বছরের হিসেব করলে অভিজিৎ রায় জন্মেছিলেন বাংলাদেশের জন্মলগ্নে। বাংলাদেশের বয়স আজো বেড়ে চলে প্রতিটি বছর, তাঁর বয়স থেমে গেছে ২০১৫ তেই। লেখকের সন্তান তাঁর বই। চাপাতির ঘায়ে তাঁর দেহকোষের বিভাজন-পুনঃবিভাজন থেমে গেলেও বইগুলো থেকে যাবে মুদ্রণ-পুনঃমুদ্রণের চক্রে আরও বহুকাল। নৈতিকঠোলারা হয়ত বইমেলা-প্রকাশনী-ছাপাখানা বন্ধ করে প্রবল আতংকে ঠেকিয়ে রাখবার চেষ্টা করবেন আলো। তবু তড়িৎ-বই আর আন্তর্জালিক জগতে অনেক কপি পৌঁছে যাবে আরও অনেক অনেক মানুষের কাছে।
অভিজিৎ রায় লেখা শুরু করেছিলেন ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ দিয়ে। এই বইটিতে নিউটন-গ্যালিলিও থেকে শুরু করে, আইনস্টাইনকে ছুঁয়ে স্ট্রিং তত্ত্ব পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন লেখক। একেবারে সাবলীল বাংলায় কাঠখোট্টা বিজ্ঞানের ছয়টি অধ্যায়। সবশেষে একটি অতিরিক্ত অধ্যায়ে আলোচিত আপাতদৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ অপ্রাসঙ্গিক ‘মহাবিশ্ব এবং ইশ্বরঃ অন্তিম রহস্যের সন্ধানে’। এই অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন ‘ঘড়ির কারিগর’ শীর্ষক বহুল প্রচারিত (ও জনপ্রিয়) ফ্যালাসির খণ্ডন সহ ‘সাম্প্রতিক’ তথ্যের যৌক্তিক বিশ্লেষণ। হায় সেলুকাস! নীলক্ষার নীল জলে চাঁদ ডুবে যাবার পরের ঘুটঘুটে আঁধারে আজও গোল হয়ে আসে সকলে, ঘন হয়ে আসে সকলে- তারপর হালাল বইমেলায় বেস্ট সেলার হয় ‘প্যারাডক্সিকাল সাজিদ’।
সংখ্যাগরিষ্ঠের তথাকথিত ‘অনুভূতি’ কিভাবে ধর্ম কিংবা মতবাদ নাম নিয়ে ভাইরাসের মতন গেঁড়ে বসে মস্তিষ্কে এবং ছড়িয়ে পড়ে- সেকথাই বারবার এসেছে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটিতে। রূপা খাতুন কিংবা রোহিঙ্গা, পিনোকীও কিংবা ক্রিকেট, ট্র্যাম্প কিংবা আইএস, গফুর কিংবা টকশো, গুরমিত কিংবা ট্রান্সকম সবখানেই ঘুরেফিরে ভাইরাসের জয়জয়কার। প্রমথ চৌধুরী যেমনটি লিখেছিলেন- “ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়!” একই কথা কি এই ভাইরাসের জন্যও প্রযোজ্য নয়? এই প্রসঙ্গেই অভিজিৎ রায় লিখে গেছেন-
যে কোন ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য গড়ে তোলা দরকার ‘এন্টিবডি’, সহজ কথায় তৈরি করা দরকার ভাইরাস প্রতিষেধকের। আর এই সাংস্কৃতিক ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে আমার-আপনার মতন বিবেকসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষেরাই। আমি কিন্তু আসলেই মনে করি এই এন্টিবডি তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সামাজিক সচেতনতা। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী সাইটগুলোর বড় ভূমিকা আছে। ভূমিকা রাখতে পারে বিশ্বাসের নিগড় থেকে বেরুনো মানবাতাবাদী গ্রুপগুলো এবং মুক্তবুদ্ধিচর্চাকারী গ্রুপগুলো। দরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার। দরকার খোলস ছেড়ে বেরুনোর সৎ সাহসের। দরকার আমার আপনার সকলের সদিচ্ছার। আপনার-আমার এবং সকলের প্যারাসাইটিক প্রচেষ্টাতেই হয়ত আমরা একদিন সক্ষম হব সমস্ত বিশ্বাস-নির্ভর ‘প্যারাসাইটিক’ ধ্যানধারণাগুলোকে তাড়াতে। এগিয়ে যেতে সক্ষম হব বিশ্বাসের ভাইরাসমুক্ত নীরোগ সমাজের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে।
বিশ্বাসের ভাইরাস, ২য় সংস্করণ (জুন-২০১৪), জাগৃতি, পৃ-২৩০
রোগের ভাইরাস দূর করা বড় কঠিন ও কষ্টের কাজ, তবু তা করতেই হয়। নীরোগ শিশুর নিরাপদ ভবিষ্যতের বৃহত্তর স্বার্থে নবজাতকের মোলায়েম হাতে ইনজেকশনের সুঁই ঢোকানোর মতন নিষ্ঠুর আচরণ করতে পিছিয়ে থাকেন না মা-বাবা। সে দাঁতে দাঁত চেপেই হোক, আর বিকশিত দন্তপাটি সহকারেই হোক। বিশ্বাসের ভাইরাস দূর করাও বড় কঠিন ও কষ্টের কাজ, তবু তা করতেই হবে। আর নতুবা, আমাদের মেনে নিতে হবে সাস্টের ড্রোন গবেষণার বদলে ‘রেপিং ক্লাব’ (বিদ্রঃ সামগ্রিকভাবে সাস্টের শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদটুকু আমার ভাল লেগেছে, সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠের অবস্থান উল্টো হয়ে থাকে)। নির্ভয়াকান্ডে ভারতের মতন খেপে ফুঁসে ওঠার বদলে আমরা বারংবার দেখব রূপার জামার মাপ কিংবা তনুর নাট্যচর্চা নিয়ে তুমুল পিনাকীয় টকশো এবং টিকে থাকবে ‘অই ছেড়ি ওড়... ...দে’ টাইপের ফেসবুকীয় (এবং বাস্তব) দল। রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক চিন্তাভাবনা ছাপিয়ে ‘সংখ্যাগুরু’ হয়ে যাবে “চলুন রোহিঙ্গা বোনদের...” কিংবা “এদেশী বৌদ্ধদের...” গ্রুপ। এই দলেভারীদের জন্যই কি আজো পবিত্রজ্ঞান করে টিকে থাকে ‘মালে গনিমৎ’ এর কুৎসিত প্রথা?
আজকের দিনটিতে আমরা মন খারাপ করে বসে না থেকে বরং ধুলো পরা কিবোর্ড নিয়ে আবার নাড়াচাড়া করি? বহুদিন আগে লিখেছিলাম-
‘অভি’দা একটা কাজই করে গেছেন- বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি। আমি স্বপ্ন দেখি শত অভিজিৎ তাঁর রেখে যাওয়া আলোটা হাতে নেবে, ছড়িয়ে দেবে, নিরন্তর পথ দেখাবে আঁধারের যাত্রীদের। স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই, তাই না?’
যদিও, মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য। তবুও, আজ অভিদার জন্মদিনে পুনরায় পণ করছি- আবার বিজ্ঞান লেখালেখি শুরু করব। ম্লানমুখে ‘শুভ জন্মদিন অভিজিৎ রায়’ বলার চাইতে, লেখক অভিজিৎ রায়কে সম্মান জানাবার কার্যকর পথ বোধকরি সেটিই।
১২.০৯.২০১৭
মন্তব্য
And ideas are bulletproof!
অতএব লেখা চলুক।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
And, submarines are waterproof too!
অতএব, ডুবসাঁতার সিরিজ আকারে চলুক!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
লেখালেখি চলবে...
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
হুম, চলুক তবে...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বেশি কিছু বলার নেই, লেখার অনেক কিছু রয়েগেছে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
হ্যাঁ!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
চলুক!
হয়তো, হয়তো না!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নিজেই এগিয়ে এসে আলোটা হাতে নিয়ে সামনে পা বাড়ানোর মত দায়িত্ব নেয়ার মত সাহস খুব বিরল একটা গুন। কিন্তু সেটা আপনার মধ্যে আছে। জয়যাত্রায় অগ্রীম শুভেচ্ছা রইলো।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী
ধন্যবাদ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন