জীবনানন্দ, আমার জীবনের আনন্দ - ১৩

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: বিষ্যুদ, ২২/১০/২০২০ - ১২:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'বাংলা দেশের রং যে নীল তা এই সব যাত্রায় খুব টের পাওয়া যেত- আকাশ নীল, বাতাস নীল,প্যাডলের আঘাতে ফেনিল জলটুকু ছাড়া পুরো মেঘনা কালচে নীল, তীরের পাটখেত নীল, সুপুরি-নারকেল বন নীল, গ্রামের গাছগাছালি নীল, ধূ ধূ জলের দূরের তীরও শুধু একটা হালকা নীল রঙের রেখা। এই নীল জীবনানন্দ আরো অনেক বেশি দেখেছিলেন :

অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে নীল বাংলার বনে
মাঠে ফিরি একা,
-
'সুদূর প্রবাস থেকে ফিরে এসে বাংলার সুপারির বন দেখিয়াছে- অকস্মাৎ গাঢ় নীল'

-

'ভাঙা মঠ নীল হয়ে আছে শ্যাওলায়'

-

'রাতের আকাশ নক্ষত্রের নীল ফুলে ফুটে রবে'

-

'চলে যায়; নীলাম্বরী স'রে যায় কোকিলের পাখনার মতো..
তারপর চ'লে গেল: উড়ে গেল যেন নীল ভোমরার সনে'

-

'বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর,
তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।'

- মণীন্দ্র গুপ্ত

( নীল সবুজ মাতৃভূমি প্রবন্ধের অংশ)

আজ মানুষটার চলে যাবার দিন, হয়তো বিপন্ন মুগ্ধতায়, জীবনের প্রতি চাপা অভিমান বা গাঢ় উল্লাস রেখেই উনি বিদায় নিয়ে ছিলেন।
তাঁর স্মরণে সমগ্র বিশ্ব থেকে তোলা ১৫টি আলোকচিত্র এবং একটা আলোকচিত্র উনাকে নিয়ে লেখা কবি মণীন্দ্র গুপ্তের একটা লেখার কিছু লাইনে থাকলো এই ছেলেমানুষি ভালবাসাময় ছবি ব্লগে।


অদ্ভূত অমল আলো একবার জ্বলে ওঠে চারিদিকে সন্ধ্যা আসিবার আগে ।
য়ুনানী যুগের স্তম্ভ–মাঠের বাদামি ঘাস—নদী— ঢের মজুরের মুখ—মনে হয় - সুমেরীয় ।
ইহাদের ইতিহাস শেষ হ’য়ে গেছে তবে বহু দিন ।
কপিশ মাটির গর্ভ খুঁড়িলেই অখণ্ড প্রেমিক প্যারাফিন
এরা সব। এই ভৌতিক আলো চাই নাকো—আমি চাই ক্ষেম।
ইহাদের অরুন্তুদ উৎস তবু সুমেরীয় প্রেম।

( মুহূর্তটি পেয়েছিলাম নওগাঁর মান্দা উপজেলার চৌবাড়িয়া হাটের পথে)


প্রেম কি জাগায় সূর্যকে আজ ভোরে?
হয়তো জ্বালায়ে গিয়েছে অনেক - অনেক বিগত কাল।
বায়ুর ঘোড়ার খুরে যে পরায় অগ্নির মত নাল
জানে না সে কিছু -তবু তারে জেনে সূর্য আজিকে জ্বলে।

( আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার ইয়েসোমিতি জাতীয় উদ্যানে দাবানলে মধ্যে)


আমাদের মৃত্যু নেই আজ আর,
যদিও অনেক মৃত্যুপরম্পরা ছিলো ইতিহাসে;
বিস্তৃত প্রাসাদে তারা দেয়ালের অব্‌লঙ ছবি;
নানারূপ ক্ষতি ক্ষয়ে নানা দিকে ম’রে গেছি— মনে পড়ে বটে
এই সব ছবি দেখে; বন্দীর মতন তবু নিস্তব্ধ পটে
নেই কোনো দেবদত্ত, উদয়ন, চিত্রসেনী স্থানু।
এক দরজায় ঢুকে বহিষ্কৃত হ’য়ে গেছে অন্য এক দুয়ারের দিকে
অমেয় আলোয় হেঁটে তা’রা সব।

(বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর রাজশাহীতে অবস্থিত বরেন্দ্র জাদুঘরে)


যেই সব বালিহাঁস মরে গেছে পৃথিবীতে
শিকারীর গুলির আঘাতেঃ
বিবর্ণ গম্বুজে এসে জড়ো হয়
আকাশের চেয়ে বড়ো রাতে;
প্রেমের খাবার নিয়ে ডাকিলাম তারে আমি
তবুও সে নামিল না হাতে।

(জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বালিহাঁস উল্লেখা আছে যদিও, কিন্তু এই হাঁস দুটো খয়রা-চকাচকি, হিমালয় পেরিয়ে পদ্মায় এসে কারও লোভের বিষে মারা গিয়েছিল বিষ খেয়ে রাজশাহীর পদ্মায়)


সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে।

তুমি সেই নিস্তব্ধতা চেনো নাকো; অথাবা রক্তের পথে

পৃথিবীর ধূলির ভিতরে

জানো নাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে;

সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে;

গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের- ইন্দ্রধনূ ধরিবার ক্লান্ত আয়োজন

হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন।

( পেরুর উপত্যকা)


ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে;
সময়ের এই স্থির এক দিক,
তবু স্থিরতর নয়;
প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।

(গ্রীষ্মের হেলসিংকি)


তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাঙ্খার ঘর!..
যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর
যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;

( ফিনল্যান্ডের বনে)


হে নাবিক, হে নাবিক, কোথায় তোমার যাত্রা সূর্যকে লক্ষ্য ক’রে শুধু?
বেবিলন, নিনেভে, মিশর, চীন, উরের আরশি থেকে ফেঁসে

অন্য এক সমুদ্রের দিকে তুমি চ’লে যাও— দুপুর বেলায়;
বৈশালীর থেকে বায়ু— গেৎসিমানি— আলেকজান্দ্রিয়ার
মোমের আলোকগুলো রয়েছে পিছনে প’ড়ে অমায়িক সংকেতের মতো;
তারাও সৈকত। তবু তৃপ্তি নেই। আরো দূর চক্রবাল হৃদয়ে পাবার

প্রয়োজন রয়ে গেছে— যতদিন স্ফটিক-পাখনা মেলে বোলতার ভিড়
উড়ে যায়ু রাঙা রৌদ্রে; এরোপ্লেনের চেয়ে প্রমিতিতে নিটোল সারস
নীলিমাকে খুলে ফেলে যতদিন; ভুলের বুনুনি থেকে আপনাকে মানবহৃদয়;
উজ্জ্বল সময়-ঘড়ি— নাবিক— অনন্ত নীর অগ্রসর হয়

( চীন সাগরে, দালিয়ান শহরের কাছে)


হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু- সরু- কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের
ঝাউয়ের-আমেরঃ
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে !

( নরওয়ের উত্তরের বনে)


সকলেই পথ চলে ,- সকলেই ক্লান্ত তবু হয় ;-
তবুও দু’জন কই ব’সে থাকে হাতে হাত ধ’রে !
তবুও দু’জন কই কে কাহারে রাখে কোলে ক’রে !

( কম্বোডিয়ার সিয়েম রিপে)


- এইবার কুয়াশায় যাত্রা সকলের।
সমুদ্রের রোল থেকে একটি আবেগ নিয়ে কেউ
নদীর তরঙ্গে- ক্রমে - তুষারের স্তূপে তার ঢেউ
একবার টের পাবে- দ্বিতীয়বারের
সময় আসার আগে নিজেকেই পাবে না সে টের-

(বাল্টিক সাগরে)


একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এ ক পরিচিত মুমুর্ষুর বিছানার কিনারে।

( মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে)


সমুদ্রের যৌবন-গর্জন
তোমারে ক্ষ্যাপায়ে দেছে, ওহে বীর শের!
টাইফুন্-ডঙ্কার হর্ষে ভুলে গেছ অতীত-আখের
হে জলধি পাখি!

( বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে)


যেদিন আমি পৃথিবীর থেকে চলে যাব- হে শঙ্খমালা-
অপরিসীম নক্ষত্র তুমি বিছিয়ে রেখো আকাশে,
আকাশের অন্ধকার সমতলতা ঘিরে যুগান্তের লুপ্ত মানবীদের মতো
কয়েকটি নির্জন নক্ষত্র-
এর চেয়ে গভীর জিনিস কী আর থাকতে পারে
কী আর থাকতে পারে শঙ্খমালা-

( এস্তোনিয়ার বাদায়)


পৃথিবীর অই অধীরতা
থেমে যায়, আমাদের হৃদয়ের ব্যথা
দূরের ধুলোর পথ ছেড়ে
স্বপ্নেরে — ধ্যানেরে
কাছে ডেকে লয়
উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়
মানুষেরও আয়ূ শেষ হয়
পৃথিবীর পুরানো সে পথ
মুছে ফেলে রেখা তার —
কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ
চিরদিন রয়!
সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব —
নক্ষত্রেরও আয়ু শেষ হয়

( ভারতের গোয়ালিয়রের দুর্গে)

এই সিরিজিটা নিয়মিত করার চেষ্টা করব এখন থেকে। আগের এক ডজনের লিংক এখানে

জীবনানন্দ দাশ জুড়ে থাকুন আমাদের মনন সমগ্র জীবন জুড়ে, পৃথিবীর পথে পথে।


মন্তব্য

তানিয়া শুকরানা  এর ছবি

সুন্দর উপস্থাপনা। কয়েকটি ছবি বেশ ভাল লাগলো। বিষ খেয়ে মরে পড়ে থাকা একজোড়া হাঁস বড্ড করুণ!

তারেক অণু এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। সেই দিনটা আমাদের জন্য খুব করুণ ছিল।

করবী মালাকার এর ছবি

সুন্দর পরিবেশনা!

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ

রানা  এর ছবি

আজকে চারদিকে খুব গুরু বন্দনা হচ্ছে, অনেক বন্দনায় ভীড়ে একটা অন্যরকম কিছু উপহার দেবার জন্যে অনেক ভালোবাসা

তারেক অণু এর ছবি

শুভেচ্ছা, চেষ্টা করব নিয়মিত সিরিজটা চালু রাখতে

মন মাঝি এর ছবি

চমৎকার!
এই আইডিয়া নিয়ে (ছবির সাথে কবিতা) আমিও একটা পোস্ট দিয়েছিলাম এক সময়। তবে আমার ছবিগুলি সাদামাটা ছিল, আপনার এগুলি দুর্দান্ত হয়েছে!!! চলুক চলুক চলুক

****************************************

তারেক অণু এর ছবি

আবারও হয়ে যাক তবে! মনের মায়া থাকলেই হয়, আদতে ছবিতে এমন কিছুই যায় আসে না। শুরু করে দিন ফের

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।