সময়ের উজানে

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বিষ্যুদ, ০২/০৪/২০০৯ - ৮:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


দিনের কড়া আলো গবাক্ষপথে মধুর হয়ে এসে পড়েছে আমাদের শীতলপাটিতে,অয়স্কান্ত চুপ উদাস হয়ে মেঝেতে বসে আছে হাঁটুমুড়ে, আমি শীতলপাটিতে বাবু হয়ে বসে চুপ করে বসে বসে শুনছি বাচক্ণবীর কথা৷ উনি ঋগ্বেদের নারী ঋষিদের রচিত ঋকগুলি সংকলন করেছেন, সেইসব ঋকে তাঁরা কি বলতে চেয়েছেন, মানবহদৃয়ের কি প্রার্থনা উঠে গেছে উর্ধলোকের দিকে সেইসব পংক্তির মধ্য দিয়ে, সেসব কথা বুঝিয়ে বলছিলেন৷ সূর্যা, অপালা, বিশ্ববারা, লোপামুদ্রা, যমী ... এনার কথা অদ্ভুত সুরেলা, যাদুর মতন৷ শুনতে শুনতে আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম মন্ত্রোচ্চারণরত মানুষগুলিকে, কোনো এক সুদূর সকালে৷

মিত্র বরুণ ইন্দ্র সূর্য জল মেঘ .... আশ্চর্য প্রার্থনামন্ত্র সব, কী অদ্ভুত সুরেলা,কী আশ্চর্য সচ্ছন্দ দৃঢ় অথচ কী কোমল! এইজন্যেই কি ইনি নারী ঋষিদের রচনাগুলি সংগ্রহ করেছেন? জলের মতন টলটলে বয়ে যাওয়া এইসব ঋক, পুরুষদের ঋকগুলি হয়তো পর্বতের মতন কঠিন, আকাশস্পর্শী কিন্তু স্থানু৷ তারই পাশ দিয়ে কুলে কুলে মন্ত্রকথা কইতে কইতে এগুলো চলে গেছে কাজলরেখা নদীর মতন, তরল কোমল বেগবতী৷

বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির স্তবগান, সূর্যকে চন্দ্রকে মেঘকে আকাশকে পার্সনিফাই করে তাঁদের জন্য রচিত সূক্ত৷ কিন্তু কোনো একটা গভীর কথা কোথাও আছে, অনধিকারী অব্রতচারী আমি ধরতে পারছি না৷ এটা কি কথোপকথন? কোনো এক সবের মধ্যে কোথাও কোনো যোগসূত্র বোঝানোর জন্য? নাকি কেবল কবিতাই শুধু? শব্দের ফুলঝুরি, পোয়েটিক লাইসেন্স নেওয়া বানানো কথামালা? নাকি রহস্যাকারে কোনো অন্য কথা ভেতরে বলে দেওয়া?

ভাবনায় পড়ে গেলাম৷ তিনহাজার বছর পরের আমরাও হয়তো এখনো একই উপাসনা করি, পদ্ধতিটা আলাদামাত্র৷ প্রাকৃতিক শক্তিকে জানার ও জেনে সেটাকে কাজে লাগাবার চেষ্টাই তো করছে সমস্ত বিজ্ঞান, তাই নয় কি? আমাদের অংকের আঁকিবুকিও তো সেসব না-চেনা মানুষের কাছে রহস্যবিদ্যাই মনে হবে!

এখন ঋষি বাক্ এর কথা বলছেন বাচকণবী,ইনি যে ঋক রচনা করেছেন সে অসাধারণ উচ্চমার্গীয়,যোগযুক্তা হয়ে ইনি বলছেন, সৃষ্টির শুরুতে আমি ছিলাম, আমি আকাশকে প্রসব করেছি, আমিই সেই৷ প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম৷

কথা শুনতে শুনতে আমি আবিষ্ট, উনি কথা থামালেও মন্ত্রগুলির সুরের রেশ কানে গুণ গুণ করে ... হঠাত্ আমি সম্বিত্ ফিরে পেয়ে ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম," বাচক্ণবী, যদি কিছু মনে না করেন, আপনি শুন:শেপের কথা বলতে পারবেন আমায়?"

উনি চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন প্রদীপের মতন জ্বলজ্বলে দুখানা চোখ মেলে৷ অত্যন্ত সতর্ক ও শক্ত গলায় বাচকণবী বললেন, "শুন:শেপের কথা কিকরে জানলে?"

আমি যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললাম,"জেনেছি এখানে আসার আগে এই কাল সম্পর্কে অনুসন্ধান করে৷ কিন্তু পুরানো মিথ-ইতিহাসে তো সবই মিশে থাকে, কোন্‌টা সত্যি হয়েছিলো কোন্টা রূপক অতদূর থেকে বোঝা যায় না৷ তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি৷"

"বুঝতে পারছি৷ কিন্তু আমাকেই বা কেন? স্বয়ং ঋষি দৈবরাতি আছেন,ওনাকে কেন জিজ্ঞাসা করোনি?"

"ওনাকে জিগিয়েছিলাম৷ উনি আপনার চেয়েও বেশী শক্ত হয়ে গেলেন৷ তাই আনকথা-বানকথা বুনে আমায় ব্যাপারটা থেকে ওনাকে সরাতে হলো৷ উনিও ওটা সিম্বলিক হতেও পারে বলে হাঁফ ছাড়লেন৷ কিন্তু আমার কৌতূহল যায় না,আর কাউকে ও তো জিজ্ঞাসা করা তো যাবে না, কেউ তো এইসময়ে নেই৷ সেই স্বার্থপর রাজা, সেই অদ্ভুত সন্তানবিক্রয়কারী বাপমা, সেই যুপে বাঁধা বালক, কালান্তক খড়্গ হাতে ঘাতক---কেউ তো নেই! কবেই তো তারা মিলিয়ে গেছে সেই পুরাতন রক্তসন্ধ্যাটির মতন৷ আপনি বলুন দেবী, যদি কোনো কিছু আপনার জানা থাকে৷"

উনি অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন চুপ করে, তারপর খুব আস্তে আস্তে কইলেন,"কি হবে তোমার শুনে? তোমার জানা গল্প আর আমার জানা গল্প এক হোক, ভিন্ন হোক, দুইয়ের কাছেই তো গল্প মাত্র৷ সত্যি সত্যি চেনা চোখে দেখা কানে শোনা হাতে ছোঁয়া তো আমারও নয়! তবে আমার গল্প কেন বেশী বিশ্বাসযোগ্য হবে?" উনি হাসছেন, কিন্তু তাতে এখন তাতে আর আগুন-আভা নেই,অশ্রুজলের মতন সে হাসি টলটল করছে৷

ডানহাত তুলে চোখ মুছতে মুছতে উনি বললেন, "সে বলেছিলো, অবাধমানি জীবসে৷ আমাদের মুক্ত হয়ে বাঁচতে দাও৷ খুলে দাও সব পাশগুলি৷ এটা কি সকলের ক্ষেত্রেই সত্য না? রূপক কি রূপক শুধু? ওর মা,ওর মা ... ওর মা বলেছিলো এইটাকে দিয়ে দাও, ছোটোটাকে দেবো না, এইটাকে দিয়ে দাও ... এইটাকে বলি দিক ওরা৷ ও কাঁদছিলো, খড়গ হাতে ঘাতক থেমে গেলো, বললো "আমার ঘরেও ছেলেপুলে আছে, পারবো না এর গলা কাটতে৷" তখন ... তখন ... ও: কী ভয়ংকর! তখন ভীড়ের থেকে ওর বাবা এসে বললো আরো অর্থ পেলে সে নিজেই ছেলেকে বলি দিতে পারে৷" এইবারে কান্নায় স্বর ডুবে গেলো, আমি অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে উপবিষ্ট ওঁর মৌঞ্জীমেখলার কাছে নত হয়ে বললাম, "বলতে হবে না৷ ওসব বলতে হবে না ৷ একদম কিচ্ছু বলতে হবে না আপনার৷ আমি খুব দু:খিত৷ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি৷"

উনি কাপড়ের প্রান্ত দিয়ে জলেভেজা মুখ মুছতে মুছতে বললেন,"না,না, ঠিক আছে৷ঠিক আছে৷ সত্যি তো তুমি তো জানতে না৷"

"আর, শেষ পর্যন্ত নিশ্চয় বলি দেয় নি,গল্পে তো তাই বলে, না?"

"না,তা দেয় নি৷ কৌশিক তো ওকে বরুণমন্ত্র শিখিয়ে দিলেন কিনা! স্বয়ং বরুণ এসে ওকে মুক্ত করে দিলেন তারপরে৷"

বৃষ্টির পরে রোদ্দুরের মতন এখন ঝলমল করছে বাচকণবীর মুখ, ঐ যে যখন শরতের নীল আকাশ আরো নীল হয়ে যায়,দ্রুত মেঘের পালকগুলি উড়ে উড়ে সরে যেতে থাকে, ঠিক সেইরকম৷ আমি বললাম,"দেবী,আপনি তাহলে জনকের যজ্ঞসভার গল্প বলুন৷ সেতো আপনার চোখে দেখা হাতে ছোঁয়া ঘটনা৷"

"আচ্ছা, সময়ভ্রমণ যদি করতেই পারো,তবে নিজেই কেন সেখানে চলে যাচ্ছো না? সোজাসুজি গিয়ে দ্যাখো কি হয়েছিলো৷" উনি হাসছেন৷

আমিও হাসলাম,"সে দু:খের কথা আর বলেন কেন৷ অনেক ঝামেলা আছে৷ আমাদের যন্ত্র একদম রুডিমেন্টারি৷ অত নিঁখুত করে ওভাবে যাওয়া যায় না৷"

"সত্যি সত্যি যে সময়ভ্রমণ করছো, তাই বা এত নিশ্চিত্ হচ্ছো কিকরে? হয়তো এ তোমার স্বপ্নমাত্র৷ প্রমাণ কিকরে করবে?"

"না না, প্রমাণ তো করবো না!!! আমি তো এমনি-এমনি ঘুরছি৷ কি উদ্দেশ্যে ঘোরাচ্ছেন উনি, মানে যিনি যন্ত্র চালিয়ে আমাকে ওধার থেকে পাঠিয়েছেন, ওসব প্রমাণ ট্রমান তাঁর ব্যাপার৷ সত্য হোক আর স্বপ্ন হোক,আমার লাভ বৈ ক্ষতি কোথায়?"

উনি এবারে জোরে হেসে উঠলেন,"বাপরে, কিসব যুক্তি!"

ভরপুর মধ্যাহ্নভোজের পরে আমরা একটু বিশ্রাম করলাম পাঠকক্ষেই৷ একটু ঘুমানোর পরেই উঠে পড়ে ওনাকে ঘাড়ে নাড়া দিয়ে তুলে দিলাম কারণ উনি বলেছিলেন আমি জাগলেই ওনাকে জাগিয়ে দিতে৷ আমি ওনাকে জাগিয়েই দিব্যি হাত বাড়িয়ে ওনাকে বালিশের পাশে খুলে রাখা হেডফোন আর মাইক্রো কানে লাগিয়ে দিলাম৷উনি হকচকিয়ে গেছিলেন প্রথমে, দ্রুত সামলে নিলেন৷

অয়স্কান্ত ঘরের কোণ থেকে হেঁটে এসে আমাদের বাও করে বললো, "নোমোস্কার, ক্যামোন আছেন?"

আমরা দুজনেই হাসছি,আমি বললাম,"অয়স্কান্ত,যাও না, ঘুরেঘেরে আশ্রমটা দ্যাখো না৷ এই দিদিমণির সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ কথা কইতে হবে৷তুমি শুধু শুধু বোর হবে, তার চেয়ে যাও না, ঘোরো না৷"

অয়স্কান্ত মুখ ব্যাজার করে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো,তারপরে আস্তে আস্তে দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে চুপ করে বারান্দাতে বসে রইলো৷ কিছুতেই ও যাবে না এর থেকে বেশী দূরে৷

আমি বাচক্ণবীকে জিগালাম,"দেবী, তখন আপনি প্রমিস করেছেন জনকের বহুদক্ষিণ যজ্ঞের সভার ঐ তক্কোবিতক্কের কথা সব বলবেন৷ এখন বলুন৷"

"দ্যাখো ঋ, আমি যদি ঐ যজ্ঞসভার গপ্পো তোমায় বলি,সেটা কি আর নিরপেক্ষ হবে? নিশ্চয় নিজের অজান্তেই নিজেকে ডিফেন্ড করে করে বলবো৷ দৈবরাতি আলোচনায় থাকলে উনি মাঝে মাঝে ওনার ভার্সনটা দিতে পারতেন, সে অনেক সুবিধে হতো৷"

"কিন্তু আমাদের কি করার আছে? উনি নিজেই তো রাজী হলেন না থাকতে৷ পড়িমরি করে পালালেন৷"

বাচকণবী হেসে ফ্যালেন পড়িমরি করে দৈবরাতি দৌড়ে পালাচ্ছেন, পালাতে পালাতে পিছনে তাকিয়ে দেখছেন--- এইরকম একটা দৃশ্য কল্পনা করেই হয়তো৷ আমিও হাসতে থাকি, তারপরে বলি, " উনি ঐ যজ্ঞের আগে থেকেই আপনাকে চিনতেন, তাই না? "

"হ্যা, ঁচিনতেন৷ খুব একটা দেখাসাক্ষাত্ অবশ্য হয় নি, উনি খুব ব্যস্ত থাকতেন কাজকর্ম নিয়ে৷"

"হুঁ, তাতো এখনো থাকেন দেখলাম৷ এরই মধ্যে দিব্যি তো সংসারও করছেন, দিব্যি দুই দুইজন স্ত্রী ... "

"আসলে সংসার করা তো বারণ না! অনেক ঋষিই তো গৃহস্থ৷ চিরব্রহ্মচারীও অবশ্য অনেকে আছেন৷ যার যেমন অভিরুচি,যার যেমন পরিস্থিতি---সেই হিসাবেই সবাই চলেন৷ এই নিয়ে খুঁত ধরতে যাওয়া অর্থহীন৷"

"তা ঠিক৷ কিন্তু নানা কথায় খালি অন্যদিকে চলে যাচ্ছি আমরা৷ এইবারে আপনি জনকের সভার গল্প বলুন৷ সত্যি সত্যি আপনি এত এত প্রশ্ন করেছিলেন যে দৈবরাতি বলেছিলেন মুন্ডু খসিয়ে দেবেন?" হাসতে হাসতে আমি মুখে ওড়না চাপা দিয়ে থামাতে চেষ্টা করছি,পারছি না৷

ভুরু কুঁচকে ভদ্রমহিলা রাগতে চেষ্টা করে হাসির বন্যায় ভেসে গেলেন, কইলেন,"আসলে আমি ওকে ক্ষ্যাপাতে চেষ্টা করছিলাম৷ যাতে ক্ষেপে গিয়ে প্যাঁচে পড়ে যায়৷ কিন্তু ক্ষেপলো না, দিব্যি পয়েন্ট করে করে উত্তর দিয়ে গেলো৷ শেষে এসে বললো আর প্রশ্ন করলে নাকি আমার মাথা গুলিয়ে যাবে৷ আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলো, তাই নিজে না ক্ষেপে আমাকে ক্ষেপিয়ে দিলো৷ অথচ অল্পবয়সে চট করে রেগে যেত, একবার তো রেগে গিয়ে নিজের কেরিয়ারের কথাও না ভেবে সো-ও-ও-জা নিজের গুরুকে ত্যাগ করে আরেক গুরুর কাছে চলে গেলো৷ "

আমি অত্যন্ত কৌতূহলী,"সে আবার কি? কবে এসব হয়েছিলো? বলুন তো ডিটেলে৷"

বাচক্ণবী গুছিয়ে বসলেন গল্প বলার মুডে৷ তারপরে বললেন," দৈবরাতির গুরু তো ছিলেন ব্যাসদেবের শিষ্য বৈশম্পায়ন৷ তো, সেখানে উনি বেদবিদ্যা ইত্যাদি শিখছিলেন, কিন্তু তখনো শেখেন নি কিকরে লোককে না চটিয়ে দিয়েও ঠিক ঠিক কমুনিকেট করা যায়৷ একদিন কি একটা প্রায়শ্চিত্ত ব্রত শিষ্যদের উপরে চাপিয়ে দেয়ায় শিষ্যরা ক্ষেপে গিয়ে আড়ালে অসন্তোষ প্রকাশ করতে লাগলো দৈবরাতির কাছে৷ এদিকে সরাসরি গিয়ে যে বুঝিয়ে বলবে তাও পারে না, বৈশম্পায়নের খুব পাওয়ার আর ইনফ্লুয়েন্স৷ স্বয়ং রাজা যুধিষ্ঠিরের সভায় গিয়ে মহাভারত পড়েন,সোজা কথা? তো, বৈশম্পায়ন তো আবার নাকি কিরকম আত্মীয় ছিলো দৈবরাতির৷ কিরকম মামা না কী যেন৷ তাই ওনাকে এসে বন্ধু সতীর্থরা কয় এ কি কান্ড! আমাদের দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করাবে কেন? আমরা কি করেছি? উনিও ভাবলেন তাই তো! সত্যি কথা! এরা তো কিছু করেনি!"

উনি থামলেন, আমি রাখতে পারছি না কৌতূহল--"তারপরে? তারপরে বুঝি দৈবরাতি নিজেই পাওয়ারফুল বৈশম্পু-মামার কাছে গিয়ে হাজির সতীর্থদের হয়ে কথা কইতে!"

ভদ্রমহিলা কৃত্রিমরাগে চোখ পাকালেন," বৈশম্পুমামা আবার কি? শ্রদ্ধা করে কথা কও৷"

"সরি সরি, ভুল হয়ে গেছে৷ আসলে আমাদের সময়ে এরকম চিম্পু চিম্পু নাম অশ্রদ্ধার নয়, ভালোবাসার প্রকাশ৷ যাকে যত বেশী ভালোবাসি তাকে তত চিম্পু চিম্পু নাম দিই৷"

"অ, তাই কও৷ তবে ও বুড়ো খুব সুবিধার লোক ছিলো বলে মনে হয় না৷ যাকগে,আমার কি? এসব আবার না কেউ শোনে৷" বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে কইলেন, "হ্যা, দৈবরাতি গিয়ে বৈশম্প্যায়নকে ব্যাপারটা নিয়ে বললেন৷ বললেন ওরা যখন দু:খ পাচ্ছে, আমাকেই পুরো কাজটা করতে দিন না৷ দ্যাখো এত ভালো একটা প্রস্তাব শুনে কোথায় বুড়া ছেলেটাকে ভালো কইবে, তা না ক্ষেপে রেগে চটে একাকার! কইলেন তোমার এত অহংকার! তুমি একা করতে চাও এতজনের কাজ! দাও, যা বিদ্যা দিয়েছি ফিরিয়ে দাও৷ তারপরে চলে যাও৷"

"অ্যাঁ? সে কি কথা? বিদ্যা ফিরিয়ে দেবে কিকরে?"

"সেই তো কথা, কাউকে শিখিয়ে দিলেই বিদ্যা ফিরিয়ে দেওয়া হয় না, স্মৃতি থেকে ওটা ঘষে তুলে ফেলবে কিকরে?"

"তারপরে? তারপরে কি হলো দেবী?"

"তারপরে তুমুল গন্ডগোল! উনি সব বিদ্যা ফিরিয়ে দিয়ে আশ্রম ছেড়ে চলে গেলেন৷ ওনার ফিরিয়ে দেওয়া সেই বিদ্যা হলো তৈত্তিরীয় উপনিষদ, উনি নিজে কোনোদিন এগুলো আর মনে করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করে চলে গেলেন৷"

উনি চুপ করে বসে রইলেন, আমিও চুপ করে রইলাম, দেখছিলাম গবাক্ষের বাইরে বেলা ঢলে এসেছে, সেই সাদা তিত্তিরিপাখিগুলি কিচিরমিচির করে গাছে ফিরে আসছে৷ আমার মনে হলো সেই পর্তুগীজ পরিত্যক্ত নাবিকের গল্প-দ্বীপের পাখিরা ওর কথা শুনে শুনে বুলি শিখেছিলো "মা রী সি নী তুলুং সা আ, কাম হিয়ার হেল্প মী৷"

কি হয়েছিলো সেই নাবিকের? কোনো উদ্ধারকারী জাহাজ কি ওকে তুলে নিয়ে দেশে ফিরিয়ে দিয়েছিলো? অথবা সে ঐ দ্বীপেই মরে গেছিলো? দ্বীপের পাখিরা কিন্তু ভোলে নি, ওরা একই ভাবে বুলি আওড়াতো মা আ আ রী ঈ ঈ ঈ সী নী তু উ উ লুং সা আ আ আ কাম হিয়া-আ-আ-আর হেল্প মী ঈ ঈ ঈ৷ সমুদ্রদিগন্তে এমনি সন্ধ্যা নেমে আসতো, ঐ দিকচক্র থেকে আসতো কি কোনো জাহাজ?

"এরপরে উনি অরুণ ঋষির আশ্রমে যান, তাঁরা ছিলেন আদিত্যবাদী৷ অরুণ ঋষি অনেক খোলামেলা মনের লোক ছিলেন,অনেক উদারপন্থী৷ সেখানে দৈবরাতি নিজেই স্বাধীনভাবে তপস্যা গবেষণা করে জ্ঞানসংগ্রহ করেন৷ সেখানেই উনি অনেক অনেক নতুন জিনিস রচনা করেন৷ অনেক গল্প চলে আসছে সেসব নিয়ে৷ স্বয়ং আদিত্য মানে সূর্য নাকি ওনাকে এসে বিদ্যা প্রদান করে যান বাজী অর্থাত্ ঘোড়ার রূপ ধরে৷ দৈবরাতি নিজের নামের আগে তাই বাজসনেয় শব্দটি যোগ করেন আর রচনা করেন বাজসনেয় সংহিতা৷"

আমি হেসে বললাম,"ভাগ্যিস উনি তখন পড়িমড়ি করে চলে গেলেন৷ নইলে এখানে থাকলে এসব শুনলে ভারী সংকুচিত হয়ে যেতেন৷"

ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতে কইলেন,"এখানে উনি থাকলে এসব কথা উঠতেই দিতেন না৷ তার আগেই এমন সব কূটতর্ক উত্থাপন করতেন যে তার জট ছাড়াতেই দিনকাবাড় হয়ে ... এইরে! সন্ধ্যে নেমে গেলো৷ এসো ঋ, সন্ধ্যারতি দেখবে না?"

উনি উঠে পড়লেন, সঙ্গে সঙ্গে আমিও ৷


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

চমৎকার, প্রত্যেকবারের মতোই!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ওরে লেখারে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মূলত পাঠক এর ছবি

এমন চমৎকার লেখা স্রেফ ৩৭ বার পঠিত? সচলদের হ'লটা কী?

মূলত পাঠক এর ছবি

এমন চমৎকার লেখা স্রেফ ৩৭ বার পঠিত? সচলদের হ'লটা কী?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।