সত্য (কল্পগল্প)

স্পর্শ এর ছবি
লিখেছেন স্পর্শ (তারিখ: মঙ্গল, ২৩/০৭/২০১৩ - ৭:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই ক্যাফের সুবিধা হলো, চেয়ারগুলোতে রীতিমত পদ্মাসনে বসা যায়। সেই লোভেই যাওয়া। না ধ্যান করতে নয়। গল্পেরবই-টই পড়ি আরকি। ফ্রী ভাউচার পাওয়া গেছে একটা। চা-কফির উচ্চমূল্য নিয়ে তাই আজ কোনো দুঃশ্চিন্তা নেই। ব্যাগের মধ্যে কয়েকটা গল্পের বই আছে, পেপারের ড্রাফ্ট আছে। আর আছে স্কেচবুক, ল্যাপটপ, হেডফোন, পানির বোতল আর পেনসিল। তার মানে এখানে তাবু খাটিয়ে রীতিমত বসবাস শুরু করে দেওয়া যাবে। স্টারবাকসের এইটাই সুবিধা। কিছুমিছু একটা কিনে সামনে মগটা রাখলেই হলো। সারাদিনের জন্য ঐ টেবিল দখল। আজকের ল্যাটেতে অবশ্য কোনো হৃদয়াঙ্কন পাওয়া গেল না। তাই বেশি করে চিনি মিশিয়ে কোনার দিকে একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম।

পাশেই গ্লাস প্যানেল। বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। ওপারেই পানি জমে, ডোবা মত সৃষ্টি হয়েছে। দেখলে দেশের বাড়ির কলপাড়ের কথা মনে পড়ে। ছোটো ছোটো কচু গাছ। ব্যাং, ব্যাঙাচি, মশার শুককীট, শ্যাওলা এসব নিয়ে রীতিমত একটা মাইক্রো ইকোসিস্টেম। নিশ্চয়ই কোন কর্তৃপক্ষের চোখে পড়েনি। তাহলে এতক্ষণে শানবাধাই করে ফেলতো। এ দেশে, প্রাকৃতিক দৃশ্যের দেখা মেলা ভার। গাছে পাতাগুলোও ছোট বড় হয়ে গেলে কেটে কুটে সমান করে রাখে। এই বেখেয়ালের ডোবা তাই প্রাণভরে উপভোগ করতে লাগলাম। এইটুকু ময়লা পানি, তার মধ্যে কতশত প্রাণ! মহাবিশ্বের আর কোনো গ্রহে কি এমন আছে? এসব ভেবে মনের মধ্যে কেমন কবি কবি ভাব এসে গেল।

এক সময়, ব্যাগ থেকে একটা বই বের করলাম। রোয়াল্ড ডালের দশটি ছোট গল্প। প্রথম গল্পটাতে এমন একটা বৃষ্টির দিনের কথাই লিখেছে। এক বৃদ্ধ তার মানি ব্যাগ ভুলে গেছে। একটা দামী ছাতা নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিতে চাইছে গল্পের প্রোটাগনিস্টের কাছে। ডালের সব গল্পে একটা উইকেড টুইস্ট থাকে। এইগল্পটাও সেদিকে এগোচ্ছে।

একটু বাদে ক্যাফেটা পুরোপুরি ভরে গেল। ভার্সিটি এলাকা, সবাই তরুণ-তরুণী। তাদের নানান রকম গুঞ্জন আর বৃষ্টির রিমঝিম মিলে দারুণ একটা আবহ সৃষ্টি হয়েছে। নিজের স্টাডিতে বসে থাকলে নিশ্চিত এতক্ষণে পড়ে পড়ে ঝিমাতাম। এখানে এসেছি বলে স্বীয় দূরদর্শিতাকে আরেকবার বাহবা দিতে হলো।

এক সময় ল্যাপটপ খুলে বসতেই, পুরোনো প্রেম জেগে উঠলো মনে। মাঝে মধ্যে এমন হয়। নীল একটা স্ক্রীনে কিউবেসিক কোড লিখতে লিখতে, স্থান-কাল সব মিলেমিশে যাচ্ছে। মা ডাকছে, খেতে। বাবা বলছে, বাইরে গিয়ে একটু খেলাধুলা করলেও তো পারিস, সারাদিন কম্পিউটার! আমি তখন এলিসের মত, আয়নার বদলে এই কম্পিউটার মনিটরের মধ্যে দিয়ে চলে গেছি অদ্ভুত এক ওয়ান্ডার ল্যান্ডে! পৃথিবীর মানুষ সেই জগতের কী জানে? ছেলেবেলার সেই অভিযান অবশ্য এখনো শেষ হয়নি আমার। এই যে কোন দূরের দেশে, অদ্ভুত এক ক্যাফেতে বসে ব্যাঙের ছানা দেখতে দেখতে পাইথনে কোড লিখছি। এটাও সেই অ্যাডভেঞ্জারের একটা পর্ব ছাড়া আর কি?

একটা ঘোরের মধ্যে, পুরোনো একটা সমস্যা নিয়ে কাজ করলাম কিছুক্ষণ। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের পেপারটার নতুন একটা ড্রাফ্ট লেখা হলো। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বহুবিশ্ব তত্ত্ব সময় প্রবাহ আর চেতনার (কনসাসনেশ) ধারণায় কীভাবে প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে ভাবছি, এমন সময় চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে আমার টেবিলের পাশে। ভরা ক্যাফে। নিশ্চয়ই সিট পাচ্ছে না। কিন্তু আমি তাকে নিয়ে ভাবতে চাই না। মাথা না ঘুরিয়ে পেনসিল আর কাগজ নিয়ে ডুব দিলাম নিজস্ব ওয়ান্ডার ল্যান্ডে। লোকটা আমাকে আর ডিসটার্ব করে নি।

স্থান-কাল আবার যখন স্বাভাবিক হয়ে এলো। তখন বেশ খিদে লেগে গেছে। বাইরে সন্ধ্যা। বৃষ্টি থেমেছে। কাঁচের ওপারের ডোবায় একটা ব্যাং ডাকছে। ভিতরে বসে শোনা যায় না, তবে গলার কাছে ফুলে ফুলে ওঠা দেখে বোঝা যায়। আমি আমার গাট্টি বোচকা গুছিয়ে রওনা দিলাম বাসায়।

বাইরের ড্রপ অফ পয়েন্টে পৌছাতেই, আবারো ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। এই দেশের এই এক সমস্যা। সারাবছর বৃষ্টি লেগে থাকে। হুঠ হাঠ, এলিফ্যান্টস-অ্যান্ড-ডাইনোসরস বৃষ্টি। ব্যাগটা ওয়াটারপ্রুফ নয়। তার মানে ক্যাফেতে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করাই ভালো। ততক্ষণে সম্ভবত ফেলে আসা সিটটা দখল হয়ে গেছে। তারপরও ফিরে গেলাম। দেখাই যাক। গিয়ে দেখি, আমার চেয়ারটাতে কে একজন পদ্মাসনে বসে গভীর মনযোগে কাগজে আঁকিবুকি করছে। ল্যাপটপে পাইথন কোড রান হচ্ছে। পাশে একটা চেয়ার ফাঁকা। ছেলেটা উঠে তাকালে অনুমতি নিয়ে বসে পড়া যেত। পুরো ক্যাফেতে আর কোনো ফাকা সিট নেই। তবে মনে হচ্ছে ব্যাটা ভাবসমাধি খেয়েছে। মাত্র দু-মিনিট হলো সিট টা ছেড়ে গেছি। এর মধ্যেই জায়গা দখল করে এত মনোযোগ ফলাচ্ছে কিভাবে ভেবে পাচ্ছি না। আমি যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছি সেটা চোখের কোনা দিয়ে খেয়ালও করেছে মনে হলো। তারপরেও মনোযোগের ভান করেই যাচ্ছে। ছেলেটাকে আবার কেমন চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছি মনে আসছে না। মেজাজ খারাপ হলো। নাহ, এর কাছে বসা যাবে না।

বৃষ্টির জোর তখনো একটুও কমেনি। বেরিয়ে যেতে যেতে, একটা অস্বস্তিকর সম্ভাবনার কথা মাথায় উকি দিলো। কিন্তু না, এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। স্পেসটাইম কন্টিনিউয়াম, এটা সাপোর্ট করবে না। কিন্তু, আমি নিজেই তো একটু আগে ভাবছিলাম, স্থান-কাল হয়তো সরলরৈখিক নয়, বরং শাখাপ্রশাখাওয়ালা ওয়ালা ফ্র্যাক্টালের মত, অসীম সংখ্যক পুনরাবৃত্ত ক্ষুদ্রাংশ নিয়ে তৈরি, যার প্রতিটি অংশ আবার অসীম সংখ্যক পুনরাবর্ত্ত ক্ষুদ্রাংশ নিয়ে তৈরি.. এভাবেই একটা কন্টিনিউয়াম তৈরি করেছে। এমন কি হতে পারে না, সময়ের ক্ষুদ্র দুটো প্রশাখা, মিলে গেল আবার একটু পরে? অবশ্য এমনও হতে পারে, যে আমি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি; যা কিছু দেখছি, শুনছি, তার অনেকটাই হয়তো শুধুই আমার কল্পনা?

এটা বুঝতে পারছিলাম, যে সম্ভাবনাগুলোর যে কোনো একটা সত্য হলেই আমার বাকি জীবনটা আর আগের মত থাকবে না। একবার পিছন ফিরলেই অবশ্য নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু, খুব খিদে পেয়েছে। খালি পেটে এইসব সত্যের মোকাবেলা করা মুশকিল. . .


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

চিন্তিত
জগলুল সিঙ্গালুর‍্যাটি নামের সাইন্স ফিকশনটার কথা মনে পড়ে গেল

স্পর্শ এর ছবি

চিন্তিত এটা কার লেখা? হুমায়ুন আহমেদ নাকি জাফর স্যার?
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

জাফর স্যার।
আপনার এই লেখাটার কাছাকাছি আরেকটা আছে - প্রোগ্রামার।

অতিথি লেখক এর ছবি

চালায়া যান - আপনার হইবো।
-প্রোফেসর হিজিবিজবিজ

চরম উদাস এর ছবি

চলুক

স্পর্শ এর ছবি

হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ক্যাপ্টেন নিমো এর ছবি

চলুক ভাল লাগল

স্পর্শ এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

এয়্যারেই বলে খিদার উপকারীতা। অই সব সময়ে কখুন ফিরা তাকাইতে নাই। জানলাম ক্যামনে? নিজের জীবন দিয়া জানছি গো দাদা, ফিরা তাকাইছিলাম - সর্বনাশ হইয়া গ্যাল! আর পুরান আমিটায় ফিরতে পারলাম না! অখন সারাদিন, এমন কি রাইতেও মিনোটারের গোলকধাঁধার মত সচলায়তনের গলির গলি তস‌্য গলিতে ঘুইরা ব্যারাই! ক‌্যন যে ভরা প্যাটে কম্পিউটার খুলতে গেসিলাম ওঁয়া ওঁয়া
খাসা গল্প নামাইছেন। মানে হইল গিয়া পরেরটা কহন আইব? হাসি
- একলহমা

স্পর্শ এর ছবি

হে খিদা তুমি মরে করেছো মহান।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ছায়ামানবী এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম ভালো লাগলো।

স্পর্শ এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ছাইপাঁশ  এর ছবি

এক নিশ্বাসে পড়েছি!

স্পর্শ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। গল্পটা টানা পড়া যাচ্ছে জেনে প্রীত হলাম। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

আয়নামতি এর ছবি

মানে আছে কোনো! গল্প লিখেছেন সেখানেও গুজে দিলেন বিজ্ঞান রেগে টং
আমার মত নিরেট মাথার পাঠকের কথা একটুও তো মাথায় রাখা যায় নাকি!
তবে গল্পটা লিখেছেন দারুণ চলুক আমি দু'বার পড়ে ফেললাম দেঁতো হাসি

স্পর্শ এর ছবি

বিজ্ঞান কই? এইসব আবজাব।
পড়েছেন জেনে ভালো লাগলো। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

বন্দনা এর ছবি

সক্কাল সক্কাল এমন একটা গল্প পড়ে মনটা ভালো হয়ে গেলরে। চলুক

স্পর্শ এর ছবি

থ্যাঙ্কিউ! মন্তব্য পড়ে আমারো মনটা ভালো হয়ে গেল। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

আইলসা  এর ছবি

ভালো হইছৈ। তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় খারাপ লাগলে, একদাম বাহুল্য-বর্জিত, চিকনা-চামেলি টাইপ লেখা।
জগলু'স সিংগুলারাটি মনে হয় জাফর ইকবালের লেখা।

স্পর্শ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। গল্পটা আরো ছোটো করতে চেয়েছিলাম। এর কমে পারা গেল না। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুন লাগলো চলুক , জগলুল সিঙ্গালুর‍্যাটি গল্পটা জাফর স্যার এর লেখা, আপনার গল্পটা অনেকটা একই ভাবধারার (আপনার উনার মত লেখক হওার সম্ভবনা প্রবল চোখ টিপি
ইসরাত

স্পর্শ এর ছবি

ধন্যবাদ ইসরাত। হাসি
কিন্তু, শুধু শুধু লজ্জা দেন কেন?


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

শুধু শুধু কোথায় লইজ্জা দিল!! ঠিকাছে।।(স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট)

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বাস্তবেও মাঝে মধ্যে এমন ঘোরলাগা ঘটনা ঘটে যায়, কেমন যেন... কোনো ব্যাখ্যা নাই...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

স্পর্শ এর ছবি

বাস্তবতা জিনিসটা আসলেই বিশাল গোলমেলে।
হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

আমারো ক্যাফেতে বসতে ইচ্ছা হলো, তারমানে গল্প ভাল্লাগ্ছে (স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট)

স্পর্শ এর ছবি

ভালো লেগেছে শুনে আমারো ভালো লাগলো। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

উইকেড টুইস্ট শয়তানী হাসি

রাত-প্রহরী এর ছবি

খাসা হইছে। লেখা -গুড়- হয়েছে

------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

তানভিরুল সিঙ্গুলারিটি! পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম দেঁতো হাসি

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

শাফায়েত এর ছবি

স্থান-কাল হয়তো সরলরৈখিক নয়, বরং শাখাপ্রশাখাওয়ালা ওয়ালা ফ্র্যাক্টালের মত

দারুণ!! হাততালি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

কল্যাণ এর ছবি

দারুণ হাততালি

আর নাই? পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

সো এর ছবি

দারুন গল্প!
অনেক আগে কাছাকাছি কনসেপ্টের একটা গল্প লিখেছিলাম। মনে পড়ে গেলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।