ছন্দ লেখা- মন্দ লেখা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৬/০৬/২০০৭ - ২:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:
লেখার প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে অন্য প্রসঙ্গে খানিকটা আলোচনা করি। আচ্ছা, ভাল মানুষ মন্দ মানুষ বলতে আমরা কি বুঝি? এ নিয়ে অসংখ্য কঠিনসব মত আছে। আমার মোটা দাগের মত হচ্ছে, মানুষটা একজন শাঁসালো নেতা, নাকি জাঁকালো সেলিব্রেটি তাতে কী আসে যায়! যদি না মানুষটার প্রকৃতির প্রতি, প্রকৃতির সন্তানদের জন্য প্রগাঢ় মমতা লালন করেন। তো, লেখার যে প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল। মৌলিক বলতে আদৌ কোন লেখা নাই- সবই প্রকৃতির নকল। এখন এই নকলবাজি কে কি ভাবে করছেন, সেটাই দেখার বিষয়। একজনকে অশরীরী কিছু একটা আঁকতে দিলে সে এমন একটা কিছুই আঁকবে প্রর্কৃতির কোন না কোন একটা অংশ চলে আসবে অবলীলায়। আচ্ছা, কঙ্গোর নরখাদক লেন্দু উপজাতির ভাল সাহিত্য কি এটা হতে পারে না? মানুষের মাংস খাওয়ার রগরগে বর্ণনা! মাংস খেতে খেতে আলোচনা হচ্ছে কেন মাংসটা ভাল করে সেদ্ধ হয়নি। এটা কি রান্নার দোষ নাকি মানুষটাকে মেরে ফেলার পর সব রক্ত ঝরিয়ে ফেলা হয়নি বলে? নাকি যে রান্না করছিল সে খানিকটা অন্যমনস্ক ছিল বলে। হয়তো এইসব ডিটেইলসের মধ্যে বেরিয়ে আসবে কোন একটা মানবিক গুণ, বা পাঠকদের চোখে ধরা পড়বে ভাবের খেলা। কে জানে, এই একটি ভাব আমূল পরিবর্তন এনে দেবে একজন মানুষের গোটা অবয়বে। তার মনটা হবে তলতলে- অজানা ছাপ পড়বে অনায়াসে। আসলে মস্তিষ্ক তাকে নিয়ে কি খেলাটা খেলবে এটা আগাম বলা ভারী মুশকিল। ভাল লেখার মান কে নির্ধারণ করছেন এটা খুব জরুরী। আমরা যেমন নতজানু হয়ে মেনে নেই অল্প কিছু উন্নত দেশের শাসন তেমনি তাঁদের লেখা নিয়েও গদগদ হয়ে যাই। রাশিয়ার অনেক লেখকের হাত সোনা দিয়ে বাঁধাই করে না দিলে অন্যায় হয় কিন্তু প্রতি নিঃশ্বাসে মায়াকভস্কি, দস্তয়ভস্কি বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলার প্রয়োজন আছে কী! একজন লেখকের লেখা ভাল লাগলেই তাঁর সব লেখা নিয়ে লাফাতে হবে কেন? রুশোর কনফেশনস যেমন আমার কাছে আহামরী কিছু মনে হয়নি তেমনি এই ভদ্রলোকের এই কথাটাও আমার ভাল লাগেনি। রুশোর বক্তব্য: আমাকে বোঝা অত সহজ না, বা আমার আমার কোন পূর্বগামী নেই তেমনি কোন অনুগামীও কখনও হবে না। বাহ, অবিকল ঈশ্বরসুলভ কথাবার্তা! এমনিতে আমি লেখকদের দ্বিতীয় ঈশ্বর বলি কিন্তু প্রথম ঈশ্বরদের নিয়ে কিঞ্চিত জটিলতা দেখা দেয়। এঁদের কাজ-কারবার গ্রহবাসী বুঝবে কেমন করে! এদের লেখা নিশ্চই পড়ার জন্য না, কাপড় মুড়িয়ে রেখে দেয়া- অবসরে ধুলো ঝেড়ে সাফসুতরো করা। আফসোস, উন্নত দেশের ক-জনই বা সুবোধ ঘোষ, মনোজ বসু, সতীনাথ ভাদুড়ী, এঁদের লেখা পড়েছেন? কোন নামকরা লেখকের লেখা ভাল না লাগলে স্পষ্ট করে বলতে পারি না আমরা- জাত যায় যে! রবিবাবুর উপন্যাস আমাকে টানে না- কিন্তু তাঁর ছোটগল্প মনে হয় অসাধারণ। লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলি আর বিড়বিড় করি, দাদা সম্ভবত কোন বিষয় বাদ দেননি। এখন তাঁর উপন্যাস কেন ভাল লাগে না এ নিয়ে কার সঙ্গে মারামারি করব? অন্তত নিজের সঙ্গে মারামারি করা খুব একটা কাজের কাজ না। তাঁর উপন্যাস উপন্যাস হয়নি এটা বলে মাথা হারাব বুঝি! আবার এটাই বা কেমন করে স্বীকার করি কেবল আমার মননের ঘাটতিই এর জন্য দায়ী- অথচ তাঁর একেকটা ছোটগল্প পড়লে বুকের গভীর থেকে বেদনা পাক খেয়ে উঠে- আহা, এমন একটা ছোটগল্প লিখে মরে গেলেই কী! নাই বা হলো জ্যোৎস্না রাত। আমার মনে হয় একটা লেখার পেছনের কলমবাজ মানুষটাই মূখ্য। তিনিই ঠিক করেন আমাদের কি দেখাবেন- কোন ভাবনায় জড়িয়ে ফেলবেন। প্রকৃতির নকলবাজ এই মানুষরা একই বিষয় নিয়ে লেখেন একেক ভঙ্গিতে। একটা ভার্চুয়াল জগৎ সৃষ্টি করেন- আমরা পাঠকরা কতটা অবাধে ওখানে বিচরণ করব এটা আগাম বলা মুশকিল। যখন অবিকল তাঁর চোখ দিয়ে যখন আমরা দেখি তখন সেই মানুষটা অসফল এই দাবী করার যৌক্তিকতা কোথায়! কেউ লেখায় আলগা কাঠিন্য এসে ভারী আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। পাঠকের সংখ্যা বেড়ে গেলে জনপ্রিয় ধারার লেখা হয়ে গেলে, লজ্জায় যে মাথা কাটা যায়!চারদিকে গোলমালে কান পাতা দায়, মান গেল, মান গেল- গভীরতা গেল রে, গভীরতা গেল! এ তেই তিনি সুখী; স্বল্পসংখ্যক পাঠক তার লেখা বুঝলেন- আর যারা বুঝলেন না, তারা লজ্জার মাথা খেয়ে স্বীকার করতে আগ্রহ বোধ করলেন না। বিচিত্র কারণে তিনি আর নিজের চোখের দিকে তাকালেনই না। তবে এও সত্য, লেখক যদি পাঠককে সবই বলে দেন তাইলে নিশ্চিত পাঠককে বড়ো নির্বোধ ভাবেন। যেন পাঠক বেচারার আর কোন কাজ নাই- মস্তিষ্ক ফ্লাওয়ার ভাসে জমা রেখে, খালি করোটিতে চায়ে চুমুক দিতে দিতে পড়ে যাওয়া। লেখক মাস্টার, পাঠক ছাত্র। অনেক দুঁদে লেখকই জাঁক করে বলেন, আমি তো আমার নিজের আনন্দের জন্য লেখালেখি করি। তাইলে বাপু, নিজের লেখা নিজে পড়লেই হয়। ভায়া, অন্ধকারে দাঁত বের করে বসে থাকুন না, আটকাচ্ছে কে! কেই বা দিব্যি দিয়েছে আপনি নিজের লেখা নিজে পড়তে পারবেন না! একটু অন্য রকম করে বলা যাক। একটি পরিবারের বিভিন্ন সদস্য ঘুরতে বেরিয়েছেন। একেকজনকে একেকটা দিক টানছে। কেউ যেটা দেখে উচ্ছ্বসিত অন্য একজন হয়তো ওটার দিকে ভাল করে দৃষ্টিও ফেলেননি। কেন? এর উত্তরে হাজারো ব্যাখ্যা দাঁড় করানো চলে। তেমনি ছন্দ লেখা-মন্দ লেখারও অসংখ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। যেমন, আমার মতে, এই লেখাটা একটা মন্দ লেখা। আমার বিনীত ব্যাখ্যাটা হচ্ছে এই, মূল ফোকাস থেকে আমি সরে এসেছি। ভাবনা হয়েছে এলামেলো। কিন্তু আমরা সব সময় বিক্ষিপ্ত ভাবনা ভাবব না এটা ভাবাটাও খানিকটা অস্বাভাবিক। যেমন এটা ভাবা, আমরা আজ পর্যন্ত যা খেয়েছি তার সবটাই শরীর ধারণ করে বসে থাকবে!

মন্তব্য

সৌরভ এর ছবি
হুমম, এরকম করে ভাবি নি কখনো তো । লেখার মান কিংবা ভাল লেখা বা মন্দ লেখা -ব্যাপারগুলান সবই তো আপেক্ষিক। সস্তা প্রেমের গল্পও কখনো কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ে। আর গুরুগম্ভীর লেখার পাঠক হারিকেন দিয়ে খুঁজতে হয় । ------ooo0------ অনুভূতিশূন্য কেউ একজন

আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

কর্ণজয় এর ছবি
ভালো লেখা কোনটা এ নিয়ে কম্যূনিষ্টদেও এক ধরনের সরল বিবেচনা ছিল। সংগ্রামী সাধারন জীবনের উচ্চকিত নৈতিকতার স্পন্দন না থাকলে এটা ভাল লেখা না। এ ব্যাপারে লেনিনের (মার্কস কি? সন্দেহে পড়ে গেলাম) একটা সমালোচনায় তিনি বালজাক নিয়ে (বালজাক রাজা রাজড়ার ভোগবাদী জীবনের ছবি একেছেন) বলেছিলেন '’ ভালো - দারুন ভালো- আসলে বাস্তবতাকে ভেতরের মাল মসলাশুদ্ধ তুলে আনতা পারাই ভালো সাহিত্যের কাজ (সাহিত্যের আরো কাজ আছে নিশ্চয়ই কিন্তু সেটা আর এখন ...)
আরিফ জেবতিক এর ছবি
ওয়েলকাম ব্যাক দ্য গ্রেট শুভ উইথ হিজ ব্লগিং। আপনার চিন্তাভাবনার সাথে একমত।ভালো লেখা বলে আলাদা আলাদা ব্রান্ডিং হতে পারে,কিন্তু চিরন্তন ভালো লেখক আসলেই চিহ্নিত করা যায় কি না সেটা নিয়ে তর্ক থেকে যায়।একই লেখকের সব লেখা ভালো হবার কোন উপায় নেই,অন্তত একই পাঠকের কাছে তার সব লেখা সমান আবেদন নিয়ে আসাটা অসম্ভব প্রায়।তাই ট্যাগিং করে ভালো লেখার সংজ্ঞা নির্ধারন একটা অপচেষ্ঠা মাত্র। আরেকটা কথা,রবিবাবুর উপন্যাস যে টানে না,ছোটগল্প টানে,এটা আমি ভেবেছি শুধু আমার বেলাতেই হয়েছে,এখন একজন সঙ্গী দেখে ভালো লাগলো।
সুমন চৌধুরী এর ছবি
ভালো লেখার প্রথম শর্ত হইলো ..তাকে লিখিত হইতে হবে ..
সুমন চৌধুরী এর ছবি
শুভ, লিখিত হইলে বোঝা যায় ইহা একটা লেখা। ভালো-খারাপ নির্ভর করে অবস্থান-বোধ আর বিচার পদ্ধতির উপর। আজ পর্যন্ত আমার কোন কবিতা কোন পত্রিকায় ছাপা হয় নাই কারণ সম্পাদকদের বিচারপদ্ধতিতে সেগুলা কিছু হয় নাই। আমি তাদের সঙ্গে একমত না কারণ আমি অন্য পদ্ধতিতে বিষয়টা দেখি। বিষয় নির্বাচন এবং প্রকাশ ভঙ্গীর বৈচিত্র্য স্বীকার কইরা নিলে সকলের অনুসরণীয় পদ্ধতি বইলা কার্যত কিছু থাকে না। যা বল্লাম সেইটাও অবস্থান নিরপক্ষে না।
কনফুসিয়াস এর ছবি
ভাল লাগলো পইড়া। আমার অবশ্য চিরকালই মনে হয় লেখালেখি জিনিসটা ভালো মন্দ কোন ধরণের ফরম্যাট মানে না কখনোই। সেই পারিপার্শিকতার উপর অনেক বেশি ডিপেন্ড করে। পাঠকের মনের ওপর, শিক্ষার ওপর, হাবিজাবি আরো অনেক কিছুর ওপর। -কনফুসিয়াস

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

হাসান মোরশেদ এর ছবি
রবিবাবুর নৌকাডুবি আর রোমেনা আফাজের কিংবা আকবর হোসেনের উপন্যাসের ভেতর লেখকের নাম ছাড়া তেমন কোন আলাদা গুনাগুন অন্ততঃ আমার কাছে লাগেনি । লেখালেখি ভালো না খারাপ-বিচার বিবেচনা আপেক্ষিক নিঃসন্দেহে । প্রশ্ন উঠবে কার কাছে ভালো? কার কাছে খারাপ? পাঠক তো কোনো একক মৌল নয় । নিকোলাই অস্ত্রভস্কি'র ইস্পাত পড়ে কেউ প্রবল প্রনোদনা পাবেন, কারো কাছে প্রোপাগান্ডা মনে হবে । কাশেম বিন আবুবকরের ' নেকাবের নীচে লাল গোলাপ' দেখেই কেউ নাকসিটকাবেন,গ্রামের কোন কিশোর হয়তো এটা থেকেই লাইন কোট করে তার প্রেমিকা'কে চিঠি লিখবে । কারো কারো লেখার বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে ।একটা মেসেজ দেয়া। কেউ হয়তো মেসেজ দিচ্ছেননা, শুধু ছবিটা আঁকছেন। কেউ সিদ্বান্তে আসছেন,পাঠককে তার সিদ্বান্ত জানিয়ে দিচ্ছেন; কেউ হয়তো পাঠকের ভাবনায় ঝড় তুলে ছেড়ে দিচ্ছেন, সিদ্বান্ত পাঠক নিক । পাঠকের দায়বদ্ধতা কিংবা পাঠকের প্রস্তুত হবার ও একটা ব্যাপার থাকতে পারে। চেখভের একটা কথা ভালো লেগেছিলো--'আমি তো ডাক্তার না যে প্রেস্ক্রিপশন দেবো ।গল্পে শুধু সংকট এঁকে রাখছি,সমাধান পাঠক খুঁজে নিক' শুভ'কে ধন্যবাদ আলোচনার সুত্রপাতের জন্য

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ভাস্কর এর ছবি
শুভ ভাই আলোচনা আগাইলো ভালো...মনে হইলো এইটা আসলেই আলোচনার জন্য ভালো টপিক। আমার এই বিষয়ে একটা পোস্ট ছিলো...হাসান মোরশেদ মনে হয় আমার পোস্টটা খেয়াল করেন নাই। বালখিল্য মনে হইলেও ধন্যবাদ পাইলে ভালো লাগে। নাকি ঐটা খারাপ পোস্ট আছিলো? ----------------------------------------------------- বরফখচিত দেশ ক্যান এতোদূরে থাকো!

স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

হাসান মোরশেদ এর ছবি
বিরহী ভাস্কর, হুশিয়ার । আপনার পোষ্ট আসলেই চোখে পড়ে নাই । এখনই খুঁজে নিচ্ছি ।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
সাহস পাইলাম।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।