ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: মঙ্গল, ৩০/০৬/২০২০ - ১০:৪৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলায় লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ বইগুলোর একটি ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না।‘ লেখক ১৯৮৫ সালে তাঁর বড় মেয়ে মৌলির উদ্দেশ্যে অপূর্ব মূর্ছনায় বাঙময় সুরে লিখেছিলেন নিজের শিশুকাল ও গ্রামের কাব্যগাথা, ৫৬ পাতার সেই কাব্যিক স্মৃতিকথা যেন এক পাহাড়ি ঝিরির মতো বয়ে চলা কবিতা, যার শুরুর দিকে তিনি বলেছেন,

““মৌলি, তোমাকে বলি, তোমার মতোই আমি এক সময় ছিলাম-ছোট, ছিলাম গাঁয়ে, যেখানে মেঘ নামে সবুজ হয়ে নীল হয়ে লম্বা হয়ে বাঁকা হয়ে শাপলা ফোটে; আর রাতে চাঁদ ওঠে শাদা বেলুনের মতো। ওড়ে খেজুর গাছের ডালের অনেক ওপরে। যেখানে এপাশে পুকুর ওপাশে ঘরবাড়ি। একটু দূরে মাঠে ধান সবুজ ঘাস কুমড়োর হলদে ফুল। একটা খাল পুকুর থেকে বের হয়ে পুঁটিমাছের লাফ আর খলশের ঝাঁক নিয়ে চলে গেছে বিলের দিকে। তার উপর একটি কাঠের সাঁকো। নিচে সাঁকোর টলোমলো ছায়া। তার নাম গ্রাম। “

মায়া আর অসহায়তা নিয়ে বুনেছেন শব্দের নকশীকাঁথা-

“তুমি জানো না, কোনোদিন জানবে না,কেমন লাগে একটি নড়োবড়ো বাঁশের পুলের ওপর দাঁড়িয়ে কালো জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তুমি শিশির দেখো নি, কুয়াশা দেখো নি, কচুরি ফুল দেখো নি। তুমি ধানের শীষ দেখেছো টেলিভিশনে, চিল দেখেছো ছবির বইতে। নালি বেয়ে ফোঁটাফোঁটা খেজুরের রস ঝরতে দেখো নি, পুকুরে দেখো নি মাছের লাফের দৃশ্য। তুমি জানো না কেমন লাগে উথাল-পাতাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে, আর কেমন লাগে একটি পাখির পেছনে ছুটে ছুটে সকালকে দুপুরের দিকে গড়িয়ে দিতে। আমি জানি; - না আমি জানতাম।
এখন তো আমি জড়িয়ে আছি শহরে; আমার পায়ের নিচে শক্ত কংক্রিট,চোখে নিঅন আলো, চারদিকে গোঁ গোঁ করা ট্রাকের উল্লাস। কতো দিন আমি, তোমার মতোই চাঁদ দেখিনি। শহরে কি চাঁদ ওঠে? কুয়াশা নামতে দেখি নি দুধের সরের মতো, পদ্মার পারে দেখি নি ধবধবে কাশফুলের সাদা মেঘ। কতো দিন দেখি নি ধানের গুচ্ছ, তারার গুচ্ছের মতো। কিন্তু যখন আমি হাঁটি, বিকেলে বেড়াই, বই পড়ি, ঘুমোতে যাই, গড়াই স্বপ্নের কথা ভেবে ভেবে, তখন আমি একটি ফুলের গন্ধ পাই। সে-ফুল আমার গ্রাম, সে-ফুল আমার গাঁ।আমার ছোটোবেলার গ্রাম। রাড়িখাল।“

এই বইটি বাংলাদশের প্রত্যেক শিশুকিশোরের পড়া থাকার দরকার, যার জন্য সবচেয়ে ভালো হয় হাইস্কুলে র‍্যাপিড রিডার হিসেবে এর অন্তর্ভুক্তি ঘটলে।

কী মায়া, কী দরদ, কী অপূর্ব ভালোবাসায় তিনি এঁকেছেন বাল্যগ্রামের ছবি

“আমাদের গাঁয়ের অধিকাংশ লোক গোলাপ দেখে নি, ঘ্রাণ চায় নি গোলাপের। তারা দেখে নি কোনো চোখ-ঝলসানো নাচ, কোনো দিন দেখার স্বপ্নও দেখে নি। কবিতা পড়ে নি তারা, কোনোদিন পড়ার কথা ভাবে নি। কখনো তাদের বুক থেকে চোখের জলের মতো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নি এ-কথা ভেবে যে এ-জীবনে তাদেরও একটি কবিতা পড়া হলো না। কেউ রাজা হ'তে চায় নি তারা। জরির পোশাক প'রে গোঁফ রেখে ধারালো তলোয়ার হাতে ক'রে ফিরতে চায় নি কেউ তারা। তারা চেয়েছে ভাত। স্বপ্ন দেখেছে মধুর মতো, তারার মতো, চাঁদের মতো, কড়িফুলের মতো ভাতের আর ভাতের আর ভাতের। জেগে উঠে দেখেছে সামনে প'ড়ে আছে শূন্য মাটির বাসন।”

কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি, প্রতিটি পাতায় এমন মধুভরা শব্দাবলী-

“পৌষের কুয়াশায় চুলার পাড়ে কি যে সুখ! আমার চোখ পড়ে চুলার ভেতরের দৃশ্যের ওপর। চারপাশ তখন স্বাদে ভরা-রসের ঘ্রাণ, নারকোলের সুগন্ধ,ঘন দুধের গাঢ় ঘ্রাণ। আর ঐ চুলার ভেতরে দাউ দাউ জ্বলছে সৌন্দর্য। চুলার ভেতরে কি ফুটেছে একলক্ষ গোলাপ? লাল হয়ে উঠেছে কৃষ্ণচূড়ার বাগান? না, চুলার ভেতরে দাউদাউ জ্বলছে সুগন্ধি আমকাঠের চলা; আর তার টুকরোগুলো বিশাল দামি হীরকখণ্ডের মতো দগদগ করছে”

আর শিশুমনের বিষাদময় অনুভূতি-

“সবাই চ'লে গেছে, ঘোলা হয়ে আছে আমাদের পুবপুকুরের টলটলে জল। ভীষণ বিষন্ন দেখায় পুকুরটিকে। ঘন ঘোলা পানি শব্দ করে না, কলকল করে না, নিথরভাবে প'ড়ে থাকে। তাতে ভাসতে থাকে ছিঁড়েফাড়া কচুরিপানা - এদিকে ভাসে ওদিকে ভাসে। মনে হয় কাঁদে। ঘোলা জলে কচুরিপানার ছবি গেঁথে আছে আমার চোখে। যখন আমি এ-শহরে, শহরকে আমার অনেক সময় ঘোলাজলের পুকুর ব'লেই মনে হয়, কাউকে ঘুরতে দেখি একা একা - বিষন্ন, মলিন উস্কোখুস্কো, তখনি মনে পড়ে মানুষ নামার পরে পুবপুকুরের ঘোলাজলে ভাসমান জীর্ণ কচুরিপানাগুলোকে। এমন কচুরিপানা-মানুষ দেখেছিলাম আমি একাত্তুরের সাতাশে মার্চে। পঁচিশে মার্চের আক্রমণ ও ছাব্বিশে মার্চের সান্ধ্য আইনের পরে সাতাশে মার্চে ঢাকা শহরের মানুষেরা বেরিয়ে পড়েছিলো রাস্তায় - হাঁটছিলো, ভয় পাচ্ছিলো, নিরুদ্দেশ পথ চলছিলো, ঠিক যেনো আমাদের পুকুরে মানুষ নামার পরে ঘোলা জলে এলোমেলো ভাসমান ছিন্নভিন্ন কচুরিপানার দল।”

শেষের আগের অধ্যায়ে জানার তাঁর আশঙ্কা -

“গ্রাম মরে যাচ্ছে। গ্রামেরা মরে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে রাড়িখাল। ছিলো একটি মিষ্টি মেয়ের মতো-খুব রূপসী-চাঁদের মতো। কোন মড়কে ধরলো তাকে! তার চোখ বসে যাচ্ছে, কালচে দাগ চোখের চারপাশে। সে গোলগাল মুখটি নেই, কেমন শুকনো। এখনি ঢলে পড়ে যাবে যেনো। গ্রাম মরে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে রাড়িখাল। তার বুকের ভেতর কোন অসুখ বাঁধলো বাসা? খুঁটেখুঁটে কুরেকুরে খাচ্ছে তাকে কোন অসুখ? সে কি একেবারে মরে যাবে? ঢুকবে কবরে? তাকে ঘিরে রাতভর চিৎকার করবে কয়েকটা লালচে শেয়াল?”

যদি আপনি সেই দুর্ভাগা হন যে এই বইটিকে ভালোবাসায় সিক্ত করেন নি, এর জাদূতে সিক্ত হন নি এখনো, তাহলে এখনই সময়। পড়ুন, আশেপাশের মানুষকে পড়ান, আপনার বাড়ন্ত সন্তানকে অবশ্যই এর সাথেই বড় করুন।

হুমায়ুন আজাদ বাংলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিদের একজন, এবং আমার কাছে এটিই কবিতা না হয়েও তাঁর শ্রেষ্ঠতম কবিতা।

ছবি: 
07/07/2011 - 11:39অপরাহ্ন

মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধভরপুর মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তারেক অণু এর ছবি

পরের লাইনে বাকী টুকু

ওডিন এর ছবি

হুমায়ুন আজাদ বাংলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিদের একজন, এবং আমার কাছে এটিই কবিতা না হয়েও তাঁর শ্রেষ্ঠতম কবিতা।

পুরোপুরিভাবে একমত

তারেক অণু এর ছবি

শুভেচ্ছা

সোহেল ইমাম এর ছবি

কেউ রাজা হ'তে চায় নি তারা। জরির পোশাক প'রে গোঁফ রেখে ধারালো তলোয়ার হাতে ক'রে ফিরতে চায় নি কেউ তারা। তারা চেয়েছে ভাত। স্বপ্ন দেখেছে মধুর মতো, তারার মতো, চাঁদের মতো, কড়িফুলের মতো ভাতের আর ভাতের আর ভাতের। জেগে উঠে দেখেছে সামনে প'ড়ে আছে শূন্য মাটির বাসন।”

গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছের আজগুবি ইতিহাসের বিপরীতে হয়তো এই পংক্তিগুলোই ছোটদের মনে ভাবনার বীজ বুনে দেবে কোন সময়।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তারেক অণু এর ছবি

সেইই, আসল ইতিহাস আসুক সামনে

নীলকমলিনী এর ছবি

খুব ভাল লিখেছো। তোমার লেখাটি পড়ে আমার নিজের গ্রাম নিয়ে কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর আমার বাবা বার্ষিক ছুটিতে আমাদের গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যেতেন। আর সে কারণেই কিশোরগন্জের একটি অজপাড়াগাঁ আমাদের সব ভাইবোনের প্রিয় জায়গা। বাড়ী যেতে হলে প্রথমে ট্রেনে পরে নৌকায় করে বাড়ীর ঘাটে নামতাম। পথে যেতে যেতে নদীর ধারে আমাদের সব আত্মীয়দের বাড়ীতে থেমে থেমে যেতাম। আর নদীতে মাছ ধরতে থাকা জেলেদের থেকে মাছ কিনতে কিনতে যাওয়া হতো। বাড়ীতে পৌঁছানোর সাথে সাথেই বউরা সব মাছ কাটতে বসে যেতো। আমরা যতদিন থাকতাম ভুঁইয়া বাড়ীর সবার একসাথে রান্না হতো। এখনো আমি বা আমার ভাই যখন দেশে যাই , পুরো বাড়ীর সবাই মিলে প্রতিবেলা একসাথে খাই।
অনেকদিন পর সচলে মন্তব্য করলাম। পুরোনারা আবার লিখছে, নুতন অনেকেই ভাল লিখছে, আবারো মাঝে মাঝেই সচলে ঢুঁ দেবো।

তারেক অণু এর ছবি

আপনার স্মৃতিচারণগুলো খুব ভালো লাগে আপু, টুকরো টুকরো গল্প একেক কালের স্মৃতি নিয়ে আসে। সেই, সচলের পোষ্ট আপনার কমেন্ট ছাড়া সম্পূর্ণতা পায় না কিন্তু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।