অতীতের সাথে পত্রালাপ (চার) – গাণিতিক সময়

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শনি, ১৫/১২/২০১২ - ২:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রিয় বন্ধু রতিকান্ত,
এবার তোমাকে লিখতে অনেকটা দেরী করে ফেললাম। ছয়শ বছর পরের পৃথিবীতে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যে এই বিরতির দরকার ছিল হয়তো। এর মাঝে অনেক ঘটনা অকস্মাৎ ঘটেছে, অনেক কিছু নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ীই করতে পেরেছি। এখানকার রীতিনীতিও কিছুটা বুঝতে শিখেছি। তারপরও বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

অতি সাধারণ একটি সমস্যাই খুব ভুগিয়েছে। তুমি তো জান, আগে আমাদের পৃথিবীতে ছিল চারপাশে অবারিত মাঠ আর জঙ্গল। মল মূত্র ত্যাগ করা হতো কোনো গাছের আড়ালে মাঠে বসে। কারো সামনে পড়ার সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। এখনকার এই পৃথিবীতে চারিদিকে মানুষ আর মানুষ। নিঃশ্বাস নেবার এক চিলতে জায়গাও নেই। তেমনি এক জায়গা নিষ্ফল খুঁজে হন্যে হয়ে ফিরে আসি। অবশেষে দবিরকে সমস্যাটির কথা বলতে বাধ্য হই। সে আমাকে এমনি এক জায়গায় নিয়ে যায়, যেটি আক্ষরিক অর্থেই ভয়াবহ। একটি অতি নোংরা ডোবার আবর্জনায় চারটি লম্বা কাঠ পুঁতে তার উপর একটি ছাদহীন ছোট্ট ঘর। একটি সরু নড়বরে কাঠের পাটাতন বেয়ে সে ঘরে উঠতে হয়। দবিরের কাছে শুনি, শিশুরা বসে সে পাটাতনে। ফলতঃ সেটিও শুকনো বিষ্ঠায় ঢাকা। ঘরটির ভেতরে আড়াআড়ি কাঠের উপর আরও বেশী নড়বড়ে দুটো পাটাতন বসানো। সেখানে বসেই কাজ সমাধা করতে হয়। কাঠের পাটাতন বেয়ে ওঠার সময়েই কাঁপতে থাকে পুরোটা। ঘরের ভেতর ঢোকা অবধি সে কাঁপুনি বাড়তেই থাকে। যাহোক, আমি আমার কর্ম সমাধা করলাম, কি ভাবে করলাম, সেটি বলে তোমাকে বিব্রত করতে চাই না আর।

দবির বলেছে, একটি মোহর বেঁচেই আমি অনেক টাকার মালিক। টাকা জিনিসটা কী, সেটি বুঝিয়ে বলা দরকার তোমাকে। আগের চিঠিতে এক বান্ডিল কাগজের কথা বলেছিলাম, যেটি মাটির নীচে লুকিয়ে রাখে দবির। তুমি ভীষণ অবাক হবে শুনে, এর নামই টাকা ও এখনকার সময়ে এই কাগজ দিয়েই বিভিন্ন দ্রব্যের আদান প্রদান হয়। আমি নিজেও খুব অবাক হয়েছি ও এমনকি বিশ্বাসও করতে চাইনি। কিন্তু দবির আমাকে নিয়ে একটি দোকানে যায় ও তথাকথিত টাকার বিনিময়ে খাবার দাবার কেনে। এসব কেনার পরও তামার কিছু মুদ্রা ফেরত দেয় দোকানী। দেখে আমিও বিশ্বাস করতে বাধ্য হই।

এই কদিনে দবিরের সাথে কথার আদান প্রদানে অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা পরস্পর পরস্পরের কথা অনেক সহজে বুঝতে পারি। এই অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ছোট্ট ঘরে আমার অবস্থা ও বিশেষ করে প্রকৃতির ডাক সম্পাদনে আমার ভয়াবহ সমস্যা বুঝে দবির একটি বাড়ি ভাড়া নিতে বলে। রাজি হয়ে দবিরকেও আমার সাথে আসতে বলি। এখানে এই মানুষটিই আমার সবচাইতে কাছের ও নতুন পৃথিবীতে পদচারনায় তার সাহায্য আমার খুবই দরকার। দবির রাজি হয়, তবে বস্তিতে নিজের ঘরটিও রাখতে চায়। এর কারণ যে গোলাপবানু, সেটি আমার জানা। তবে গোলাপবানুর কথা পরে বলব তোমাকে।

আমাদের নতুন বাড়িতে তিনটি ঘর। দুটো ঘর আমদের দুজনের জন্যে ও একটি বসার ঘর। আলাদা একটি রান্নাঘরও আছে। মল-মূত্র ত্যাগের জন্যে আলাদা একটি ছোট ঘর, সেখানে স্নানের বন্দোবস্তও রয়েছে। প্রথমে খুব ঘৃণা হয় আমার, যে দেয়ালের ভেতরে বাসস্থান, সেখানেই পায়খানা! দবির বলল, সমস্ত বর্জ্যই নল বেয়ে বাইরে চলে যায়, তারপরও ঘৃণার অনেকটা রয়েই যায়। এখন সেটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মানুষ কতো দ্রুত অভ্যাস পালটাতে পারে, নিজেকে দেখেই অবাক হই বারবার। আরও অবাক হয়েছি ঘরের বাতি দেখে। দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম দুজন দুজনের ঘরে। ঘুম ভেঙ্গে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার। দবির ঘরে এসে ঢুকতেই দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠে ঘর। হাজার টুকরোয় সূর্য একদিন ভাঙ্গবে যখন, তখনই ধ্বংস পৃথিবীর। এমন কথাই তো শুনে এসেছি এতদিন। আমার মনে হয় সেকথাই সত্য হতে যাচ্ছে আজ। ভয়ে চীৎকার করে উঠতেই দবির হেসে শান্ত করে আমায়। এটি যে বৈদ্যুতিক বাতি, সেটি বুঝিয়ে বলে। একটি বোতাম টিপে কয়েকবার জ্বালিয়ে নিভিয়ে দেখাল আমাকে। তার কথা সব না বুঝলেও বলার ভঙ্গি আমাকে শান্ত করতে পারল। মানুষ এতকিছু আবিষ্কার করেছে, যা তুমি আমি কল্পনাও করতে পারিনি। তবে ক্ষণিক আরামের বাইরে এসব আবিষ্কারের ফলাফল ভালো না মন্দ, সেটি বলার সময় এখনও আসে নি।

আজকাল বাতাসেই আগুন জ্বালায় মানুষ। শুকনো কাঠ ও ডালপালার খোঁজার দরকার পড়ে না। রান্নাঘরে রান্না করার সময় দবির কী যেন করে, দপ করে চুলোর উপরে নীলাভ আগুন জ্বলে ওঠে সাথে সাথেই। রান্না শেষ হওয়া অবধি বাতাসেই জ্বলতে থাকে সে আগুন। একটি কল ঘুরিয়ে জল আনা যায়। আগুনের উপর ধাতুর তৈরি ডেকচি বসিয়ে সে জলে রান্না সারে দবির। আমার মনে হয়, মানুষের অনেক আবিষ্কারের মাঝে এই আবিষ্কার একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। এসব দেখে অবাক হইনা আর। সামনে আরও দেখতে হবে, সেভাবেই মনকে তৈরি করে নিয়েছি।

এবার তোমাকে যে সব জিনিস নতুন করে চিনলাম, তার বিবরণ দিচ্ছি। রাস্তায় যে সব জন্তু দেখে ভয় পেয়েছিলাম, সেগুলো আসলে জন্তু নয়। এরা মানুষেরই আবিষ্কার, মোটরগাড়ি। প্রয়োজন বুঝে এদেরকে ছোটোবড়ো করে গড়া হয়েছে। একজন মানুষ এর ভেতরে বসে একে পথ দেখিয়ে চালিয়ে নিয়ে যায়। মানুষ ও মালামাল পরিবহনের জন্যে এখনকার সমাজে এটি অবশ্য জরুরী। তবে অনেক ধনী লোকের নিজস্ব মোটরগাড়ি আছে। গানবাজনা সম্পর্কে দবির যা বোঝাল আমায়, সেটি বোধগম্য হয়নি আপাততঃ। সে আমাকে উদাহরণ সহ বুঝিয়ে দেবে বলেছে। আরেকটা জিনিসের কথা বলল দবির। মানুষ একা একাই কথা বলে, বলে যে কথা তোমাকে বলেছি, সেটি ঠিক নয়। মোবাইল ফোন নামের একটি ছোট্ট যন্ত্র হাতে নিয়ে একজনের সাথে দূরের আরেকজন কথা বলতে পারে। শুনে খুবই আনন্দ হয় প্রথমে। ভাবলাম, তোমাকে একটি মোবাইল ফোন পাঠিয়ে পরস্পরের সাথে কথা বলতে পারব। কিন্তু একটু পরেই থাকে না সে আনন্দ আর। কারণ এই যন্ত্র অবস্থানগত দূরত্বকে অতিক্রম করলেও সময়গত দূরত্বের অতিক্রমে কার্যক্ষম নয়। তোমার সাথে আমার যোগাযোগের এই চিঠিই আজ অবধি একমাত্র মাধ্যম।

মানুষের এতো আবিষ্কারের পরও মনে হয় সময়কে অতিক্রম করার বিজ্ঞানে আমরাই এগিয়ে। তুমি আর আমি মিলে যে গাণিতিক রহস্যের সমাধান করে সময়কে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছি, সেটি এখনকার পৃথিবীকে কেউ পেরেছে কি না, এ নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। আমার এই ধারনার একটি কারণ বলছি তোমাকে। এখনকার মানুষকে খুব বস্তুবাদী মনে হয়। এদের প্রতিটি আবিষ্কারের বস্তুই নিজেদের আরাম আয়েশকে ঘিরে। দ্বিমুখী, বহুমুখী গতি নিয়ে কাজ করতে পারলেও একই দিকে সবসময় ধাবিত সময়কে নিয়ে কাজ করার পেছনে যতোটা আত্মিক শক্তি দরকার, এখনকার বস্তুবাদী মানুষের ভেতরে সেটি আছে কি না, এই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আমার। তারপরও বলছি, এটি আমার একান্তই প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ। আমাকে আরও দেখতে হবে, আরও চিনতে হবে আর এই দেখা আর চেনার মাঝেই লুকিয়ে আছে অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর।

তোমার কুশল কামনা করি।
ইতি
তোমার বন্ধু রামকুমার

চলবে,,,

অতীতের সাথে পত্রালাপ (এক) - অবতরণ
অতীতের সাথে পত্রালাপ (দুই) – দবির মিয়া
অতীতের সাথে পত্রালাপ (তিন) – পথ আর ঘর


মন্তব্য

দিগন্ত বাহার এর ছবি

চলুক
আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন‌্যবাদ! ভালো থাকবেন।

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আগেরগুলো পড়া হয়নি। এতো দেখি একেবারে প্রাগৈতিহাসিক!
কেমন আছেন তীরুদা?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তীরন্দাজ এর ছবি

প্রাগৈতিহাসিক? কারা, আমরা না?‌ ছয়শ বছর আগের রামকুমারের সময়টি?

অনেক দিন পর সাড়া পেয়ে ভল লাগল। আগেরগুলো পড়া না থাকলে পড়ে নিন।

ভালো আছি। জানুয়ারির শেষে দেশে আসছি। হয়তো দেখা হবে বইমেলায়। আপনি ভালো তো?

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

অতিথি লেখক এর ছবি

মজা পাচ্ছি। চলুক।

ফারাসাত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।