তাক থেকে নামিয়ে - ০৩

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি
লিখেছেন সাক্ষী সত্যানন্দ [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৮/০৪/২০২০ - ২:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

০১। যতবার জন্ম নিই ঠিক করি থাকবো ঠিকঠাক

সুদূর অতীতে একদা সচলে এসেছিলাম শাহবাগসঙ্কুল উতলা দিনগুলোয়। কাদের মোল্লার চ্যালাচামুন্ডারা তখন নেতার অনুকরণে ভি-চিহ্ন দেখিয়ে বেড়াত যত্রতত্র। পরমগ্রন্থের নির্দেশ মেনে কোপাকুপি শুরু হবার পরে, তা আরো বেড়েছিল। আল্লামা ছাইদীর চ্যালারা তখন একাধিক অঞ্চল যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়েছে, চন্দ্রদেবতার অঙ্গুলিহেলনে নিরীহ মানুষ মরেছেও। উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে, মফস্বলের এক কোণে বসে নিজের চিন্তাভাবনাগুলো মেলে দেয়ার একটাই জানালা ছিল আমার, সচলায়তন। তখন কাজের চাপ ছিল কম। ছাত্রদের যা বোঝাতে চাইতাম, সেগুলোই লিখে রাখতে গিয়ে জন্ম হয়েছিল এসো কোয়ান্টামের রাজ্যে শীর্ষক লেখালেখিগুলোর। তখন প্রতিবছর প্রায় নিয়ম করে লিখে রাখতাম বইমেলার স্মৃতি। এই লেখালেখিগুলো সময়ানুক্রমে পড়লে, আলোহাতে চলা একটি উৎসব কিভাবে ধাপে ধাপে আঁধারের যাত্রী হয়েছে তার আন্দাজ পাই। এইবছর সেটিও হয় নি। হবে কি ভাবে, বইমেলা শুরু হয়েছে একদিন দেরিতে, আর ‘ঈদ পড়েছে যষ্ঠিমাসে গ্রীষ্মে যখন থাকেই ছুটি’ মেনে হ্যাট্রিক তিনখানা শুক্রবার গেছে বেনোজলে ভেসে। বোনাস ২৯ তারিখই ভরসা, কিন্তু একদিনে আর কি হয়? বইমেলার স্মৃতিকাহন লেখা হয় নি আর।

এই ‘তাক থেকে নামিয়ে’ সিরিজটা নিয়মিত চালাব পণ করেছি বহুবার। কিন্তু, জানেন তো, মানুষ পণ করে পণ ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্যই, তাই না? রবিবুড়ার কথার উপরে কথা নাই। আরেকবার অবশ্য, খন্দকারের অন্ধকার বইটির তাতে বেশ তেতে উঠেছিলাম। সচলে ধারাবাহিক ভাবে লিখতে পারা ‘ধারাবাহিক’ মনে হয় এই দুটোই। এরপরে মোল্লাসায়েব-মীরভাই-মতিকাকু-চৌধুরীসা’ব-কামারুমিয়া সবার দেউটিই একে একে নিভেছে। কর্মস্থল, শহর, শিক্ষা, পরিবার সবই বদলেছে। দিন বদলের মাইডাস ছুঁয়ে গেছে তরল ব্যাস্ততাকেও। হায়, কখনো কি ভেবেছিলাম সচলে লগাতে অপেক্ষায় থাকতে হবে এমন অদ্ভুত আঁধারের? বন্দীজীবনে পরিবার দু-টুকরো হয়ে আছে স্থবির দুই শহরে। কর্মহীন স্থবিরতার শাপে একটিই নগদ বর। টানা বইপড়ার সুযোগ পেলাম বহুদিন পর। গ্রন্থগত বিদ্যা জিনিসটা অনেকটা বাংলার মার্কেজের লেখা বইগুলোর মতন, রাস্তাঘাট থেকে লোক ধরে এনে বিলিয়ে না দেয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। শহরবন্দি** জীবনে রাস্তায় লোকজন খুঁজে পাওয়া দায়। ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া বলিয়া একগাল হাসিতে হাসিতে’ তাই ঘরের ছেলে সচলেই ফিরে এলাম। আপেক্ষিকতা নিয়ে প্রচুর(!) পড়াশুনা চলছে, কাতুকুতু বুড়োর মতন পালক হাতে করে শোনাব, রয়েসয়ে অপেক্ষা করুন।

** লকডাউনের পরিভাষা হতে পারে কি?

০২। তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে গোলাপ

যা বলছিলাম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর অত্যন্ত বদলোক। নামের আগে সৈয়দ দেখে ভুলবেন না, এই সৈয়দ সেই সৈয়দ নয়। ভদ্রলোককে প্রথম দেখেছিলুম টিএসসির কোনও এক সমাবেশে। আলোচ্যসূচি কি ছিল মনে নাই! দাশরথির মতন একমাথা ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে কি জানি এক বাক্স বাজিয়ে জলের গানের তালে তাল ঠুকছিলেন। তখন ভদ্রলোকের উর্ধাঙ্গ ছিল সীমারের ন্যায় পাষাণ, নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে খুলিতে ছড়িয়ে ছিল গাদাখানেক চুল। পরে ভদ্রলোকের সাথে আবার দেখা হয়েছিল স্বপ্নাহত যেদিন নিহত হলেন, ঠিক সেদিন, একেবারে ঘটনাস্থলেই। সেইদিন ভদ্রলোককে দেখে চমকেই উঠেছিলুম বটে। ঝাঁকড়া অবিন্যাস্ত চুল-গোঁফের সাথে যত্ন করে আঁচড়ানো রাবীন্দ্রিক শ্মশ্রুমন্ডিত চেহারায় হঠাৎ প্রয়াত আনিস ভাই ভেবে চমকে ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক। আমার ধারণা এই কথা অনেকের কাছেই শুনতে হয়েছে তাঁকে! যাক গে, লেট লতিফ হিসেবে ভদ্রলোকের সঙ্গে বসেছিলুম এক টেবিলেই বটে। তারপর কাচ্চিঘাতে ভদ্রলোক বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বিস্তারিত আলাপ আর হয় নি। এবারের বইমেলার শেষদিকে হঠাৎ দেখি খোমাবইতে কার যেন পোস্টে ভদ্রলোকের খোমা দেখা যায়, হাতে বই, পেছনে ব্যানার আর চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়। অর্থাৎ কিনা, মোড়ক উন্মোচনের আয়োজন। আবার সে এসেছে ফিরিয়া বলে- আবার সেই সীমারসুলভ খোমার পুনরাবির্ভাব! আপনারাই বলুন, যে ভদ্রলোক(!) নিজের চেহারাটাও একরকম রাখতে পারে না, তাঁকে কি ভদ্রলোক বলা সমীচিন? কাভি নেহি।

তাছাড়া পরিচিতজনেরা বলেন, ভদ্রলোকের গুদামে নানান দুষ্প্রাপ্য বইয়ের মজুত আছে। এহেন একজন মজুতদার তো ভদ্রলোক হতেই পারেন না, তাই না? এই পর্যন্তও মেনে নিয়েছিলাম, হাজার হলেও এককালে এই লেখাটি লিখে উস্কে দিয়েছিলেন খন্দকারের অন্ধকার পশ্চাতদেশে অভিযান চালাতে, এই ভেবে। তাই ভেবে বইমেলার একমাত্র দিনে তিনকপি বইও কিনেছিলুম। বিপত্তিটা হল, সে বইখানা পড়তে গিয়েই। প্রকৃত ভদ্রলোকের বই হয় এমন, কিংবা এমন। সেখানে রেফারেন্সের ঝকমারি থাকেনা, বড়জোর কোচিং মালিক সমিতির সভাপতির বইবিতান ঠকমারির একখানা জম্পেশ লিংক থাকে। অথচ, সেই বইতে কাঙ্ক্ষিত সেই লিংক নেই, আছে গাদাখানেক রেফারেন্স। মার্ক জাকারবার্গের ম্যাট্রিক্স দুনিয়ায় কেউ য়্যাত্তো য়্যাত্তো রেফারেন্স ঘাঁটবে? হুঁহ! খাল কেটে কুমির আনার মতন করে বইটা পড়তে দিয়েছিলুম পিতৃদেবকে, অবসরে পিতা-পুত্র মিলে বেশ পারিবারিক টকশো করার মকশো করবো, এই ভেবে। ও বাবা, পিতৃদেব দেখি সৈয়দ সায়েবের বই পড়ে পড়ে রেফারেন্স খোঁজেন, আর হ্যাডকের গলায় হুকুম করেন- পুস্তক লে আও! লে বাবা! সেই পুস্তক লে আও করতে গিয়ে ঝাকানাকার স্প্রে করা ধুলা ঘেঁটেঘুঁটে দেখি, সৈয়দ সায়েবের রেফারেন্স দেয়া বইগুলোর অধিকাংশই ভল্টে আছে। বেশ, এপর্যন্তও ঠিক আছে। এরপরের অবস্থা অনেকটা হ্যারি পটারের দ্বিতীয় বইটির মতন। সে বছর হগওয়ার্টসে টম রিডলের ডায়রির সূত্রে কিশোর ভলদোমর্টের আত্মা যেমন ইচ্ছেমতন ‘হুইস্কি লে আও’ বলে খাটিয়ে মারছিল জিনি উইজলিকে, তেমনি এই কালো বইটা খোলার পরেও সৈয়দ সায়েবের প্রাপ্তবয়স্ক আত্না ইচ্ছেমতন খাটিয়ে মেরেছেন আমাদের বাপ-বেটাকে। এরপরেও বলতে হবে উনি ভদ্দরনোক? প্রশ্নই আসে না!


পিতৃদেবের চাহিদামোতাবেক গন্ধমাদন ঘেঁটে বার করা নজুসঞ্জীবনী, যাঁরা পড়েন নি, পড়ে ফেলুন।

০৩। আপনিই সে প্রতিভাবান পুরুষ, যাঁকে আমরা খুঁজছি

নভেম্বর ১৯৭৫ বইটিতে লেখকের ভাষ্য আছে অল্পই। মূলত ১৪ জন অবঃ ফৌজি, ২ জন অবঃ বিপ্লবী, ১ জন অবঃ ভাষা সৈনিক, ১ জন অবঃ বাজিকর, ১ জন অবঃ রাজনীতিক, ১ জন অবঃ আমলা, ৬ জন অবঃ সাংবাদিক, এবং ৪ টি (তন্মধ্যে একটি অবঃ) পত্রিকা আর্কাইভের তথ্যই এই বইয়ের মূল কুড়ুল** বলা যায়। একজন দক্ষ পাচকের মতন, লেখক সেই কুড়ুলগুলোকে পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে রেঁধেছেন এই বইটি। উপরি পাওনা হল লেখকের হেঁশেল আর ভাঁড়ার থেকে সময়মত সরবরাহকৃত লবণ, খুদ আর ঘি। এই ১৪ জন বা ২ জন বা ৬ জন আদতে কে বা কাহারা জানতে চাইলে মূল বইটি সংগ্রহ করে পড়ে ফেলুন। এই বইটি পড়লে জানতে পারবেন, পঁচাত্তরের নভেম্বরে (যেটি আদতে আগস্টের ধারাবাহিকতা মাত্র) বীর সৈনিকেরা কে/কি/কোথায়/কিভাবে করছিলেন। আলগা স্মৃতিচারণ পাঠে খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের ক্যু নিয়ে একটা ‘আলাদা মোহ’ ছিল, সেই মোহভঙ্গ হয়েছে আমার। একাত্তরের সেক্টর কমান্ডার খালেদ আর পঁচাত্তরের ক্যু-কমান্ডার খালেদকে বোধকরি একই চরিত্র হিসাবে ভেবে নিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে দুজনে আলাদা মানুষ, আলাদা চরিত্র। প্রথমজনের জন্য এখনও ভালবাসাটুকু রেখে দিয়েছি, এটুকু তাঁর প্রাপ্য। পরেরজনের বেনিফিট কেটে ডাউটগুলোই ঘনীভূত হয়েছে। ছেঁড়া সুতোগুলোর অনেকগুলোই জোড়া লেগেছে। দিন শেষে ক্যু মানে ক্যু, এতে সুমহান কিছু নেই, কখনও ছিল না আদতে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যেমনটি বলেছিলেন- “হাতে বন্দুক থাকলে নিরীহ মানুষেরও চোখ পড়ে পশুপক্ষীর দিকে!” ব্যাপারটি একেবারেই এমন। নজরুল ভাইয়ের বই পড়তে গিয়ে বাড়তি পাওনা এই বইগুলো ‘একসাথে পরপর’ পড়ে ফেলা। বইগুলো কেনা ও পড়া হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। এভাবে মিলিয়ে পড়া হয়নি কখনও। (একবার কিছু পড়া হয়ে ছিল খন্দকারের নর্দমা ঘাঁটতে গিয়ে, তবে সেটি আংশিক।) একবারে পড়ে ফেলার সুবিধা হল মোটামুটি পুরো ছবিটা দেখে ফেলা যায়। অবঃ জেনারেল মহোদয়দের স্মৃতিকথাগুলো অধিকাংশই অন্ধের হস্তীদর্শন। সেটি অস্বাভাবিক নয়, বঙ্গভবনে যিনি আছেন আর রেডিও স্টেশনে যিনি আছেন, একই ঘটনায় দুজনের স্মৃতি ভিন্ন হবে এটিই স্বাভাবিক। তবে সেই আলাদা আলাদা স্মৃতির জিগ-স-পাজল মিলিয়ে না দেখলে হাতির দাঁত অথবা ল্যাজ নিয়েই বসে থাকতে হবে। নানান জনের ধর-মুড়ো-ল্যাঞ্জা একত্র করে, এই হাতির কাঠামোটি দাঁড় করিয়েছেন লেখক সৈয়দ নজরুল। একটা টুপিখোলা (খুলতে আপত্তি থাকলে টুপিপড়া পড়ুন) অভিবাদন তাঁর প্রাপ্য। নজরুল ভাই, পরের সংস্করণে রেফারেন্সগুলো আরেকটু জায়গামত চিহ্নিত করে দিলে, অর্থাৎ কোনটা কার ভাষ্য এটি পাদটীকা হিসেবে দিলেই ভাল হয়। প্রয়োজনে সাথে আছি।

** কুড়ুলের জাউ (রুশদেশের উপকথা, প্রগতি প্রকাশন) দ্রষ্টব্য।

এই পঠনপ্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে যুক্ত করেছি আরো কিছু বই। এর অধিকাংশই ৭২-৭৫ সময়কালের রাষ্ট্রপতি, কমিশন সদস্য, মন্ত্রী প্রমুখ ভারী ভারী পদধারী ব্যক্তিদের। আমার চাচা একবার বলেছিলেন- “পাকি জেনারেলদের বইপত্র ঘেঁটেঘুটে মুক্তিযুদ্ধের রক্তগুলো কার কার হাতে মেখে আছে, বেশ আন্দাজ পাওয়া যায়। প্রতিটি পাকি জেনারেল নিজেকে নিপাট ভদ্রলোক দাবী করে আঙ্গুল তুলেছেন পাশের সহকর্মীর দিকে। আঙ্গুলগুলো মুছে দিলেই প্রকৃত চিত্রের অনেকখানি ফুটে ওঠে।” ৭৫ এর আগে পরের কাহিনি নিয়ে দেশীয় অবঃ জেনারেল ভাইদের স্মৃতিকথাগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য! অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার সদস্য বা অন্যান্য কেষ্টুবিষ্টুদের জন্যও একই প্যাটার্ন প্রযোজ্য! সকলেরই কমন দাবী, আমি অমুক রাজার হাতি মেরেছিলুম, ব্যাটা তমুক সেটা ঠেকিয়ে উজিরের ঘোড়া মেরে নিয়ে গেল! অথচ, তাঁদের কথাতেই ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে স্বাধীনভাবে কাজের পরিবেশ দিয়েছিলেন’ এমনতরো আত্মঘাতী কথাবার্তাও রয়ে গেছে! ইন্টারেস্টিং হল, এনাদের নাম মুছে ভাষ্যটি পড়তে গেলে কখনো কখনো অবিকল বর্তমানের ছবি ভেসে ওঠে। এনাদের অনেকেরই আরেকটা ইন্টারেস্টিং ‘খন্দকার সিনড্রোম’ আছে। এঁদের অনেকেরই বিশাল হা-হুতাশ, আহা বঙ্গবন্ধু আমাকে অমুক ব্যাপারে বিস্তারিত বললেন না কেন? ব্যাটা অলম্বুষ কাহিকা, আদার ব্যাপারীকে জাহাজের খবর কেন দিতে হবে? তুমি বেটা জাম্বুবান, এটুকুও বোঝোনি যে সব খবর জানার মতন দায়িত্বশীল হলে তোমাকে সেটা জানানোই হত! আজকের দিনে জন্মালে এঁরা বড়সড় ফেসবুক সেলিব্রিটি কিংবা টক-শো সেলিব্রিটি হতেন নিঃসন্দেহে। আরো ইন্টারেস্টিং হল, এনারা অনেকেই মোশতাকের মন্ত্রীসভারও সদস্য। অথচ মোশতাক মন্ত্রীসভায় এনারা কি বিপুল উদ্যমে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার ‘স্থাপন’ করছিলেন, সে ব্যাপারে এনারা স্পিকটি নট। প্রফেসর স্লাগহর্ন যেমন ভলদোমর্টের মন্ত্রণার স্মৃতি লুকিয়ে রেখেছিলেন কালো ধোঁয়াশায়, এনারাও অবিকল তাইই করেছেন। জীবিত বঙ্গবন্ধু যেমন যেকোন সুযোগেই তাঁর চওড়া বুকে আড়াল করে রেখেছিলেন অবিশ্বস্ত বাঙ্গালির হাজারো পাপ, ৭২-৭৫ সালের পরেও বুলেটের পাশাপাশি ‘বিশ্লেষক’ মহোদয়দের পুরো গালাগালিটা বুক পেতে নিয়েছে তাঁরই লাশ। এবার মনে হয় সময় এসেছে উজির-নাজির-কোতোয়ালদেরও একটু প্রশ্নের মুখোমুখি করার। নইলে বড় অবিচার হয়।


পিতৃদেবের চাহিদামোতাবেক গন্ধমাদন ঘেঁটে বার করা সম্পূরক বুদ্ধমূর্তির বুস্টারডোজ।

০৪। যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধভরপুর

এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি আছে ১২৯-১৩৩ পৃষ্ঠায়। তথ্যসূত্র হিসেবে যে বইটির কথা বলা আছে, সেটি আমার সংগ্রহে আছে প্রায় এক দশক আগে থেকেই। পোস্টে সংযোজিত প্রথম ছবিতে বইটি আছে নিচ থেকে দু-নম্বরে, বইটি এখনও পাওয়া যায় কি না- নিশ্চিত নই। সে বইয়ের প্রথম অংশে প্লেজিয়ারিস্টিক অধ্যাপক সায়েবের প্রচুর গণ-টোকাটুকি থাকায় পুরো বইটি পড়ার ধৈর্য হয়নি কখনো। ভেবেছিলাম পুরো বইটিই বুঝি টুকলিফাই করে লেখা, অথচ অধ্যাপক সায়েবের নিজস্ব স্মৃতিও আছে এতে। ১৯৭০-৭১ সালের সংগ্রাম আর্কাইভের মতন, এই নিজস্ব স্মৃতির গুরুত্ব অনেক। পাঠকের হয়ত মনে আছে, ‘হ্যারি পটার ও চৈতাজসংঘ’ বইটিতে আলবাস ডাম্বলডোর উতলা হয়ে উঠেছিলেন, প্রফেসর হোরেস স্লাগহর্ণের চেপে রাখা ‘এক চিলতে’ স্মৃতির জন্য। এক চিলতে হলেও ওই সুনির্দিষ্ট স্মৃতিখন্ডে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। আমাদের প্রফেসর সায়েবের এই স্মৃতিটুকুও তেমনই ভয়াবহ তথ্যের আধার এবং আঁধার দুইই।


সৈয়দ নজরুল ফিচারিং ভাষা সৈনিক (অবঃ) ফিচারিং আবদুল মান্নান


সৈয়দ নজরুল ফিচারিং ভাষা সৈনিক (অবঃ) ফিচারিং নিজামী এট. আল.

অনলাইনে বা অফলাইনে সূক্ষ্ণতম বোঁটকা গন্ধ পেলেও যারা আগাম সতর্ক হয়ে যাই, তাঁদের নিয়ে মডারেট ভাইয়েরা সদাই ‘রজ্জুতে সর্পভ্রম’ বলে কটাক্ষ করে থাকেন। সচলের ইতিহাসেই এমন বাদানুবাদের একাধিক ইতিহাস আছে। মডারেটপন্থীরা এই অংশ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন, যে বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির নামের সংগঠনটি কতটা ভয়ানক। (শাহবাগ পরবর্তী ছাত্রলীগ নেতাদের একটি বড় অংশও যত্রতত্র ব্যাক্তিগত শত্রুতাহেতু শিবির তকমা বিলিয়ে ব্যাপারটি লঘু করেছেন। এদের ব্যাপারটিও আমলে নিয়েই সাবধান থাকা প্রয়োজন।) করোনাসঙ্কুল এই সময়ে ‘ভাল খবর’ একটিই, সূর্যসৈনিক মাজেদ সায়েব জেলখানায় তশরিফ রেখেছেন। আশা করি শবে বরাতের আগেই শবে ঝুলন মুবারক নাজেল হবে এই বছরে। সেই সংগে আগাম ‘সর্পভ্রম’ করে যাই, ঘরপোড়া গরুরা তো ডরাবেই সিঁদুরে (আপত্তি থাকলে সিঁদুর কেটে খুনে পড়ুন) মেঘ দেখে! এর আগেও ফারুক-রশিদ গং যতবার বাংলাদেশে এসেছে, কোনবারেই খামাখা আসে নি। এবারের আগমনটিও একেবারে সরল দৃষ্টিতে দেখতে আমি অপারগ। খতিয়ে দেখা একান্তই প্রয়োজন। কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শর্তাধীন মুক্তির চন্দ্রবিজয়ী পেঙ্গুইন পাখিটির মুক্তির দাবিও (অন্তত অনলাইনে) বেশ জোরেশোরে চোখে পড়ছে। আলামতগুলো খুব সুবিধার নয়।

০৫। ব্যাধিকে রূপান্তরিত করছি মুক্তোয়

আমাদের দাদা-নানাদের প্রজন্মে এমনকি বাবা-চাচাদের প্রজন্মেও বিশ্বাসের ভাইরাসকে এতটা আগ্রাসী হতে দেখি নি। (বিদ্রঃ এটি আমার ক্ষুদ্র নমুনাক্ষেত্র হেতু প্রাপ্ত সীমিত তথ্যের কারণেও হতে পারে।) ইদানীং যেমনটি দেখছি, সম্ভবত আরও দেখব। এককালে পাঠ্যবইতে ‘হাশরের দিন বলিবেন খোদা, হে আদম সন্তান, আমি চেয়েছিনু ক্ষুধায় অন্ন, তুমি কর নাই দান...’ কিংবা ‘মানুষ মুহম্মদ’ পড়ান হত। এখন কি পড়ায়? নাকি বখতিয়ারের ঘোড়া এসে গেছে খটাখট শব্দে? মোতাহার হোসেন চৌধুরীর একটা লেখায় ছিল- ‘ধর্ম হল অশিক্ষিত লোকের কালচার, আর কালচার হল শিক্ষিত লোকের ধর্ম!’ ধর্ম আর কালচার কিন্তু দুই অংশে দ্বিবিধার্থে ব্যবহৃত, হরিকে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায় টাইপ অবস্থা। খুউপ খিয়াল কইরা! এককালে (এমনকি এখনও গুটিকয় পাওয়া যায়) ধার্মিকেরা ধর্মকে নিতেন সহজাত নীতিবোধের সহায়ক কাঠামো হিসেবে। খেয়াল করুন, তাঁদের চিন্তাকাঠামোয় ‘সহমর্মিতা’ কিংবা ‘নীতিবোধ’ আগে থেকেই ছিল, সেটি গ্রন্থগত নয়, তাঁদের কাছে কিতাব হল সেই অন্তর্জাত নীতিবোধ বাস্তবায়নের সাহায্যকারী মাত্র। এখন বোধহয় গণেশ (গনেশে আপত্তি থাকলে পড়ুন আযাযিল, আরব্যপুরাণ মতে উনি উল্টেই তো শয়তানের জন্ম, না?) উল্টেছে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনেক সায়েন্স ফিকশনে বহুবার, কল্পিত ভবিষ্যতে সহায়ক “নেটওয়ার্ক” যেভাবে হয়ে উঠেছে সভ্যতার প্রভু, এখানেও ঠিক তাইই। এখনকার ধার্মিকেরা কাজী আব্দুল ওদুদের সেই ‘শান্তোজ্জ্বল ইসলাম’ ছিঁড়েখুঁড়ে বানিয়েছে সাইদী-মিজানের ঔরসজাত হিংস্র এক ইসলাম। ধার্মিকেরা বরাবরই দাবী করেন, তাঁদের মত ও পথই একমাত্র মোক্ষ! অথচ, তাঁদের ভাষ্য একটি নয়, অনেকগুলোই বটে। এবং প্রতিটি ভাষ্যই ব্যাস্ত পাশের জনের ভাষ্যকে “ব্যাটা তুই বাতিল মাল, আমিই সত্য, আনাল হক্ব!” বলে হুঙ্কার দিতে ব্যাস্ত। এইখানে শরণ নিতে হয় রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির। গোর্কি তার আত্মজৈবনিক ‘আমার ছেলেবেলা’ বইয়ে বলেছিলেন-

দিদিমার ভগবান সারাদিন দিদিমার সঙ্গেই থাকেন। এমনকি জন্তু-জানোয়ারকেও তিনি সেই ভগবানের ভাগ দেন। এই বিশ্বচরাচরের সব কিছুর প্রতিই তাঁর সমান স্নেহ, সমান আদর।

দাদামশায়ের ইশ্বর জোর দেন ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতায়। ঈশ্বরের রাজ্যে পাপের শাস্তি হয়ে আসে দুর্ভিক্ষ আর মহামারী। সেই ইশ্বর হলেন উদ্যত তলোয়ারের মতন, অবিশ্বাসীদের মাথার ওপরে উদ্যত চাবুক।

দুনিয়ার প্রতিটি মানুষই যেন বিভিন্ন মাত্রার একেকজন দিদিমা আর দাদামশায়। বাইবেলের ঈশ্বর দাবী করেছিলেন মানুষকে নিজের ছাঁচে গড়ে তোলার। অথচ চারপাশে দেখে চলেছি উল্টোটা। প্রত্যেকেই ঈশ্বরকে গড়ে তুলছেন নিজের ছাঁচে। সেজন্যই বুঝি বাপ-দাদার ঈশ্বর নীতির প্রশ্নে অটল, সর্বাগ্রে ন্যায়ের কষ্টিপাথরে মেপে কাজ করতে ব্যাগ্র। অন্যদিকে, গোলাম আজমের ঈশ্বর বেমালুম তার মতন, তিরিশ লাখেও তার পেট ভরে নি, ভরে না। প্রমথ চৌধুরী ভুল বলেন নি, ‘ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়’- এ এক নিদারুণ সত্য। বিবর্তনীয় কাঠামোয় ন্যায়বান ইশ্বর বোধকরি ‘ফিটেস্ট’ নন, বরঞ্চ হিংস্র ইশ্বরই টিকে থাকার দাবীদার। আবহমান কালের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাধিক্য বোধহয় সে ইঙ্গিতই দেয়। স্টিভেন ওয়াইনবার্গ একবার বলেছিলেন- ‘ভাল মানুষকে দিয়ে খারাপ কাজ করাতে ধর্মের জুড়ি নেই।’ ওয়ানবার্গের উক্তিটির সত্যতা প্রমাণ করে চলেছেন অগণিত দাদামশায়ের হিংস্র ইশ্বরেরা। দিদিমার ইশ্বর সেঁধিয়ে যাচ্ছেন গহীনতম কোনে। কে বলেছে হোমো স্যাপিয়েন্স মাত্রই আশরাফুল মাখলুকাত? নিজেকে নিজে উপাধি দিলেই হল? এত সহজ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইয়োরোপের ইশ্বর খ্রিস্টান দাদামশায়দের কবল থেকে অনেকটা মুক্তি পেয়েছিল। করোনা পরবর্তী বিশ্বে ভারতবর্ষের ভগবান কি মুক্তি পাবেন গেরুয়া দাদামশায়দের নিগড় থেকে? কিংবা ওয়াইসির আওতাভুক্ত ইশ্বর কি মুক্তি পাবেন ৭৩! জাতের (যারা প্রত্যেকেই নিজেকে একমাত্র সহীহ বলে দাবী করেন) দাদামশায়দের হাত থেকে?

পুনশ্চঃ উপ-শিরোনাম গুলো অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের কবিতাসমগ্র থেকে বেছে নেয়া।

০৭-০৪-২০২০
বাংলাদেশ


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

এমনকি এই করাল করোনা-কালেও তোমার লেখা দেখলে মনটা ভালো লাগে।
বরাবরের মতই তীব্র এবং কষায়।
তারিখ লিখেছ ০৭-০৪-২০১৯। যদি সেটা ভুল হয়ে থাকে আর, ঠিক করতে চাও, প্রতিমন্তব্য না লিখে ঠিক করে নিলে আমি মন্তব্য সম্পাদনা করে নেব।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- করোনাকালে সবই বন্ধ, এই জানালাটাই খোলা কেবল! মন খারাপ

আপেক্ষিকতা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটির ফল, জানেন তো বেগ বেশি বাড়লে সময় উল্টোদিকে যায়। সময় পরিভ্রমণ করে ১০০ বছর ভবিষ্যতে গিয়ে সম্পাদনা করে এলুম। মন্তব্যটা বরং থাক। পরে বুদ্ধমূর্তি নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া হলে কাজে দেবে! দেঁতো হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

শুধু স্মৃতি রোমন্থনই হচ্ছে আজকাল, বুড়ো হয়ে গেলেন নাকি?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এই লেখাটা নামছে না যে! আজ একখানা 'গুরুগম্ভীর' লেখা নামানোর চেষ্টা করেছি। সে লেখায় অবশ্য আমার অবদান অল্পই, তবু পড়ে মতামত জানালে খুশি হব। লেখেন না কেন?

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

এক লহমা এর ছবি

আজ তুমি ঠেলে দিলেই নেমে যাবে হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এই নিন, হারারির হারাকিরি! লইজ্জা লাগে

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।