ছেঁড়াখোঁড়া স্বপ্নেরা - ২

দময়ন্তী এর ছবি
লিখেছেন দময়ন্তী (তারিখ: মঙ্গল, ১৩/০৯/২০১১ - ৮:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব


-
যুঁইয়ের জীবনে আজ একটা বিশেষ দিন। আজ ও প্রথমবার রিকশায় চড়েছে। বীণা, অসীমা আর যুঁই আজ স্কুল থেকে আসার সময় কিশোরগঞ্জ টেলার্সের সামনে থেকে রিকশায় চড়ে ওরা তিনজন হেমন্তবাবুর বৈঠকখানা পর্যন্ত এসেছে। কিশোরগঞ্জে রিকশা চালু হয়েছে বছরখানেকেরও ওপর, কিন্তু ওদের তাতে চড়বার কোনও সুযোগই হয় নি। কিশোরগঞ্জের মধ্যে কোথায়ও যেতে গেলে হেঁটেই যায়, বড়জোর বাবার সাইকেলে বসে; তাও আজকাল বড় হয়ে গেছে বলে সাইকেলে চড়লে মা বকে। ওকেও, বাবাকেও। আর দেশের বাড়ী জঙ্গলবাড়ীতে কিম্বা মামার বাড়ী বাজিতপুরে যেতে গেলে সেই নৌকা আর গোরুর গাড়ীই ভরসা। ওরা তিনবন্ধু ক'সপ্তাহ ধরেই শলা পরামর্শ করছিল, কেমন করে সবার চোখ এড়িয়ে একটু রিকশায় চড়া যায়। অসীমার খুব সাহস; দিব্বি রিকশাওলাদের কাছে গিয়ে ভাড়াটাড়া জেনে এসেছে। যুঁই তো ভয়েই মরে যায়, কেউ যদি দেখে ফেলে মা'কে বা বাবাকে বলে দেয়! বীণাও ভীতু। ওদের ভয় দেখে রিকশাওলা একগাল হেসে বলে আইস্যা অফনেরা এক আনা দিয়েন, লন বসেন'। কোনওমতে গাদাগাদি করে তিনজনে উঠে বসে। সে কী আশ্চর্য্য এক অভিজ্ঞতা --- রাস্তার লোকগুলোকে কেমন ধীরগতি লাগে --- ওরা কেমন সাঁই সাঁই করে চলে এলো ---- বসার জায়গাটাও কেমন আরামদায়ক সাইকেলরডের মত অমন শক্তমত নয়।

হেমন্তবাবুর বৈঠকখানার সামনে থেকে যুঁইরা হেঁটেই পাড়ার মধ্যে ঢোকে, যে যার বাড়ী চলে যায়। যুঁইয়ের একটু একটু ভয় ভয় লাগতে থাকে ---- মা যদি জানতে পারে, কী করবে! এমনিতেই তো কথায় কথায় বলে "হ: হইতাস তো ঐ অরুণার লাহান'! এত খারাপ লাগে যুঁইয়ের এই তুলনাটা। ও কেন অরুণাদির মত হবে? অরুণাদি নাকি নিজে নিজেই বিয়ে করে নিয়েছে --- কি লজ্জার কথা ---- অরুণাদি নাকি বাড়ী এসেছিল, ওর মা দেখা করে নি, মুখে কাপড় ঢাকা দিয়ে ঘরে শুয়েছিল। ওর বাবা এসে চীত্কার করে বের করে দেয় ওদের বাড়ী থেকে। সেই থেকে কোন কাজ অপছন্দ হলে মা অরুণাদির সাথে তুলনা দেয় --- যুঁইয়ের গাল কান গরম হয়ে যায়, কিন্তু মা'কে কিছু বলতে সাহস পায় না।

বাড়ী ঢুকে দেখে দাদা মেজদা এসেছে কলকাতা থেকে, সেজদাও বাড়ীতে। দাদা মেজদা কলকাতায় মেসে থেকে কলেজে পড়ে। স্বদেশী আন্দোলনে সব স্কুল কলেজ বন্ধ, ওরা তাই এই সুযোগে কদিন বাড়ীতে থেকে যাবে। যুঁই তাড়াতাড়ি হাতপা ধুয়ে শাড়ী বদলে রান্নাঘরে যায় মা'কে সাহায্য করতে। মাও বেশ খুশীখুশী। ওকে বলে লুচিগুলো বেলে দিয়ে গিয়ে পড়তে বসতে। "আইচ্ছ্যা' বলে ও কাজে লেগে যায়, মনে মনে ভাবে এখনও তো সন্ধ্যে হতে দেরী আছে, তবে আগে আগে পড়া করে নিলে দাদাদের কাছে বসে গল্প শুনতে পাবে।


--
যুঁইদের সারা মাসের চালডাল, তরি তরকারী আসে দেশের বাড়ী মানে জঙ্গলবাড়ী থেকে৷ ওখানে মেজজ্যাঠা আর মণিজ্যাঠা থাকেন৷ সারাবছর তদারকি করে জমিজিরেত দেখভাল্ করেন, প্রতি তিনমাসে চাল পাঠান, ডাল আসে বছরে দুবার আর মাসে মাসে ঠিক চলে আসে কিছু শাকসবজি আর সময়ের ফল৷ বাড়ীতে অতিথি এলে বাবা কিশোরগঞ্জ বাজারে যায় নিশি-চাকরকে সঙ্গে নিয়ে৷এমনিতে বাজার যাওয়ার তেমন দরকার পড়ে না৷ দেশের বাড়ী থেকে যা এলো তো এলোই৷ রোজের তরকারী, মাছ বাড়ীতেই রাখা হয়৷ নইল্যা আসে মাছ নিয়ে৷ বাবা ভেতরবাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়, মা দেখে দেখে রাখে৷ যতদিন দাদু বেঁচে ছিল বারবাড়ীর বারান্দায় বসে থাকত সারা সকাল আর দেখে মাছ, দুধ সব রাখত৷ নিশিকে দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিত৷ মা নিয়ে ঠিকঠাক ব্যবস্থা করত৷

দাদুর কথা মনে পড়লেই যুঁইয়ের মন খারাপ লাগে৷ দাদু ওকে খুব ভালবাসত৷ মা কিন্তু দাদুকে খুব ভয় পেত৷ দাদু কালাজিরা চালের ভাত খেত, সেই ভাত বসানো হত দাদু যখন তেল মেখে পুকুরঘাটের দিকে যাবে, তখন৷ দাদু চান করে এসে পাতে বসবে আর মা বেড়ে দেবে গরম ঝরঝরে ভাত৷একটুও আগেপরে হওয়া চলবে না৷ হলে কী হবে? তা কেউ জানে না৷ শুধু মা যখন মামাবাড়ী যায় তখন দিদিমণিকে বলে 'তাইন যহন পুকুরের লাহান যাইবো তহনই ভাত বসানি লাগবো, একটুও আগেপরে হওনের উপায় নাই'৷ দিদিমণিও ঘাড় নেড়ে বলে 'হ আগের দিনের লুক তো ত্যাজটা খুব আসে অহনও'৷ সেবারে মামাবাড়ী থেকে ফিরে যুঁই যখন ভেলুকে আদর করতে গিয়ে কামড় খেল; আসলে ভেলু কিকরে যেন ওর চেনের সাথে জড়িয়ে গেছিল, যুঁই বোঝে নি গলা জড়িয়ে আদর করতে গেছে আর অমনি ভেলু ঘ্যাঁক করে যুঁইয়ের নাকের পাশে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে; যুই কাঁদতেই মা ভীষণ বকতে শুরু করেছিল আর অমনি দাদু ডেকে উঠল 'বৌমাআ'৷ ব্যাস! মা একদম চুপ৷ শুধু যুঁইয়ের দিকে রাগীচোখে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করছিল৷ দাদু তারপর লাঠি নিয়ে বেরোল সঙ্গে নিশির কোলে যুঁই, রমেন ডাক্তারের ডিসপেন্সারিতে গিয়ে কি যেন একটা অ্যাসিড দিয়ে ঐ নাকের পাশটা ভাল করে মুছে দেওয়া হল৷ সাইট্রিক অ্যাসিড? না না নাইট্রিক অ্যাসিড বোধহয়৷ এই নামটা ওর কিছুতেই মনে থাকে না আর মেজদা আর সেজদা খালি 'বলদা বলদা' বলে খ্যাপায়৷ উফ! কি ভীষণ জ্বালা করেছিল৷যুঁইয়ের জোরে চীত্কার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ভয়ে পারে নি৷ মা যদি আড়ালে পেয়ে মারে! অসুখ বিসুখ করলে মা খুব রাগ করে৷ দাদু, বাবা অনেকক্ষণ ইংরিজিতে কিসব আলোচনা করেছিল, যুঁই বুঝতে পারে নি, শুধু 'গার্ল চাইল্ড' শব্দটা বারবার শুনেছিল৷ এটার মানে ও জানে, ছোটমেয়ে, আর 'ডেঞ্জার' মানে বিপদ তাও জানে ও৷ ঐ অ্যাসিড দিয়ে মোছানোর জন্য ওর নাকের পাশে একটা ছোট টোলমত গর্ত আছে৷ ওকে অবশ্য আর ইঞ্জেকশান নিতে হয় নি৷

সেজদা ওদের ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে দুরন্ত, তারপরই মেজদা৷ আরও ছোটবেলায় সেজদা যখন বাড়ীর প্রায় উল্টোদিকে বিপিন পন্ডিতের পাঠশালায় পড়তে যেত, তখন একটু বেলা হয়ে গেলেই ওদিক থেকে চীত্কার করত 'দাদুউ আমারে অহনও ছুটি দেয় নাআ'; আর অমনি দাদু এদিক থেকে বলত 'বিপিন ভানুরে ছাইড়্যা দাও'৷ ব্যাস সেজদাও অমনি কোনোদিকে না তাকিয়ে, পণ্ডিতমশাই ছুটি দিয়েছেন কিনা না দেখেই একদৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে বাড়ী৷ মেজদা আর সেজদা মিলে প্রায়ই নরশুন্দা নদীতে নৌকা বাইতে যায়৷ কোন মাঝি নৌকা রেখে একলা একলা বসে আছে দেখলেই ওরা সেই মাঝির সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে, আর ভাব জমে গেলেই নৌকা নিয়ে ভাসা৷ ওরা প্রায়ই ঐপারে যায়, কিন্তু নামে না৷ ভদ্রবাড়ীর ছেলেদের নাকি ঐপারে নামতে নেই৷ তবে মেজদা, সেজদার গল্প শুনে যুঁই বুঝেছে যে ওরা ওপারে নামে, ঘুরে ফিরে দেখে, এমনকি ওপারে ওদের বন্ধুও আছে৷একবার এক মাঝি কিছুতেই নৌকা দিতে রাজী হল না৷ মেজদা ঠিক করে ওকে শাস্তি দিতে হবে৷ তক্কে তক্কে থাকে৷ একদিন মাঝি নৌকা বেঁধে রেখে নদীতে নেমেছে প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতে৷ নরশুন্দায় বর্ষা ছাড়া সারাবছরই প্রায় কোমরজল বা বুকজল থাকে৷ এই বর্ষাতেই যা একটু নৌকা চলে৷ যাইহোক, নৌকা খালি দেখে মেজদা আস্তে আস্তে নৌকায় ওঠে৷ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে একটা শিশিভর্তি মধু৷ আ: মধু বড় ভাল জিনিষ, ও তাড়াতাড়ি শিশি খুলে ঢকঢক করে অনেকটা গলায় ঢেলে দিয়েই দৌড়ে নেমে যায়৷ আর তারপর ----------- কিছুক্ষণ পরে ভানু দেখে মেজদা প্রাণপণে জল খাচ্ছে, তার চোখমুখ লাল, নাকচোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়াচ্ছে৷ রাতে বৈঠকখানায় বাবা সবাইকে ডেকে খুবই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল 'সুভাষ তুই মাঝির ত্যাল খাইলি ক্যান?' মাঝি এসে নালিশ করে গেছে৷

যে কোন ঝগড়ায় মেজদাকে জব্দ করার বা থামিয়ে দেওয়ার মোক্ষম অস্ত্র ভাইবোনেরা পেয়ে গেল৷ ভানু ও অন্য ভাইবোনেরা স্রেফ বলত 'তর সেই মাঝির ত্যাল খাওয়ন ---- ' ব্যাস! মেজদা কখনও বলে মাঝি তেলটা অন্য কোথায়ও ফেলেছে, সে আসলে মধুই খেয়েছিল৷ কখনও বলে ইচ্ছে করেই তেল খেয়েছিল৷ মোটকথা সুভাষ যে মাঝির ত্যাল খাইসিল এই নিয়ে নরশুন্দার কুচো মাছগুলোরও কোন সন্দেহ ছিল না৷


মন্তব্য

আয়নামতি এর ছবি

ম্যাঁও

দময়ন্তী এর ছবি

চিন্তিত

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

আয়নামতি এর ছবি

দিদি ভাবনায় পড়ে গেলেন যে! বিড়ালটা চালান দিয়েছিলাম ফাষ্টু হবার জন্য। তুলিদি ফাষ্টু হলে কত্ত কী খেতে দেয়
আপনি কি কি খেতে দেবেন দেন দেখি দেঁতো হাসি ................প্রথম পর্ব পড়েছি। দ্বিতীয়টাও পড়লাম। আমার বেশ ভালো লাগছে। একটা কথা বলি? প্রত্যেকটা বাক্যের শেষে দাড়িটা বড্ড কাছ ঘেঁষে হওয়ায় দেখতে ভালো দেখায় না আর পড়তেও মাঝে মাঝে হোচট লাগে(আকারের মত মনে হওয়ায়) এটার ব্যবস্হা নিলে হয় না?

অপছন্দনীয় এর ছবি

এতো কিছু থাকতে বেচারা নিরীহ বিড়ালটা কেন?

তানিম এহসান এর ছবি

এই প্রশ্নটা আমিও করতে চাচ্ছিলাম! এ কেমন ধারা ব্যবহার একটা বেড়ালছানার সাথে!!

আয়নামতি এর ছবি

@পছন্দনীয় @তানিম এহসান(আপনি হাচল হয়ে গেছেন তো! অভিনন্দন আবারও দেঁতো হাসি ),

বিড়াল/বেড়াল ছানাটাকে কী আমি মেরেধরে পাঠিয়েছি নাকি! যেই আমি পা বাড়িয়েছি, ওমনি তিনি সামনে এসে ম্যাঁও বলে আবদার ধরলো যেন তাকেই পাঠাই। কী আর করা, আমি না এসে বিড়ালছানাকেই চালান দিলাম। এখন থেকে ওই আমার হয়ে ফাষ্টু হবার দৌড়ে থাকবে। হুহু বাবা! বুঝেশুনে....... শয়তানী হাসি

তানিম এহসান এর ছবি

বাটি চালান, ঘটি চালান - ইত্যাকার নানারকম তুকতাক চালানের কথা শুনেছি, জীবনে এই পেরথম বার শুনলাম বেড়াল চালান দেয়া হয়! বিরাট গায়েবি ব্যাপার, মাথা ঘুরতেছে! আপনার উয়ীদ লাঠিটা কোথায় চালান করছেন আয়নামতি আপা খাইছে

আয়নামতি এর ছবি

হিহিহি আপনি দেখি লাঠির কথা ভুলতেই পারছেন না! ওটা আমার কথা নয় রে ভাই। এক আন্টির কথা...সে আরেক কাহিনি বটে! জানেন না বুঝি, 'দেয়ার ইজ অলওয়েজ এ ফার্ষ্টটাইম ফর এভরিথিং' দেঁতো হাসি

অপছন্দনীয় এর ছবি

পুরো পড়ে মন্তব্য করবো দমুদি হাসি

 তাপস শর্মা  এর ছবি

হাসি । চুপচাপ পড়ে জাচ্ছি। আর আগামী পর্ব চলে আসুক অতি শীগগির।

চুপি চুপি জানিয়ে জাই যুঁই এর মেজদার মতো আমারও তেল খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে ছেলেবেলায়। সে তেল অবশ্য কেরোসিন তেল, উফ, ভয়ানক অভিজ্ঞতা।

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

দেঁতো হাসি

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

তানিম এহসান এর ছবি

কিশোরগনজ, বাজিতপুর নামগুলো একটা কেমন যেন টেনে ধরলো, আমার বাড়ী বাজিতপুর! নরসুন্দা নদী এখন মৃত প্রায়। প্রথম পর্ব থেকেই পড়ে যাচ্ছি, ভালো লাগছে!

আশালতা এর ছবি

তারপর ? পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

অরফিয়াস এর ছবি

চলুক

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

কল্যাণF এর ছবি

চলুক

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বেশ বেশ!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।