সিকিম - ঝর্ণা যেথায় বসত করে - ২

দময়ন্তী এর ছবি
লিখেছেন দময়ন্তী (তারিখ: শনি, ২৩/০৪/২০১১ - ১:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব

গ্যাংটক - ১
========

হোটেল থেকে জানা গেল গ্যাংটক সাইটসিয়িঙের ২-৩ রকমের প্যাকেজ হয়। সেভেন পয়েন্ট হলে ১০০০/- টাকা, টেন পয়েন্ট হলে ১২০০/-টাকা ১৫ পয়েন্ট হলে ১৫০০/-টাকা ইত্যাদি। এটা পুরো গাড়ী বুক করার খরচ। কেউ শেয়ারে যেতে চাইলে মাথাপিছু দু তিনশো টাকার মত লাগে।

১৯৪০ সাল অবধি গ্যাংটক ছিল ছোট্ট একটা পাহাড়ী জনপদ, তিব্বতের লাসা থেকে ভারতের পূর্বপ্রান্তে আসাযাওয়া করা ব্যবসায়ীদের এক রাত্রি আস্তানা নেওয়ার জায়গা। ১৮৪০ সালে এনচে গুম্ফা তৈরী হওয়ার পর বৌদ্ধধর্ম চর্চার কেন্দ্র হিসাবে গ্যংটকের গুরুত্ব বাড়ে। ব্রিটিশদের হাতে তিব্বতের পরাজয়ের পর তিব্বত ও ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে একটি বৃহৎ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে গ্যাংটক গড়ে উঠতে থাকে। সিকিমে ব্রিটিশের অধীনস্থ নামগিয়াল বংশ শাসন চলছে তখন। ১৮৯৪ সালে সিকিমের সম্রাট রাজধানী তামলং থেকে সরিয়ে গ্যাঙ্টকে নিয়ে এলে গ্যাংটক ক্রমে ক্রমে বড় শহর রূপে গড়ে ওঠে।

গ্যাংটকের আবহাওয়া ভারী চমৎকার। সারাবছরই না-ঠান্ডা, না-গরম একটা ব্যপার। এখানে বলে রাখি, গ্যাংটকসহ গোটা সিকিমেই কোথাও সিলিং ফ্যান বা টেবল ফ্যান দেখি নি। এসির তো প্রশ্নই নেই। ছাদের সিলিঙে ফ্যান লাগানোর কোন ব্যবস্থাই নেই। এর থেকেই খানিকটা অনুমান করা যায় আবহাওয়া সম্পর্কে। ঠান্ডাও তেমন মারাত্মক কিছু পড়ে না। গ্যাংটক ও আশেপাশে এই অক্টোবরে দিনেরবেলায় তো হাফহাতা শার্ট/কুর্তাই ঠিক আছে, সন্ধ্যের পরও ফুলহাতা হলেই চলে। গরম জামাটামার দরকার নেই।

যাই হোক, সাইট সিয়িঙে বেরিয়ে প্রথম গেলাম রাঙ্কা মনাস্টারি। বেশ নতুন গুম্ফা, বেশীদিন তৈরী হয় নি। ঢোকার মুখেই লম্বা সারিতে জপযন্ত্র। একধার থেকে একটা একটা করে ক্লকওয়াইজ ঘুরিয়ে অন্যধার অবধি পৌঁছে গেলে বস্তা বস্তা পূণ্য অর্জন হয়। সব ধর্মেই কিছু শর্টকাট পূণ্যার্জনের ব্যবস্থা থাকে। সে অমুক তমুক নদীর জলে ডুব দিয়েই হোক, কি ভগবানের উদ্দেশ্যে কোন পশুবলি দিয়েই হোক কি জপযন্ত্র ঘুরিয়েই হোক। মস্ত প্রাঙ্গনের এক কোণায় কিছু বাচ্চা বাচ্চা লামা বসে পড়াশোনা করছিল। বছর ১০-১২ র বেশী বয়স নয় কারো। ক্রমশঃ পর্যটকদের ভীড় বাড়তে থাকায় তারা পুঁথিটুথি গুটিয়ে উঠে যায়। বয়সোচিত চাপল্যে কয়েকজন দুটো করে সিঁড়ি টপকে টপকে ওঠে। ঘোর অধার্মিক বলেই বোধহয় আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এইটুকু টুকু ছেলে কোথায় হেসেখেলে বাবা মায়ের কাছে বড় হবে, তা না বাবা মা ওদের দিয়ে দিয়েছে গুম্ফায়, সন্ন্যাস নেওয়ার জন্য।

From Sikim

জপযন্ত্র - রাঙ্কা মনাস্টারি

From Sikim

দেওয়ালচিত্র - রাঙ্কা মনাস্টারি

From Sikim

ছাদের সিলিং - রাঙ্কা মনাস্টারি

পরবর্ত্তী গন্তব্য বন-ঝাকরি ফলস ও এনার্জীপার্ক। ঝাকরি হল ওঝা বা শমেন ( Shamanism -- Shaman ), যারা দুষ্ট আত্মা তাড়িয়ে রোগবালাই দূর করে। বনঝাকরি আর বনঝাকরিণী এই জলপ্রপাতের আশেপাশেই ডেরা বেঁধে থাকত বলে কথিত। বনঝাকরি আর বনঝারিণীর মূর্তিও আছে। বনঝাকরি বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোট্টা পুরুষ, বনঝাকরিণী লম্বা, ঘোরকালো, হাতে খড়্গওয়ালা, করালবদনা অতি ভীষণ দেখতে নারী। দুইপাশে দুই বড় শ্বদন্ত বেরিয়ে আছে, হিংস্র মুখভঙ্গী। শুনলাম বনঝাকরি নাকি ছোট ছোট পবিত্রচিত্ত বাচ্চাদের ধরে আনত শমেনিজম-এ দীক্ষা দিয়ে 'ঝাকরি' করার জন্য। যেসব বাচ্চা সত্যিই 'পবিত্রচিত্ত' এবং যারা বনঝাকরিণীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারত (যে বাচ্চাগুলো চালাকচতুর আর কি!) তাদের ঝাকরি তার বিদ্যা উজাড় করে শিখিয়ে দিকে দিকে পাঠিয়ে দিত মানবকল্যাণের জন্য।

From Sikim

বন্ ঝাকরি ফলস

From Sikim

বন্ ঝাকরি ফলস

এহেন পবিত্র জায়গায় সিকিম সরকার কিছুদিন আগে একটি সৌরশক্তি গবেষণা ও উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন করেছেন। সঙ্গে একটি পুঁচকে মিউজিয়ামও আছে। আর এইসব থাকলে তার সঙ্গে দু চারখানা স্যুভেনিয়র'এর দোকান টোকানও থাকবে বৈকী। কাজেই দু চারখানা খাবার দোকান ও একটা মোটামুটি গোছের রেস্ট্যুর‌্যান্টও আছে।

এইসব দেখেটেখে গেলাম রোপওয়ে দেখতে। লোয়ার গ্যাংটক থেকে এক্কেবারে আপার গ্যাংটকের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত যাওয়ার রোপওয়ে আছে। কেবলকারে করে ওঠার জন্য এমন লম্বা লাইন পড়েছে যে দেখেই ভয়ে পালিয়ে এলাম। দেখতে খুব কিছু আহামরি লাগলও না, অল্প একটুখানিই চড়া, তাও বন্ধ কেবলকারের মধ্যে। এখান থেকে গেলাম একটা পুষ্প প্রদর্শনী দেখতে। সিকিমের প্রাক্তন রাজার বাগানের একপ্রান্তে একটা ছোট্টমত গ্রিনহাউস বানিয়ে তারমধ্যে কিছু গাছপালা, ফুল ইত্যাদি। না দেখলেও তেমন কোন ক্ষতি নেই।

দো-দ্রুল-চোর্তেন স্তুপ- বেশ বড়সড় স্তুপ। এখানেও সারিবেঁধে ১০৮ টা জপযন্ত্র রয়েছে। এই স্তুপের শিখরটা সোনায় মোড়া। এখানে গুরু রিম্পোচে ( পদ্মসম্ভব) এর দুটো মস্ত মস্ত মূর্তি আছে।

From Sikim

এর কাছেই নামগিয়াল ইন্সটিট্যুট অফ টিবেটোলজি, একটা অসাধারণ জায়গা। এই ইন্সটিট্যুট ও মিউজিয়াম সোমবার থেকে শনিবার সকাল দশটা থেকে বিকেল ৪ ট পর্যন্ত খোলা। দেখতে গেলে বিকেল তিনটের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া ভাল। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। মিউজিয়ামে দুর্দান্ত ভাল থাংকা আর পুঁথি বা পুঁথির অংশবিশেষ রয়েছে। সংস্কৃত, নেপালী, চাইনিজ, তিব্বতী, লেপচা এমনকি বাংলা স্ক্রিপ্টও দেখলাম। যদিও অক্ষরগুলো দেখে মোটেও বর্তমান বাংলা হরফের সাথে কোন মিল পেলাম না। একাদশ ও দ্বাদশ শতকের দুটো পুঁথির অংশ, প্রজ্ঞা-পারমিতা সূত্র লেখা রয়েছে। বৌদ্ধধর্ম ও তন্ত্রসাধনার বিভিন্ন উপচারও রয়েছে। তার মধে একজোড়া পাত্র, মানুষের মাথার খুলি দুইভাগ করা, মৃত আত্মার উদ্দেশে জল দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হত। এছাড়া রয়েছে বোধিসত্ত্বের বিভিন্ন মূর্তি। এগারোমাথা আর হাজারহাতওয়ালা অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি আছে। আছেন তারাসুন্দরী ও আরো দুজন দেবী (নাম ভুলে গেছি)। অবলোকিতেশ্বরের মূর্তিটায় একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলাম। মাথাগুলো রাবণের মত পাশাপাশি অবস্থিত নয়, একটার উপরে আরেকটা করে চুড়োর মত করা। এইভাবে অন্তত পাশফিরে ঘুমানো যাবে, রাবণের ঐ পাশাপাশি মাথা সাজানোয় পাশ ফিরে ঘুমানো সম্ভব নয়।

এই ইন্সটিট্যুটের সাথে একটা হ্যান্ডিক্র্যাফটস আইটেমের দোকানও আছে। কিন্তু আমি যখন পৌঁছেছি ততক্ষণে ওটা বন্ধ হয়ে গেছে। অল্পস্বল্প দুঃখ রয়ে গেল সেজন্যে।

গনেশ টক আর হনুমান টক পাহাড়ের ওপর গনেশ আর হনুমানের মন্দির। এরমধ্যে হনুমান টক মস্ত উঁচু। বহুদিনের অনভ্যাসের পর সারাদিনধরে পাহাড়ের বিভিন্ন উচ্চতায় ওঠানামা করে বেজায় ক্লান্ত ছিলাম, হনুমান টকে উঠি নি কষ্ট করে। গনেশ টকে উঠেছিলাম, মন্দির কেমন জানি না, তবে ওপর থেকে ভিউটা চমৎকার।

দিনের সর্বশেষ গন্তব্য তাশি ভিউ পয়েন্ট। বেশ অনেকখানি সিঁড়ি বেয়ে উঠে একটা সরু ফালিমত জায়গায় একটা দূরবীণ রাখা। ওপর থেকে গ্যাংটক শহরটার ভারী চমৎকার ভিউ পাওয়া যায়। আর অন্যান্য কিছু অনামা শৃঙ্গের সাথে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘাও। এই গোটা ট্যুরে মেঘ আর কুয়াশা আমার সঙ্গ ছাড়ে নি, এখানেও যখন গেলাম, টিকিট কাউন্টারের প্রৌঢ়া হেসে বললেন 'উপরে উঠে লাভ নেই, তেমন কিছু দেখতে পাবেন না, আপনি চাইলে টিকিট দেব, তবে আমি বলি বরং কাল সকালে আসুন।' পরে আবার কবে যাব না যাব ভেবে জোর করে টিকিট নিলাম, উঠলাম। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা হায়, কিছু মেঘের পুঞ্জ হয়েই রইল।

এরপরে সোজা এসে নামলাম এম জি মার্গে, গ্যাংটকের মল এলাকা। দুপাশে অজস্র দোকান আর অজস্র ট্যুরিস্ট দেখতে দেখতে পেলিং যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য খোঁজ শুরু করলাম। একটা কি যেন ট্র্যাভেল এজেন্সি, একটি লেপচা ছেলে বসেছিল, অসম্ভব উদাসীন গলায় বলল 'আভি বুকিং করনে সে বহোত জাদা লাগেগা। আপ দশেরাকে বাদ আও সস্তে মেঁ হো যায়েগা।' সে এমনকি আমার থেকে অ্যাডভান্স বুকিং নিতেও অস্বীকার করে। তাশি ভিউ পয়েন্টের সেই প্রৌঢ়া, এই ছেলেটি --- এ শুধু হিমালয়েই সম্ভব, আগেও দেখেছি। সমতলের কোন ট্যুরিস্ট স্পটে কক্ষণো এভাবে বলে দিত না, ভ্যাবলা ট্যুরিস্টের থেকে একটু বেশী রেট নেওয়াটাই দস্তুর তো। মাঝে মধ্যে হিমালয়ে গেলে মানুষের প্রতি ক্রমক্ষীয়মাণ বিশ্বাস আবার ফিরে ফিরে আসে।

আর একটু খোঁজাখুঁজির পর সিকিম ট্যুরিজমএর একটা অফিস দেখলাম। সেখানে ঢুকে আলাপ হল জনের সাথে। জন শাঙ্কের, অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার অপারেশানস - STDC । ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে বুকিঙের ব্যবস্থা করলেন। রাবাংলায় কোনও বুকিং পাওয়া গেল না। পেলিঙে হোটেলের বাজেট রুম পাওয়া গেল, বাকী সব বুকড। উনিই পরামর্শ দিলেন টিমি চা বাগানের ভেতরে পিডবিউডির বাংলোয় থাকতে। জায়গাটা অনেক নীচে বলে আমি একটু খুঁত্খুঁত করছিলাম, কিন্তু জন বারবারই বললেন যে একেবারে বাগানের ভেতরে থাকার অভিজ্ঞতা নাকি একেবারে ইউনিক।

ভদ্রলোক আমার থেকে দুই রাত পেলিঙের হোটেলের আর একরাত টিমি বাংলোর ভাড়া নিয়ে ওখানে ফোন করে কনফার্ম করে দিলেন। আমাকে কোন রিসিট দিলেন না, বরং নিজের কার্ড দিলেন একটা। আমার কুচুটে মন ঠিক নিশ্চিন্ত্ হতে না পেরে ওঁকে রিসিটের কথা, কনফার্মেশানের কথা জিজ্ঞাসা করল। ভারী অবাক হলেন ভদ্রলোক। বললেন রিসিট তো দেবে ঐ হোটেল বা বাংলোর লোকজন, আর উনি তো ফোনে বলেই দিয়েছেন যে টাকা উনি পেয়ে গেছেন, আবার সমস্যা কী? তা বটে! আমিও মাথাটাথা চুলকে বেরিয়ে এলাম।

পেলিঙে হোটেল 'হাং রী লজ' আপার পেলিং, দিনপ্রতি ৮০০/-টাকা। টিমি টি গার্ডেনের বাংলো দিনপ্রতি ১০০০/- টাকা। লোকাল সাইটসিয়িঙের ব্যবস্থা হোটেল/বাংলো থেকে করে দেবে, আমাকে সেখানেই টাকা দিতে হবে।

পশ্চিম সিকিমের ব্যবস্থা মোটামুটি হল। ব্যাস নিশ্চিন্ত! এইবারে একটু দোকানবাজার দেখা যাক। কাল আবার ছাঙ্গু নাথুলা যাওয়া।


মন্তব্য

কৌস্তুভ এর ছবি

ছবি দিছেন, এইবার মোগাম্বো খুশ হুয়া।

দময়ন্তী এর ছবি

হে হে হাসি

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

সবজান্তা এর ছবি

আমার পরিচিত অনেকেই ভাবে পাহাড়ের নামে বিশেষত হিমালয়ের এই দিকগুলি সম্পর্কে আমি রীতিমতো আদিখ্যেতামি করি। এই অভিযোগের ব্যাপারে আমি আসলেই কখনো কিছু বলি না। হিমালয় রেঞ্জের খুব অল্প জায়গাতেই গিয়েছি, যতোগুলিতে গিয়েছি সেগুলিও সবটুকু ঘুরেছি এমন না। কিন্তু এই পাহাড়গুলি গেলে এমন কী ছবি দেখলে, কিংবা আরো কমে বললে শুধুমাত্র কোন লেখা পড়লেই দারুণ রকমের রোমাঞ্চ হয়। যে যাই ভাবুক, এটা একদমই সৎ, নিখাঁদ সত্যি কৈফিয়ৎ আমার।

আপনার এই লেখাটা পড়তে পড়তেও আমার সেরকমই আনন্দ হচ্ছে। আমি সিকিম গিয়েছিলাম একটু চোরাই বুদ্ধিতে, এর বর্ণনা অবশ্য অনেক আগে সচলের একটা লেখাতেও দিয়েছিলাম। যাই হোক আমার হাতে সময় বেশ কম ছিলো, তার উপর একদমই হোমওয়ার্ক করে যেতে পারিনি- তাই গ্যাংটক শহরে এমজি মার্গ ছাড়া আর কিছুই দেখা হয়নি। আপনার লেখাতে গুম্ফার বর্ণনা পড়ে মনটা একটু খারাপ হলো। হিমালয় সংলগ্ন যেকোন এলাকায় গেলে আমি সাধারণত সেখানকার গুম্ফাগুলি দেখতে চেষ্টা করি। দেখা যাচ্ছে, একটা আমি মিস করেছি মন খারাপ

মস্ত প্রাঙ্গনের এক কোণায় কিছু বাচ্চা বাচ্চা লামা বসে পড়াশোনা করছিল। বছর ১০-১২ র বেশী বয়স নয় কারো। ক্রমশঃ পর্যটকদের ভীড় বাড়তে থাকায় তারা পুঁথিটুথি গুটিয়ে উঠে যায়।

আমি এমন কিছু বাচ্চা দেখেছিলাম দার্জিলিঙে, ঘুমের গুম্ফাতে। তাঁরা অবশ্য আলাদা একটা রুমে বসে অদ্ভুত একটা ভাষায় সুর করে কিছু একটা পড়ছিলো। আমার মনে হচ্ছিলো যেন একবারে স্বপ্নের দুনিয়াতে চলে আসলাম। একটু অন্ধকার মতো একটা ঘর, মেঝেটা একদম জমানো ঠাণ্ডা, দেয়ালে ঢাউস সাইজের ছবি- বাস্তব মনে হওয়ার কোন কারণ ছিলো না দেঁতো হাসি

এর কাছেই নামগিয়াল ইন্সটিট্যুট অফ টিবেটোলজি, একটা অসাধারণ জায়গা। এই ইন্সটিট্যুট ও মিউজিয়াম সোমবার থেকে শনিবার সকাল দশটা থেকে বিকেল ৪ ট পর্যন্ত খোলা। দেখতে গেলে বিকেল তিনটের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া ভাল। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। মিউজিয়ামে দুর্দান্ত ভাল থাংকা আর পুঁথি বা পুঁথির অংশবিশেষ রয়েছে। সংস্কৃত, নেপালী, চাইনিজ, তিব্বতী, লেপচা এমনকি বাংলা স্ক্রিপ্টও দেখলাম। যদিও অক্ষরগুলো দেখে মোটেও বর্তমান বাংলা হরফের সাথে কোন মিল পেলাম না। একাদশ ও দ্বাদশ শতকের দুটো পুঁথির অংশ, প্রজ্ঞা-পারমিতা সূত্র লেখা রয়েছে। বৌদ্ধধর্ম ও তন্ত্রসাধনার বিভিন্ন উপচারও রয়েছে। তার মধে একজোড়া পাত্র, মানুষের মাথার খুলি দুইভাগ করা, মৃত আত্মার উদ্দেশে জল দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হত।

এই অংশটা পড়ে আমি কাঁনতে কাঁনতে... এইটা মিস্কর্সি ওঁয়া ওঁয়া

মাথাগুলো রাবণের মত পাশাপাশি অবস্থিত নয়, একটার উপরে আরেকটা করে চুড়োর মত করা। এইভাবে অন্তত পাশফিরে ঘুমানো যাবে, রাবণের ঐ পাশাপাশি মাথা সাজানোয় পাশ ফিরে ঘুমানো সম্ভব নয়।

হা হা হা হা গড়াগড়ি দিয়া হাসি

তাশি ভিউ পয়েন্টের সেই প্রৌঢ়া, এই ছেলেটি --- এ শুধু হিমালয়েই সম্ভব, আগেও দেখেছি। সমতলের কোন ট্যুরিস্ট স্পটে কক্ষণো এভাবে বলে দিত না, ভ্যাবলা ট্যুরিস্টের থেকে একটু বেশী রেট নেওয়াটাই দস্তুর তো। মাঝে মধ্যে হিমালয়ে গেলে মানুষের প্রতি ক্রমক্ষীয়মাণ বিশ্বাস আবার ফিরে ফিরে আসে।

এই অংশটা খুবই সত্যি আমার কাছে। আমি ভারতে যতোবার পাহাড়ে গিয়েছি, তার প্রতিবারই দার্জিলিং, না হলে সিকিম। আমার কখনোই কোন মানুষকে নিয়ে সমস্যা হয়নি। গত বছর গেলাম সিমলা, মানালি, রোতাং- আমি জানি না কার কী অভিজ্ঞতা, আমারগুলি ভয়াবহ। মানুষের ব্যবহার গড়ে বেশ খারাপ। সবাই গলা কাটার ধান্ধায়। আমার ধারণা ছিলো ট্যুরিস্ট স্পটের নিকৃষ্টতম অভিজ্ঞতা বাংলাদেশেই হয়েছে আমার। ভুল। জেনেরালাইজড হতে পারে, তবুও বলি- সিমলা, মানালি ওসবদিকের লোকজন অনেক বেশি ধূর্ত, আর ব্যবহারও মোটের উপর খুব খারাপ।

যাই হোক, এতো বকবক করলাম কারণ আপনার লেখাটা সেরকমই মারদাঙ্গা হচ্ছে। বহুদিন পর কিছু পড়তে এতো দারুণ লাগছে। জলদি পরের পর্ব চাই।

দময়ন্তী এর ছবি

ধন্যবাদ৷ হাসি

হ্যাঁ সচলে আপনার সেই লেখা আমি পড়েছি৷ গুম্ফাগুলোর ভিতর আসলেই কেমন গা ছমছমে পরিবেশ৷ গ্যাংটক থেকে কাছে হয় রুমটেক মনাস্টারিও৷ আমি যাই নি, মানে সময় পাই নি৷ পরে রিনচেমপং যাব সময় ঐটা দেখে নেব ভেবেছি৷

সিমলা-মানালি-রোটাংএ আপনার খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে শুনে খুব খারাপ লাগল, অবাকও হলাম৷ হিমালয়ের ঐ অংশেও আমি ঘুরেছি এবং আমার অভিজ্ঞতা খুবই ভাল৷ আমার অভিজ্ঞতায় দিল্লী-আগ্রা=রাজস্থান ইত্যাদিতে অবশ্য লোকের ব্যবহারও খারাপ আর ঠকানোর চেষ্টাও ষোলআনা

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

মুস্তাফিজ এর ছবি

পাহাড়ের মানুষজনের সরলতা আসলেই উল্লেখ করার মতন, সেটা হিমালয় হউক আর আমাদের পার্বত্য এলাকার মানুষজনই হউক। একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে।
২য় পর্বের জন্য ধন্যবাদ।

...........................
Every Picture Tells a Story

দময়ন্তী এর ছবি

আমি আসলে হিমালয় ছাড়া আর কোন পার্বত্য অঞ্চল দেখিই নি৷ আরাবল্লী অল্পস্বল্প, কিন্তু সেখানকার লোকজন বিশেষ সুবিধের নয়৷

হাসি

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

ওডিন এর ছবি

দারুণ!! চোখ বড় বড় করে পড়লাম দেঁতো হাসি

আমি সিকিমে গেছিলাম দুইহাজার চারে, পিতার হাত ধরে এক কনফারেন্সের সূত্রে। আমাদের পারমিট ছিলো শুধু গ্যাংটক এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, আর তখন ছোট ছিলাম, বাপের হাতে চড়থাপড় খাবার ভয় ছিলো, তাই একলা একলা বাইরে যাওয়ার সাহস হয়নাই মন খারাপ প্রায় পুরো শহরটা হেটে হেটে ঘুরে দেখেছি তিনদিনে। কনফারেন্সের এক পিচ্চি ডাক্তারকে ধরে বাসে করে রুমটেকও গেছিলাম। তবে সিকিমে থেকেও গ্যাংটকের বাইরে যেতে পারলাম না- এইটা খুবই হতাশাজনক ছিলো। পরেরবার সিকিম না দেখা পর্যন্ত এই আফসোস রয়ে যাবে।

দময়ন্তী এর ছবি

ধন্যবাদ৷ হাসি

না না বাচ্চাদের একদম বাবার হাত ছেড়ে একলা একলা ঘোরাঘুরি করা ঠিক না৷

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

অদ্রোহ এর ছবি

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া। পড়তে দারুণ লাগল, সিরিজ দৌড়াক...

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

দময়ন্তী এর ছবি

ধন্যবাদ৷ হাসি

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আহ্... কী দারুণ...
ছবিগুলো আরেকটু বড় দেওয়া যায় না?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

দময়ন্তী এর ছবি

ধন্যবাদ৷ হাসি

কী করে বড় করব?

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

আমি কেনু ছবি দেখতে পাচ্ছি না? কেনু? কেনু?? কেনু??? ওঁয়া ওঁয়া

তবে দারুণ লাগলো পড়তে!! পরের পর্ব কবে আসবে??

আমি কবে দেখতে যেতে পারবো?? মন খারাপ

মাথাগুলো রাবণের মত পাশাপাশি অবস্থিত নয়, একটার উপরে আরেকটা করে চুড়োর মত করা। এইভাবে অন্তত পাশফিরে ঘুমানো যাবে, রাবণের ঐ পাশাপাশি মাথা সাজানোয় পাশ ফিরে ঘুমানো সম্ভব নয়।

আমার ধারণা পৌরাণিক চরিত্রেরা নানা ম্যাজিকাল পাওয়ারের অধিকারী যেহেতু ছিলেন, তাই ওঁদের এই একাধিক মাথা বা হাত আসলে আমরা সাধারণভাবে যেরকম ভেবে নেই তেমন নয়, বরং হওয়া উচিত, রিট্র্যাক্টেবল, রোটেটেবল, ইত্যাদি, মানে চাইলেই রাবণ তার মাথা একটার উপরে একটা অ্যারেঞ্জ করে ফেলতে পারতো, বা পাশাপাশি, কোনটা হয়তো সামনে ঘুরে থাকতো তো কোনটা পেছনে। আমার পৌরাণিক জ্ঞান অবশ্য সীমিত, অবলোকিতেশ্বরের কে?!

অট: দমুদিদি, পোস্ট দেবার সময়ে লেখার কয়েক লাইন বা প্রথম প্যারার পরে split summery at cursor ব্যবহার করলে লেখাটার ঐ অংশ পর্যন্ত টিজার হিসেবে নীড়পাতায় দেখাবে। না হলে কেমন যেন ফাঁকা হয়ে থাকে।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

দময়ন্তী এর ছবি

ধন্যবাদ৷ হাসি
কিন্তু ছবি কেনু দেখতে পাচ্ছেন না? কি বিপদ! অ্যাঁ

'অবলোকিতেশ্বর' একজন বোধিসত্ত্ব৷ মহাযান বৌদ্ধরা এঁকে খুব মান্যিগণ্যি করে৷

অট: জানি, কিন্তু করতে ল্যাদ লাগে আর কি৷ হাসি

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

এখন দেখতে পাচ্ছি। হাসি
মনে হয় রাতে নেট স্পিডে প্রবলেম ছিল। পরেরবার ছবিগুলো বড় সাইজেই দিয়ে দিন দমুদি।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

রানা মেহের এর ছবি

গত দুবছর ধরে পাহাড় পাহাড় করছি, যাওয়া আর হয়না।
কবে যে হবে তাও জানিনা।
লেখা দারুন লাগছে

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

দময়ন্তী এর ছবি

ধন্যবাদ৷ হাসি
কেন কেন? যাওয়া হয় না কেন? 'ধুত্তোর' বলে সব ফেলে রওনা দেন৷

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

অসাধারণ! এই বর্ণনা যেন সিকিম থেকে একদল সবুজ বাতাস বয়ে এনে আমায় নিরাময় করে দিয়ে গেল!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

দময়ন্তী এর ছবি

ধন্যবাদ৷ হাসি

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

দমুদি, চমৎকার।

দ্বিতীয়টা আগে পড়ে ফেললাম। এবার আগের পর্ব পড়তে যেতে হবে।

দময়ন্তী এর ছবি

ধন্যবাদ শুভাশীষ

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

দময়ন্তী এর ছবি

ভুল জায়গায় মন্তব্য এসেছিল

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

ফকির লালন এর ছবি

চলুক, ছবি আরো একটু বড় করা যায়না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।