মুহম্মদ জুবায়েরের অপ্রকাশিত রচনা: বালকবেলা / ‘আহা কী যে বালখিল্য’ - ০৫

সন্দেশ এর ছবি
লিখেছেন সন্দেশ (তারিখ: রবি, ০৮/০২/২০০৯ - ৫:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৬. নানা রঙের মানুষগুলি - ১


খোকা চিনাবাদাম, খোকা চিনাবাদাম
টিনের মধ্যে বাদাম, চিনাবাদাম।

এই চিনাবাদাম-কাব্যের রচয়িতা আমাদের পাড়ার শুক্কুর আলীর। শুধু রচনা নয়, সুরারোপ ও গাওয়ার কাজটিও স্বয়ং সে-ই করে। সবাই তাকে শুকরা ডাকে। ঠেলাগাড়ি চালাতো সে। শুকনো পাটকাঠির মতো শরীর, তোবড়ানো গালমুখ, থুতনিতে অল্প দাড়ি। অশক্ত শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে ঠেলাগাড়ি চালানোর পরিশ্রম তার জন্যে দুরূহ হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে অসহ্য পেটে ব্যথা হয়, তখন আর কিছু করা সম্ভব হয় না। এই শুকরা একদিন নতুন পোশাকে আবির্ভুত হয়। কোথা থেকে জোগাড় করেছিলো কে জানে, পরনে তালি দেওয়া ফুলপ্যান্ট, পুরনো চক্কর-বক্কর শার্ট, গলায় কাপড়ের চওড়া ফিতে দিয়ে আড়াআড়ি ঝোলানো রং-করা পুরনো কেরোসিনোর টিন। মাঝখানে একটা জায়গা গোল করে কেটে ঢাকনা বানানো। তার ভেতরে চিনাবাদাম। স্বরচিত গান গেয়ে সে পাড়া মাথায় তুলে ফেললো। বিচিত্র পোশাকের কারণে হোক বা তারস্বরের গানের কারণে, তাকে ঘিরে বালক-বালিকা, এমনকি বয়স্করাও ভিড় করতে লাগলো। মন্দ নয় শুকরার নতুন জীবন ও পেশা। পেটের ব্যথাটি অবশ্য তাকে ছেড়ে যায় না, মাঝেমধ্যে অকস্মাৎ আক্রমণ করে বসে। তখন গান ও বাদাম বিক্রিতে বিরতি দিয়ে শুকরাকে কাতর মুখে বসে থাকতে হয়। তখন জানি না, পরে এই উপসর্গটি আলসার বলে জানা হয়।

আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকের বাড়ির ভদ্রলোকের নাম ময়েজউদ্দিন। তাঁর পেশা কী ছিলো মনে পড়ে না। বাড়ির সামনে মাথাসমান উঁচু মাচা করে লাউ-কুমড়া-সীম ইত্যাদি ফলাতেন। নিচে বেগুন-টমেটো-শসা-মরিচ। তাঁকে ভাবলে একটি ছবিই চোখের সামনে ভাসে। বেশ গোলগালমতো শরীর, উচ্চতায় কিছু খর্ব বলে তা আরো বেশি গোলাকার লাগে, আড়ালে কেউ কেউ ময়েজ ভুঁড়ি বলে থাকে, লুঙ্গিটি হাঁটু পর্যন্ত উঁচু করে পরা, খালি গা – খুরপি হাতে নিড়ানি দিচ্ছেন অথবা মাচা মেরামত করছেন। তাঁর একটিমাত্র পুত্র, তখন তার বয়স একুশ-বাইশ, নাম মনে নেই। ওই বাড়িতে কোনোদিন কোনো মহিলা বা মেয়েকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

তখনকার বগুড়া শহরের এক প্রান্তে এই পাড়ার আধ-ভুতুড়ে অন্ধকারে ন'টা বাজলেই অনেক রাত। এরও কিছু পরে রাতের নৈঃশব্দ আরো গাঢ় হয়ে এলে একজন মানুষ 'হ্যায় আপনা তো দিল তো দিওয়ানা, না জানে কিসপে আয়েগা'-র সুরে শিস দিতে দিতে আমাদের বাড়ি পেরিয়ে যেতেন। কালাম ভাই। তখন তিনি বিশ-বাইশ বছরের যুবক, কী করতেন ঠিক জানি না। আমাদের দক্ষিণে দুই বাড়ি পরে বেশ বিরাট জায়গা নিয়ে তাঁদের বাড়ি। উঁচু করে দেওয়াল ঘেরা বাড়ির বাইরে ছোটোমতো একটি মাঠ। আমরা বলি কালাম ভাইদের মাঠ, এখানে আমরা বালক-বালিকারা খেলাধুলা করি। মাঠের উল্টোদিকে বিশাল একটি তেঁতুল গাছ, যার নামে এই জায়গার নাম তেঁতুলতলা।

শোনা যেতো তেঁতুলতলার ওই বিশাল ঝাঁকড়া গাছের মাথায় অশরীরীদের দেখা যায় চন্দ্রালোকিত রাতে। দিনের বেলায় ঝরে পড়ে ছোটো ছোটো শুকনো পাতা আর পাকা তেঁতুলে গাছতলাটি ভরে থাকে। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ওপরে তাকিয়ে দেখা যায়, ফলবান গাছটির পাতা বাতাসে ঝিরঝির কাঁপে। তখন সেদিকে তাকিয়ে কে বলবে এই গাছে কোনো কোনো রাতে অশরীরীরা যাতায়াত করে!

তেঁতুলতলার গা ঘেঁষে পি টি স্কুলের আজিজ স্যারের একতলা বাড়ি। খুব রাগী বলে খ্যাতি আছে আজিজ স্যারের। অথচ গ্রীষ্মকালের অপরাহ্নে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বারান্দার একটি চেয়ারে বসে তাঁকে হাতপাখার বাতাস খেতে দেখলে সে কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যেতো না। অবশ্য কথা তিনি কম বলেন, হাসতে দেখা আরো দুর্লভ ঘটনা। একদিন সাহস করে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তেঁতুলতলার অশরীরীদের কথা। আজিজ স্যার গলা খুলে হাসেন। বলেন, হামি তা'লে এই গাছতলার বাসাত অ্যাদ্দিন আছি ক্যাঙ্কা কর্যাুলে ?

কালাম ভাইয়ের বাবা হাসান তালুকদার গম্ভীর ধরনের মানুষ। কালাম ভাইয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ সত্ ভাইয়ের নাম বাবু। তিনি থাকেন মূল বাড়ির বাইরে একটি বিশাল ঘরে, ঘরটি সম্ভবত এককালে বৈঠকখানা ছিলো। বাবু ভাই খেলাপাগল, নাটকপাগল মানুষ। পাড়ার নাটকের মহড়া হয় তাঁর ঘরে। নাটক হতো সংলগ্ন মাঠে, যা আমাদের খেলার মাঠ। বাবু ভাইয়ের ঘরটি তখন গ্রীনরুমে রূপান্তরিত হয়।

মূল বাড়ির ভেতরে কী উপলক্ষে যেন একবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে গাছপালা ঘেরা বিশাল বাড়ি, পেছনে একটি পুকুর। কালাম ভাইয়ের ছোটো আরেক ভাই ছিলেন, নাম সম্ভবত ছিলো নয়া, স্থানীয় উচ্চারণে লয়া ডাকা হতো। সুন্দর ফর্সামতো দেখতে ছিলেন, শোনা যায় যুবক বয়সে তাঁর খৎনা করানো হয়েছিলো। তাঁদের তিন ভাইয়ের চেহারায় বস্তুত কোনো মিলই ছিলো না। বাবু ভাইয়ের মুখ ও শারীরিক গঠন অনেকটা তাঁর বাবার মতো। কালাম ভাই মাঝারি স্বাস্থ্যের, শ্যামলা রং, মুখে বসন্তের দাগ তাকে কালোর দিকে ঠেলে দিয়েছে। চোখ সামন্য ট্যারা।

দিনের বেলায় কালাম ভাই গান গাইতেন না, শিসও দিতেন না। কোনোদিকে না তাকিয়ে চুপচাপ নিজের মতো হেঁটে চলে যেতেন। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, আমার কাছে এই কালাম ভাইয়ের ছবি। সেই সময় আর কোনোভাবে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তাঁর হাঁটার ধরণটি বিশিষ্ট ছিলো। একেকটা ধাপ সামনে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের পায়ের গোড়ালিটি কেমন উঁচু হয়ে সামান্য লাফিয়ে ওঠে, মনে হয় যেন নাচতে নাচতে যাচ্ছেন। মানুষটি শান্তশিষ্ট, কারো সাতে-পাঁচে নেই। তাঁর ওই হাঁটার ভঙ্গিটি এবং গভীর রাতের শিস তাঁকে বিশিষ্ট করেছিলো আমার বাল্যকালে।

আঠারো-ঊনিশ বছরের ব্যবধানে কালাম ভাইয়ের সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিলো। ঠিক দেখা হওয়া বলা চলে না বোধহয়। তিনিও আমাকে দেখেছিলেন নিশ্চিত, কিন্তু হয় চিনতে পারেননি অথবা চিনতে চাননি। শান্তাহার থেকে বগুড়ার বাসে উঠেছি। সেই বাসের চালক কালাম ভাই। আমার ছেলেবেলার চেনা কালাম ভাইকে এভাবে দেখতে চাইনি। তিনি যদি আমাকে না চিনে থাকেন, অথবা চিনতে না চেয়ে থাকেন, তাতে কোনো অন্যায় হয়নি।

আমাদের পাড়ায় একটি ক্লাব ছিলো – ফোর এইচ ক্লাব। হেড, হার্ট, হ্যান্ড অ্যান্ড অনেস্টি – এই চার এইচ মিলিয়ে ফোর এইচ ক্লাব। তখন জানতাম না, অনেক বছর পরে জেনেছি ফোর এইচ নামের একটি সামাজিক আন্দোলনের সূচনা আমেরিকায় বিশ শতকের শুরুর দিকে। ক্রমে তা পৃথিবীর অনেক দেশে বিস্তৃতি পায়। বগুড়ার মতো ছোটো শহরে কী উপায়ে কার উদ্যোগে ফোর এইচ ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো জানা নেই। তেঁতুলতলার সামান্য দক্ষিণে একটি চৌরাস্তার মোড়ে টিনের চালওয়ালা একটি অপরিসর মাটির ঘরই ক্লাবঘর। বারান্দায় সারা দিনমান ক্যারমবোর্ড খেলা হয়।

স্থানীয় ফুটবল লীগে খেলে আমাদের ক্লাব, তেমন ভালো কিছু করেনি কখনো। তবে খেলার দিন বিকেলে ক্লাবঘর থেকে জার্সি-বুট পরা খেলোয়াড়রা পায়ে হেঁটে মাইল দেড়েক দূরের আলতাফুননেসা মাঠের দিকে রওনা হলে পাড়ায় সাড়া পড়ে যায়। আমাদের বয়সী পাড়ার ছেলেরা তাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটি। রিকশাপ্রতি চার বা ছ'আনা পয়সার সংস্থান করা সম্ভব হলে রিকশায় চাপিয়ে দেওয়া হতো খেলোয়াড়দের, তখন আমরা রিকশার পেছনে দৌড়াই।

রিকশার পেছনে দৌড়ানোর আরো উপলক্ষ পাওয়া যেতো। প্রতি শুক্রবার নতুন ছবি আসে শহরের দুই সিনেমা হল উত্তরা ও মেরিনায়। রিকশায় বাদ্য বাজিয়ে শহরের সব অলিগলিতে সেইসব ছবির লিফলেট ছুঁড়ে দেওয়া হয়। আমাদের এলাকায় লিফলেট ছড়ানো রিকশার বাদ্য শুনলে আমরা ছুটতে থাকি। নায়ক-নায়িকার সাদা-কালো ছবি সম্বলিত একটা লিফলেট হস্তগত করা গেলে মানবজন্ম সার্থক হয়ে যায়। আরেক ধরনের প্রচার হয় রিকশা ও মাইক্রোফোনে ঘোষণা সহযোগে। ফুটবল লীগের সেরা ক্লাবগুলির খেলার দিন প্রচার করা হয়। মাইক্রোফোনে ঘোষণা: হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার, অদ্য বিকাল পাঁচ ঘটিকায় আলতাফুননেসা খেলার মাঠে বাঘে-সিংহে লড়াই...। বাঘ-সিংহ বলতে বগুড়ার তখনকার অভিজাত দুই দল সিঅ্যান্ডবি (কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডিং, কেউ কেউ বলতো চোর অ্যান্ড বাটপাড়) এবং হোয়াইট ক্লাব। সিঅ্যান্ডবি পরে ইউনাইটেড ফ্রেন্ডস ক্লাব বা ইউএফসি-তে রূপান্তরিত হয়। হোয়াইট ক্লাবে তখন খেলেন পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে মধ্যমাঠের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় অমলেশ সেন। সিঅ্যান্ডবি-র হয়ে একবার এক দীর্ঘদেহী তরুণ গোলকীপার খেলতে এলেন রংপুর থেকে, এই প্রথম বাঁ-হাতি গোলকীপার দেখলাম। নাম শাণ্টু, পরে জাতীয় দলের অপরিহার্য গোলকীপার ছিলেন দীর্ঘকাল।

ফোর এইচ ক্লাবের আরো কিছু ক্রিয়াকাণ্ড ছিলো। বছর বছর ক্যারম টুর্নামেন্ট হতো ক্লাবঘরের বারান্দায়। শীতকালের সন্ধ্যায় আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট কালাম ভাইদের মাঠে। এইসব টুর্নামেন্টে শহরের সব পাড়া থেকে সেরা ক্যারম ও ব্যাডমিন্টনবিদদের খেলা দেখার সুযোগ হতো।

বছরে একটি করে নাটক মঞ্চস্থ হতো, আবৃত্তি ও গান সহযোগে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী। নাটকের রিহার্সাল হয় বাবু ভাইয়ের ঘরটিতে দরজা বন্ধ করে। ছোটোদের সেখানে প্রবেশ করার অধিকার নেই, আমরা ভিড় করি পেছনদিকে ঘরের একমাত্র জানালাটিতে। সেখানেও তাড়া খেতে হয়, বিশেষ করে নায়ক-নায়িকার মধ্যে ভালোবাসাবাসির কথা হচ্ছে। ছোটোদের সেসব শোনা উচিত নয়। নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার সময় অবশ্য এইসব বিধিনিষেধের কথা কেউ মনে রাখতো না, তা সব বয়সীদের জন্যে উন্মুক্ত। তখনকার দিনে পাড়ার নাটক মানেই নাট্যকারের নাম অবধারিতভাবে কল্যাণ মিত্র। বৌদির বিয়ে, শেষ প্রহর - এইরকম দুয়েকটা নাম মনে পড়ে।

(চলবে)


পর্ব - ০১, পর্ব - ০২, পর্ব - ০৩, পর্ব - ০৪




জুবায়ের ভাইয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে পাঠকদের কাছে অনুরোধ রইলো, রেটিং পদ্ধতির ব্যবহার না করার। ধন্যবাদ।



মন্তব্য

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

কোন কমিটমেন্ট না, একদম অনেস্ট অনুভূতিটা বলি
আমি এবার দেশ থেকে ফেরার সময় এখন দেশের সবচেয়ে নামকরা পাঁচজন লেখকের বই কিনে আনলাম। বইগুলো পড়ার সময় আমার বারবার মনে হয়েছে ব্লগে এগুলোর চেয়ে অনেক ভালোমানের লেখা পড়া হয়!
জুবায়ের ভাইর এলেখাটা পড়ে আবারও একই কথা মনে হলো।
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আরিফ জেবতিক অফলাইনে  এর ছবি

এই সিরিজটা পড়ে যাই , কিন্তু কখনো মন্তব্য করি না ।

রানা মেহের এর ছবি

কীযে সুন্দর
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

s-s এর ছবি

কি রকম একটা পুরনো বইয়ের গন্ধ নাকে এসে লাগে এটা পড়লে -- ---
(আচ্ছা রেটিং না দেবার অনুরোধ সত্ত্বেও রেটিং দিলেন কে?
শ্রদ্ধা প্রকাশ বশত: হয়তো না দিলেই পারতেন--- ---- ---- )

জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।