ছেঁড়াখোঁড়া স্বপ্নেরা - ৩

দময়ন্তী এর ছবি
লিখেছেন দময়ন্তী (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৪/১১/২০১১ - ১১:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব


--
দাদারা বাড়ীতে আসায় যুঁইয়ের মা ওদের ভাইবোনকে নিয়ে ক'সিনের জন্য মামাবাড়ী বেড়াতে চলল৷ বাজিতপুর যেতে গেলে শেষ দু মাইল ওরা সাধারণত: হেঁটেই যায়, কিন্তু এবারে মা'য়ের শরীর খারাপ, তাই মা'র জন্য বড়মামা গরুর গাড়ী নিয়ে এসেছে৷ মা তিন দাদাকে নিয়ে গরুর গাড়ীতে চড়ে বসলেও যুঁই বায়না ধরে বড়মামার সাথে সাইকেলে যাবে৷ দুয়েকবার আপত্তি করে মা'ও মেনে নেয়৷ আর যুঁইকে পায় কে! সাইকেলের রডে বসে পটর পটর করে কথা বলতে বলতে চলে৷ কথায় কথায় জানতে পারে সোনামাসিমা আর শেফালীমাসিমাও এখন এসেছে৷ দিদিমণিরও নাকি শরীর খারাপ৷ ছোটমাসীমা একা পারবে না মা আর দিদিমণি দুজনের আঁতুড় তুলতে৷ওদিকে চামেলীমাসিমার শ্বশুরবাড়ী সেই সাঁত্রাগাছি --- সে অনেকদূর, কলকাতার কাছে৷ তাই সোনামাসিমাকে খবর দেওয়া হয়েছিল৷ শেফালীমাসিমা এমনি এমনিই বেড়াতে চলে এসেছে৷ যুঁই বলে, মেজদা গিয়েছিল চামেলীমাসিমার বাড়ী৷ ওঁর কথাবার্তার ধরণ নাকি একদম বদলে গেছে৷ ওখানকার লোকেদের মত করে কথা বলেন৷ মেজদা আর সেজদা তাই নিয়ে খুব হাসাহাসি করছিল৷ যুঁইরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে গেল৷ বৈঠকখানায় হ্যাজাক নিয়ে দাদুমণি সরকারমশাইয়ের সাথে বসে হিসাব দেখছেন৷বড়ঘরে একটা হ্যারিকেন নিয়ে মন্টুমামা পড়ছে৷ ছোটমাসীমা পড়তে আসবে রান্না আরেকটু এগিয়ে দিয়ে৷ নাম ধরে মামা ডাক মা খুব অপছন্দ করে, কিন্তু অনেক বকাবকি সত্ত্বেও প্রভাস, সুভাষ, ভানু আর যুঁইকে দিয়ে মেজমামা ডাকানো যায় নি৷ চারজনই 'মন্টুমামা' বলে ডাকে, বড়রা কেউ সামনে না থাকলে 'মন্টু' বলেও ডাকে৷ মন্টু যুঁইয়ের চেয়ে তিন বছরের ছোট|

রাতে পুবের ঘরে শুতে গিয়ে যুঁই জানতে পারে ওরা এখন এখানেই থেকে যাবে মা'র আঁতুড় না ওঠা পর্যন্ত৷ কলকাতায় কলেজ খুলে গেছে জানতে পারলে দাদা আর মেজদা এখান থেকেই সোজা কলকাতা চলে যাবে৷ একঢালা বিছানায় শুয়ে সোনামাসিমা, ওঁর দুই মেয়ে দেবী, ছবি, শেফালীমাসিমা, ছোটমাসিমা, বড়মামার মেয়ে রুমু, যুঁই সবাই মিলে গল্প করতে থাকে৷ পাশের ঘরে দাদারা সব, মন্টুমামা, রতন, ঘোঁতন এখনও হইহই করে ক্যারাম খেলছে৷ সলতে পড়ে যাওয়ায় হ্যারিকেনটা একবার নিভু নিভু হয়ে গেছিল৷ সেই সুযোগে নাকি ভানু আর মন্টু কি একটা চোট্টামি করেছে৷ তাই নিয়ে খুব চেঁচামেচি চলছে৷ এরই মধ্যে ছোটমাসীমা হঠাৎ বলে 'জানস হেইবাড়ীর বুইড়্যা পিসি এক্কেরে ফাগল হইয়া গ্যাসে৷ গায়ে আর জামাকাপড় রাখতেই চায় না৷অনঙ্গদাদু কি যে করবেন ভাইব্যা পাইতাসেন না'৷ সোনামাসিমা জিগ্যেস করেন 'ছুডুপিসি কিতা করে?' ছোটমাসিমা বলেন'হ্যায় একরহমই আসে৷ আর খারাপ কিসু হয় নাই'৷ ঘরজুড়ে সবাই চুপ হয়ে যায়৷মামাবাড়ীর পাশের বাড়ীটা অনঙ্গদাদুদের৷ অনঙ্গদাদুর দুই মেয়েই বালবিধবা৷ একজন নয় আর অন্যজন চোদ্দয় বিধবা হয়েছে৷ অনঙ্গদাদুর অসম্ভব নিয়মনিষ্ঠার জন্যই কিনা কে জানে, গত তিন চার বছর ধরে দু জনেরই মাথায় অল্প স্বল্প গোলযোগ দেখা দিয়েছে৷ ওদের ধানের গোলার সাথে লাগোয়া উঠোনটার পাশেইঅনঙ্গদাদুদের পশ্চিমের কোঠার পিছনদিকটা৷ ওখানেই দুই মেয়ে থাকে৷ ঐ উঠোনে যখন দাদুমণিদের মুনিষ, রাখাল, বাগালরা খেতে বসে, তখন অনেকসময়ই দেখা যায় বুইড়্যা পিসি আর ছুডুপিসি জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে৷ মুনিষদের জন্য মাছের কাঁসি আনলেই দুই পিসি খুব করুণভাবে এক টুকরো মাছ চাইতে থাকে৷ প্রথমবার দেখে যুঁই খুব অবাক হয়ে দিতে গিয়েছিল৷ বড়মামাদের রাখাল কালীচরণ দেখতে পেয়ে হাঁইমাই করে চেঁচিয়ে ওঠে --'করেন কি দিদিঠাকরাইন, আপনার মায়ে জানতে পারলে মাইরা ফালাইব'৷ যুঁই ভয় পেয়ে থেমে যায়৷ পরে মা জানতে পেরে ওকে বলেছিল 'বিধবা মাগীরে মাছ দিতে গেসলা, অতখানি বড় হইছ, তোমার হুঁশ পব কিসু নাই? হ্যারা তো ফাগল, তুমি জাইন্যা বুইঝ্যা দিলে পাপ তো তুমার হইব'| মাঝে মাঝে বুইড়্যা পিসি বেশ ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গীতে ফিসফিস করে বলতেন 'বাবায় নাই এইহানো, একটা কাতল মাছের পেটি দে না রে আমারে৷ কাউরে কইতাম না'৷ কত মাছ ওরা ফেলাছড়া করে খায়, আর একটা টুকরোর জন্য 'হেইবাড়ী'র পিসিদের আকুলিবিকুলির কথা মনে হলেই যুঁইয়ের কিরম কান্না কান্না পায়, আর একটু ভয় ভয়ও করে৷ ভয় কেন করে সেটা ঠিক বোঝে না, কিন্তু যুঁই দেখেছে ওর কিরকম একটা অজানা ভয় করতে থাকে৷ ঘরে 'ভগবানের মাইর' জাতীয় দু একটা কথার পর সবাই আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে৷ বাইরে খিড়কির পুকুরের ধার থেকে ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসে৷ দূরে কটা শেয়াল ডেকে উঠল একসাথে৷ যুঁইয়ের দুচোখ ছাপিয়ে হু হু করে কান্না আসে, আর --- আর সেই অজানা ভয়টাও তীব্র হয়, প্রচন্ড ভয় আর কান্নার বেগ চাপা দিতে বালিশটা নিয়ে মাথা চাপা দেয় যুঁই৷

পরের পূর্নিমার আগেই অনঙ্গদাদু পশ্চিমের কোঠার সাথে একটা খাটা পায়খানা আর একটা চানের জায়গা বানিয়ে উঁচু পাঁচিল দিয়ে সবটা ঘিরে দিলেন৷ পাঁচিলের গায়ে একটা দরজা মূল বাড়ীতে যাওয়া আসার জন্য৷ তাতে সারাদিন তালা দেওয়া থাকে৷ পশ্চিমের কোঠার জানলাগুলোর অর্ধেক ইঁট গেঁথে বন্ধ করে দিলেন৷ শুধু ওপরের দিকে একটা করে ফালিমত খোলা রইল৷ তাই দিয়ে বুইড়্যা পিসির নাকের ডগা অবধি আর ছুডুপিসির চোখ পর্যন্ত দেখা যায়৷


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ হচ্ছে দিদি, চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

সিরিজ পড়ছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।