একদা, তিনি বৃদ্ধ হয়েছিলেন। এবার তিনি বিদায় নিলেন। তিনি, অর্থাৎ অধ্যাপক অজয় রায়। সরাসরি তাঁকে কখনও শ্রেণীকক্ষে পাইনি। তবু ঘটনাক্রমে যিনি হয়ে উঠেছিলেন একান্ত আপনার জন। অধ্যাপক অজয় ছিলেন আমার শিক্ষকদেরও শিক্ষক, আক্ষরিক অর্থেই। তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম কলাভবন অথবা টিএসসি চত্বরের কোনও এক আলোচনা সভায়, বামঘেঁষা কোনও এক ছাত্র সংগঠনের আয়োজনে। অনুষ্ঠানের উপলক্ষ্য ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। অজয় স্যার আলোচনা করেছিলেন স্মৃতির মিশেলে বসুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে। তখন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে, রঙ্গিন চশমার ঘোর তখনও কাটে নি। যা দেখি/শুনি তাই ভাল লাগে, এমন দশা। তার মাঝেও আলাদা করে মনোযোগ টেনেছিলেন অধ্যাপক রায়। মৃদু কন্ঠেও যে দৃপ্ত স্বরে কথা বলা যায়, সেটি আমি প্রথম শুনেছি তাঁর কণ্ঠেই। তখনও তাঁর পরিচয় জানা হয় নি। দু’মাস পরে নবীন বরণের মঞ্চে তাকিয়ে দেখি, ওমা! সেই একই ব্যক্তি বসে আছেন সাবেক বিভাগীয় প্রধানের সারিতে। অর্থাৎ, তিনি আমার বিভাগেরই অগ্রজ। বক্তব্য পর্বে টের পেলাম তিনি আমার হবু শিক্ষকদেরও অধিকাংশের শিক্ষক।
অধ্যাপক অজয় রায় যেহেতু তখন অবসরপ্রাপ্ত, সরাসরি তাঁর ক্লাস পাইনি আমাদের প্রজন্মের কেউ। তবু দেখাসাক্ষাৎ হত নানান সেমিনার আর বিভাগীয় আয়োজনে। মাঝেমধ্যে একাকী ঝোলা ঘাড়ে হেঁটে যেতেন বিজ্ঞান পাঠাগারের পেছনে সেন্টার অফ এক্সেলেন্সের (অধুনা বোস সেন্টার) দিকে। প্রথম বর্ষে আমরা বাংলা মাধ্যম থেকে যাওয়ারা ইংরেজি মাধ্যমের অকূল পাথারে ডুবতে ডুবতে ভেসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। এমন সময় বাংলা একাডেমির কোনও এক ‘সেল’ চলাকালীন আমরা আবিষ্কার করি- বাংলা একাডেমি প্রচুর পাঠ্যবই প্রকাশ করে, এবং তার সিংহভাগ না হলেও ব্যাঘ্রভাগ আদতে পদার্থবিদ্যা আর গণিতের। এই সেল ঘাঁটতে গিয়েই আবিষ্কার করি হ্যালিডে-রেসনিক রচিত পদার্থবিদ্যার ধ্রুপদী পাঠ্যবইটির বাংলা অনুবাদ আছে, চার খণ্ডে প্রকাশিত। সে বই পেয়েছিলাম একেবারেই জলের দরে। হলে এনে খুলে দেখি অনুবাদক চতুষ্টয়ের নামঃ অজয় রায়, র ই ম আমিনুর রশীদ, মেজবাহউদ্দিন এবং শাহজাহান তপন। চতুর্থজনের নামের সাথে পরিচয় ছিল একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যবই থেকেই। মাঝের দুজনকে পেয়েছিলাম শ্রেনীকক্ষে, পরে অবশ্য দুজনেই বিভাগ ছেড়ে যান দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষপদের দায়িত্ব নিয়ে। এই মাঝের দুজনও অধ্যাপক অজয় রায়ের ছাত্র, পরবর্তীতে সহকর্মী। এই সুত্রে অধ্যাপক রায় আমার শিক্ষকদেরও শিক্ষক, আক্ষরিক অর্থে। আর প্রথম বর্ষে আলো হাতে তিনি পথ দেখিয়েছেন আমাদের মত অকূল পাথারে পড়া আধাঁরের যাত্রীদের, তাঁর বইয়ের মধ্য দিয়ে। হ্যালিডে-রেসনিকের এই বইটি অনুবাদ করা হয়েছিল বাংলাদেশের সূচনালগ্নেই। আজকে যারা ‘বাংলায় বিজ্ঞান হয় না’ বলে হল্লা করেন, তাঁদেরকে এই বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ জানাই। প্রায় অর্ধ-শতক আগের বই হিসেবে বইটি যথেষ্ট খটোমটো। তবু আলোকবর্তিকা হিসেবে এই বইটির অবস্থান অনন্য।
তার অনেক পরে, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাবার পরে জেনেছিলাম ইনিই অভিজিৎ রায়ের বাবা। সচলে অভিদার লেখা আছে প্রচুর, কিন্তু ধাক্কা দেয়ার মতন লেখা ছিল ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন’ এই লেখাটি। নিজের পিতার অনেক আচরণ বুঝতে এবং কিঞ্চিত কোমল দৃষ্টিতে দেখার শিক্ষা পেয়েছিলাম এই মায়া ছড়ানো লেখাটিতেই। আহা অজয় স্যার! ২৫ মার্চের রাতে ইয়াহিয়া খানের বাহিনীর নির্মম শিকার আতাউর রহমান খান খাদিম স্যারের স্মৃতি জানতে আপনার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলাম কতবার! আপনি রাজিও হয়েছিলেন, সাক্ষাতের সময়টাই কেবল ঠিকঠাক করা হল না। আর হবেও না। এই খবর থেকে জানলাম যে আপনার দেহও ব্যয় করা হবে মানবজাতির জন্যই। “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ। মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান” এই কথাগুলো আওড়ানো হয় প্রচুর, অথচ আক্ষরিক অর্থেই এই চরণদ্বয়ের যোগ্য মানুষ অতি বিরল। অভিদার বিদায়ের পরে লেখা কথাগুলো থেকেই উদ্ধৃত করি-
অভি’দা শরীরটা কেটেকুটে হয়তো বৃহৎ কোনও গবেষণা হবে। নাহয় ক’জন ডাক্তারের প্র্যাকটিসই হবে, তারপর সেই ডাক্তারেরা হাজারো মানুষের চিকিৎসা করে বেড়াবেন। অভিদা’র শরীর কেটে হাতপাকানো ডাক্তারেরাই হয়তো একদিন মানুষের পাশাপাশি একইরকম দেখেতে অন্ধকারের কোনও কীটের চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলবে। সেই কীটেরা হয়ত জানবেও না যাঁকে ধ্বংস করার এত প্রচেষ্টা, তাঁর অমলিন ভালবাসার ছোঁয়া নিয়েই তাদের কলুষিত বেঁচে থাকা। অভিজিৎ রায় জিতে যাবেন ঠিক এইখানটাতেই। আমরা হারতে হারতে চুপচাপ কবরে সেঁধিয়ে যাব, তারপর ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করব শিঙ্গা বেজে ওঠার। একজন অভিজিৎ একাই আলো হাতে নিয়ে আঁধারের যাত্রীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলবেন নিরন্তর।
হুবহু একই কথা অধ্যাপক অজয় রায়ের জন্যও প্রযোজ্য। অজয় রায়ও জিতে যাবেন ঠিক এইখানটাতেই। বিদায়, অধ্যাপক।
মন্তব্য
সাক্ষী সত্যানন্দকে ধন্যবাদ এই লেখাটির জন্য।
বিদায় অধ্যাপক।
---মোখলেস হোসেন।
ধন্যবাদ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
শ্রদ্ধা, ভালবাসা
ধন্যবাদ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
তাঁর জন্য শ্রদ্ধা ও বিনম্র অভিবাদন।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
শ্রদ্ধা ও ভালবাসা
ধন্যবাদ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
তাঁর জন্য শ্রদ্ধা!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অনেকদিন পর সচলে এসে একটি মর্মস্পর্শি বিষয় তুলে ধরলেন, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!
ধন্যবাদ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন