চলচ্চিত্রে পাখি দেখার প্রতিযোগিতা

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: রবি, ২৫/১০/২০২০ - ৩:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কাহিনীর শুরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, এক বছরে কত বেশী প্রজাতির পাখি একজন দেখতে পারবেন এটা মূলত শুরু হয়ে ছিল রজার টোরে পিটারসনের বিখ্যাত ফিল্ডগাইড প্রকাশিত হবার পরপর, কারণ তার আগে অধিকাংশ মানুষই পাখি দেখার জন্য খুব বেশি ভ্রমণ করতেন না। ইতিহাস বলে ১৯৩৯ সালে গাই এমারসন নামে এক ব্যক্তি ৪৯৭ প্রজাতির পাখি এক বছরে দেখে এই রেকর্ড স্থাপন করেন, তারপর থেকে প্রতি বছরই চলছে এই রেকর্ডকে নতুন করে ভাঙার চেষ্টা, আর এক বছরে এই যত বেশী সম্ভব পাখির প্রজাতি দেখার চেষ্টাকেই বলে ‘ দ্য বিগ ইয়ার’ যা অনেক পাখি দর্শকের কাছেই স্বপ্ন।

আর এই বিষয়টি নিয়েই এক মজার সিনেমা নির্মিত হয় হলিউডে ২০১১ সালে, যেখানে পাখিদর্শক হিসেবে অভিনয় করেছিলেন জনপ্রিয় তিন অভিনেতা ওয়েইন উইলসন, জ্যাক ব্ল্যাক আর স্টিভ মার্টিন।

ঘটনার শুরুতে দেখা যায় কেনি বস্টিক একজন বিশ্বরেকর্ডধারী পাখিদর্শক, আগের বছর বিগ ইয়ার করে ৭৩২ প্রজাতির পাখি দেখে অতি বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু বস্টিক বেশ প্রতিযোগী মনোভাব সম্পন্ন একজন মানুষ, তার কাছে যে ভাবেই হোক প্রথম হওয়াটাই মুখ্য বিষয়, এবং সেই সাথে অন্য কাউকে তার রেকর্ডের ধারে কাছেও আসতে না দেয়ার জন্য নীতিহীন কাজ করতেও তার কোন আপত্তি নেই যা আবার একজন নিসর্গপ্রেমীর কাছে কাম্য নয়।

( এখানে বলতে হয় যে বিগ ইয়ার করলে আসলে তাদের পাখি দর্শক বা বার্ড ওয়াচার এখন আর বলা হয় না, তাদের বার্ড টুইচার বলে ( Bird Twitcher) বা যারা কেবলই পাখি এক নজর দেখে বা ছবি তুলেই চলে আসেন, তাদেরও বার্ড টুইচার বলা হয়, এর বাংলা আমরা এখনও ব্যবহার শুরু করি নাই, কিন্তু শব্দ বানাতে হবে)

দৃশ্যপটে হাজির হন স্টু নামের একজন কোটিপতি, এক নামকরা কোম্পানির সিইও, যিনি অবসরে যাচ্ছেনই মূলত একটা বিগ ইয়ার করার জন্য, এবং যেটা ছিল তার সারা জীবনের স্বপ্ন।

আর বাল্টিমোরের ৩৬ বছরের এক কম্পিউটার প্রোগ্রামার ব্রাড, যে কিনা ডাক শুনেই নির্ভুল ভাবে প্রায় সমস্ত পাখি চিনতে পারে। যদিও অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল না হওয়ায় বাবা-মার কাছ থেকে তাকে হাত পাততে হয় এই বিগ ইয়ারে অংশ নেবার জন্য, যাতে তার বাবার প্রবল আপত্তি ছিল।

ব্যস, শুরু হয় বিশাল দেশ যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে ৩ মানুষের পাখি দেখার প্রতিযোগিতা! এই সুযোগে আমরা দর্শকেরাও কিছুটা উপভোগ করি আমেরিকার ভূপ্রকৃতির বিশাল বৈচিত্রতা। পাখি দেখার জন্য আলাস্কার একেবারে শেষ মাথায় হাজির হন তারা, যার পর থেকেই সাইবেরিয়া শুরু, সেখানের বিশেষ পাখিগুলো দেখার জন্য, কখনো বা রকি পর্বতমালায়, কখনো লুইজিয়ানার বাদায়, কখনো মণ্টানার বনে, ইউটাহর উপত্যকায় হাজির হয় সবাই। কখনো স্নো-কক দেখার জন্য হেলিকপ্টার ভাড়া করতে হয় তাদের, কখনো নৌকায় বা ছোট্ট জাহাজে চাপতে হয় সামুদ্রিক পাখি দেখবার জন্য, আর অধিকাংশ সময়ই গাড়ীতে।

আর সেই সাথে দেখা হয় অপূর্ব কিছু পাখি সেটা তুষার প্যাঁচা থেকে শুরু করে হামিংবার্ড হয়ে ঝড়ের কবলে পড়া হাজার হাজার পাখিতে যেয়ে ঠেকে শেষ অবধি।

এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে যে আসলেই সারা আমেরিকাতে পাখি দেখা কীরকম জনপ্রিয় একটা শখে পরিণত হয়েছে। বিগ ইয়ার হয়তো করছে অল্প কয়েকজন মানুষে, যেহেতু এটা পুরো এক বছর সময় এবং বিপুল খরচের ব্যাপার কিন্তু সেই সাথে কোথাও বিরল পাখি দেখা গেলেই সেখানে হাজার নিসর্গপ্রেমী মানুষের ভিড়, এমনকি সাধারণ পরিচিত পাখি দেখতেও মানুষের আগ্রহ লক্ষ্যণীয়।

সেই সাথে কয়েকটা জিনিস চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যেমন ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডোর মত প্রাকৃতিক ঘটনায় অনেক প্রজাতির পাখি দেখা সম্ভব নয় এমন জায়গায় দেখা দিতে পারে, কারণ ঝড়ের মুখে পরে তাদের আর কোন উপায় থাকে না বাতাসের সাথে চলে আসা ছাড়া। আর সামুদ্রিক বা জলচর পাখিরা তখন সোজা কাছের ডাঙ্গায় চলে আসে। আর সেখানেই ভিড় করে এত বিরূপ আবহাওয়ার মাঝেও পাখিদর্শকেরা। যে ঘটনাটিকে তারা বলেন ফল আউট ‘Fall out’।

আবার দেখানো হয়েছে পাখি দেখার নেশা কিভাবে মানুষকে কাছে টেনে আনে বা দূরে ঠেলে দেয়, যেমন ব্রাডের প্রাক্তন স্ত্রী তাকে ছেড়েই গিয়েছিল পাখিদের জন্য সময় দেবার জন্য, আবার সিনেমার মাঝেই এলি নামের এক পাখিপ্রেমী মহিলার সাথে সম্পর্ক হয়ে ব্রাডের, যা সম্ভবত টিকে যাবে আজীবন।

এদিকে কেনি বস্টিক টানা দুই বছর বিগ ইয়ার করতে যেয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে স্ত্রীকে দেবার মত কোন সময়ই তার হাতে থাকে না, এবং নানা অজুহাত করে, মিথ্যা বলে সে সন্তানকাঙ্ক্ষী স্ত্রীর হাসপাতালে থাকার সময়েও এড়িয়ে যায় প্রতিযোগিতার মোহে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দেবার মতো অনৈতিক কাজ করে বস্টিক প্রতিযোগিতায় ফের প্রথম হবার জন্য।

এভাবেই সিনেমাটি এগিয়ে চলে নানা চমকপ্রদ ঘটনার মধ্য দিয়ে। এবং শেষ হয় সেই বছর বিগ ইয়ারের ফলাফল দিয়ে, যা জানতে হলে ঠিক ১০০ মিনিটের চলচ্চিত্রটি আপনি দেখে ফেললেই পারেন, পাখিপ্রেমী হলে মজাই পাবেন, না হলেও বিনোদন আছে অপার। ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন ডেভিড ফ্রাংকেল।

উল্লেখ্য বাস্তবে গত বছরে, ২০১৯ সালে যে বিগ ইয়ারে বিজয়ী হয়েছিল সে ৮৪০ প্রজাতির পাখি দেখেছিল।


মন্তব্য

সুজয় এর ছবি

জ্যাক ব্ল্যাকের টিপিকাল মুভি ভেবে দেখতে বসেছিলাম। কিন্তু যারপরনাই অবাক হলাম দেখে, “দি সিক্রেট লাইফ অব ওয়াল্টার মিটি” এর পরে এটা আরেকটা পিস যেখানে সিনেমার সিনেই প্রকৃতির প্রতি প্রেম হয়ে যায়...

তারেক অণু এর ছবি

পাখিদের নিয়ে অবশ্য বেশ ভালো কিছু সিনেমা আছে, যা নিসর্গপ্রেম জাগাবার জন্য চমৎকার। এর আগেও সচলে একাধিক সিনেমার রিভিউ লেখা আছে, এই ধরনের চলচ্চিত্রের।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।