামগঞ্জের সব তরুণ-যুবারা মউজদ্দীনের নামে মাতাল ছিলো। অত্যন্ত আমি তাই দেখেছি। হাছন উতসব ও কবিতা লেখালেখির কারণে ঢাকার কবি, লেখক, সাংবাদিকদের সাথেও তার যোগাযোগ ছিলো নিবিড়। জাসদের রাজনীতি করেই তিনি বড় হয়েছেন। সুতরাং জাসদ রাজনীতির সাথেও তার যোগাযোগ ছিলো। যদিও বোনজামাই এমপি সুলতান মনসুর ও এলাকার রাজনীতির প্রেক্ষাপটের কারণে শেষে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। জাসদ নিয়েও আমাদের বিভিন্ন ঠাট্টার তিনি শিকার হতেন। কিন্তু নিষ্ঠুর সেসব আক্রমণেও তিনি খুব একটা উত্তেজিত হতেন না। ত্রুটিগুলো মেনে নিতেন। আর স্মিত হেসেই সব জবাব দিতেন। সুদর্শন ছিলেন। গায়ের রং টকটকে ফর্সা, স্লিম একহারা সবল লম্বা দেহ কাঠামো অথচ নম্র ও বিনয়ী স্বভাব সেইসাথে চোখেমুখে একরকম নিষ্পাপ কমনীয়তা। ভীষণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিলেন, স্ত্রীর প্রভাবেই বেশি হয়তো, পরিপাটি পোষাক পড়তেন। রাজনীতিবিদদের মতো নয়, কবিদের মতোও নয়। ইন করে পড়া স্ট্রাইপড্ ফুল শার্টের সাথে কালো বা গাঢ় রংয়ের প্যান্ট। চকচকে জুতা ও চামড়ার বেল্ট তাকে দেখতে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মনে হতো পোষাকে, অথচ মুখের দিকে তাকালেই বুঝা যেত শিশুর সারল্য, দার্শনিকের অন্যমনস্কতা।

৭.
যোগ্য প্রেমিকা-স্ত্রী পেয়েছিলেন মউজদ্দীন। ছাত্রাবস্থায় বৈরাগী ধরনেরই ছিলেন, ছোট'পাই অনেক বেশি গুছিয়ে দিয়েছেন তার জীবন। ছোট'পা নিজেও কবিতা লিখেছেন, আর আট-দশটা কিশোরীর মতো। কিন্তু কবিকে ভালবাসতে গিয়ে হয়তো নিজের কবিতার খাতাটা লুকিয়ে ফেলেছেন। বেশ ক'বার ছোট'পার সাথে আমার দেখা হয়েছে। ছোটবেলার কথা খুব একটা মনে নেই। কিন্তু উত্তরার বাসায় যখন দেখা হয়েছিলো তখন মনে হয়েছিলো একবারে আপন ভাইয়ের মত করেই আমাকে ভালবাসেন তিনি। মউজদ্দীনের সব রাজনৈতিক কর্মীরাও ছোট'পার একইরকম ভালবাসা পেয়েছে। এদের কারো সাথে কোনো যোগাযোগ না হয়েও আমি বুঝতে পারি, এরা সবাই মউজদ্দীন ভাইয়ের কথা মনে করে যতটা চোখের জল ফেলবে ততটাই চোখের জল ফেলবে ছোট'পার কথা মনে করে।

৮.
আরেকদিন আড্ডা হচ্ছে সেলিমের বাসায়। সেলিম গান গাইছে। হঠাত সে মউজদ্দীন ভাইকে গান গাইতে বলে। আমি হতবাক হই। সুনামগঞ্জের সবার গলাই সুরেলা একথা আমি জানি কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে গান ধরেন মউজদ্দীন ভাই। তার চরিত্র বৈশিষ্ট্যের মতই খুবই মগ্ন ধরনের একটা লোকোগীতি। মনে নাই ঠিক কোন গানটা। তারপর তার কাছ থেকে জানতে পারি যে সুনামগঞ্জে একটা সঙ্গীত শিল্পী গোষ্ঠীও আছে তাদের। রাজনীতির ব্যস্ততায় এখন আর নিয়মিত যেতে পারেন না। তবে গেলে একটু আধটু গানের চর্চা হয়। সেলিমের প্রথম ক্যাসেটে আমার লেখা দুটো গান তার সবচে পছন্দের ছিলো। আর ছিলো অজয়দার লেখা এই গানটা, 'দেখা হবেনা, জানি আর কোনোদিন দেখা হবেনা.... দিন চলে যায়, রোদেলা মায়ায়/রাতেরও আকাশ কাঁদে তারায় তারায়.....ছায়াপথে আলো নেই, চাঁদে নেই কোনো জোছনা... দেখা হবে না...জানি আর কোনোদিন দেখা হবে না...'

৯.
জঙ্গির গুলি নয়, ড়্যাবের ক্রসফায়ার নয়, দুর্যোগ বা মহামারী নয়, এই প্রিয় মানুষদের চলে যাওয়ার কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। বিশ্বের সবচে বেশি সড়ক দুর্ঘটনার দেশ বাংলাদেশ। সেখানে ছোট রাস্তায় চলে বড় বড় গাড়ি। গতির সীমারেখা কেউ মানে না। রাস্তায় কোনো শৃঙ্খলা নেই। চালকদের যথাযথ ট্রেনিং নেই। আল্লাহ-খোদার নাম লিখে রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে দেয় মালিকেরা। আর গাড়ির ভিতরে লেখা থাকে দোয়া-দুরুদ। এই ভরসায় রাস্তায় নেমে বিপুল সংখ্যক মানবসম্পদ অঘোরে প্রাণ দিচ্ছে প্রতিবছর বাংলাদেশে। এক ইলিয়াস কাঞ্চন ছাড়া আর কেউ এ নিয়ে উচ্চাবাচ্যও করে না। এতো বড় ঘাতককে অদৃষ্ট বলে মেনে নেয় জনগণ।

আমার অদৃষ্ট নাই।
আমার ইচ্ছা করে সংঘর্ষের মুখ থেকে মউজদ্দীন ভাই -ছোট'পার গাড়িটা সরিয়ে আনতে। তাদেরকে বলতে ইচ্ছে করে, তোমাদের যাওয়ার সময় হয়নি। এই পৃথিবীতে কত অপ্রয়োজনীয় লোকেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তোমাদের মত সজ্জন লোকেরা কেন চলে যাবে এতো তাড়াতাড়ি।
মুখ ফুটে হয়তো ভালবাসি বলিনি, তাই বলে আমাদের বুকে যে ভালবাসার ঘাটতি ছিলো না তাতো তোমরা জানো। তবে কেন?
তাহলে এমন করে চলে যাবে কেন?
এতো অকালে? এতো অসময়ে?
সত্যি সত্যি কি আর তোমাদের সাথে, আর কোনোদিন দেখা হবে না....? কোনোদিন না...?


মন্তব্য

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

গল্পগুলো শেয়ার করার জন্যে অশেষ ধন্যবাদ।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এসব মানুষের ভালোমানুষির খবর আমরা জানতে পারিনা, জানানো হয়না। কিন্তু যখন জানা হয় তখন তাঁরা চলে যান অনেক দূরে। সেখানে শ্রদ্ধা পৌছেনা, পৌঁছেনা কোন বাণী।
তাঁদের জন্য ভালোবাসা আর আত্নার শান্তি কামনা করছি।

??? এর ছবি


..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

অতিথি লেখক এর ছবি

আরো কয়েকটি লেখা প‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ড়েছি প্রয়াত কবির উপর। আপনারটাই সবচেয়ে ভাল লাগলো। ব্যক্তিগত বেদনার গাঢ় পলিমাটিতে মোড়ানো ভূমিতেই কেবল এমনি সুন্দর পুস্পের সমাহারকে আশা করা যায়। যেহেতু আমি সুনামগঞ্জ এর লোক নই, তাই উনার কথা জানতাম না। দু:খ লাগছে এই জেনে যে আমরা কেবল মৃত্যুর পরেই ইনাদের মতো লোকদের নিয়ে কথা বলি।
চাঁদের আলো দেখবার জন্য শহরের বাতি নিভিয়ে ফেলার শুনে চোখে পানি এসেছে। কতখানি মমতা থাকলে এই কাজটি করা যায় ভাবছি। অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।

আইডি: নির্বাসিত।

হিমু এর ছবি

প্রত্যেকটা মৃত্যুর কাছে ছোট হয়ে যাই, বলার কিছু থাকে না।


হাঁটুপানির জলদস্যু

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

খুবই দুঃখিত। আর কি ই বা বলতে পারি?

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ধ্রুব হাসান এর ছবি

" বিশ্বের সবচে বেশি সড়ক দুর্ঘটনার দেশ বাংলাদেশ। সেখানে ছোট রাস্তায় চলে বড় বড় গাড়ি। গতির সীমারেখা কেউ মানে না। রাস্তায় কোনো শৃঙ্খলা নেই। চালকদের যথাযথ ট্রেনিং নেই। আল্লাহ-খোদার নাম লিখে রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে দেয় মালিকেরা। আর গাড়ির ভিতরে লেখা থাকে দোয়া-দুরুদ। এই ভরসায় রাস্তায় নেমে বিপুল সংখ্যক মানবসম্পদ অঘোরে প্রাণ দিচ্ছে প্রতিবছর বাংলাদেশে। এক ইলিয়াস কাঞ্চন ছাড়া আর কেউ এ নিয়ে উচ্চাবাচ্যও করে না। এতো বড় ঘাতককে অদৃষ্ট বলে মেনে নেয় জনগণ।"
শোহেইল ভাই ঠিক এই ব্যাপারটাই আমাকে প্রচন্ড পীড়া দেয়, যখন আমরা সড়ক দুর্ঘটনাকে অদৃষ্টের লীলা বলে মেনে নেয়; ভাবি আহা ভালো মানুষগুলো বেশী দিন বাচেঁনা! আমার দুঃখের চেয়ে রাগ হয় অনেক...প্রতিটি অনাকাঙ্খিত মৃত্যু আমাদের শুধু দুঃখিতই করে! এ পর্যন্ত আমার পাচঁজন আপন মানুষ অকালে চলে গেলেন; দু'জন সড়ক দুর্ঘটনায়, একজন হার্ট অ্যাটাক করার পর ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়ে, আরেকজন আগুনে পুড়ে। কিন্তু সবাই নিজেদের এবং আমাকেও সান্তনা দিল এই বলে "মানুষের হায়াত যখন শেষ তখন আমরা কিইবা করতে পারি" !......আমি নিজেকে দূর্বল চিত্তের ভাবিনা না, তাই সান্তনাও পাইনা......শুধু নিঃশব্দে চোখ ফিরিয়ে নেই। ভাবি তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হলে কি মিনিমাম ড্রাইভিং রুল মেনেও গাড়ি চালানো যাইনা? নিদেন পক্ষে কেউ যদি লেইন মেনেও গাড়ি চালায় তাতেও শতকরা ৬০জন মানুষের জ়ীবন দুর্ঘটনার কবলে পড়েনা। যেখানে গতির সীমারেখা কেউ মানতে চাইনা, লেইন শৃঙ্খলা মেনে গাড়ি চালাইনা সেখানে আল্লাহ-খোদার নাম লিখে প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষকে পরপারে পাঠানো যায় সত্য কিন্তু এই হঠাত মরে যাওয়ার হার কমবেনা , বরং যে কোনদিন এই দুর্যোগ নেমে আসতে পারে আমার, আপনার সকলের জীবনে। তখনো আমাদের আপনজনেরা কেবল দুঃখিতই হবে আমাদের মতো !

গতকাল দেশের ভয়াবহ প্রাকিতিক দুর্যোগের মাঝে যখন মউজদ্দীন ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদটা প্রথম শুনি স্তব্দ হয়ে গেছিলাম ক্ষনিকের জন্য, তারপর সচলে ওনার প্রিয়জনদের লেখাগুলো পড়ে বুঝলাম কিছুই বলার নেই আমার। কিন্তু আজকে আপনার লেখাটা পড়ার পর আর চুপ থাকতে পারলাম না। মউজদ্দীন ভাইকে যতখানি জানি তার শতভাগই তুহিন ভাইয়ের মাধ্যমে (গত বছর নাকি এই বছর ঠিক মনে নেই,যখন তিনি লন্ডন এলেন পরিচয়ও হয়েছিলো)। আর সেই সূত্র ধরে বৃটেনে বসবাস করা মউজদ্দীন ভাইয়ের অনেক আপন মানুষজনকেও চিনি, মজার ব্যাপার হলো আমার প্রায় সকল পরিচিত আড্ডাবাজ সিনিয়র বন্ধুই সুনামগঞ্জের; এইটার আরেকটা কারন হতে পারে মেমসাহেবের আড্ডা! যাইহোক এই ভুমিকার অর্থ হলো, যখনি কোন সুনামগঞ্জ সংখ্যাগরিষ্ট বড়ভাই-বন্ধুদের আড্ডাই যেতাম সেই আড্ডার কোন না কোন ভাগে উঠে আসতো সুনামগঞ্জ আর স্বাভাবিকভাবেই আসতো নগর পিতা মউজদ্দীন ভাইয়ের নাম। সুনামগঞ্জ শহরের গল্পগুলোর দুটো জিনিষ আমাকে অবাক করতো খুব, এক. সেই শহরের প্রতিটি মানুষ গান পাগল (কেউ লেখেন, কেউ গান, কেউবা গাইয়েদের সেবা করে আনন্দ খোজেঁন), দুই. এ্যালকোহল প্রিয়তা (মনে হয় মদ সবাই ভালোবাসেন)। যাইহোক, শহরের বাতি নিভিয়ে জ্যোস্না দেখার গল্প, হাছন উতসবের গল্প কিংবা প্রথম সুনামগঞ্জ শহরে চট্রগ্রামের ব্যান্ড সোলসের কনসার্টের গল্প অথবা একাদিক মিষ্টি প্রেমের কাহিনী, সবই শোনা আমার, কোনটাই বাদ পড়েনি......আর এই সমস্ত গল্পের সাথে জড়িয়ে আছেন
মউজদ্দীন ভাই! তাই লোকটা সুনামগঞ্জের আর দশটা তরুণের যেমন প্রিয়,আমার কাছেও তেমন প্রিয়; আপাত দূরের এই লোকটা কখন যে এতটা জানা হয়ে উঠলো ঠেরও পাইনি! তাই তার মৃত্যুও আমার আপন মানুষের মৃত্যুর অঙ্ঘ হয়ে উঠে আর দশটা মৃত্যু সংবাদকে ছাড়িয়ে......সুনামগঞ্জবাসীর মতো আমিও স্তব্ধ হয়ে যায়! মনে পড়ে এই কদিন আগে নতুন তত্তাবধায়ক সরকার আসার পর তিনি তুহিন ভাইকে ফোন করেছেন বেশ কয়েকবার, হেতু হলো -নতুন করে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গড়বেন সুনামগঞ্জে,তাই তার প্রিয় যোগ্য পুরানো রাজনৈতিক সহকর্মীদের দেশে ফিড়িয়ে আনতে চান। আশার আলো দেখেছিলেন তিনি......যাইহোক ঐটা ভিন্ন আলোচনা।......কেন জানি এত কিছু মনে পড়ছে আজ!......আজ এতগুলো মৃত্যু (আটশোর বেশী মানুষ এখন পর্যন্ত মারা গেছে) সংবাদ দেশে তারমাঝেও যেন এই মৃত্যুটা মানা যাই না ।।

(বিনীত অনুরোধ সচলের মুডুদের প্রতি, ঘূর্ণিঝড় সিডরের তান্ডবে অনির্দৃষ্ট সংখ্যক মৃত মানুষগুলোর প্রতি সম্মান জানিয়ে দিনটিকে জাতীয় শোক ঘোষনা করে সচলের ইন্টারফেসটিকে কালো রঙের করা হোক।)

হাসান মোরশেদ এর ছবি

নিজস্ব এবং সামষ্টিক শোকে স্তব্দ হয়ে আছি ।
-----------------------------------------
'জলপ্রিয় হে যুবক, তোমার ভিতরে এত
ভাঙনের পতনের শব্দ শুনি কেন!'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।