মোক্ষ, নির্বাণ ও মাতৃগর্ভ : প্রথম পর্ব

সোহেল ইমাম এর ছবি
লিখেছেন সোহেল ইমাম [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/০৭/২০১৬ - ১২:৪৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের আধ্যাত্মিক সাধনার ইতিহাস বলে মানুষ মাত্রই আধ্যাত্মিকতার বীজ নিয়েই এ পৃথিবীতে আসে। তাই হয়তো আমরা বারবার ঈশ্বরের দিকে ঘুরে যাই, ঈশ্বরকেই খুঁজি। প্রবলভাবে ঈশ্বরের অসীম সত্ত্বার মধ্যেই নিজের অস্তিত্ব মিলিয়ে দিতে চাই। ভাবা হয় যার মধ্যে এই বীজ অঙ্কুরিত হতে পেলোনা, পুষ্টি পেলোনা তার জীবন অর্থহীনতায় তলিয়ে যাবেই। কখনও আবার ঈশ্বর নয় আধ্যাত্মিক সাধনার সর্বোচ্চ স্তরটিকে মোক্ষ বা নির্বাণ বলে অভিহিত করা হয়। আর এই মোক্ষ বা নির্বাণের অবস্থায় উপনীত হতে সাধককে আত্মসত্ত্বা বিলীন করে দিতে হয় একটা রহস্যময় অনির্বচনীয় কিছু একটার মধ্যে। এই আত্মসত্ত্বার বিলোপকে আবার অধ্যাত্মবাদের জগতে নেতিবাচক বলে ভাবা হচ্ছেনা, ভাবা হচ্ছেনা এটা মৃত্যুরই সমতুল্য কিছু। বরং বারবারই অবস্থাটিকে পরম শান্তিময় বলে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু আদতেই এই মোক্ষ বা নির্বাণ শব্দের মাধ্যমে কি বোঝানো হয় বা হয়েছে তার রহস্য ভেদ করাই দুস্কর। অধ্যাত্মবাদের জটিল গ্রন্থীর অনুসরন করা সত্যিকার অর্থেই দুরূহ। কিন্তু কেন পৃথিবীর এত প্রজাতির প্রাণীকুলের মধ্যে কেবল মানবমনেই এই আধ্যাত্মিকতার কল্পতরু পল্লবিত হয়ে ওঠে? অধ্যাত্ববাদের দুরূহ ধ্যান ঋদ্ধ সাধনা মার্গ অনেকভাবে, অনেক দিন থেকেই এ রহস্যকে আরো জটিল রহস্যে আবৃত করে ব্যাখ্যার প্রয়াস চালিয়ে এসেছে। মানব বোধে যা অর্জিত হয়েছে তা আজ অবধি অনির্বচনীয় ব্যাখ্যাতীত একটা অনুভবই থেকে গেছে । অনুসন্ধানের আলোকপাত অন্যদিক থেকেও হয়েছে। অপার্থিব পন্থা ছেড়ে অনেকেই পার্থিব শিকড়ের সন্ধান করেছেন এই অপার্থিব কল্পতরুর। দেখতে চেয়েছেন মানব জীবনের একেবারে আরম্ভের সময়টা ধরে। ঠিক যখন একটা শিশুর জন্ম হয়।

একটা শিশুর ভূমিষ্ঠ হবার মুহূর্তটিকেই আমরা মানব জীবনের প্রারম্ভ বলে আখ্যা দিই। কিন্তু এখনকার অবসটেট্রিক্স সময়টা পিছিয়ে দিচ্ছে আরো পেছনে। মানব জীবনটা সত্যিকার অর্থেই শুরু হয়ে যায় মাতৃগর্ভেই। গর্ভের মধ্যে এ্যামনিওটিক ফ্লুইডে ভর্তি এ্যামনিওটিক স্যাকের আবরনের সুরক্ষার মধ্যেই মানব ভ্রূনের বিকাশ আরম্ভ হয়। একেবারে ভূমিষ্ঠ হবার মুহূর্ত অবধি মানব শিশু এই এই জৈব তরলের মধ্যেই বিকশিত হতে থাকে। এই তরলই নাজুক ভ্রূনটিকে যে কোন ছোট-খাটো আঘাত বা ধাক্কার হাত থেকে রক্ষা করে। প্লাসেন্টা মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি ও অক্সিজেন আম্বিলিকাল কর্ড মারফৎ ভ্রূনের শরীরে সরবরাহ করে। মাতৃগর্ভে অবস্থানকালীন সময়ে এই আম্বিলিকাল কর্ডই অজাত শিশুর জীবনসূত্র হয়ে দাঁড়ায়। এ এক ভিন্ন মানব জীবন। আল্ট্রাসাউণ্ড ও বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক মনিটরিং যন্ত্রপাতির সাহায্যে এখন মাতৃগর্ভে ভ্রূনের বিকাশের প্রায় প্রতিটি স্তরই অনুসরন করা সম্ভব হয়েছে। আর এসব তথ্যই বলে দিচ্ছে মাতৃগর্ভের অভ্যন্তরে শিশুর এই জীবন পর্বটিও গুরুত্বের দিক দিয়ে কোন অংশেই কম নয়। নেহাত শরীরতত্ত্বের দিক থেকেই শুধু নয়, এই তথ্যগুলো জন্ম পরবর্তী মানব মনে আধ্যাত্মিক অভীপ্সার জটিল রন্ধ্র গুলোতেও আলোকপাত করতে সাহায্য করছে ।

যখন জন্ম প্রক্রিয়া আরম্ভ হয় তখন এই গর্ভস্থ শান্তির জগতটিতে তোলপাড় দেখা দেয়। জন্মের কিছু আগে থেকেই শিশুটির আশপাশ থেকে এ্যামনিওটিক ফ্লুইড নেমে যেতে শুরু করে। প্রসবকালীন কন্ট্র্যাকশন ক্রমেই শিশুটিকে এতদিনের সাচ্ছন্দ্যময় অবস্থান থেকে ঠেলে নিয়ে চলে অনিশ্চিত একটা গন্তব্যের দিকে। যে প্রাণ গর্ভের মধ্যে পরম শান্তির একটা জগতে সৃষ্টি হয়েছে এবং এই শান্তিতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল তার কাছে এই ঘটনা পরম্পরা অস্তিত্বের বিপন্নতার অনুভব নিয়ে হাজির হয়। অতঃপর শিশুটি জন্মের দিকে ক্রমশঃ আরো অগ্রসর হতে থাকলে আরো ক্লেশকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। প্রসুতি মাতার প্রসব যন্ত্রনার তীব্রতার আড়ালে শিশুর জন্ম অভিজ্ঞতা চাপা পড়ে যায়। মনোবিজ্ঞানী ম্যাথু এ্যাপলটন এই দিকটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করে বলেন,

...the idea that birth may be painful for the baby as well as the mother carries very little weight. As most of the pain for mothers is caused by the contact between the baby, especially the head and shoulders of the baby, with the cervix and the bones of the maternal pelvis, it is surprising that so little attention is given to the experience of the baby and what the consequences of that may be. This is especially true when we consider how soft and thin the bones of the baby’s cranium are. That babies are deeply affected by the way they are born and that this has profound consequences throughout life is, in my experience, a reality I have come to accept without reserve.

শিশুর জন্ম অভিজ্ঞতার এই কষ্টকর দিকটাকে স্মরনে রেখেই আরেকজন প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী Otto Rank একে The trauma of birth বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সত্যিকার অর্থেই শিশুটি যখন অপরিসর বার্থ ক্যানেল অতিক্রম করে তখন যে দুর্বহ চাপ তার কাঁধ, বুক ও মাথার উপর পড়ে তাতে যন্ত্রনা ও অস্তিত্ব বিপন্নতার আতঙ্ক তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে।আম্বিলিকাল কর্ডের মাধ্যমে মাতৃদেহের সাথে তখনও সংযুক্ত থাকায় সে মুহূর্তের প্রসুতি মায়ের যন্ত্রনা, আতঙ্ক ও দিশাহারাবোধের ফলে নিঃসৃত হরমোন ও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানও শিশুটির শরীরে এসে তার জন্ম অভিজ্ঞতাটিকে সত্যিকার অর্থেই ট্রমার স্তরে নিয়ে যায়। আবার ম্যাথু এ্যাপলটনের ভাষায় এ অবস্থার বর্ণনাটি শুনি,

There are times in the birth process where babies do not know if they are going to survive. They are being crushed under intense pressure, flooded by stress hormones or drugs through the umbilical cord or deprived of oxygen as the cord gets compressed during the contraction. Babies express the powerful emotions that any of us would associate with such intense experiences; rage, panic, sadness, disorientations.

জন্ম সংক্রান্ত এই ট্রমার কথা অবসটেট্রিসিয়ানদের বর্ণনায়ও আমরা পাচ্ছি, যেখানে এই জন্ম অভিজ্ঞতাটির বর্ণনায় বলা হচ্ছে,

Birth is indeed a normal part of the cycle of life. Yet birth is certainly capable of becoming our very first trauma. This trauma may be extreme, producing obvious injury. However, even when a normal birth appears to be completely trauma free, the pressure applied to the infant’s cranium can still cause some problem.

গর্ভের ভেতর এ্যামনিওটিক ফ্লুইডের মধ্যে ডুবে থাকার ফলে সঙ্গত কারনেই শিশুর ফুসফুসের মধ্যেও এই তরল থেকে যায়। জন্মের আগে অবধি ফুসফুসের কাজ শুরু না হওয়ায় এবং শিশুর প্রয়োজনীয় অক্সিজেন আম্বিলিকাল কর্ড মারফৎ শিশুর শরীরে পৌঁছে যাওয়ায় এটা তেমন কোন অসুবিধার সৃষ্টি করেনা। অপরিসর বার্থ ক্যানেল আর মায়ের শরীরের পেলভিসের হাড়ের মধ্যে দিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুকে যে অসহ্য চাপ সহ্য করে বেরিয়ে আসতে হয় সেই চাপেই ফুসফুসের মধ্যে জমে থাকা এ্যামনিওটিক ফ্লুইড বেরিয়ে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশের স্থান তৈরী করে দেয়। বেশিরভাগ শিশুই এই চাপ সহ্য করেই ভূমিষ্ঠ হয় এবং প্রথম শ্বাস নেওয়া ছাড়াও এই চাপের প্রতিক্রিয়াতেই শিশুর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রও শুষ্ঠভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু যে শিশুটি জন্ম নিচ্ছে তার এতসব জানবার উপায় নেই। সে জানেনা জন্মের সময়ের এই ক্লেশকর অভিজ্ঞতা তাকে মাতৃগর্ভের বাইরের পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার উপযোগী করে তুলছে। তার স্বল্প অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এই অসহ্যচাপ ও আনুষাঙ্গিক ক্লেশকর অনুভবের সাথে সে তুলনা করবে তার জন্ম মুহূর্ত পূর্ববর্তী গর্ভের শান্তিময় অবস্থাটির। প্রথমে এই শান্তির আশ্রয় থেকে ক্রমশঃ স্খলিত হওয়া তারপরই অনভ্যস্ত চাপ ও জন্ম যন্ত্রনা। ক্রমশঃ সেই যন্ত্রনা ও আতঙ্কের বোধের তীব্রতায় শ্বাসরোধ এবং সাময়িকভাবে চেতনা হারিয়ে ফেলা, এ সমস্ততেই সে অনুভব করে সে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে। তার কাছে এই ট্রমা মৃত্যুর আস্বাদ এনে দেয়। শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়ে যখন নিঃশ্বাস নেয় ও গর্ভের বাইরের পৃথিবীতে বেঁচে ওঠে এবং তার পঞ্চেন্দ্রিয়ে নতুন জগতটিকে বিস্ময় নিয়ে আস্বাদন করতে শুরু করে তখন কিন্তু তার গর্ভকালীন জীবনের মৃত্যু ঘটে গেছে। এই স্মৃতি একটি মৃত্যুর স্মৃতি হয়েই তার স্মরনের কোঠায় সঞ্চিত হয়ে যায়। সেই স্মৃতি সমস্ত জীবনভর কিভাবে মানুষের মনোজগতে হানা দেয় তার অনবদ্য বিবরন পাই মিথলজীর অধ্যাপক ও গবেষক জোসেফ ক্যাম্পবেলের বর্ণনায়, তিনি বলছেন,

The first indelible imprints are those of the moment of birth itself. The congestion of blood and sense of suffocation experienced by the infant before its lungs commence to operate give rise to a brief seizure of terror, the physical effects of which (caught breath, circulatory congestion, dizziness, or even blackout) tend to recur, more or less strongly, whenever there is an abrupt moment of fright. So that the birth trauma, as an archetype of transformation, floods with considerable emotional effect the brief moment of loss of security and threat of death that accompanies any crisis of radical change.

জন্ম অভিজ্ঞতার এই ক্লেশকর মৃত্যুযন্ত্রনাতুল্য অনুভবের স্মৃতি যেমন পূর্ণবয়স্ক মানব মনে সুপ্ত থেকে যায়, তেমনি গর্ভস্থকালীন পরম শান্তিময় জীবনটির স্মৃতিও সযত্নেই সঞ্চিত থেকে যায়। এই স্মৃতি কি সত্যিই সঞ্চিত থাকা সম্ভব? প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই ওঠে, বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার পথকে প্রশ্নের কাঁটার ওপর দিয়েই যেতে হয়। অনেকেই বলেন মস্তিস্কের যে পূর্ণতার ফলে মানব মনে যথার্থ অর্থে স্মৃতি শক্তি অর্জিত হয় গর্ভস্থ শিশুর মস্তিস্ক সেই পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনা। ভূমিষ্ঠ হবার পরও মস্তিস্কের সেই পূর্ণতা অর্জন করতে আরো সময় লাগে। সে কারনেই প্রায়শই একেবারে শিশু অবস্থার স্মৃতি আমাদের স্মরনে আসতে চায়না। এ সূত্রে ভূমিষ্ঠ হবারও আগে গর্ভস্থকালীন স্মৃতির অম্তিত্বও কি প্রশ্ন-কন্টকিত হয়ে ওঠেনা? কিন্তু মানতেই হবে মানব মস্তিস্ক মানব দেহের একটি জটিল অংশ। মস্তিস্কের ক্ষমতা ও কাজ করবার ধরন নিয়ে অনুসন্ধান এখনও চলছে এবং আরো চলবে। এখনই নিশ্চিত করে বলাবার মত সময় না এলেও বিভিন্ন গবেষনার ফলে এই বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান ক্রমেই বাড়ছে। গর্ভস্থ শিশুর স্মৃতি শক্তির সম্ভাবনা নিয়ে গবেষনাও থেমে নেই। নেদারল্যান্ডে ৯৩ জন প্রসুতি মায়ের পেটের সাথে বিশেষ একধরনের শব্দ করবে এমন ডিভাইস আটকে একটা গবেষনা চালানো হয়েছিল। ৩০ থেকে ৩৮ সপ্তাহ বয়সের গর্ভস্থ শিশুকে এই শব্দ শুনিয়ে তাদের স্মৃতির পরীক্ষা নেওয়াই ছিল এই গবেষনার উদ্দেশ্য। দেখা গেছে প্রথমে বিচলিত হলেও খুব দ্রুত গর্ভস্থ শিশু এই নতুন শব্দে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, অর্থাৎ এই শব্দকে তারা আর বিপদজনক ভাবছেনা। দশ মিনিট পর আবার এই শব্দ তাদের শোনানো হলে তারা চঞ্চল হয়ে উঠছেনা বা তাদের হৃৎস্পন্দনও বৃদ্ধি পাচ্ছেনা। এই গবেষনার মুখ্য গবেষক নেদারল্যান্ডের Maastricht University র অবসটেট্রিক্সের অধ্যাপক জে. জি নিজুস ( J.G. Nijhuis) বলেন, “ব্যাপারটা নিউইয়র্ক এর রেল-ষ্টেশনের পাশে থাকতে থাকতে সেই শব্দের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার মত। এটা একটা শিক্ষার মত যা বিপদজনক ও নিরাপদ উদ্দীপনার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে। এটা খুবই প্রাথমিক ধরনের একটা স্মৃতি শক্তি।”
একবারে প্রাথমিক ধরনের স্মৃতি ছাড়াও অন্যান্য সূত্রেও গর্ভস্থ শিশুর স্মৃতির প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। ডেভিড বি. চেম্বারলেনের লেখায় যেমন পাচ্ছি,

Unexpected evidence for prenatal learning and memory comes from studies of taste and olfaction. Until recently, olfaction was thought to require air, hence, learning of odors was not considered possible before birth. Current understanding, however, recognizes the complex interaction of chemosensory receptors in utero. Many chemical compounds, including those from the mother’s diet, pass through the placenta and reach the baby in utero while others flow in the capillaries of the nasal mucosa. By breathing and swallowing amniotic fluid, a baby becomes familiar with the mother’s diet, including things like garlic. Even before post-nasal exposure to breast milk, babies already know and prefer their own mother’s milk. Abrupt changes in her diet during the perinatal period can confuse babies and upset breast feeding.

গর্ভস্থ শিশু এ্যামনিওটিক ফ্লুইডে ডুবে থাকায় সেই তরল যেমন পেটে ও ফুসফুসে অবধি স্থান জুড়ে থাকে তেমনি শিশুর নাসারন্ধ্রের সংস্পর্শেও আসতে বাধ্য। প্রসুতি মায়ের সাধারনভাবে গৃহিত খাদ্য সমূহ এই এ্যামনিওটিক ফ্লুইডকে যে হারে স্বাদ-গন্ধ যুক্ত করে প্রসুতি মায়ের বুকের দুধও সেই একই হারে স্বাদ-গন্ধ যুক্ত হয়ে থাকে। এ্যামনিওটিক ফ্লুইডের ফ্লেভারের সাথে পরিচিত থাকায় ভূমিষ্ঠ হবার পরও শিশু নিজের মায়ের বুকের দুধ সচ্ছন্দে গ্রহন করে, কেননা তাতে সেই একই ফ্লেভার থাকে; যদিনা মায়ের খাদ্যাভ্যাসে বড় কোন পরিবর্তন এসে থাকে। গর্ভে থাকাকালীন শিশু পুষ্টি পায় আম্বিলিকাল কর্ড মারফৎ, তার মুখে খাদ্য গ্রহনের অভ্যাস না থাকলেও এ্যামনিওটিক ফ্লুইডের ফ্লেভারের স্মৃতি তাকে মায়ের বুকের দুধ গ্রহন করতে সাহায্য করে। এখানে দেখা যাচ্ছে শুধু শব্দ উদ্দীপনা সংক্রান্ত স্মৃতিই নয়, আস্বাদন ও ঘ্রাণ সংক্রান্ত স্মৃতিরও কিছু অংশ শিশু গর্ভ থেকে অর্জন করেই ভূমিষ্ঠ হয়। শুধু এ্যামনিওটিক ফ্লুইডের স্বাদই নয় মায়ের কণ্ঠস্বরের সাথে গর্ভস্থ জীবনেই শিশুর পরিচয় ও সেই স্মৃতির সহায়তায় ভূমিষ্ঠ হবার পর মায়ের কণ্ঠস্বর চট করে চিনে নেওয়া এবং পরবর্তীতে মাতৃভাষা সাবলীলভাবে আত্মস্থ করবার মাধ্যমেও আমরা গর্ভস্থ শিশুর স্মৃতি শক্তির যে পরিচয় পাচ্ছি তাতে এ সিদ্ধান্তে আসা যায়না যে গর্ভস্থ শিশু গর্ভস্থ অবস্থার কোন স্মৃতিই স্মরন করতে পারেনা। ডেভিড বি. চেম্বারলেন তার একটা লেখায় বলছেন,

A mother’s voice reaches the uterus with very little distortion as the sound waves pass directly through her body. Acoustic spectroscopy, which makes possible elaborately detailed portraits of sound similar to fingerprints, has documented prenatal learning of the mother tongue.

গর্ভস্থ শিশুর স্মৃতি নিয়ে গবেষনা বিভিন্ন ধরনেই হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। গর্ভের মধ্যের অবস্থানরত ভ্রূন ও পরবর্তীতে ভূমিষ্ঠ নবজাতক যখন একটি জীবনেরই অখণ্ড অংশ তখন গর্ভস্থকালীন জীবনের ছায়া পরবর্তী জীবনে একেবারেই পড়বেনা বা প্রভাব ফেলবেনা তা হতে পারেনা। সুস্পষ্টভাবে গর্ভস্থ অবস্থার স্মৃতি মানুষ মনে করতে পারেনা কারন এই দুই জগত, মাতৃগর্ভ আর বাইরের পৃথিবী, এতটাই ভিন্ন আর এতে অবস্থানরত অবস্থায় মানুষের ভূমিকাটিও মৌলিকভাবেই এতখানি আলাদা যে তাতে সুস্পষ্ট স্মৃতি উদ্ধার করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষতঃ গর্ভে অবস্থানকালীন মানব জীবনের নিস্ক্রিয় ভূমিকা এর একটি কারন। জন্ম পরবর্তী সক্রিয় জীবনে এই নিস্ক্রিয় জীবনের অভিজ্ঞতাটি সক্রিয় জীবনের অনুভব দিয়ে, ভাষা দিয়ে চিত্রিত করা সহজ কাজ নয়। তাছাড়া ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই শিশুর পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের উপর এই রূপ-রস-রং-শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ ভরা বিপুলা পৃথিবী যেভাবে ঝাপিয়ে পড়ে তাতে শিশুর বিস্ময়ের প্রবলতায় গর্ভস্থকালীন স্মৃতি আর চেতনায় প্রধান স্থানটি জুড়ে থাকেনা। এছাড়াও রয়েছে শিশুর নিজস্ব জীবন সংগ্রাম। খাদ্য আর আপনা আপনি আম্বিলিকাল কর্ড বেয়ে শিশুর শরীরে পৌঁছে যায়না। তাকে কেঁদে উঠে, ক্ষোভ প্রকাশ করে খাদ্যের প্রয়োজনের কথা জানাতে হয়। এ্যামনিওটিক তরলের আরামদায়ক সুরক্ষাও আর নেই, প্রতিটি অস্বস্তিকর অনুভবে তাকে সক্রিয় হয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করে সমস্ত অসুবিধার প্রতিবিধান করতে হয়। এভাবে গর্ভের নিস্ক্রিয় জীবনের স্থবির বাস্তবতা তার চেতনা থেকে দূরবর্তী হতে থাকে। কিন্তু শিশু জীবন পথে ক্রমেই অগ্রসর হতে থাকলে আকাঙ্খার পর আকাঙ্খার উদ্ভব এবং আকাঙ্খার বস্তু সমূহের প্রাপ্তি ক্রমশঃই দুস্প্রাপ্য, দুরুহ ও অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে উঠতে থাকলে এমন একটা সময়ের স্মৃতি স্মরনের কোঠায় উকি দেয় যখন সে তার কাঙ্খিত বস্তু অযাচিত ভাবেই পেয়ে যেত, যে সময় তাকে শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্লেশ স্বীকারও করতে হতোনা। রূঢ় পৃথিবীর প্রতিকুলতার বিপরীতে মাতৃগর্ভের স্মৃতি আবার জীবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করে। কিন্তু এই বাইরের জগতের শব্দাবলী আর ভাষায় গর্ভের স্মৃতিকে চিত্রিত করা এতখানিই দুরূহ হয়ে ওঠে যে সেই স্মৃতি একটা নাম না জানা আকুলতা, অতৃপ্তির মত চেতনায় হানা দিতে থাকে। বহির্মুখী মানুষেরা এই আকুলতাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেননা কিন্তু অন্তর্মুখী কল্পনাপ্রবনদের চিত্তের এই আকুলতা প্রশমিত হওয়া দুস্কর।

আমাদের প্রাচীন মিষ্টিক সাধকরা এই আকুলতায় অস্থির, অধীর হয়ে একে বুঝবার প্রয়াস করেছেন। একটা অজানা নামহীন তৃষ্ণা তাদের ব্যাকুল করেছে সব সময়। মনোজগতের গহীনে যে শান্তির জগতের স্মৃতি আলেয়ার মত, মরিচিকার মত ক্রমাগত হাতছানি দেয় তাকেই আরো পষ্ট করে দেখার প্রয়াসী হয়েছিলেন তারা। নিজের অজান্তেই আধ্যাত্মিক সাধনার নামে ফিরে যেতে চেয়েছেন পেছনে ফেলে আসা মাতৃগর্ভের শান্তির জগতে। আধ্যাত্মিকতার ইতিহাস তাই এই প্রত্যাবর্তনের পথ খোঁজারই ইতিহাস। যুগের পর যুগ ধরে সাধকরা এই পথেরই তালাশ করেছেন। আত্মনিমগ্ন ধ্যানের মাধ্যমে ঠাহর করতে চেষ্টা করেছেন কোন পথে মোক্ষ। তারা তাদের সমস্যা সমাধান কল্পে নিজের সত্ত্বার মধ্যেই ডুব দিয়েছিলেন। অন্ধের হস্তি দর্শনের আদলে বুঝতে চেয়েছেন তৃষ্ণার স্বরূপ। এই তৃষ্ণার উপর মনোসংযোগ করে বুঝতে চেয়েছেন কি করলে এই তৃষ্ণার উপশম হয়। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগোলেও অনুসন্ধানের আন্তরিকতায় পথ অবশ্য তারা পেয়েও ছিলেন শেষকালে। আর এখানেই আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসের আরম্ভ।

কিন্তু সমস্যা হলো একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ কিভাবে প্রত্যাবর্তন করতে পারে মাতৃগর্ভে। প্রথমত তাকে শিশু হতে হবে, ছেঁটে ফেলতে হবে সেইসব বাড়তি ‘জঞ্জাল’ যা জমিয়ে জমিয়ে সে শিশু থেকে পূর্ণবয়স্ক মানুষে পরিনত হয়েছে। একটা গর্ভস্থ শিশুর জীবন পরম সারল্যের উদাহরন। গর্ভস্থ শিশুকে খাদ্যের জন্য, শ্বাস গ্রহনের জন্য নিজ থেকে কোন প্রয়াসই প্রায় করতে হয়না। গর্ভস্থ জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই তার কাটে ঘুমিয়ে। মাঝে মধ্যে হাত-পা মেলে দিয়ে এ্যামনিওটিক স্যাকের দেয়ালের পরিধি ছুঁয়ে পরখ করা বা মায়ের শরীর সংবাহিত হয়ে আসা মায়ের কণ্ঠস্বর, বাইরের অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা ছাড়া প্রায় ঘটনাহীনভাবেই চলে তার সরল জীবন। এ জীবনে সে আর কিছু যে আকাঙ্খা করবার আছে সেই বোধ বা জ্ঞানই অর্জন করতে পারেনা। তার অস্তিত্বের জন্য যে অবস্থাটি প্রয়োজনীয় সেই অবস্থাটি বজায় থাকলেই তার আর কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই, চাওয়ারও নেই। গর্ভের বাইরে এসে নতুন জীবন শুরু করা মাত্র তার জীবনের সেই সারল্য খুব দ্রুত অপসারিত হতে থাকে। জন্মের পরই একটা শিশুকে খাদ্যের জন্য কেঁদে উঠে জানান দিতে হয় তার ক্ষিধের কথা। তেমনি তার আরামের প্রয়োজন, উষ্ণতার প্রয়োজন, মাতৃস্পর্শের প্রয়োজন দিয়ে শুরু করে দীর্ঘ হতে শুরু করে তার আকাঙ্খার তালিকা। পূর্ণবয়স্কতায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমরা আমাদের আকাঙ্খা দিয়েই আমাদের জীবন ভরিয়ে ফেলি। আকাঙ্খা গুলো থাকেই সব সময়, কোনটা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হয়, কোনটা পেলামনা বলে কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়, কোনটা আবার পাবোনা জেনেও মন থেকে ছুড়ে ফেলা যায়না। গর্ভস্থ শিশুর জীবনের সারল্য থেকে এই তৃষ্ণা, কামনা-বাসনা-বৈষয়িকতার বাড়তি প্রত্যঙ্গ গুলোই আমাদের পূর্ণ বয়স্ক মানুষে পরিনত করে। এই বাড়তি প্রত্যঙ্গ গুলো ছেঁটে না ফেললে মাতৃগর্ভে প্রবেশের জন্য সরল শিশুর আকৃতি পাওয়া সম্ভব নয়। কামনা-বাসনা আর বৈষয়িকতার বাড়তি বোঝা নিয়ে সেই পরম শান্তির মাতৃগর্ভে ফিরে যাওয়া যাবেনা এটাই ছিল আমাদের সাধু-সন্তদের উপলব্ধী। কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনার মাধ্যমে কামনার উচ্ছেদ তাই মোক্ষ অর্জনের সাধনার মূল কথা হয়ে দাঁড়ায়।

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থঃ
১। Birth Trauma: A Cultural Blind Spot : Matthew Appleton MA RCSTA UKCP (September 30, 2011)
http://www.matthew-appleton.co.uk/resources
২। Prenatal Memory and Learning : David B. Chamberlain
https://birthpsychology.com/free-article/prenatal-memory-and-learning
৩। The Trauma of Birth
http://www.osteodoc.com/birthtrauma.htm
৪। THE TRAUMA OF BIRTH (Das Trauma der Geburt,1924) : Otto Rank (English Translation : 1929) / The Dover Edition - 1993.
৫। THE MASKS OF GOD : PRIMITIVE MYTHOLOGY :Joseph Campbell / LONDON : SECKER & WARBURG : 1960. (61-62)


মন্তব্য

নরাধম এর ছবি

খুবই তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। অনেক ধন্যবাদ। চলুক

সোহেল ইমাম এর ছবি

লেখাটা পড়বার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেকদিন পর সোহেল ইমাম। তথ্যবহুল লেখা সন্দেহ নেই, তবে দ্বিতীয় পর্ব না পড়া অবধি বুঝতে পারছিনা ঠিক কোথায় চলেছেন।

----মোখলেস হোসেন

সোহেল ইমাম এর ছবি

আশা করি দ্বিতীয় পর্বেই বোঝাতে পারবো কোথায় চলেছি। অনেক ধন্যবাদ মোখলেস ভাই ধৈর্য্য ধরে পড়বার জন্য। হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

পাইনিয়াল গ্ল্যান্ড অ্যাক্টিভেটিং লেখা। পরের পর্বগুলো আমার পড়তেই হবে।

--- জে এফ নুশান

সোহেল ইমাম এর ছবি

জে এফ নুশান লেখাটা আপনার আগ্রহ জাগাতে পেরেছে দেখে ভালো লাগছে। সময় নিয়ে লেখাটা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।