সুমন চৌধুরীর দু:সাহসী অনুবাদ প্রচেষ্টার পর্যবেক্ষণ অথবা অজানা ভাষার কবিতা-অনুবাদের সমালোচনা চেষ্টা

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: শুক্র, ০২/১১/২০০৭ - ৭:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুমন চৌধুরী ব্রেখটের একটা কবিতা অনুবাদ করেছেন তার পোস্টে। সরাসরি জার্মান থেকে। ব্রেখটের প্রতি আগ্রহের কারণে অনুবাদটা পড়েছি যাকে সুমন চৌধুরী বলছেন অনুবাদের দু:সাহস। অনুমান করি এটা তার বিনয় এবং সমালোচনা থেকে বাঁচবার ঢাল। অনুদিত কবিতা আমরা অবশ্যই পড়তে চাই। সেজন্য প্রবাসী কবিরাই তো ভরসা। ... ...
সুমন চৌধুরীর অনুবাদটা পড়ার পর একটা সমালোচনা লেখার খায়েশ হওয়াতে আমার এই পোস্ট। ভূমিকাটুকু ছাড়া তার পোস্টের শেষে মন্তব্য হিসেবেই এটার জন্ম। ... ...
আগেই বলা ভালো জার্মান আমি জানি না। আর জার্মান কবিতার অনুবাদ কতটা ঠিক হলো তা বিচার করাতো অসম্ভব। কিন্তু সুমন চৌধুরী মূল জার্মান কবিতা দিয়ে দিয়েছেন। সেই অজানা ভাষার কবিতার দিকে তাকিয়ে অনুবাদের সমালোচনা কতটা করা যায়, এই লেখা তারও একটা প্রচেষ্টা। আমরা ধারণা করেই থাকি, যে কবিতা লেখার থেকে কবিতার সমালোচনা করাই সহজ। ... ...
যারা সুমন চৌধুরীর অনুবাদ পড়েননি, তারা সুমনের পোস্টে গিয়ে মূল কবিতা ও সুমন চৌধুরীর অনুবাদ পড়ে নিতে পারেন। অথবা এই পোস্টের নিচে আগেই উঁকি দিয়ে তারপর সমালোচনা পড়তে শুরু করেন।

কবিতা হিসেবে অনুবাদটা খুবই পছন্দ হয়েছে। তবে অনুবাদ হিসেবে ঠিক বুকে টেনে নিতে পারছি না। কারণ আকারে প্রকারে আমার মনে হচ্ছে, অর্থাত অর্থ না বুঝে শুধু রোমান হরফ পড়তে পারার ক্ষমতায়, মূল জার্মান কবিতা অনেক বেশি কাব্যিক।

ধারণা করি মূল ভাব অনুবাদে এসেছে। সুমন চৌধুরি নিশ্চয়ই ব্রেখটের নামে নিজেই একটা কবিতা লেখেননি। সুতরাং ভাবটি ব্রেখটের এটা নিশ্চিত হই সুমনের উপর ভরসা করে। কিন্তু মূল ভাবটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট নয়। আমি অনুবাদে মূল কবিকে যত বেশি পাওয়া সম্ভব ততোটাই চাই । কারণ আমি ব্রেখটকে বুঝতে, জানতে ও পড়তে এই অনুদিত কবিতাতে চোখ রেখেছি।

মূল কবির যে ভাষাভঙ্গি, ছন্দ, চরণ বিন্যস্ততা; অনুবাদে সেগুলো ধরার চেষ্টা করার কঠিন কাজ সুমন চৌধুরী স্পষ্টতই এড়িয়ে গেছেন। বলা যায় হয়তো, অনুবাদের পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি নিয়েছেন।

কেন? তার ব্যাখ্যা আমরা জানি না (সুচৌ জানালে আমরা আরেকটা লেখা পাবো আর অনেক অনেক বিতর্ক বা আলোচনা করতে পারবো।)। কিন্তু যে কারণেই তিনি এই এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন না কেন, তার ফলাফল হিসেবে যে অনুদিত কবিতাকে আমরা পাচ্ছি তা ব্রেখটকে আমাদের কাছে আরো ভালোভাবে পৌঁছে দিচ্ছে না। তাকে পৌঁছাচ্ছে কম কাব্যময় করে, কম ব্যঞ্জনাময় করে। জিব্রাইল এখানে আল্লাহর বাণীতে সিনটেক্স এরর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। চোখ টিপি

আমি ধারণা করি যে ব্রেখটের ভাষাভঙ্গির মধ্যে তার দশক বা সমকালীন জার্মান কবিতার একটা ছাপ আছে। অনুবাদে সেটা উধাও হয়ে সমকালীন বাংলা কবিতা ঢুকে পড়েছে।

সাদা চোখে আমরা দেখতে পাই মূল কবিতাটি দুটি অনুচ্ছেদের। ৮ ও ৪ লাইনের। মাঝে কবির একটি পরিকল্পিত বিরতি বা ছেদ।
সেইসাথে দেখা যায় প্রতি চরণের সাথে পরবর্তী চরণের একটি অন্তমিল আছে। শব্দার্থ না বুঝে রোমান হরফ ধরে পড়ে গেলেও আমরা একটা ছন্দ ধরতে পারি।

আমরা এও দেখি যে প্রথম অনুচ্ছেদে কবি বিষয়টাকে উপস্থাপন করছেন। কেন গাছটাকে মানুষ অন্য গাছ হিসেবে ভুল বুঝে তাই হয়তো প্রথমেই জানিয়ে দিচ্ছেন হয়তো। তারপর প্রথম অনুচ্ছেদেই আমরা দেখতে পাই কবি প্রশ্ন তুলছেন। নানা প্রশ্ন। আমরা প্রশ্নচিহ্ন দেখে এটা অনুমান করতে পারি যেরকম প্রশ্নচিহ্ন আমরা অনুবাদে দেখি না। আমি ধারণা করি এসব প্রশ্ন দিয়ে তিনি মানুষের ভুল ধারণাকে নাড়াও দিচ্ছেন, তাদের যুক্তিকে কেটেও দিচ্ছেন।

তারপর, জার্মান ভাষা না বুঝেও আমি ধরতে পারি, যে এই উপস্থাপনার অনুচ্ছেদের ৮ লাইন বাদে কবি একটা বিরতি দেন। পরিকল্পিত বিরতি। এবার তিনি অন্য কথা বলবেন। তার সিদ্ধান্ত জানাবেন এর একটা প্রস্তুতি তিনি নেন, পাঠক করেন সেই অপেক্ষা।

সুতরাং পরবর্তী অনুচ্ছেদে, আমি ধারণা করি কবি প্রথম অনুচ্ছেদে তার চিহ্নিত করা সমস্যাটাকে সংক্ষেপে দু লাইনে বলেন। অর্থাত তিনি জানান যে কেন মানুষ গাছটিকে ঠিকঠাক চিনতে পারে না। এবং শেষ দুই লাইনে কবি তার নিজস্ব সিদ্ধান্তটা দেন। এবং কাব্যের চল দেখে (জার্মান না বুঝেও) অনুমান করি মূল তথ্যটা কবি দেন শেষ লাইনে। অর্থাত এই বক্তব্যটা যে, ‌'গাছের পাতাই বলে দিচ্ছে এটা সেই গাছ'।

শেষ অংশটা সম্ভবত: সুমন চৌধুরী ঠিকঠাক রেখে দিয়েছেন। তার অনুবাদে, 'পাতা দ্যাহেন না'- অর্থাত পাতার কথা শেষেই এসেছে। (যদিও আমার ধারণা মূল কবির কণ্ঠস্বর সুমন চৌধুরীর অনুবাদের মতো এতো অধৈর্য ও বিরক্তিমাখা নয়, বরং একটু দূরবর্তী ও আনুষ্ঠানিক।)

কিন্তু কবি যে ভাবে, ধীরে ধীরে এই শেষ বাক্যে পৌঁছান সুমন চৌধুরী সেই ভঙ্গিটা অনুসরণ না করায় আমি মনে করি কবির সৃষ্টিকর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক - সিদ্ধান্ত উন্মোচনের ধারা- অনুবাদিত হয়ে ভেজাল হয়ে গেছে। অনুবাদে সব সময় কিছু ভেজাল ঢুকে যাওয়ার আশংকা থাকে। সেটা যদি দুই ভাষার পার্থক্যের কারণে হয় তবে মেনে নেয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্য কোনো কারণে হলে তা তীব্র সমালোচনায় উতরাতে হবে অবশ্যই।

কবিতার শেষ লাইন নিয়ে, পাতা ও গাছ চেনা নিয়ে কথা বলতে বলতে আমার মনে হয় ব্রেখট নিশ্চয় অপ্রয়োজনীয় অদরকারি কোনো গাছ নিয়ে কবিতাটি লিখেন নি। এত কষ্ট করে চেনানোর চেষ্টা করছেন যে গাছ সেটি মাকাল হতে পারে না। অবশ্যই এটা আমার অনুমান। আমি জার্মান জানি না। আমি অনুমান করি গাছটি জার্মানদের খুব চেনা, অতি পরিচিত, প্রায় সব বাগানে থাকা একটা গাছ হবে। আমাদের আম-জাম-বরই গাছের মত। কারণ কবিতায় বুঝা যাচ্ছে ফল ধরে না বলে একে লোকে চিনছে না। সুতরাং এটি অবশ্যই এমন একটি ফলের গাছ যার ফল দিয়েই লোকে একে এত বেশি চেনে যে এর পাতা, এর কান্ড বা অন্যান্য দর্শনীয় অংশগুলো মানুষের অজানা থেকে যায়, অগোচরেই থেকে যায়। সুতরাং এটি পরিচিত ফলের গাছ হওয়ার কথা। মাকাল হতে পারে না। অন্তত: আমার তাই ধারণা। সময়ের সাথে সাথে ধারণাটা আরো দৃঢ় হচ্ছে।

কেন সুমন চৌধুরী ফলের গাছকে মাকাল বলে অনুবাদ করেছেন তা আমার বোধে আসে না। শব্দটার অর্থ কি আসলেই তাই?

অনুভূতির এই পর্যায়ে এসে আমার মনে হয়, সুমন চৌধুরী অনুবাদক হিসেবে আলস্য ভেঙে যথেষ্ট খাটাখাটনি করেন নি। হয়তো তিনি প্রাথমিক একটা অনুবাদ তুলে দিয়েছেন। অথবা পাঠককে ততোটা আমলে নেননা। অথবা ব্রেখটকে তিনি নিজের আয়নায় এভাবেই বিম্বিত দেখতে চান। ব্রেখটকে তিনি নিজের মতো করে পাঠ করতে চান, এটাই কি তার দু:সাহস?

এই পর্যায়ে এসে আমার মনে হয়, মূল ভাষা না জেনেও অনুবাদের অনেক খোলনলচে বুঝা সম্ভব, কিন্তু ভাষা ও শব্দার্থগুলো জানা থাকলে অনুবাদকের সৃষ্টিশীলতা নিয়ে আরো গভীর গভীর প্রশ্ন তোলা যেতো।


ব্রেখটের মূল কবিতা:

Der Pflaumenbaum

Im Hofe steht ein Pflaumenbaum,
Der ist so klein, man glaubt es kaum.
Er hat ein Gitter drum,
So tritt ihn keiner um.
Der Kleine kann nicht gr? wer'n,
Ja - gr? wer'n, das m?' er gern!
's ist keine Red davon:
Er hat zu wenig Sonn'.

Dem Pflaumenbaum, man glaubt ihm kaum,
Weil er nie eine Pflaume hat.
Doch er ist ein Pflaumenbaum:
Man kennt es an dem Blatt.


সুমন চৌধুরীর দু:সাহসী অনুবাদ:

মাকাল

উঠানে মাকালের গাছ খাড়া একখান
এতো বাইঠা যে মাইনসে চিনেই না ।
জাংলা আবার দিছে ঠিকঠাক-
লোক ঠেকাইতে ।
এই বাট্টুর কপালে বড় হওয়া নাই ,
খালি হাউস আছে পাক্কা ;
রোইদ পায় ঠিকঠাক ,
ওইটা ঠিকাছে ।
মাকাল ধরে না তাই
গাছেরে মাকাল ডাকেনা কেউ !
তবে ঘটনা হইলো :
এইটা আসলেই মাকালের গাছ !
পাতা দ্যাহেন না ?


মন্তব্য

সৌরভ এর ছবি

আমার তো সুমন বদ্দার ভাষা নিয়ে হেলাখেলা দারুণ লাগলো।

পাতা দ্যাহেন না?
লাইনটায় একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ছুড়ে দেওয়া হয় পাঠকের প্রতি। বেশ লাগে।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

সৌরভের মন্তব্যে বুঝা যাচ্ছে পাঠকরা অনুবাদককে অনেক প্রশ্রয় ও স্বাধীনতাই দিয়ে থাকেন। অর্থাত মূল কবির কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি তারা শুনতে চান তা না। অথবা মূল কবিতার বক্তা যার কণ্ঠে আমরা বক্তব্যগুলো শুনছি তার যে ব্যক্তিত্ব সেটা অনুবাদে আসাটা জরুরি নয়।

সৌরভের মন্তব্য বাকীরা ভেবে দেখবেন। সেক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে, অনুবাদ ও রূপান্তরিত অনুবাদ বলে কি আলাদা অভিধা ঠিক করার দরকার আছে?
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

আমি একটা প্যারোডি বানাইতে পারি। সুমনেরটা মনে হয় প্যারোডি আর অনুবাদের মাঝামাঝি।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

সুমনেরটা মনে হয় প্যারোডি আর অনুবাদের মাঝামাঝি।
বলাইয়ের মন্তব্যে নতুন একটা অর্থ তৈরি হলো। অর্থাত অনুবাদের দু:সাহস কথাটার আড়ালে সুমন চৌধুরী কবিতাটা নিয়ে একটু রস করারও সাহস দেখিয়েছেন।
তবে আমার মনে হয় না সুমন প্যারোডির চেষ্টা করেছেন। আমার মনে হয় সুমন কবিতার বক্তা, বক্তার ব্যক্তিত্ব, ভাষাভঙ্গি, ছন্দ এগুলো বদলে দিয়ে নতুন একটা কণ্ঠস্বরে অনুবাদটা হাজির করেছেন।

তবে বলাইর প্যারোডির জন্য আমরা সাগ্রহে অপেক্ষা করবো।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

ফারুক হাসান এর ছবি

খাইছে!

----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

ফারুক হাসানের মন্তব্যটা অবশ্য সুমনের কপিরাইট মন্তব্যের সরাসরি কপি-পেস্ট। তবে এই পোস্টে সুমন চৌধুরী এই মন্তব্য করবেন কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা বাড়ানো যায়।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

অমিত আহমেদ এর ছবি

আমার মনে হয় মূল কবির প্রকাশভঙ্গীটা ব্যহত হলে সেটা আর অনুবাদ থাকে না, ভাবানুবাদ হয়ে যায়। বদ্দার কবিতাটা (মনে হচ্ছে কবিতাটা যতটানা ব্রেখটের তার চেয়ে বেশি বদ্দার) আমার কছে জটিল লেগেছে। তবে বদ্দার ব্রেখটের কবিতার শব্দ, চরন বিন্যাস, ছন্দ নিয়ে কাটাকুটি আমার ভাল্লাগলেও কবি ব্রেখট এর নাও লাগতে পারে যেহেতু "অনুবাদ" শব্দটা ব্যবহার করায় কবিতাটায় ব্রেখটের ছপ্পর লাগানো হয়ে গেছে। পাঠক বদ্দার স্টাইলকে ব্রেখটের স্টাইল বলে ধরে নিতে পারেন।

তাই শোমচৌ ভাইয়ের "অনুবাদ ও রূপান্তরিত অনুবাদ বলে কি আলাদা অভিধা ঠিক করার দরকার আছে?" প্রশ্নের উত্তরে আমি বলবো "দরকার আছে"।


ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি তোমায়!
ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

সুমন চৌধুরী এর ছবি

খাইছে!
কাহিনি হৈল,
Der Pflaumenbaum মানে পামগাছ। এইটার প্রথম অনুবাদের সময় প্রথমে গাবগাছ কইছিলাম। পরে তীরন্দাজের সাথে আলোচনা হইছিল। সেইখানে মনে হইল "মাকাল" কথাটা ব্রেখটের কন্টেক্সটের সাথে অনেক বেশী যায়। ব্রেখটের জীবনের শেষ দিকের কবিতাগুলা প্রচন্ড শ্লেষাত্মক ছিল। এইটাও তার মধ্যে একটা। গত বছর ডিসেম্বরের দিকে মাথায় ক্যারা উঠায় টাইনা ব্রেখটের ২-৩টা কবিতা অনুবাদ করছিলাম। সবগুলা নিজেরই পছন্দ হয় নাই।

কবিতা অনুবাদ প্রসঙ্গে একটা সমস্যা চিরকালীন। অনুবাদ করলে মূল টেক্সট থিকা যেই জিনিসটা হারায় সেইটাই আসলে কবিতা। অর্থাৎ কবিতার অনুবাদে অনুবাদকরে মূল কবির চাইতে বেশী খুইজা পাওয়া অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তারপরেও কবিতা অনুবাদ করা হয়। সেইখানে চেষ্টা থাকে মূল কবিতার থিম ধইরা রাইখা যথাসাধ্য কবির ব্যবহৃত শব্দগুলা টিকাইয়া রাখার।

অনুবাদে যেইটা উপরে দেখা যাইতেছে ঐটা আসলে ব্রেখটের শব্দাবলী আর থিম প্যাচাইয়া লেখা আমার কবিতা সদৃশ কিছু লেখার অপপ্রয়াস।

এই হইলো ঘটনা।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

সুমন চৌধুরী আরেকটু পরে কাঠগড়ায় দাঁড়ালে ভালো হতো। বিচারকার্য দেরিতে করার মনে হয় কিছু কিছু সুবিধা আছে। তাত্ক্ষণিক আবেগজনিত প্রতিক্রিয়া থেকে বিচারক একটু দূরে যেতে পারেন।
সুমনের আগে তার পক্ষে আরো অনেকে মতামত দিতে পারতেন। এখন অনেকে হয়তো সুমন চৌধুরীকে রক্ষার মনোভাবে আমার দিকে তীর ছুঁড়বেন।
কিন্তু এই সমালোচনা আমি আদতেই করতে যেতাম না যদি না ভাষাটা জার্মান হতো। এবং শব্দার্থ না বুঝেই কবিতার শব্দ-বাক্য গঠন দেখে আমি কবিতাটা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করতাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল অর্থ না বুঝেও অনুবাদের সমালোচনা করা যায় কিনা তার একটা চেষ্টা করা। আমার কাছে মনে হয়েছে দুয়েকটা জায়গায় সেটা ভালোভাবেই পারা গেছে। অর্থাত মূল না বুঝেও অনুবাদ পড়েও সমালোচনা করা যায়।

(বাকীগুলো দুপুরের চাইনিজ খেয়ে আসার পর।)

-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

অমি রহমান পিয়াল এর ছবি

তারপরো সেরকম হইছে। কইতারেন ব্রেখট হয়তো সমকালীন সুশীল সমাজের জন্য কোবতেটা লিখছিল। বদ্দা সবার জন্য লিখছে, সুশীলগোও সমস্যা হইবার কথা না


তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই


তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

অমি রহমান পিয়াল দেখা যাচ্ছে সুশীল সমাজের চিন্তা-ভাবনা নিয়া ভীষণ উদ্বিগ্ন আছেন।
তবে কথা ঠিক, ব্রেখটেরটা ততকালীন সুশীল সমাজের জন্য।
সুমন চৌধুরীরটা, সমকালীন সুশীল সমাজের জন্য।

সমস্যা হচ্ছে না। এটা সবার মন্তব্য দেখে অনুমান করা যায়।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

রেজওয়ান এর ছবি

শোহেইল ভাই একটি ভাল বিতর্কের অবতারনা করেছেন। মূল কবির যে ভাষাভঙ্গি, ছন্দ, চরণ বিন্যস্ততা; অনুবাদে সেগুলো আনা খুবই কষ্টকর। দুই ভাষায় অত্যন্ত ভালো দখল এবং কবিতা রচনায় অভিজ্ঞতা ছাড়া এটি প্রায় অসম্ভব বলেই আমি মনে করি। আরও অসুবিধা হচ্ছে অনুবাদের সময় রুপকগুলো ঠিকভাবে আনা যায় না।

তবে অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি যেটি মনে করি সেটি হচ্ছে মুল ভাবটিকে রেখে এবং অন্তর্নিহিত বক্তব্যকে যতটুকু সম্ভব যে ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে সেটাতে নিয়ে আশা। এর জন্যে কিছু স্বাধীনতা অনুবাদকের অবশ্যই প্রাপ্য। নাহলে কাঠখোট্টা অবোধ্য কিছু একটা দাড়াবে।

এখানে উল্লেখ প্রয়োজন যে Pflaumenbaum অর্থ প্লাম গাছ যে ফলটিকে আমরা চিনি আলুবোখারা হিসেবে। যেহেতু এই ফলটিকে আমি এতদিন শুকনো অবস্থায়ই পেয়েছি এবং এটি যে খুব মজাদার একটি রসালো ফল তা জার্মনিতে আসা পর্যন্ত বুঝিনি তাই সুমন চৌধুরীর অন্য রুপক ব্যবহার করা আমি দোষের কিছু দেখি না (তবে মাকাল ফল হবে কিনা সে নিয়ে আমার দ্বিমত আছে)। কারন পাঠকরা রুপকটির সাথে পরিচিত থাকলে ভাল।

এখন একটি ছোট এক্সপেরিমেন্ট করছি:

কবিতাটির সরল অনুবাদ হচ্ছে নিন্মরুপ:

উঠোনে একটি আলুবোখারার গাছ দাড়িয়ে
এটি এত খাটো যে একে বিশ্বাস করে না কেউ
এর চারিদিকে বেড়া দেওয়া
তাই কেউ তার আশপাশ মাড়ায়না
ছোট গাছটি বড় হতে পারেনা
মানে বড় হতে সে অবশ্যই চায়
সেটি বলছি না
এটি রৌদ্র পায় কম

আলুবোখারা গাছটিকে মানুষ কমই বিশ্বাস করে
কারন আলুবোখারা কখনই হয়নি গাছে
কিন্তু তবুও এটি আলুবোখারার গাছ
মানুষ একে পাতা দেখেই চেনে।

তবে শোহেইল ভাইয়ের কথা অনুযায়ী ছন্দ, চরণ বিন্যস্ততা যদি ঠিক রাখতে চাই তবে সেটি হয়ত এমন দাড়াবে:

উঠোনে কি গাছ ওটা, আলুবোখারা?
এত খাটো যে অসম্ভব বিশ্বাস করা।
চারিদিকে বেড়া দেওয়া খাশ,
মাড়ায়না কেউ তার আশপাশ।
ছোট গাছটি হতে পারেনা বড়।
অবশ্যই চায় হতে সে বড়সড়,
সেটা তো প্রশ্ন নয়,
রৌদ্র কম সে পায়।

আলুবোখারা গাছ বিশ্বাসে কেউ বলেনি
কারন গাছে আলুবোখারা কখনই ফলেনি
কিন্তু একে আলুবোখারার গাছ জানে
সব মানুষ একে পাতা দেখেই চেনে।

আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন সুমন চৌধুরীর মত তেমন রসালো হয়নি কারন ভাব ও ছন্দের দিকেই মনযোগ ছিল বেশী।

আর সুমন চৌধুরীর মত ভাষাভঙ্গীটি আনতে পারিনি কারন ব্রেষ্ট খুব উচ্চ মার্গের ভাষা ব্যবহার করেননি (যেমন অমি রহমান পিয়াল আন্দাজ করেছেন) তবে ছন্দ মেলাতে উনি কিছু অক্ষর ছেটে দিয়েছেন -> যেমন wer'n - werden এর বদলে।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

রেজওয়ান যে এক্সপেরিমেন্টটা করলেন তা এককথায় দুর্দান্ত।
অনুবাদের আগে এইরকম ভিন্ন ভিন্ন পাঠ নিশ্চয়ই অনুবাদক করেন।
লিখে না হলেও মনে মনে।

তবে বিশ্বাস শব্দটি আপনার অনুবাদে দেখছি। সুমনের অনুবাদ পড়ে মনে হলো এটা চেনা-জানা শব্দের কাছাকাছি কিছু একটা হবে।

যাক আপনার মন্তব্য আলোচনাটায় বিরাট মাত্রা যোগ করেছে। ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

রেজওয়ান এর ছবি

× আনতে পারিনি কারন ব্রেষ্ট খুব উচ্চ মার্গের ভাষা ব্যবহার করেননি
হবে:
আনিনি কারন ব্রেশট খুব উচ্চ মার্গের ভাষা ব্যবহার না করলেও সাধারন কথাই আনুষ্ঠানিক ভাবে বলেছেন।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

??? এর ছবি

অনুবাদ নিয়ে চিরকালীন একটা তর্ককে উসকে দেয়ার জন্য বর্তমান অনুবাদটি এক্কেবারে লাগসই। মনে পড়ে, সুভাষ বা মানবেন্দ্র-র অনুবাদে এটা পড়া হয়েছিল। সেখানে গাছের নাম "মাকাল গাছ"ই ছিল।

নানারকম নাম দেয়া হয়েছে এই কর্মটার। অনুবাদ, প্যারডি আর অনুবাদের মাঝামাঝি, রূপান্তরিত অনুবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি। অনুবাদকে অনেকে নিরাপত্তার খাতিরে অনুসৃজন বলতে চান সেও আমরা অন্যত্র শুনেছি।

তবে, বর্তমান "অনুবাদের" যে ধরন (আইজাক সিঙ্গার-এর একটা গল্প "অনুবাদ" করেছিলাম আমি একই ধরনে), তাকে যে নামই দেয়া হোক, সেটা এক বিচারে অবিশ্বস্ত অনুবাদই বটে। অনুবাদকের ব্যক্তিত্ব বেশ উজ্জ্বলভাবে ফুটে ওঠে এখানে। আমরা কি পপ মিউজিক ট্রাডিশন থেকে "রিমেক" শব্দটা ধার করতে পারি এই ফর্মটাকে ধরার জন্য?
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

অবিশ্বস্ত অনুবাদ। হুম এরকম তো হয়ই। অনেকটা আনঅথরাইজড অটোবায়োগ্রাফি'র মতো। বায়োগ্রাফি তো যে কেউ লিখতে পারে তার ইচ্ছামত।
অটোবায়োগ্রাফি নিজেকেই লিখতে হয়। সেটা অন্যে বিনানুমতিতে লিখে ছেপে দেয়ার একটা চল আছে, আনঅথরাইজড বায়োগ্রাফি বলে।

'রিমেক' শব্দটা মুভিতেই বেশি শুনি। মিউজিকে বেশি শোনা যায় রিমিক্স। অনুসৃজন শব্দটা খারাপ নয় সেইদিক থেকে।

একই ভাষা থেকে একই ভাষায় অনুবাদ হয় না? 'সংক্ষেপিত সংস্করণ' বা 'কিশোর সংস্করণে'র মত 'অনুদিত সংস্করণ'। বিহারীলাল বা মাইকেলের কবিতা অনুবাদকের নিজস্ব বাক্যভঙ্গিতে অনুদিত হলো... বাংলা টু বাংলা ....
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।