আমাদের গ্যাছে যে দিন...

নিঘাত তিথি এর ছবি
লিখেছেন নিঘাত তিথি (তারিখ: মঙ্গল, ২৫/০৯/২০০৭ - ৮:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

বেলা ৯ টা। মেয়েরা দুজনেই বেরিয়ে গেছে বাসা থকে। সরকারী সাপ্তাহিক ছুটির বাড়তি দিনটায় আলম সাহেব একলা হয়ে খুব একটা "একাকী" জাতীয় কষ্ট আজ বোধ করছেন না। বরং মেয়েরা বাসায় থাকলে অতিরিক্ত যত্নআত্তির কারনে যা করতে পারতেন না আজ নির্বিঘ্নে তাই করতে পারবেন ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

দুইদিন ধরে গান শুনতে পারছিলেন না, সিডিটা নষ্টহয়েছে মনে হয়। ঠিক করতে দিতে হবে ভাবছিলেন তখন হঠাৎই পুরনো টুইনওয়ানটার কথা মনে পড়ে। মেয়েদের বলতেই..."আব্বু, ওইটার তো দি এন্ড হয়ে গেছে, খাটের নিচে ময়লার মধ্যে পড়ে আছে। আমরা কত ট্রাই করেছি ঠিক করার, কিছু হয় না। আমাদের 'চে বেশী বয়স ওইটার তুমিই না বলেছ? দাঁড়াও তোমাকে সিডিটা তাড়াতাড়ি ঠিক করে দিব। ওকে বাবা? "

আলম সাহেব সম্মত হয়েছিলেন, সিডিটাই ঠিক করতে হবে, এখন কি আর কেউ ক্যাসেটে গান শুনে? তবু আজ মেয়েরা না থাকায় হঠাৎ কি ভেবে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েদের ঘরে এলেন। খাটের দিকে তাকিয়ে ছেলেবেলার কোন কিছু চুরি করতে যাবার আগে যেমন একটু দ্বিধাজনিত লজ্জা লজ্জা হাসি হাসতেন, আজ অনেক দিন পরে তেমনি করে হাসলেন। তারপর এগুলেন কয়েক পা। পায়ে ব্যাথা, নিচু হতে কষ্ট হয়, তবু অনেকখানি ঝুঁকে খাটের নিচে খুঁজে খুঁজে অবশেষে বের করে আনলেন যা খুঁজছিলেন এতক্ষন ধরে। সেই অতি পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ার-- তাঁর, তাঁদের।

আলম সাহেব নিজেই ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করেন টুইনওয়ানটা। নিজের ঘরে এসে সিডিটা সরিয়ে সেখানে রাখেন। কাঁপা কাঁপা হাতে একটা ক্যাসেট ঢুকিয়ে "প্লে" তে চাপ দেন। বাজে না। রেডিও অন করেন, ঘরঘর শব্দ ছাড়া কার্যকরী কিছু শোনা যায় না সেখানেও। একটা মুহুর্ত কাটে, নীরবে। তারপর...নীরবতা অক্ষুন্ন থাকে, তার সাথে ঝরে পড়ে অশ্রু, আলম সাহেবের দুই চোখ বেয়ে। এক ঝটকায় ঝাপসা চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্মৃতি।

নতুন সংসার। বিয়ের বছরেই সেই সংসার আলো করে এলো ফুটফুটে দেবদূত। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরুনো বেসরকারী কলেজের শিক্ষক আলম সাহেব নিজের সাধ্য অনুযায়ী স্বর্গ সাজান, পরী-বৌ আর দেবশিশুকে নিয়ে । সংসারে কেবল খুঁটিনাটি প্রয়োজনীয় কিছু আসবাব আর হাঁড়ি-পাতিল ছাড়া আর কোন বাহুল্য জিনিস নেই। দিনচলতি কোন এক সময়ে পরী-বৌয়ের আবদার হয় একটা টিভি কেনার। আরো কিছুদিন অপেক্ষার পরে আলম সাহেব টিভি কেনার টাকাটা জমাতে পারেন। ঠিক হয় একটা ছোট্ট সাদাকালো টিভি কেনা হবে। পরী-বৌয়ের চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখে আলম সাহেবের মনটা ভরে যায়। একসাথে বের হন টিভি কেনার উদ্দেশ্যে। দোকানে গিয়ে দুজনে মিলে দেখতে দেখতে হঠাৎ বৌ বলে তার টিভি চাই না ! আলম সাহেব অবাক, বলে কি?! লজ্জা লজ্জামুখে সে বলে " আমাকে ওই টুইনওয়ানটা কিনে দিবে? আমি টিভি দেখে কি করব? তার 'চে সারাদিন গান শুনব আর কাজ করব। দুইটা তো একসাথে কেনা যাবে না, তুমি আমাকে টুইনওয়ানটাই কিনে দাও না !" আলম সাহেব আরো অনেকক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন বৌয়ের ব্যাগ্র মুখের দিকে। নিজের মনের না বলা ইচ্ছাটা এমন করে মিলে গেলো!

আলম সাহেবর ঘরে হাঁড়ি-পাতিল,খাট-টেবিলের সাথে আরো একটি জিনিস যোগ হলো সেই থেকে আর গান-পাগল দুজন মানুষের ঘরে রাত-দিন বাজতে লাগলো গান। এরপর কেটে যেতে লাগলো দিন, সেই সংসারে যোগ হলো আরো কত কি! সেই সাথে আরো দুজন নতুন অতিথি। আরো দিন যায়.....একের পর এক...বছর পার হয়ে হয়ে ৩২ টি বছর ! একসাথে দুইজন....গানে গানে....।

আলম সাহেব পাশে রাখা গামছা দিয়ে চোখের জল মুছেন, আবার ভিজে ওঠে, আবার মোছেন। পুরো ঘরটায় চোখ ঘুরেফিরে তাঁর... এক বছর হলো প্রায়। এখনও আলনায় শাড়িগুলো তেমনি করে রেখেছেন ঠিক যেমনটা সে রেখেছিলো...জুতার স্ট্যান্ডে এখনও সারি সারি সখের জুতা তেমনি করে সাজানো। খানিক আগেই রোজকার মত সব ঝেড়েমুছে রেখেছেন নিজ হাতে। সব রয়ে গেলো...আরো কত কিছু এলো উপলক্ষ্য ধরে ধরে...এমনকি এই না বাজতে চাওয়া টুইনওয়ানটাও, কেবল সেই ফাঁকি দিলো আমাকে?

আরো দুদিন পরের বিকাল। ছোট মেয়ে ঘরে ফিরে দেখে বাবা গান শুনছে, সেই পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ারে ।

"বাবা! এটা কি করে করলে? এটা বাজলো?? ইম্পসিবল ব্যাপার !"

বাবা মিটিমিটি হাসেন, "হয়ে গেলো রে মা কেমনে যেন! দুই দিন ধরে হেডটা মুছামুছি করতে করতে মনে হয়... অনেক দিন ধরে ময়লা জমে ছিলো তো...আবার দ্যাখ রেডিওর সব স্টেশনও ধরছে। বিবিসি শুনতে পারব আবার রেগুলার।"

"কিন্তু বাবা আমরাও তো ওই হেড কত মুছে টুছে ট্রাই...."

মেয়ের কথা আটকে যায় বাবার হাসিমাখা মুখ দেখে।

আলম সাহেবের ঘরে এখন জংধরা ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজে, পাশে ঠিক করে রাখা সিডি আর মেয়েদের পিসির গানের তুমুল শব্দকে পরিহাস করেই যেন।

-----------------------------------------------------------

অনেক পুরনো লেখা। উৎসর্গ করেছিলাম বাবাকে। আজ বাবার কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। আবার এখানে দিলাম, বাবাকে উৎসর্গ করেই।


মন্তব্য

সৌরভ এর ছবি

এইসব লেখা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি।
কেন জানিনা।
এ অনুভূতির ব্যাখ্যা নেই। এ অনুভূতিকে আমি ব্যাখ্যা করতে পারি না।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

দ্রোহী এর ছবি

গল্পটা পড়ে কেন জানি বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।


কি মাঝি? ডরাইলা?

হিমু এর ছবি
আরিফ জেবতিক এর ছবি

-----------------------------------
ঢাকার ভূমে ফিরেছে একাত্তর/প্রস্তুতি নে,সময় হলো তোর..

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কি করলে এটা?
মনটাই খারাপ হয়ে গেলো । চলে যাওয়া বাবার জন্য, একা হয়ে যাওয়া মায়ের জন্য নাকি আমি ও একদিন এরকম একাকী হয়ে যাবো কিংবা কাউকে খুব একা করে যাবো-সেই ভাবনাতে?
জানিনা । কিন্তু খুব গভীরে ছুঁয়ে গেলো তিথি ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

আহা সেইসব স্মৃতিগন্ধভরা হারিয়ে যাওয়া দিন....

-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

ধ্রুব হাসান এর ছবি

সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হলো যখন বোঝা উচিত ছিল তাদের,বুঝতে চাইনি,নিজেকে নিয়েই ছিলাম যেন সারাটাক্ষন। আর আজ বুঝি সব,কিন্তু কি লাভ বুঝে? ঠিক একি ব্যাপারটাইতো ঘটবে আমার বেলায়ও...হা হা...একটা তামাশা আর কি! তবে বাবা যে কি...একটা হু হু করা একটা ব্যাপার...থাক, ভালো থাকুন।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এসব দিন যায় নাকি!
আমার তো মনে হয় ঘুরে ফিরে আসে, বারবার।

নিঘাত তিথি এর ছবি

মন খারাপ করে দেবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি না। এইসব মন খারাপের মধ্যেও কেমন যেন একটা ভালোলাগা আছে মনে হয়।

সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

এই পোস্টটা দেখে নস্টালজিক হয়ে গেলাম ,,,দুইভাবেই ,,,
অনেক আগে এই পোস্টে 'জিসকো বিবি মোটি' কে 'ডিস্কো বিবি মোটি' লিখেছিলাম চোখ টিপি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

নিঘাত তিথি এর ছবি

হি হি, মনে আছে আপনার সেইটা? আপনি, রাসেল ভাই আর হযু ভাই মিলে পুরা অমিতাভ বচচন শো শুরু করে দিয়েছিলেন।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

শেখ জলিল এর ছবি

মনে পড়ে যায় সব হারানো মানুষ
বিষাদের মেঘে ওড়ে স্মৃতির ফানুষ!

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক [ মন খারাপ ]

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।