মৃত্যু সম্পর্কিত একটি টুকুনগল্প

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৪/১১/২০১০ - ১০:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গ্রামের নাম নৈঋত। গ্রামে প্রচুর গাছগাছালি, বেশ কয়েকটি এঁদোপুকুর, অনেক অনেক ঘরবাড়ি, একটা বাজার, একটা প্রাইমারি স্কুল, তিনটা মসজিদ, অনেক পুরানো একটা জাগ্রত কালিমন্দির। একটা প্রবীণ বটগাছ। গ্রামের বুড়োরা বলে এই গাছের বয়স কমসে কম দেড়শো বছর। কালি মন্দিরের কাছাকাছি এই গাছে বছর তিনেক আগে গ্রামের চৌদ্দ বছরের মেয়ে রাশেদা গলায় দড়ি দেয়। রাশেদার মৃত্যু নিয়ে গল্পে কিছু বলার নেই কারণ পাঠক চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ের মৃত্যুর সাথে গ্রামের বখাটেদের একটা সম্পর্ক খুব সহজেই বের করতে পারেন। গ্রামের পাশের মহাসড়ক দিয়ে গ্রামে ঢুকতে গেলে প্রথম দুটি এঁদোপুকুর পেরোনোর পর তৃতীয় প্রায় এঁদোপুকুরে কিছু সাদা বক গত সপ্তাহেও দেখা যেত। কিন্তু এই কয়দিন আর দেখা যাচ্ছে না। রিকশা করে বাড়ি ফেরার পথে স্কুল মাস্টার আজিজুল এই প্রশ্ন করেন তার বাঁধা রিকশাওয়ালা হারুনকে। হারুনের উত্তরের সাথে পাঠকের ধারণা পুরোপুরিই মেলে। গ্রামের তৃতীয় মসজিদ বানানো শুরু হয় দুই বছর আগে। মাস চারেক আগে কাজ শেষ হয়। কালি মন্দির থেকে একটা বাড়ি ছাড়িয়েই নতুন এই মসজিদ। মুয়াজ্জিনের মাইকের গলার সাথে মন্দিরের টুংটাং কখনো কখনো ঐকতানে মিলে। গ্রামবাসীদের এইসব নিয়ে ঝামেলা নেই। তবে বছর বিশেক আগে পার্শ্ববর্তী দেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রেশ না ছুঁয়ে থাকার ব্যতিক্রম দেখাতে পারেনি এই গ্রাম। সেই সময়ের প্রাইমারি স্কুলের নামকরা অঙ্ক-মাস্টার রতন পালের ষোলো বছরের মেয়েটিকে গ্রামের কিছু যুবক তুলে নিয়ে যায়। মেয়েটার মৃতদেহ পাওয়া যায় দিন তিনেক পরে। কোনো একটি এঁদো না হওয়া পুকুরপাড়ে। রতন মাস্টার গ্রাম ছেড়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। সেইসময় আরো কিছু ঘটনা ঘটে। গ্রামের লোকেরা এইসব মৃত্যু আর দাঙ্গা পেরিয়ে এসেছে অনেককাল। গ্রামে একটা মনোচিকিৎসাকেন্দ্র থাকার কথা লেখক গল্পের শুরুতে দিতে ভুলে গেছেন। গ্রামবাসীরা সহজ নামে ডাকে- পাগলা গারদ। অনেক পুরানো। বটগাছের সমবয়সের কি না জানতে হলে গ্রামের প্রবীণ কারো কাছে জেনে নিতে হবে। এটা এখন চালায় মনোজ। মনোজ মনোচিকিৎসালয় মনোজ মল্লিক মনোচিকিৎসক – বিশাল সাইনবোর্ড টাঙানো মাটির ঘর টিনের চালা অফিসঘরের সামনে। পেছনে একটা মাটির লম্বা টানা ঘর। সেটা খড়ের চালা। এক একটি কক্ষ একজন উন্মাদ পাগল কিংবা মনোবিকলন রোগীর। সেখানে চৌদ্দটি কক্ষ। চারটি আপাতত ফাঁকা। বিকেলবেলা গ্রামের ছেলে-মেয়ে-বুড়ো সেখানে ভিড় করে। দেখা যায়-একটা কক্ষের ছোট্ট জানালায় ভিড় করেছে অনেক কয়জন অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়ে। মেয়েরা মুখে ওড়না দিয়ে হাসে। পিচ্চিরা অবাক হয়ে দেখতে থাকে নগ্নদেহ সেই উন্মাদের শীর্ণকায় শিশ্ন। উন্মাদ বলে ওঠে- এই তোরা ট্রান্সলেশন কর দেখি- ফারিয়া চোখেমুখে কথা বলে।

মনোজের মা রাতে প্রবীণ বটবৃক্ষের মৃত্যু সম্পর্কিত স্বপ্ন দেখেন। ভোরের দিকে মনোজের মা মারা যান।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কম্পিউটারের স্ক্রীনে এই গল্প যেমন দেখতে পাচ্ছি তাতে লাইন ১ থেকে ১১ (আসলে ১২'র শুরু) পর্যন্ত গল্পটা এক খাতে বয়েছে। লাইন ১২'র শুরু থেকে ২১-এর প্রায় শেষ পর্যন্ত বয়েছে আরেক খাতে। লাইন ২১-এর প্রায় শেষ থেকে ৩৩ (আসলে ৩২ ১/২) পর্যন্ত গেছে তৃতীয় খাতে। লাইন ৩৪ আর ৩৪ ১/২ কে কে চতুর্থ খাত বলা যায়। একে আলাদা অনুচ্ছেদে দেবার দরকার হলো কেন? এটা ট্যুইস্ট সেটা বোঝানোর জন্য? এখানে খাত বলাটাও আসলে ঠিক হচ্ছেনা, কারণ এখানে কাহিনীর কন্টিনিউটি বজায় রাখা হয়নি, শুধু ভৌগলিক অবস্থানটা এক।

একই সময়ে বা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, এক বা একাধিক স্থানে সমান্তরালে প্রবাহিত কাহিনী ধরেও গল্প আগাতে পারে। সেখানে অনুচ্ছেদ তো অনুচ্ছেদ, বাক্য পর্যন্ত মার্জ করে যেতে পারে। উদাহরণের জন্য নবারুণ ভট্টাচার্যের "যুদ্ধ পরিস্থিতি" দ্রষ্টব্য। পরম বিচারে কোনো সরল রেখাই সরলরেখা নয়, সুতরাং সমান্তরালে প্রবাহিত সরলরেখা অসীমে গিয়ে মিলিত হয় এমন ধারণা থেকে সমান্তরালে প্রবাহিত কাহিনীকে অসীমে লিঙ্ক-আপ করা যায়। কিন্তু এখানে তা করতে গিয়ে কাহিনীতে ফাঁক থেকে যাচ্ছে। গল্পের আকার ছোট করতে গিয়ে অযাচিত কাঁচি চালালে দরকারী ধমনী বা স্নায়ুরজ্জু কাটা পড়তে পারে।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

পাণ্ডবদা,

গল্পটা লেখার পর নাম দিয়েছিলাম- মৃত্যু সম্পর্কিত একটা টুকুনগল্প। এতে গল্পের মাজেজা প্রথমেই উন্মোচিত হয়ে যায়। তাই নাম বদলে দিয়েছিলাম। এখন আবার স্বনামে ফিরিয়ে আনলাম।

গল্পের খাতগুলোর suture নামের মধ্যেই। তবে মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক নয়। রাশেদার মৃত্যু। বক কেটে খাওয়া। অঙ্কের মাস্টারের মেয়ের মৃত্যু। চতুর্থ ঘটনা উন্মাদ নিয়ে। কিছুটা রূপক। সেটাও অস্বাভাবিক।

একমাত্র স্বাভাবিক মৃত্যু ধরে নেয়া যায় শেষ দুটি বাক্যের মধ্যে বলা মৃত্যুকে। তাই আলাদা লাইন।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

দুর্দান্ত এর ছবি

গত কয়েকটি অনুগল্পে ক্রমশ একটা রোগের ধীর কিন্ত নিশ্চিত ছড়িয়ে পড়ার উদিশ পাচ্ছি। বদলে যাচ্ছে চারদিক, আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে এক অসুচিতে। এই বদলকে আপনার গল্পগুলো প্রকাশ করছে অনেকভাবেই, তবে ফিরে ফিরে আসা একটি উদাহরন হল আরবী নামের চরিত্রদের কনুইয়ের গুতোয় বাংলা নামের চরিত্রগুলোর সরে যাওয়া।

প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা আটপৌরে মঞ্চের পটভূমিকেও পাল্টে দিচ্ছে সেটা আপনার লেখায় আরো পষ্ট করে অনুভব করি।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা থেকে এই অঞ্চলের লোকজন মুক্ত হতে পারে না। রাষ্ট্র দেশ মদদ দিলে মুক্তি কখনোই মিলবে না।

-----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

গল্পটা ভাবালো। টুকুনগল্পে এইভাবে একটা অনির্দিষ্ট-বিক্ষিপ্ত, অদেখা সুতো দিয়ে জোড়া লাগানো বাক্যগঠন প্রক্রিয়াটি বেশ পছন্দের। সমস্যা হলো, পাঠক হিসেবে এতে আমি অন্ততঃ গল্পকারের ফোকাস বিন্দু আলাদা করতে পারিনে।

পারবো না জানি, তবু এই লাইনে একটা চেষ্টা করা দরকার।

_________________________________________

সেরিওজা

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লেখ সুহান। আর যাই হোক আমার আব্‌জাব্‌ থেকে ভালো হবে।

-----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

কামরুল হাসান রাঙা [অতিথি] এর ছবি

লেখা ভাল হয়েছে, তবে এই প্লটে বড় গল্প হলে আরও জমত।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হুম।

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হাসি

কমেন্ট করলে নামটা নিচে দিয়ে দিয়েন, স্যার।

-----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

দ্রোহী এর ছবি

আপনি উপন্যাসের প্লট দিয়া টুকুন গল্প ল্যাখেন ক্যামনে?

আপনি কী খান আসলে?


কাকস্য পরিবেদনা

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

অন্যরকম গল্প। ভাল লাগল।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হাসি

কমেন্ট করলে নামটা নিচে দিয়ে দিয়েন, স্যার।

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সাইফ তাহসিন এর ছবি

মৃত্যু নিয়া ব্যবসা আমার, তাই মৃত্যু ভালু পাই না মন খারাপ, ব্যাড ফর বিচিনেস

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মন খারাপ

----------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার ছোটগল্পগুলো বিষয়, আঙ্গিকে যতই বৈচিত্রময় হোক না কেন, একটা জিনিস কমন থাকে- বিন্দুতে সিন্ধুর স্বাদ। তবে মাঝে মাঝে বিন্দু দিয়ে পোষায় না, পড়তে পড়তে পিপাসা বেড়ে যায়। এটাতে তেমন লাগেনি যদিও। লেখাটা পূর্ণাঙ্গই মনে হয়েছে। বটগাছটা প্রতীকি মনে হল, তাই কি?

ফারাবী

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ছফার প্রবীণ বটবৃক্ষ। প্রতীকি তো অবশ্যই।

--------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।