বাগানে গোপনে একজন মালী আসে অথবা আসে না

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: শুক্র, ০৫/১০/২০০৭ - ১০:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাগানবাগান
অনেকদিন ধরে অবহেলায় পড়েছিলো তাদের বাগান। বাগানের মালিক দুই বন্ধু বহুদিন পর খোঁজ নিতে এসে দেখলেন ছোট ছোট আগাছায় ভরে গেছে বাগানটি তবে আগাছাগুলোর মাঝে কিছু ফুলের গাছ হয়েছে যেগুলো ভারী সুন্দর। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বললো, "নিশ্চয়ই কোনো মালী এখানে আসে এবং এই ফুলগাছগুলোর পরিচর্যা করে"। এ বিষয়ে তারা খোঁজখবর করা শুরু করলো কিন্তু কোনো প্রতিবেশিই এমন খবর দিতে পারলো না যে তারা কাউকে এই বাগানে কখনও কাজ করতে দেখেছে। বন্ধুটি তখন তার মালী যে আসে সেই বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিলো, "যখন সব মানুষ ঘুমিয়ে যায় মালীটি নিশ্চয় তখন আসে। সেজন্যই কেউ তাকে দেখতে পায়না"। দ্বিতীয় জনের পাল্টা উত্তর, "না, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই শব্দ শুনতে পেতো। তাছাড়া, কেউ যদি এই ফুলগাছগুলোর যত্ন নিতেই এখানে আসতো, তাহলে সে নিশ্চয়ই আগাছাগুলোও কেঁটে-ছেঁটে রাখতো"।

দ্বিতীয় বন্ধু তার বিশ্বাসে অটল। সে বললো, " দেখো, কীভাবে এগুলো সাজানো। বুঝাই যাচ্ছে এখানে একটি সৌন্দর্যবোধ কাজ করছে এবং এর একটা উদ্দেশ্য আছে। সুতরাং আমি বিশ্বাস করি কেউ একজন আসে। হতে পারে এমন কেউ আসে যাকে নশ্বর চোখে দেখা যায় না। আমি বিশ্বাস করি, যত ভালোভাবে আমরা বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখবো ততো বেশি আমরা এই সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হবো যে কেউ একজন আসে"। তারপর তারা বাগানটিকে ভালোভাবে পরীক্ষা করা শুরুকরলো। কখনও কখনও তারা এমন কিছুর সংস্পর্শে আসলো যা ইঙ্গিত করে যে সত্যিই একজন মালী এই বাগানে আসে। কখনও কখনও তারা ঠিক বিপরীত কিছুর প্রমাণ পেলো। আবার কখনও তাদের এমনও মনে হলো যে, যে লোকটি বাগানে চুপিসারে আসে সে ক্ষতি করার উদ্দেশ্যেই ঢোকে, সে দুষ্ট লোক। বাগানটিকে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা তো তারাই করলোই। তাছাড়াও একটি বাগানকে ফেলে রাখলে কি ঘটে তা জানার জন্য তারা গবেষণা করতে থাকলো।

এইসব পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে একজন যা জানতে পায় তা আরেকজন শিখে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর গবেষণার শেষে একজন বললো, "আমি এখনও বিশ্বাস করি একজন মালী আসে"। অন্যজন বললো "আমি বিশ্বাস করি না"। তাদের গবেষণায় বাগান সম্পর্কে তাদের পর্যবেক্ষণ একইরকম। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তগুলো ভিন্ন ভিন্ন। প্রাপ্ত তথ্যে উপাত্তে কোনো পার্থক্য ছিল না। এমন কি তারা যদি আরো বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতো তাতেও কোনো পার্থক্য তৈরি হতো না বলেই তারা মনে করে। কিংবা এবিষয়েও তাদের কোনো মতপার্থক্য নেই যে ফেলে রাখলে একটি বাগান দ্রুত অগোছালো ও জংলা হয়ে যায়।

এই পর্যায়ে, এই পতিত বাগান ও তার গাছপালা সম্পর্কে "একজন মালী আসে" বিষয়ক হাইপোথিসিসটি আর গবেষণার বিষয় থাকলো না। একজন হাইপোথিসিসটি মেনে নিচ্ছে এবং অন্যজন মেনে নিচ্ছে না। মজার বিষয় হলো দুজনের কেউই বাগানের ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটবে বলে আশা করছে না যা অন্যজন করছে। বাস্তব বিষয়গুলো সম্পর্কে দুজনের ধারণাই একরকম। তাহলে, দু'জনের মধ্যে পার্থক্যটা কী? একজন বলছে, "A gardener comes unseen and unheard. He is manifested only in his works with which we are all familiar".। অন্যজন বলছে, "No, there is no gardener"।

মালী সম্পর্কে তারা যে আলাদা আলাদা কথা বলছে তার উপর ভিত্তি করে বাগানটির সম্পর্কে তাদের অনুভূতি আলাদারকম হয়ে যাচ্ছে। একই তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দু'জন দুইভাবে বিষয়টির ব্যাখ্যা দিচ্ছে। তাতে বাগানটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটা ভিন্ন চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। বাগানের অতীতটিও ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে এই ব্যাখ্যায়। তবে বাগানটির ভবিষ্যত সম্পর্কে তাদের আশা-আকাঙ্খা একইরকম মনে হচ্ছে। দু'জনই চায় আগাছামুক্ত সাজানো-গোছানো একটি বাগান।

উপরের "মালী"-র রূপকটি একটি বিখ্যাত রূপক। জন উইজডম তার ধর্মের দর্শন বইটির শুরু করেছিলেন এই গল্প দিয়ে। এই গল্পটির সারকথা হলো, বিবদমান দুই পক্ষ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় এমন তথ্য-উপাত্ত বিষয়ে আপত্তি তোলে না, এমনকি ভবিষ্যতে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কি পাওয়া যেতে পারে তা নিয়েও কোনো বিরোধে লিপ্ত হয় না। বরং একই ধরনের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তারা ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। উভয়পক্ষই পৃথিবী সম্পর্কে তাদের মনের ভাবকেই কথার মাধ্যমে প্রকাশ করছে। তবে কোনো বক্তব্যে ভাবের প্রকাশ ঘটলেই সেটি যে জগৎ সম্পর্কে সত্য কথা তা বলা যাবে না।


মন্তব্য

অরূপ এর ছবি

চলুক
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নির্বোধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!

ফারুক হাসান এর ছবি

জটিল পোস্ট।
তবে শুধু ধর্মের ব্যাপারেই রূপকটা ব্যবহার্য না। আমার মনে হয় শিল্পকলার রস আস্বাদনের ক্ষেত্রেও মালী'র রূপকটা খাটে।
যা জলের মত সহজ, তার জন্য রূপক দরকার হয় না। বেসিকালি, রূপক যেটা করে তা হলো, ঘোট পাকানো। সে ধর্মেই হোক, আর শিল্পকলায়।
রূপক ব্যাপারটাই এমন।

-----------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

একমত।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সৌরভ এর ছবি

আবার দেখা হয়ে গেলো সেই পোস্টটার সাথে যেটার মাধ্যমে আমি শৌমচৌদার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

কৃতজ্ঞতা।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

দ্রোহী এর ছবি

সেইরকম.............


কি মাঝি? ডরাইলা?

??? এর ছবি

বেসিকালি, রূপক যেটা করে তা হলো, ঘোট পাকানো।

ঘোট পাকানো জিনিসটা বুঝলাম না। তবে ধর্ম জিনিসটা বিশ্বাস/অবিশ্বাস-এর ওপর দাঁড়ানো। তবে এই রূপকটা অনেকটা অধিবিদ্যার রূপক বলে মনে হল।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

ফারুক হাসান এর ছবি

ঘোট বলতে আমি বুঝিয়েছি, এক ধরনের তুলনার অবতারনা করা যা প্রকৃত ব্যাপারটাকে রহস্যের চাদরে জড়িয়ে রাখে। প্রায়শই এতে কল্পনার অতিরঞ্জন নয় তো সত্যের নিদারুণ ব্যাত্যয় ঘটে।
তবে, রূপকের সৌন্দর্যের সাথে এর কোনো সংঘর্ষ নেই। শিল্পে রূপকের স্থান অভিজাত স্তরেই। বরং কাটখোট্টা জলবত তরলং বর্ণনার চেয়ে রূপক অনেক শক্তিশালীই।
তাই শিল্পের ঘোট খারাপ অর্থে নয় সুষমাবর্ধক হিসেবেই আমার কাছে ধরা দেয়।
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

??? এর ছবি

বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম ঐটা ফাহা থুক্কু ফারুক হাসানের মন্তব্য ছিল।
ঠিকই বলেছেন। তবে "প্রকৃত" বা "সত্য" কি আসলেই কখনো আবিষ্কারযোগ্য, বিশেষত সৌন্দর্যবিদ্যায়?

..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

ফারুক হাসান এর ছবি

সুমন ভাই, জটিল প্রশ্ন। আবিস্কারের নেশাই তো শিল্পকলার ড্রাইভিং ফোর্স।
সৌন্দর্যকার হিসেবে আপনার উত্তরেরই অপেক্ষায় রইলাম।

(পুনশ্চ: দৈবাদেশপ্রাপ্ত হইয়া নিকটা বদলাইলাম হো হো হো
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

আমিও দেখি ফারুক হাসান। আর অবাক হই।
দৈবাদেশ কীভাবে পাইলেন তাও লিখেন। মালী সত্যি সত্যি আসে কিনা ধন্দ দূর হোক আমাদের।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

ফারুক হাসান এর ছবি

সে এক বিরাট ইতিহাস। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, কোথাও কেউ নেই। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, ভেতরে কেবল ত্রিতালে শব্দের ঠুকাঠুকি। আর টেবিলের কোণায় একটা চিঠি; উপর নিচের দুই সম্বোধনসূচক শব্দাবলি সেন্সর করে তুলে দিলে দাড়ায়-

আমি টুকুন আপার সাথে শপিংয়ে যাচ্ছি, চিন্তা কোরো না। fruit খেয়ে গোসল দাও। পারলে বাথরুম কি একটু ক্লিন করবে? ফ্রিজে মাংস ও শাক আছে, বের রে গরম করে খেয়ে শেষ করবা।* আর বাসায় থেকে পড়ো।
নো 'blog' এ ঢুকাঢুকি।
পানি, কোক খেয়ো।
*একটা বাটিতে সবজিও আছে, খাবা।

আমি উঠে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখি। অনেকটা ধন্দ হয়, যে জীবন দোয়েলের সে কই? যে জীবন স্বাপ্নিকের সে কোথায় হারিয়ে গেছে? এক টুকরো চিরকুটে বাধা আমার দিনাতিপাতে লেগে থাকা আড়স্টতার ঝোলটুকুর দিকে আমি কুন্চিত ভ্রু নিয়ে তাকিয়ে থাকি।

কোথায়ো বাজ পড়ার শব্দ হয়। আমি কেঁপে উঠি, কিন্তু নড়ি না। কন্সটেনটিন হই, গ্যাবরিয়েলের ধবধবে পাখা পুড়িয়ে শুদ্ধতা অর্জন করি।
ঠিক তখনই আমার ঈশ্বরের কথা মনে পড়ে যায়। না, আমি তাকে জপ করি না। কেবল নিজের ভেতর স্রষ্টার বল পাই। কি আছে যাকে গড়েছি আমি, যাকে একদলা থুথুর মত ভালোবাসি যখন সে ভিজিয়ে রাখে আমার উষ্ঠ!
আমি নাম বদলানোর সিদ্ধান্ত নেই। সে কি দৈবাদেশ নয়?
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।