ইতিহাসবৃত্ত

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/১১/২০০৮ - ১০:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ওরাক(cont.)

জোর করে ভাবনা থামিয়ে রুশা পড়ে চললো ওরাকের নোটবই-
"ফিনিক্সে প্রথমে আমার কাজকর্ম ছিলো সাধারণ, অনিয়মিত। সর্বক্ষণের কাজকর্ম কিছু ছিলো না। কখনো কখনো প্রয়োজন পড়লে হয়তো প্রকৌশলীদের সাহায্য করা বা সার্ভিসিং এর কোনো কাজ থাকলে তা করা। বেশীরভাগ সময় এইসব প্রয়োজন পড়তো আন্ত:-গ্যালাক্টিক ওয়র্পড্রাইভের সময়। যদিও ফিনিক্সের ভ্রমণপথ প্রি-প্রোগ্রামড, তবু স্পেসটাইমের ফাঁক দিয়ে ঝাঁপের সময় অতিরিক্ত কিছু প্রস্তুতির দরকার হতো। তো, সেইসব সময়ে প্রকৌশলী রোবটদের সাহায্য করতে হতো। তখন আমি সাময়িকভাবে বিশ্রাম ত্যাগ করে কাজে মেতে উঠতে পারতাম। কিন্তু তারপরে আবার যে কে সেই। কাজ নেই,কাজ নেই। শুধু নিশ্চল বসে থাকা অপেক্ষা করে। কি যে কষ্টের সেইসব সময়গুলো! সময় যেন কাটতেই চাইতো না।

এই প্রায় নিষ্ক্রিয়য় অবস্থায় চুপ করে বসে থাকার সময় শুধু একদম ভেতরের একটা ক্ষুদ্র নিউক্লিয় শক্তি-উত্‌স সক্রিয় থাকতো। মাইক্রো-ফিউশনের চারটে ইউনিটের মধ্যে মাত্র একটা চালু, বাকী তিনটে বন্ধ। সেই একটা নাকি কখনো থামে না, থামলেই নাকি সব শেষ। এই "সব শেষ" কথাটার মানে আমি কোনোদিন বুঝতে পারিনি, শুধু একটা শিরশিরে ভয় ঝিনঝিন করতে থাকতো কথাটার মধ্যে। কিজানি হয়তো তাও আমার কল্পনা!"

এইখানে এসে আবার রুশা থামে, সে ভাবে সে নিজে কি বুঝতে পারে "সব শেষ" কথাটার মানে কি? ডিসম্যান্টল করে ফেলা মানে শেষ, কিন্তু তার পরেও থেকে যায় মেমরি কিউব, সেইগুলোও যদি ইরেজ করা হয়, তাহলেও হয়তো কোথাও থেকে যায় কিছু। যেমন রয়ে গেছে ওরাকের নোটবই, সত্যিই কি সবকিছু শেষ হয়?

ঝাপসা চোখ পরিষ্কার করে আবার রুশা পড়ে চলে- " অপেক্ষার সময়গুলো বড় দীর্ঘ লাগতো, একসময় কেমন একঘেয়ে লাগতে শুরু করলো যদিও আমার তা লাগা মোটেও উচিত ছিলো না। কিন্তু আমার তো অনেককিছুই অনুচিত। প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ ছিলো যে আমার কলকব্জায় কোনো বিরাট কিছু গন্ডগোল আছে যা কিনা কেউ ধরতে পারে নি। সেই গন্ডগোলের ফলেই আমার নানা উদ্ভট অনুভবের ব্যারাম! অনুচিত সব ভয়ভাবনা এসে থানা গেড়েছে আমার মধ্যে! আমি বিশেষজ্ঞ রোবটদের কাছে গিয়ে থরো চেকাপ করালাম, তারা সবকিছু খুঁজেপেতে দেখে রায় দিলো সব ঠিকঠাক। অথচ আমার অস্বস্তি, ভয়, একঘেয়ে লাগা, বিরক্ত লাগা এসব রয়েই গেলো। আমি পরে খুঁজে খুঁজে এসব শব্দ জেনেছি, রোবটদের মধ্যে এসব শব্দের প্রচলনই তো নেই! মানুষের অভিধানে এসব আছে, কারণ এইসব নিতান্ত ইন-এফিশিয়েন্ট আর ভেজা-ভেজা ব্যাপারগুলো মানুষেরই একচেটিয়া অধিকারে। এইসব দোষই নাকি মহত্‌ গুণ হয়ে দেখা দেয় মানুষের ক্ষেত্রে,কারণ তারা স্রষ্টা, নতুন পথের সন্ধান তারা দিতে পারে। তাই এইসব নেসেসারি ইভিল তারা বহন করে। তা হবে, আমি আর কিকরে তা জানবো? আমি মেটালরোবট, আমার জীবনে এসব অহেতুক বোঝামাত্র। আমার ক্ষীণ একটা সন্দেহ আছে পালিমার রোবটেরা হয়তো এসব কিছু কিছু অনুভব করে কিন্তু কাউকে বলে না। ওদের বুদ্ধিমত্তা আমাদের থেকে অনেক উঁচু, হয়তো তারাও স্রষ্টা, হয়তো তারাও নতুন পথ দেখতে পায়! " আবার রুশার মুখে ক্ষীণ হাসি দেখা দেয়, বাইরের থেকে কিছু বুঝতে পারা কত কঠিন! সে, পলিমার রোবট, সে কি স্রষ্টা? সে কি নতুন পথ দেখতে পায়? সে জানে,না, না,না। সে শুধু নিয়মমালা পালন করে। অথচ ওরাক ভাবতো তারা কত জানে, কত বোঝে!

"এইসব অপেক্ষার সময়গুলো ক্রমে ক্রমে আরো বেড়ে গেলো। আমার পক্ষে আরো অসহ্য হয়ে উঠলো সব। আন্ত:-গ্যালাক্টিক ওয়র্পড্রাইভও কমে গেছিলো অনেক, তখন মানবশিশুদের তৈরী করা শুরু হয়ে গেছে- চিকিত্‌সক রোবটদের ব্যস্ততা তুঙ্গে। ন্যানি রোবটদের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। ওদের কাজের ব্যস্ততা দেখে ঈর্ষা হতো। এও এক অচেনা অনুভব, কেমন একটা খোঁচা লাগার মতন,কিন্তু মেটাল নেইল নেই, স্পার্ক নেই, কিছু নেই, তাও খোঁচা। রহস্যময়। আমি জানি আমার উচিত ছিলো আবার চেকাপ করানো, কিন্তু আমি যাই নি। জেনেশুনে সেই আমার প্রথম নিয়মলঙ্ঘন। " রুশা কেঁপে ওঠে,নিয়মলঙ্ঘন করা তাহলে সম্ভব? সে ঠোঁট কামড়ায়।ভাবতে চেষ্টা করে ওরাককে দেখে তার কখনো অন্যরকম কিছু মনে হতো কিনা! না, সবসময় ওরাককে সাধারণ নিয়মবদ্ধ বলেই মনে হয়েছে! কোনো অস্বাভাবিক কিছু সে লক্ষ করেনি। তার পর্যবক্ষণ শক্তি ভালো, কেন তাহলে কিছু সে অনুমান করলো না?

আবার সে পড়তে থাকে-"একসময় আমি ডাইরি লেখার কথা ভাবতে শুরু করলাম। নিয়মে কোথাও বলা ছিলো না যে রোবট ডাইরি লিখতে পারবে না। আমি সেক্ষেত্রে কোনো নিয়ম ভাঙি নি। ডাইরি লিখতে লিখতেই আমি শিখতে থাকলাম অনেক কিছু। সাধারণ তথ্যভান্ডারে আমার অ্যাক্সেস ছিলো বলে বেশীরভাগ জিনিসই আমার পক্ষে জানা সহজ ছিলো। কিন্তু শুধু তথ্য জানা আর জিনিসটা আসলে বুঝতে পারা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার, তা তখনই বুঝতে শিখি।"

রুশার রিসিভারে ডাক আসে, সে তাকায়। নী ডাকছে। এখনই তাকে যেতে হবে সংরক্ষিত তথ্যের ঘরে, এখন অবশ্য নী'দের কাছে সবই অ্যাক্সেসিবল। তাদের বয়স সতেরো হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পরেই ফিনিক্স-১ পৌঁছবে গন্তব্য গ্রহে।

রুশা নোটবই বন্ধ করে গুছিয়ে রাখে, পরে বাকীটা পড়বে। এখন নী'র কাছে যেতে হবে, নী'র ডাক উপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না। রুশা নী'কে জানায় সে আসছে এখুনি।

(চলবে)


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

পড়ছি .........হাসি
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ ভাই কীর্তিনাশা।
এদিকে খবর দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। মুম্বাই। কি হচ্ছে এসব?
ভাই বোন বন্ধু পরিজনই তো কারুর না কারুর!
এইসব দেখে দূরের গ্যালাক্সির দিকে উড়ে যেতেই ইচ্ছা করে। মন খারাপ
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।