পূর্ব ইউরোপ- ১৮ (শেষ পর্ব, গন্তব্য- হেলসিংকি)

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: শুক্র, ০৩/১০/২০১৪ - ১২:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাল্টিক সাগর পাড়ি দিচ্ছি আবার ভাইকিং লাইন জাহাজে চেপে, আপাত গন্তব্য ফিনল্যান্ডের রাজধানী, অনেক বছরের আবাস হেলসিংকি। অদ্ভুত নীলাভ উত্তুরে আভায় পরিচিত সাগরকেও কেমন অজানা লাগে। গতকাল ভোরে রওনা দেয়া হয়েছিল হাঙ্গেরির মিসখল নগরী থেকে। তখন শুধুই ফেরার তাড়া। নতুন করে আর কোথাও না যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরে তখনও ফিনল্যান্ডের দক্ষিণতম প্রান্ত। হাঙ্গেরি থেকে ঘণ্টা দেড়েকের মাঝেই চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙ্গে জন্ম হওয়া স্লোভাক রিপাবলিক এসে গেল যাত্রা পথে।

নিরিবিলি দেশটি খুব ভাল লাগে সবসময়ই, ইউরোপের মাঝে খুব শান্ত একটা দেশ, যেখানে বলা চলে কখনও কিছুই ঘটে না, আর আছে তাতার পর্বত, বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয়া হাজার হাজার স্বর্ণকেশী আর আমার সবচেয়ে প্রিয় বিয়ার জল্যাতি বাজান্ট (দ্য গোল্ডেন ফেজান্ট)। কথা ছিল ইতিহাসের প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার কাউন্টেস এলিজাবেথ বাথোরির প্রাসাদ দুর্গে যাওয়া হবে , কিন্তু পরিকল্পনা বদলে ফেলায় তা চলে গেল দেশটির আরেক মাথায়, আমরা সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথে মাত্র দুই ঘণ্টারও কম সময়ে পাড়ি দিয়ে ফেললাম স্লোভাকিয়া, খুবই অন্যায্য ভাবে! কিন্তু, ঐ যে, ফেরার তাড়া!

সামনে তখন দানব দেশ পোল্যান্ড। যার পূর্ব প্রান্তের সরু রাস্তা সবসময়ই সরগরম থাকে মালবাহী লরির ভিড়ে, ফলে গাড়ী খুব দ্রুত চালানো যায় না প্রায় কখনোই। এমন ভাবেই চলতে লাগল গাড়ী ঢিমেতালে, আর গড়াতে লাগল ঘড়ির কাঁটা। পোল্যান্ডের মত এত বেশি গোরস্থান আর কোন দেশে দেখে নি আমরা কেউই! খানিক পরপরই ক্রুশ লাগানো কবরস্থান, এত বেশি এবং এতই ঘন ঘন যে ভুলেই যেতে হয় শেষ কখন এমন কবর একটানা ১০ মিনিট না দেখে ছিলাম, এমনতর অবস্থা ছিল পোল্যান্ডে প্রথমবার প্রবেশের সময়ও। আসলেই কত কোটি মানুষের হাড় যে মিশে গেছে এই ভূমিতে!

৯২৫ কিলোমিটার গাড়ী চালিয়ে অবশেষে কাল রাত এগারটায় থামা হল রাস্তার উপরেই মিলে যাওয়া এক মোটেলে। যে কোন শহরে ঢুঁকে হোটেল খুঁজে বাহির করতে ও পরের দিন শহরের বাহিরের পথ সন্ধান করতেই প্রায় ঘণ্টাখানক সময় লাগে, তাই এযাত্রা সময় বাচাবার জন্য রাস্তার পাশেই মোটেলে থাকা হল। আজ বেশ সকাল সকাল আবার যাত্রা পথে। তখনও আমরা পোল্যান্ডের মাঝেই! তবে ঘণ্টা খানেক পরেই মিলল বাল্টিকের দেশ লিথুয়ানিয়া আর তাঁর বাংলাদেশের ন্যায় সমতল ভূমি।

লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়ার মাঝে সীমান্ত কেবল নামেই, এককালের প্রচণ্ড ব্যস্ত প্রহরী চৌকিগুলো এখন প্রায় পরিত্যক্ত, মাঝে মাঝে টহল দেয় পুলিশ, কেবল সাইনবোর্ড দেওয়া আছে দেশের নামে। এমনই কি হবে ভবিষ্যতের পৃথিবী? সাতশ কিলোমিটার রাস্তা অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতে পেরোবার সময় দেখা দিয়ে বনের মাঝে হারিয়ে গেল কয়েকটি হরিণ, আর দেখা দিয়ে ঝরে না পড়া পর্যন্ত সাথেই থাকল শরতের রঙ ঝলমলে পাতার দল।

এমন ভাবে পথ চলতে বুকের বাজে নাম না দেওয়া বেদনা রিনরিন করে বাজতে থাকে। কত জনপদে আর পা দেওয়া হবে না কখনোই, দেখা হবে কত প্রান্তরের সাথে, চোখ রাখা হবে না একদা চোখ রাখ সবুজ চোখের গভীরে, এভাবেই বয়ে যাবে জীবন শেষ দিন পর্যন্ত হয়ত। টিকে থাকার সুখ আর বর্তমানকে স্মৃতিতে পরিণত হতে দেবার বেদনা নিয়ে।

রাত আটটা বাজে, আর ২০ মিনিট পরেই হেলসিংকিতে নামতে যাচ্ছি, আমাদের এবারের যাত্রা পথে ১৯তম দেশ। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে সাথে থাকার এবং উৎসাহ জোগানোর জন্য। এখন নতুন ভ্রমণের পালা, আর তার ফাঁকে ফুরসৎ পেলেই বিস্তারিত লেখা আসবে পূর্ব ইউরোপের নানা স্থান নিয়ে। ধন্যবাদ।।

গতকালের গল্প


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

হায় হায়! ঘোরাঘুরি কি তাহলে এবারের মত শেষ হতে চলল? ইয়ে, মানে...

তারেক অণু এর ছবি

নাহ, আবার শুরু হচ্ছে-

এক লহমা এর ছবি

লিঙ্ক ধরে ধরে গিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত ফিরতি-ভ্রমণ করে এলাম হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তারেক অণু এর ছবি

ক্লান্ত নাকি!

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আহা, ঘরে ফেরার আনন্দ! হাসি

নীলকমলিনী এর ছবি

তোমার ভ্রমন ডায়রী পড়তে পড়তে আমিও ঘুরে ফেলেছি. কত অজানারে জানিলাম তোমার মাধ্যমে.
এমনকি আমাজন থেকে কিনে ফেললাম 501 Must - Visit Natural Wonders. এখন সেটা পড়ছি. গাড়ী করে ঘুরতে আমার খুব ভালো লাগে. যখন ইচ্ছে তখন থেমে পরিকল্পনার বাইরে বেড়ানো যায়. আমেরিকা কবে আসছ?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।