আমাদের গ্রাম, এক সদাহস্যময় মানুষ আর সেখানকার সংখ্যালঘু সমাজ

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৫/০৬/২০০৮ - ৩:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বেশ দূর সম্পর্কেরই আত্মীয় তিনি। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে গেলে হতো তার সাথে। আমরা এসেছি, সে খবর পেলেই আসতেন। সদাহস্যময় মানুষটি, নানা রকম হাসি, ঠাট্টা আর গল্পে মাতিয়ে রাখতেন সবাইকে। বড়দের সাথে যেমন, ছোটদের সাথেও একই রকম। শান্ত, সৌম্য চেহারা তার, এর মাঝে এত হাসিখুশী ভাব, আমাদের ভাল লাগত। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। নিজের জমিজমা ছিল, সেগুলো অন্যদের দিয়ে চাষ করাতেন। তাতে প্রাচুর্য না থাকলেও অভাব ছিল না।

তারপর শৈশব আর কৈশোর পেরিয়ে কেটে গেল অনেক সময়। নিজে দেশের বাইরে বহুবছর। যদিও প্রায় প্রতিবছরই দেশে যাই, কিন্তু গ্রামে যাওয়া হয়না সবসময়। এরই মাঝে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে গ্রামীন সমাজেও, প্রতিবারই দেশে গেলে শুনি। গ্রামে যেতেও ইচ্ছে হয়, কিন্তু প্রতিবারই যাই যাই করে পেরিয়ে গেল চৌদ্দটি বছর।

এবার তাই ঠিক করলাম, গ্রামেই যাব। অনেকেই বললো, ওখানে তো নেই কেউ, কি লাভ গিয়ে। কথাটি ঠিক, আপন যারা ছিলেন, তাদের প্রায় সবাই প্রয়াত। আমার বক্তব্য, যারা নেই, তাদের কথা আপাতত: না ভেবে যারা আছে, তাদের কথাই নাহয় ভাবি একবার। দলবল ভারি হতে দেরী হলো না। একদিন সকালে হইহই করে রওয়ানা দিলাম সবাই মিলে। নরসিংদি থেকে লঞ্চে চড়ে ছোট্ট একটি ঘাটে নেমে রিকশা নিতে হয়। আমরা অবশ্য লঞ্চের বদলে একটি বড় ইন্জিন নৌকো ভাড়া করলাম। নামার পর আগে শীতের সময়ে হেঁটে যেতে হতো পুরো পথ, আর বর্ষার সময়ে নৌকো ছাড়া চলতো না একেবারেই।

চারটে রিকশা করে কাফেলার মতোই চললাম। কোন কোন জায়গায় উচু সেতু তৈরী করা হয়েছে, রাস্তা থেকেও অনেকটা উপরে। তখন নামতে হয় রিকশা থেকে। আমি আর আমার বিদেশী বউ নেমে রিকশা ঠেলতে চাইলে হইহই করে উঠলেন রিকশা চালক। তারপরও ঠেললাম। গ্রামের লোকজন বেশ অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। যাত্রীরা রিকশা ঠেলে, এটা হয়তো এদের চোখে সচরাচর পড়ে না।

গ্রামটি উত্তর দক্ষিনে প্রায় চার কিলোমিটারের মতো লম্বা, চওড়ায় ২৫০ মিটারেরও কম। রিকশায় দক্ষিন দিক দিয়ে ঢোকার পথ। প্রথমেই পড়ে প্রায় আধকিলোমিটার লম্বা হিন্দু পাড়া, তারপর মুসলিমদের বসতি। মাঝামাঝি এলাকায় বাজার আর স্কুল, সেটা পেড়িয়ে সামান্য এগিয়েই আমাদের বাড়ী। আগে দক্ষিন দিক থেকে বিভিন্ন বাড়ীর পাশ ঘেসে, কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়ীর উঠোন পেরিয়ে উত্তরে যেতে হতো। এখন গ্রামের পুব দিক ঘেষে দক্ষিন থেকে উত্তর পর্যন্ত টানা রাস্তা।

গ্রামে ঢুকেই মনের দিক থেকে হোঁচট খেতে হলো। হিন্দু এলাকার শুরুতেই দেখি এই আধ কিলোমিটারের মাঝেই দু’টো মাদ্রাসা। আগে এখান দিয়ে যাবার সময় ঊলুধ্বণি শেনা যেতো। জোহরের নামাজের সময় হয়েছে, ছাত্ররা মাদ্রাসার চত্তরের সামনে টিউবওয়েলের পানিতে অজু সারছে। আগে এই মাদ্রাসা ছিল না এখানে। অনেকদিন পর গ্রামে এলাম, মন আনন্দে ভরাট। তাই বিষয়টি নিজের ভেতরে ততটা গাঢ় হতে দিলাম না। রিকশাও এগিয়ে চলল। আরেকটু এগিয়েই দেখি, এক বাগানের বেড়ায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে আমাদেরকেই ডেকে রিকশা থামাতে বলছেন সৌম্য চেহারার এক ভদ্রলোক। চারটে রিকশাই লাইন করে থামালাম। নেমেই দেখলাম, ইনি সেই আত্মীয়, শুরুতেই যার পরিচিতি দিয়ে এই কাহিনীর অবতারনা। আমাদেরকে দেখে খুব খুশী হলেন ওনি। কুশল বিনিময়ের বিভিন্ন আত্মীয়ের খবরাদি নেয়া হলো। দেশে এতোদিন দেরী করে এলাম, এই অভিযোগও হজম করলাম।

হঠাৎ মনে পড়লো, ওনার নিজের বাড়ী আরো উত্তরে ছিল বলে জানতাম। অনেকবারই সেখানে গিয়েছি। ওনি এই বাড়ীতে কেন? বেশ চালাক মানুষ, আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি সাথে সাথেই ধরে ফেললেন। হেসে বললেন,
- হিন্দুর বাড়ী কিনছি।
- হিন্দুর বাড়ী? তাহলে হিন্দুরা কোথায়? প্রশ্ন করলাম আমি।
- ইন্ডিয়ায় পালাইছে।
- ইন্ডিয়ায় পালালো কেন?
- ডরে পালাইছে। বলেই অমায়িক হাসলেন তিনি।

তার এই অমায়িক হাসি আমাকে আনন্দ দিতে পারলো না। ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের বাড়ীর দিকে এগিয়ে গেলাম। মাদ্রাসা আর বিভিন্ন হিন্দু এলাকায় বাড়ী কেনার একটি যোগসুত্র খুজে পেতে দেরী হলোনা। হিন্দুরা বাড়ীঘর ছেড়ে পালাচ্ছে, আর মুসলামনরা তা জলের দামে কিনে নিচ্ছে, এটা এই গ্রামের লোকদের মাঝে একেবারেই গোপন কোন কাহিনী নয়। কারো কারো সাথে কথা বলার পর, হিন্দু এলাকার অনেকটাই মুসলমানদের দখলে চলে এসেছে, অনেকেই বেশ গর্ব নিয়েই জানালো।

নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে কেন হিন্দুরা পালাবে বাংলাদেশ ছেড়ে, কেনইবা মুসলমানরা পালাবে ভারত ছেড়ে? কেন ধর্ম মানবিক যোগাযোগ, পারস্পরিক অবস্থানের মাঝে এত বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে, যে মানুষকে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে শরণার্থী হতে হয়? ঈশ্বরের ছত্রচ্ছায়ায় মানুষের মাঝে মানবতা, সৌহাদ্র আর শান্তির বানী পৌছে দেবার উদ্দ্যেশ্যে ধর্মের অবতারনা ঘটেছে পৃখিবীতে বলে দাবী করা হয়। এই দাবীর যথার্ততার প্রমান কি এই? বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর কোন নিষ্পেষন নেই, এই দাবীরও যথার্ততার প্রমান কি এই?

জানি, আমার এই প্রশ্নগুলো একেবারেই নতুন নয়। কিন্তু অনেক সময়ে পুরোনো ব্যথাই আরো অনেক বেশী ভয়ংকর, নাছোড় হয়ে চেপে বসে বুকের ভেতরে। তখন না বলে উপায় থাকে না।


মন্তব্য

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

বেশ ভাল লাগল ।

নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে কেন হিন্দুরা পালাবে বাংলাদেশ ছেড়ে, কেনইবা মুসলমানরা পালাবে ভারত ছেড়ে? কেন ধর্ম মানবিক যোগাযোগ, পারস্পরিক অবস্থানের মাঝে এত বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে, যে মানুষকে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে শরণার্থী হতে হয়? ঈশ্বরের ছত্রচ্ছায়ায় মানুষের মাঝে মানবতা, সৌহাদ্র আর শান্তির বানী পৌছে দেবার উদ্দ্যেশ্যে ধর্মের অবতারনা ঘটেছে পৃখিবীতে বলে দাবী করা হয়। এই দাবীর যথার্ততার প্রমান কি এই? বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর কোন নিষ্পেষন নেই, এই দাবীরও যথার্ততার প্রমান কি এই?
জানি, আমার এই প্রশ্নগুলো একেবারেই নতুন নয়। কিন্তু অনেক সময়ে পুরোনো ব্যথাই আরো অনেক বেশী ভয়ংকর, নাছোড় হয়ে চেপে বসে বুকের ভেতরে। তখন না বলে উপায় থাকে না।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

অতিথি লেখক এর ছবি

সংখ্যালঘুদের প্রতি এই বৈষম্য শুধু আমাদের দেশে নয়, আমার ধারনা গোটা বিশ্বের চিত্র এখানে একই রকম। তারপরও মনের ভেতর কেমন যেন লাগে - এক ধরনের ঘৃনা, আর নিজে কিছু করতে না পারার অক্ষমতার যন্ত্রনা।

কীর্তিনাশা

স্পর্শ এর ছবি

হিন্দুদের পালিয়ে যাবার ব্যপার টা নিজের চোখে দেখেছি অনেক বার।
এই লেখাটা পড়ে মনে পড়ে গেল সেসব।
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

শাহীন হাসান এর ছবি

অনেক সময়ে পুরোনো ব্যথাই আরো অনেক বেশী ভয়ংকর, নাছোড় হয়ে চেপে বসে বুকের ভেতরে। তখন না বলে উপায় থাকে না।

বাস্তবতাই লিপিবব্ধ হয়েছে .... ; পুরাতন আর নতুনের বিষয় না রেখেই লিখেছেন। ভাল লাগলো।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

স্নিগ্ধা এর ছবি

ঠিক সময়ে, ঠিক শ্রেনীতে, ঠিক পরিবারে জন্মেছি বলে মাঝে মাঝে 'নেই'ঈশ্বরের কাছে কি যে কৃতজ্ঞ লাগে!

তবে আমি খুব ভালো করেই জানি মারের সাবধান নেই - কাজেই আপনার গ্রামের সংখ্যালঘুদের মত বাস্তবতা যে কোন দিন যে কোন মূহুর্তে হতে পারে আমার, আমাদের যে কারুরই - আবার সেটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ!

অতিথি লেখক এর ছবি

বাংলাদেশে জন্ম নেয়া হিন্দুদের নিজের কোন দেশ নেই। বাংলাদেশে তারা পরবাসী আর ভারতে গেলে হয় পরগাছা । কোথায় যাবে তারা?????

অভী আগন্তুক
----------------

অতিথি লেখক এর ছবি

বিশ্বজুড়ে সংখ্যালঘূরা লঘূ থেকে লঘূতর হচ্ছে। একসময় দেখা যাবে তাদের নাম মনে করবার কেউ নেই। ভালো লেগেছে। কষ্ট পেয়েছি! কারণ কিছু সুবিধাবাদী মানুষ সংখ্যালঘূদের জন্য মিছেমিছিই আতঙ্ক ছড়িয়ে ফায়দা লোটার সুযোগে থাকে।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

রায়হান আবীর এর ছবি

মন খারাপ
---------------------------------

মাহবুব লীলেন এর ছবি

একজন লেখক
সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যাচ্ছেন
তার পাসপোর্টে ভিজিট ভিসা
কিন্তু আমি জানি তিনি চলে যাচ্ছেন

জকিগঞ্জ বর্ডার পর্যন্ত থাকার কথা বলতে বলতে গেছি
নৌকায় উঠার আগে উনি বললেন- তুমি থাকর কথা বলছ সেটা আমি শুনতে পাচ্ছি
কিন্তু আমি যে নিজেকে কতবার থাকার কথা বলছি সেটা তুমি শুনতে পাচ্ছো না
ফিরে যাও

০২

শিলচরে গিয়ে তার সাথে দেখা করেছিলাম দু বছর পরে
তিনি বললেন- থাকারও অবস্থা নেই। ফেরারও অবস্থা নেই

তীরন্দাজ এর ছবি

কিন্তু আমি যে নিজেকে কতবার থাকার কথা বলছি সেটা তুমি শুনতে পাচ্ছো না
ফিরে যাও

এরপর কিআর কি্ছু বলার থাকে ? সব বলেই দিলেন!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

দ্রোহী এর ছবি

আমরা যখন যশোরে ছিলাম তখন আমার একটা বন্ধু ছিল। তার নাম ছিল পলাশ। জাতে নমশুদ্র হিন্দু। ক্লাস এইটে পড়ি। আমি ওকে কারনে অকারনে খুব মারতাম। ও এসে আমার মাকে বলত, "মাসীমা। আমি ওকে এত পছন্দ করি তবুও ও আমাকে মারে কেন?"

খুব ভাল ছবি আঁকতো শালা। রং কিনতে পারতো না দেখে শুধু পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতো। আমাকে দেখাবার সময় বলতো এটা লাল রং হবে, এটা হবে সবুজ।

একদিন খবর পেলাম পলাশে বাবা ট্রাক চালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। স্টিয়ারিং হুইল ঢুকে গেছে পেটের ভেতর।

তারপরই চরম দুঃখে পড়ে যায় পরিবারটি। যশোর শহর ছেড়ে চলে যায় বরিশালের গ্রামের দিকে। পরে শুনেছি পলাশও মরে গেছে। পলাশের অসহায় মা, তাঁর নাবালিকা মেয়েগুলোকে নিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে।


কি মাঝি? ডরাইলা?

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

কী জীবন্ত স্মৃতি গুলো নেই হয়ে গেল!
আমারও প্রায় একই অভিজ্ঞতা... ... ...লতাগুল্মে ছাওয়া ত্রিশূলচূড় ত্রিশ্মশানে বিশ্রী পলেস্তারা আর টিনকাটা ঝাঁপ ফেলে বসেছে গ্রাম্য মনোহারী দোকান। শবদাহে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন উড়ে এসে গেঁড়ে বসা আলআমিন বিস্কুটের মালিক

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍পড়ে মনটা খুব খারাপ হলো। অধিকাংশ গ্রামেরই কি এই হাল এখন?

সাধারণ মুসলমানদের দোষ দিয়ে আর কী লাভ? তাদের ঐশী কেতাবই তো ভিন্নধর্মে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসীদের উত্পীড়ন এবং প্রয়োজনে হত্যা করা জায়েজ করে দিয়েছে মন খারাপ

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

দিগন্ত এর ছবি

এটা আবার অনেকটা একতরফা লেখা। আমার মনে হয় না বাংলাদেশ বা দেশের মানুষের খুব কিছু দায়িত্ব বর্তায় বাংলাদেশে হিন্দুদের রাখার জন্য। যারা এদেশে চলে আসেন তারা অধিকাংশই স্বেচ্ছায় ও পরিকল্পনা করেই আসেন। আপনি বলতেই পারেন যে পরিকল্পনাটা 'ভুল', কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা বিতাড়িত হন। আমি আমার জীবনে অনেক বাংলাদেশ থেকে আসা লোকজন দেখেছি, আমার নিজের আত্মীয়-স্বজন অনেকেই এসেছে। ছোটোবেলায় একসময় আমি এমন একটা জায়গায় থাকতাম যেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা লোক ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দাই নেই!! রিফিউজি ক্যাম্প আর কি ... তাই বাংলাদেশ থেকে আসা অনেক হিন্দু পরিবারের গল্পই শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। তাদের মধ্যে মোটামুটি তিনটে দল আছে। একদল ১৯৪৭ এর আসেপাশে আসা। তারা অনেকে দাঙ্গার ভয়ে বা দাঙ্গাকবলিত হয়ে এসেছেন। যারা সত্তরের দশকে এসেছে তারাও অনেকেই একই ভাবে এসেছে।

কিন্তু নব্বইয়ের দশক বা তার পরে যে কয়েক দফায় লোকজনে এসেছে তাদের অধিকাংশই ঠিকমত পরিকল্পনা করেই এসেছেন। এমন নয় যে তাদের বাংলাদেশ অনেক সম্পত্তি ছিল। কিন্তু যা ছিল তাও বেচে দিয়ে অনেকটা অন্ধের মতই ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। এটা অনেকটা বাংলাদেশী শ্রমিকদের জাহাজের পিপেয় চড়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টার মতই - তফাতটা হল, এটাতে ঝুঁকি অনেক কম, লাভের সম্ভাবনাও কম।

আমাদের বাড়িতে নব্বইয়ের দশকে কাজ করতে আসতেন এক মহিলা। উনি ঊননব্বইএর সময়ে এদেশে আসেন। তার তখন একাধিক শাড়িও ছিল না, একরকম একবস্ত্রে এদেশে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওদেশেও(পটুয়াখালি) তাদের কিছু ছিল না, যা ছিল তাও বন্যায় ধুয়েমুছে গিয়েছিল। তার পরিবারের ৪-৫ জন ছেলেমেয়ে সবাই ঘরে ঘরে কাজ করত। সেই তারাই এখন খেটেখুটে এখানে রীতিমত বড় বাড়িঘর করে ফেলেছে আর একের পর এক আত্মীয়কে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসছে। এর মধ্যে আমি তো কোথাও অস্বাভাবিক কিছু দেখি না ... তবে তারা যদি ওই একই খাটাখাটনি দেশে বসেই করতেন তাহলে দেশে কি উন্নতি হত না?

আবার বর্ধমানের এক প্রখ্যাত ব্যবসায়ীর পরিবার এসেছেন ধামরাই থেকে। ধামরাইতে তাদের বিশাল বাড়ি - এখনও আছে। তারা চলে এসছেন শুধু বাড়িতে কিছু লোকে গরুর হাড় ফেলে দিয়ে যেত বলে। বাংলাদেশের সমস্যা কি এটা? আমার তো মনে পড়ে অষ্টাদশ/ঊনবিংশ শতকে ইয়ং বেঙ্গল নামে একদল এই একই কাজ কোলকাতাতেই করে বেড়াত।

১৯৪৭ সালেই এদের ভাগ্য ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলে সংখ্যালঘুদের যে অন্য দেশে পাড়ি দিতে হবে, এটা রোখার মত ক্ষমতা কারো নেই। তার ওপর যেখানে লোকজনে ধর্মের গুরুত্ব এত বেশীমাত্রায় দিয়ে আসে। স্বাধীন বাংলাদেশের হাতে আমার মনে হয় না হিন্দুদের ভারতে আসা ঠেকানোর জন্য কিছু করার ছিল ...


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

তীরন্দাজ এর ছবি

আমার বক্তব্যের মাঝে এক তরফা, দু'তরফা তেমন কিছুই নেই। এটা আমার কয়েকমাস আগের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ। যা দেখেছি, তার বর্ণনা করেছি মাত্র।

প্রতিটি রাষ্ট্রের মৌলিক দ্বায়িত্ব, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সে দেশের নাগরিকদের জান, মালের নিশ্চয়তা প্রদান করা। সে দ্বায়িত্ব হিন্দুদের বেলায় বাংলাদেশ আর মুসলিমদের বেলায় ভারত পালন করতে পারেনি। অনেক দেশই পারে নি, সুতরাং এ দু'টো দেশকেই শুধুমাত্র দোষ দেয়া যায়না, এটা সত্যি। তারপরও যে ওরা পারে না, সেটা তাদের অপরাধ তো বটেই। এটা বলতে বাধা কোথায়? যদি পারতো, তাহলে মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে একদেশ থেকে আরেক দেশে যেতো না। এই প্রশ্নে নীতিগতভাবে সামান্যতম ছাড় দিতেও আমি রাজী নই।

আমি তারপরও ভারত আর বাংলাদেশের মাঝেই আলোচনা সীমিত রাখছি। এই দু,টো দেশ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সে দেশের নাগরিকদের জান, মালের নিশ্চয়তা প্রদান করবে তো দুরের কথা, এরা ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের গদিকে শক্ত করার হাতিয়ার হিসেবে। তাতে সাধারণ মানুষের মাঝে যে লুকোনো ধর্মান্ধতা, তা চাগিয়ে দেয়া হয় আরো বেশী করে। শাষনতন্ত্রে যাই থাকুক না কেন, নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থ করাই এসব রাষ্ট্রচালকদের প্রধান উদ্দেশ্য। তা যদি না হতো, তাহলে ভারতে শিবসেনা, বিজেপি..ইত্যাদি ও বাংলাদেশে জামাত, হরকতে জিহাদ জাতীয় দলের জন্মই হতো না। আমার মতে এধরণের রাজনৈতিক দলগুলো ভারত, বাংলাদেশ বা বিশ্বের কোথাও জন্মেরই অধিকার রাখে না। আমাদের সামনে সেরকম বিশ্ব নেই, সত্যি কথা। তবে নজরটি সেই উচুতেই থাকা দরকার, যাতে তার সামান্য হলেও অর্জন করা যায়।

আমাদের বাড়িতে নব্বইয়ের দশকে কাজ করতে আসতেন এক মহিলা। উনি ঊননব্বইএর সময়ে এদেশে আসেন। তার তখন একাধিক শাড়িও ছিল না, একরকম একবস্ত্রে এদেশে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওদেশেও(পটুয়াখালি) তাদের কিছু ছিল না, যা ছিল তাও বন্যায় ধুয়েমুছে গিয়েছিল। তার পরিবারের ৪-৫ জন ছেলেমেয়ে সবাই ঘরে ঘরে কাজ করত। সেই তারাই এখন খেটেখুটে এখানে রীতিমত বড় বাড়িঘর করে ফেলেছে আর একের পর এক আত্মীয়কে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসছে। এর মধ্যে আমি তো কোথাও অস্বাভাবিক কিছু দেখি না ... তবে তারা যদি ওই একই খাটাখাটনি দেশে বসেই করতেন তাহলে দেশে কি উন্নতি হত না?

আবার বর্ধমানের এক প্রখ্যাত ব্যবসায়ীর পরিবার এসেছেন ধামরাই থেকে। ধামরাইতে তাদের বিশাল বাড়ি - এখনও আছে। তারা চলে এসছেন শুধু বাড়িতে কিছু লোকে গরুর হাড় ফেলে দিয়ে যেত বলে। বাংলাদেশের সমস্যা কি এটা? আমার তো মনে পড়ে অষ্টাদশ/ঊনবিংশ শতকে ইয়ং বেঙ্গল নামে একদল এই একই কাজ কোলকাতাতেই করে বেড়াত।

উপরে কথাগুলোতে আমার ভয়ানক আপত্তি রয়েছে। যারা একটি বিষয়ে, বা সমস্যার কাছাকাছি না গিয়ে উপর থেকে এক পলক তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, এই কথাগুলোতে অনেকটা তারই ধরণ লুকোনো। শুধুমাত্র আপনার কথা বলছি না, আমরা বেশীরভাগ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরাই আমাদের উপরে উপরে দেখার ধরনের প্রভাবে একই দোষে দূষ্ট।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

দিগন্ত এর ছবি

আমার মনে হয় আমি খুব একটা ভাল কিছু বোঝাতে পারি নি ব্যাপারটা। দুটো পয়েন্টে সংক্ষেপে বলি -
১) ধর্ম ছাড়াও অন্য অনেক কারণেই অনেকে আসে।
২) যারা ধর্মের সমস্যার কারণে আসে, তাদের ক্ষেত্রেও সমাজের খুব একটা কিছু করার নেই। সমাজ এভাবেই বহুকালে তৈরী হয়েছে। সমাজ দু'দিনে কেন পরিবর্তন হয় নি সেটা বরং আপনার প্রশ্ন হতে পারে।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

তীরন্দাজ এর ছবি

১) অবশ্যই ধর্মের কারণ ছাড়া অনেকেই আসে। নইলে আমি নিজে জার্মানীতে প্রবাসী হলাম কেন? এটা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার, নিজ ক্ষমতায় নিজস্ব বাসযোগ্য পরিমন্ডল গড়ে তোলা। রাষ্ট্র ও সমাজ বাগড়া দেয় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই। আমরা তার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করি।

২) যারা ধর্মের সমস্যার কারণে আসে, তাদের জন্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের অবশ্যই করণীয় রয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রই তো এক্ষেত্রে প্রধান অপরাধী। ওদের করণীয় না থাকবে তো কাদের থাকবে? আমরা কিছুই করি না বা করতে পারি না। বহুকাল ধরে চলে আসছে বলে মেনে নিই সব। নিজেও হয়তো অনেকসময় তাই করি। কিন্তু একটি অপরাধবোধ এ হতাশা কাজ করে, এবং এই অপরাধবোধ ও হতাশার শাস্তি আমাদের প্রাপ্য।

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ লিখেছেন ভাই। কী যে বলব? আমি গ্রামরে মানুষ গ্রামেই বড় হয়েছি, বাঁচতে শিখেছি। আমাদের গ্রামের পাশেই ছিলো হিন্দুপাড়া। শীলদের বাড়ি। ওরা আমাদের চুল কেটে দিতো, সেই ছোটবেলা থেকেই। এক সময় দেখেছি, গ্রামের প্রভাবশালীরা নানা সময় ওদেরকে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছে। আবার গ্রামের এক অংশ আমার ওদের পক্ষ নিয়েও লড়াই করেছে। তবে তারা হাতে গোনা কয়েকজন। দুর্জনের দল পৃথিবীতে সব সময়ই ভারী ছিলো।

পরশ পাথর

পুতুল এর ছবি

দিগন্ত বলেছেন :
২) "যারা ধর্মের সমস্যার কারণে আসে, তাদের ক্ষেত্রেও সমাজের খুব একটা কিছু করার নেই। সমাজ এভাবেই বহুকালে তৈরী হয়েছে। সমাজ দু'দিনে কেন পরিবর্তন হয় নি সেটা বরং আপনার প্রশ্ন হতে পারে।"

"সমাজ দু'দিনে কেন পরিবর্তন হয় নি সেটা বরং আপনার প্রশ্ন হতে পারে।"

ভাই দিগন্ত, আমি সমাজ বিজ্ঞানী নই। সমাজ কেন দু'দিনে পরিবর্তণ হয়না তা আমার জানা নেই।

তবে, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী খোলা তলায়ার নিয়ে ঘোড়ায় চরিয়া ভারতে আশার পর আমরা মুসলমান আর হিন্দু দুই দলে ভাগ হয়ে যাই। তৎকালীন সমাজের খুব একটা কিছু করার ছিলনা।
জাহাজে করে ইউরুপের বনিকেরা বানিজ্য করতে গিয়ে আমাদের গোলাম বানিয়ে রাখল দুইশ বছর, আমাদের সমাজের করার কিছু ছিলনা।
হিন্দু মাসলমানের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে এক হপ্তার দাঙ্গায় খালি কলিকাতা শহরে নাকী ৫ লাখ মানুষ মরছে, সেখানেও আমাদের সমাজের কিছু করার ছিলনা।

তসলিমা নাসরীন খুব লঘু ভাবের সংখ্যালঘু নির্জাতনের কাহিণী বলছে লজ্জা বইয়ে। সে এখন দেশ ছাড়া, এখানে সমাজের কিছু করার নেই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশে হিন্দুছিল ২০ পার্সেন্টের কাছাকাছি, এখন ১০ আছে কিনা সন্দেহ! সমাজের কিছু করার নাই।

একদিনে সমাজ বদলায় না, তয় সমাজ বদল শুরু হইছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পার হয়নাই, ১০ পার্সেন্ট হিন্দু কমছে। আর ২০ বছরে হেই ১০ পার্সেন্টও থাকবে না। সমাজ একদিনে বদল হয়না। আর এই বদলের পিছে সমাজের লোকের কিছুই করার থাকে না। শুধু দর্শকের ভূমিকা ছাড়া।

তীরন্দাজ এসব বুঝেনা। খালি খালি বেহুদা পোষ্ট দেয়। কিন্তু আপনি আমি ঠিকই বুঝি।

"যারা ধর্মের সমস্যার কারণে আসে, তাদের ক্ষেত্রেও সমাজের খুব একটা কিছু করার নেই। সমাজ এভাবেই বহুকালে তৈরী হয়েছে।"

কিন্তু বহুকালে সমাজটারে এইভাবে বানাইল কে? হেই কারিগরের নামডা কি দিগন্ত ভাই? কদ্দুর কন চাইন হুনি!

পুষ্ট দিয়া আমাগরে ক্ষেপানের লাইগ্যা তীরুদারে একটা ৫ তারা।

**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।