সময়ের উজানে

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: রবি, ০৫/০৪/২০০৯ - ৩:৪৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিরাট এক বনের মধ্যে পথ হারিয়ে এলোমেলো ঘুরছি, কেন যে অয়স্কান্ত সঙ্গে নেই বুঝতে পারছি না, কোথায় যাবো তাও বুঝতে পারছি না, এখানে এলাম কিকরে তারও কোনো স্মৃতি নেই, কী অদ্ভুত্ অবস্থা!!!

খানিকক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে হতাশ হয়ে এক অশ্বত্থ গাছের তলায় একখানা ঘাসলতায় আচ্ছন্ন পাথরের উপরে বসে পড়লাম৷কিছুই করার নেই বলে এলিয়ে শুয়ে পড়ে গাছটাকেই দেখতে লাগলাম৷ প্রথমে অশ্বত্থ গাছ মনে হচ্ছিলো, কিন্তু দেখতে দেখতে অবাক হয়ে গেলাম, গাছটার পাতাগুলো অন্য গাছেদের মতন একেবারেই নয়, পাতাগুলো কেমন কোমল ভাঁজে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ত্রিকোণীপাত্রের রূপ নিয়েছে! ডালপালা পাতা সব মিলে অদ্ভুত্ স্পাইরালের মতন গঠনের হয়ে উপরে উঠে গেছে, নীচ থেকে দেখতে দেখতে আমি অত্যন্ত অবাক৷ উঠে গিয়ে গাছটার কান্ড স্পর্শ করতেই কি যে হলো কিছু মনে নেই, জ্ঞান ফিরে দেখি বন টন কিছু নেই, খোলা একটা জায়গা, দূরে অনেক লোকের জটলা, নানা উত্তেজিত কলরব কানে এলো,নিশ্চয় খুব ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটছে৷

কাছে গিয়ে দেখি সে এক ঘোরতর কান্ড৷ একটা বাচ্চা ছেলেকে মাটিতে পোঁতা এক বিরাট কাঠের গুঁড়ির সঙ্গে দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে বাঁধা৷ বেচারা ছেলেটা কাঁদছে৷ তার চারপাশ ঘিরে অনেক লোকে লোকারণ্য, একদম কাছে আগুনের ধুনির মতন জ্বলছে, জটামাথায় ঋষি পুরোহিত সব মহা উত্তেজিত হয়ে ঘুরছে, অনেক গয়না টয়না পরা একজন বলশালী ইয়া ভুড়িয়ালা লোকও আছে, দেখে মনে হল রাজা৷

এত লোকের ব্যারিকেড ভেদ করে কিকরে যে কন্দ্রস্থলে চলে গেলাম কেজানে! মনেও হলো না ঠেলাঠেলি করলাম, যেন মেঘ ভেদ করে এলাম৷ হচ্ছেটা কি? অথচ কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে বলেও মনে হলো না৷ আরেকটু পরে বুঝলাম এই বাচ্চাটাকে বলি দেবে,একজন লাল পাগড়ী আর লাল কাপড় পরা লোক বিরাট খড়্গ নিয়ে ধার পরীক্ষা করছে৷

নানা মন্ত্র টন্ত্র পড়ে চলেছেন দাড়িয়ালা ঋষিরা, দুজন ঋষি আগুনে কিসব কাঠপাতাধুনোগুঁড়ো ঘী ইত্যাকার জিনিসপত্র ছুঁড়ে দিচ্ছেন, মোটাসোটা ভুড়িদার রাজা উত্তেজনায় টকটকে মুখে চেয়ে আছেন, রক্তবসন ঘাতক খড়্গ পরীক্ষা শেষ করে খুঁটিতে বাঁধা বলির দিকে এগিয়ে আসছে---সব ফেড আউট হয়ে গেলো, দড়িবাঁধা বাচ্চা ছেলেটার মুখে আটকে গেলো চোখ-জলে ধোয়া পদ্মের মতন সুন্দর ছেলেটার গোলাপী-গোলাপী মুখ, চোখের দীর্ঘ পক্ষ্মগুলোতে বৃষ্টিকণার মতন জলে লেগে আছে, অভিমানে ওর ঠোঁট ফোলা--ওকে বাঁচাবার কেউ নেই৷ এত এত সব পূর্ণবয়স্ক লোক এইটুকু একটা বাচ্চা ছেলেকে বলি দিতে যাচ্ছে, ছি ছি ছি!

ইচ্ছে হলো দৌড়ে গিয়ে ঘাতকের হাতের খড়্গটা কেড়ে নিয়ে দড়ির বাঁধন কেটে দিই বাচ্চাটার, তারপরে ওর হাত ধরে ছুটে পালিয়ে যাই৷ কিন্তু কিছু খেই পাচ্ছি না, আমি কি নিরবয়ব এখানে? কেউ আমার অস্তিত্ব অনুভব করছে বলে তো মনে হচ্ছে না৷ অবয়ব নেই, কিন্তু তবু আছে একটা তীব্র আর্ত আকাঙ্খা-ঐ বালকটিকে মৃত্যু থেকে বাঁচানোর জন্য ... চিত্কার করে থামাতে ইচ্ছে করছে সব,কিন্তু স্বরযন্ত্র কোথায়?

কিন্তু একটা চমকে ওঠা শব্দ জনতার মধ্য থেকে, ফিরে দেখি ঘাতক খড়গ ফেলে দিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়েছে নতজানু হয়ে .... আকাশের সবটুকু আলো মুছে দিয়ে তীব্র আঁধি ছুটে আসছে৷ দেখতে দেখতে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেলো৷

ঝড়ের তীব্র শব্দ ডুবিয়ে দিয়ে কে যেন চিত্কার করে উঠলো, কিছু দেখা যাচ্ছে না, ধুলায় বালিতে দুনিয়া অন্ধকার, অসংখ্য পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে, অসংখ্য শংখধ্বনি, আমি খুঁটির একদম কাছে বলে এখনো ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছি-ও চোখ বন্ধ করে চুপ করে আছে, হঠাত্ ঝড়ের মধ্যে হাতড়াতে হাতড়াতে কে যেন এগিয়ে এলো-কমলা রঙের পোশাক পরা একজন লোক, খুঁটিতে বাঁধা ছেলেটাকে দড়ি কেটে মুক্ত করে কোলে তুলে নিয়ে ঝড়ের অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেলো৷

ঘামে ভিজে জেগে উঠে বসলাম, অনেকক্ষণ ঠাহর পেলাম না কোথায় আছি, তারপরে মনে পড়লো, গর্গের আশ্রমে রাত কাটাচ্ছি আমি আর অয়স্কান্ত৷ ঐ তো অতন্দ্র অয়সকান্ত দরজার কাছে বসে আছে, ওর ধাতব হাতের আঙুলের ডগা থেকে সবুজ আলো জ্বলছে আর নিভছে জ্বলছে আর নিভছে৷ দৈবরাতির আশ্রমের আগের রাত্রির মতনই ঠিক৷ তাহলে কি দেখলাম? স্বপ্ন? স্বপ্ন এত স্পষ্ট হয়?

বাচকণবী জেগে গেছেন পাশের শয্যায়, বালিশের পাশ থেকে হেডফোন মাইক্রোফোন তুলে পরে নিয়ে আমার এখানে এসে শিয়রের কাছে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কইলেন,"কি হয়েছে ঋ?"

আমি ওড়না দিয়ে মুখ-গলা মুছে নিয়ে খানিক ধাতস্থ হয়ে তারপর হেডফোন মাইক্রোফোন পরে নিয়ে বললাম,"তেমন কিছু না দেবী,অদ্ভুত্ এক দু:স্বপ্ন দেখলাম৷"

উনি আমাকে পালকের পাখা দিয়ে হাওয়া করতে করতে বললেন,"কি স্বপ্ন? কাউকে স্বপ্ন বলে দিলে ভয় কেটে যায়৷"

অয়স্কান্ত আমাদের কাছে এগিয়ে এসেছিলো দরজার কাছ থেকে,ওকে "নমস্কার কেমন আছেন" বলার অবসর না দিয়েই আমি বললাম,"আমি ভালো আছি অয়স্কান্ত, আমার তেমন কিছু হয় নি৷ একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে কেবল,আর কিছু না৷ ব্যস্ত হয়ো না,তুমি তোমার জায়গায় যাও৷"

কিজানি মনের ভুল কিনা, মনে হলো ফিরে নিজের জায়্গায় যেতে যেতে অয়স্কান্ত ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে বললো,"স্বপ্ন? স্বপ্ন? স্বপ্ন?"
মনের ভুলই হবে, অয়স্কান্ত তো ঐ তিনটে শব্দ,"নোমোসকার কেমন আছেন" ছাড়া অন্য কিছু উচ্চারণ করতে পারে না, প্রফেসর সেইরকমভাবেই প্রোগ্রাম করেছেন ওকে৷ নতুন কোনো কোয়ালিটি কিভাবে যোগ হবে? এখানের এনারা কিছু করেছেন নাকি? কিন্তু তাই বা কিভাবে হবে, এনারা রোবোটিক্সের কিছুই তো জানেন না, জানা সম্ভবও নয়৷ আমরা কয়েক হাজার বছর অতীতে এখন!

বাচকণবী আমার এখানেই এলিয়ে শুয়ে বললেন,"ঋ,আমি এখানেই থাকি বাকী রাত৷ আর ঘুমুবো না,তোমার স্বপ্ন বলে দাও৷ হয়তো তোমার ভয় কেটে যাবে৷" আমি আস্তে আস্তে স্বপ্নের এলোমেলো সাদা ধূসর সবুজ নীল ধুলোটে আগুন রঙ সব না-গাঁথা টলমল করে বেড়ানো ঘটনাগুলো আস্তে আস্তে যতদূর সম্ভব গুছিয়ে ওনাকে বলতে থাকি, বলতে বলতে সত্যিই নিজের ভিতরের একটা দমবন্ধ গুমোট ভাব কেটে যাচ্ছিলো,স্পষ্ট টের পেলাম৷

সব শুনে উনি হাসলেন, তারপরে বললেন," এখন ঘুমাও,আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই৷ কালকে সকালে তোমাকে একজায়গায় নিয়ে যাবো দৈবরাতি এলে৷ একসঙ্গেই যাবো সবাই৷যেখানে নিয়ে যাবো, সেখানে তুমি একজনকে দেখবে, তাঁকে দেখলে তোমার অনেক সংশয় দূর হয়ে যাবে৷নাও, এখন ঘুমাও৷"

উনি আমার হেডফোন মাইক্রোফোন খুলে বালিশের পাশে রেখে আস্তে আস্তে হাতচাপড়ি দিতে থাকেন মাথায়, ঘুম পাড়াবার জন্য৷ আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে আসে দেহমন, কি যেন একটা গান গাইছেন বাচকণবী, খুব মৃদু এলানো স্নিগ্ধ সুর, গভীর রাত্রির সমুদ্রবাতাসের মতন একটা দোলানি সেই সুরে, হয়তো এই গান এনাদের সময়ের ঘুমপাড়ানি গান৷

আমি ভাবছিলাম কার সঙ্গে কাল সকালে দেখা হবে? কেনই বা তাঁকে দেখলে আমার সংশয় দূর হয়ে যাবে? কিন্তু বেশীক্ষণ ভাবতে পারলাম না, ঘুমিয়ে পড়লাম বোধহয় তারপরেই৷

শরত্সকালের সোনালী রোদে অভিস্নাত বনপথ দিয়ে আমরা চারজন চলেছি৷ অয়স্কান্ত,আমি, বাচকনবী আর দৈবরাতি৷ ঋষি সকাল সকাল আমাদের নিতে এসেছিলেন গর্গের আশ্রমে৷ কিন্তু এখন সঙ্গে নিয়ে না ফিরে যেতে হচ্ছে কোথায় সে ওনারা জানেন,আমি পুরো ক্লুলেস৷

ঊষামুহূর্তে স্নান সমাপন হয়ে যাবার পরে বাচকণবী আমাকে ওনাদের মতন পোশাক পরিয়ে মাথার চুলগুলো চুড়া করে মাথার উপরে তুলে বেঁধে দিয়েছেন৷ আমি বলেছিলাম," আমি তো সন্ন্যাসিনী নই, কেন আমায় এই পোশাক আর হেয়ারস্টাইল দিচ্ছেন, লোককে বিভ্রান্ত করার জন্য?”

অমনি উনি হেসে উঠলেন, কোত্থেকে এক শিশিরে ভেজা জুঁইফুলের সদ্যগাঁথা মালা এনে ঝুঁটি ঘিরে পরিয়ে দিলেন সেই স্থূল যুথীপুষ্পের মালা৷ বললেন এতে আর লোকের নাকি কনফিউশান হবে না৷ অয়স্কান্ত খুব অস্বস্তিভরে এইসব সাজগোজপর্ব দেখছিলো, ঠিক যেন বারণ করার ইচ্ছে, কিন্তু করতে পারছে না৷ কুরুবকফুলের অবতংস মানে কানের দুল পরিয়ে দিতে ইচ্ছে ছিলো ওনার, কিন্তু হেডফোনে বাধা সৃষ্টি হবে বলে সেটা আর পারলেন না, কিন্তু আচ্ছা করে লোধ্ররেণুর পাউডার মুখে গলায় মাখিয়ে দিলেন৷ গলায় মালা দিতে চাইলে, আমি হেসে বাধা দিলাম, বললাম, "দরকার নেই, এতেই যখন কনফুশন দূর হয়ে যাচ্ছে,তখন বাহুল্যের কি প্রয়োজন?" উনি নিরস্ত হলেন,একটু দূরে গিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলেন ভালো করে,তারপরে বেশ সন্তুষ্টের মতন কইলেন,"এতেই হবে৷"

পাহাড়ের এলিয়ে পড়া পায়ের কাছে সবুজ কুঞ্জবন, সামনে একটা ভারী সুন্দর ফলের গাছ, রসে টসটসে এত্ত এত্ত বড়ো বড়ো ফল ধরে আছে, পাখিরা সেই ফলে প্রাতরাশ সারছে৷ আমরা সেই কুঞ্জবনে প্রবেশ করলাম, আরেকটু এগিয়ে একটি কুটির, লতায় পাতায় এমনভাবে আচ্ছন্ন যে ঠাহর হয় না প্রথমে৷ আমরা দাঁড়ালাম, ঋষি দরজা নক করলেন, কিন্তু ভিতর থেকে কোনো শব্দ নেই৷

আমি চঞ্চলচোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম৷ কী শান্তিময় নির্জন অরণ্যভূমি, পক্ষীকূজন,পত্রমর্মর আর দূরাগত ঝর্ণার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই৷ একেই তপোবন বলে বুঝি? এদিক ওদিকে চাইতে চাইতে খানিকক্ষণ পরে দেখি বনের অন্যদিক থেকে এক প্রৌঢ় জটাধারী প্রচুর সাদা দাড়িওলা সন্ন্যাসী মানুষ ধীর পদক্ষেপে হেঁটে আসছেন, কাছে এসে আনন্দিত বিস্ময়ে কি যেন বলে উঠলেন,অমনি সকলে সেদিকে ফিরে তাকালো৷ ঋষি দৌড়ে গেলেন ভদ্রলোকের কাছে৷ এরপরে আবেগপ্রবণ কিছু মুহূর্তের বর্ণনা বাহুল্যবোধে আর দিলাম না৷ কিন্তু আমার প্রশ্নাচ্ছন্ন মন নিবৃত্ত হয় নি, কেন এখানে এনারা নিয়ে এলেন আমায়? এখানেই কি সংশয় কেটে যাবে আমার? কেমন করে? কে এই প্রৌঢ় সন্ন্যাসী?

পরিচয়পর্ব শেষ হলে তপোবনের স্নিগ্ধ আশ্রয়ে চিকরিকাটা পাতার ছায়াজাল আঁকা রোদ্দুরের মধ্য দিয়ে প্রৌঢ় ভদ্রলোককে অনুসরণ করে চললাম আমরা৷ দূরাগত ঝর্ণার শব্দ ক্রমে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে লাগলো, বুঝলাম সেইদিকেই চলেছি আমরা৷ সেখানে পৌঁছে মুগ্ধ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম, অপূর্ব এক ঝর্ণা নেমে এসেছে পাথরের গা বেয়ে,অজস্র জলবিন্দু ছিটকে পড়ছে, নীচে একটি জলকুন্ড সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে ক্ষুদ্র একটি জলধারা বয়ে গেছে দূরে আরো দূরে৷ অপূর্ব! জলকুন্ডের কাছে সৌভঞ্জনবৃক্ষের ছায়ায় একখানি মসৃণ চওড়া চ্যাটালো পাথর৷ সেখানেই সকলে আসন গ্রহণ করলাম আমরা৷

হেডফোন-মাইক্রোফোন এখনো বাচকণবীর কাছেই, অয়স্কান্ত চুপচাপ আমাদের দেখছে,দৈবরাতি আর প্রৌঢ় ভদ্রলোক কিযেন কথা বলছেন, হঠাত্ আমার দিকে চেয়ে প্রৌঢ় কিযেন বলতেই এক অদ্ভুত্ ম্যাজিক হলো, বন, ঝর্ণা বৃক্ষমূলের প্রস্তরাসন সব মিলিয়ে গেলো৷

দেখলাম এক খরাপীড়িত শুকনো অঞ্চলে একখানি কুটির, হতশ্রী অবস্থা সেই কুটিরের৷ মাটির দাওয়ায় ছোট্টো একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে চুপ করে বসে আছেন এক শীর্ণা মা, মাঝে মাঝে পথের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছেন, হয়তো উনি কারুর আগমনের প্রতীক্ষা করছেন৷

এ কি দেখছি? এ কি কোনো দুর্ভিক্ষের গল্প? নাকি অন্য কিছু? কিভাবে এসব দেখছি? কিভাবে আমি এসবের সঙ্গে রিলেটেড? অবাক লাগছে না কেন? মনে হলো ঐ উদ্বিঘ্ন দুর্ভিক্ষশীর্ণা মা, ওঁর কোলের নির্জীব শিশুটি, আহার্যসংগ্রহে বেরিয়ে পড়া ওঁর স্বামী-সবাইকে যেন চিনি৷ কিন্তু এতো অসম্ভব! কিভাবে আমি চিনি ওদের?

কুটিরের ভিতর থেকে আরো দুটি বাচ্চা ছেলে এসে দাওয়ায় মায়ের কাছ ঘেঁষে বসে পড়লো৷ এরাও অত্যন্ত শীর্ণ, চেহারা দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে খুব ক্ষুধার্ত ও দুর্বল৷ একটি ছেলে প্রায় কিশোর বয়সী, আরেকটি ছেলে আরেকটু ছোটো৷ দূরে দেখা গেলো একজন মধ্যবয়সী মানুষ আস্তে আস্তে হেঁটে আসছেন, হাতের ছোট্টো পুঁটলিটির মধ্যে হয়তো কিছু আহার্য্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন৷ ছেলে দুটি আস্তে আস্তে দাওয়া থেকে নেমে লোকটির দিকে এগিয়ে গেলো৷ সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো, পশ্চিমের আকাশটা রক্তলাল হয়ে উঠছিলো৷

ভদ্রলোকের থলিতে ছিলো কিছু আলু আর বেগুন৷ উঠানে কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সেই আলু আর বেগুন পোড়ানো হচ্ছে এখন, ভদ্রলোক সাবধানে বেগুনগুলো উল্টেপাল্টে দিচ্ছেন, হয়ে গেলে আগুন থেকে সরিয়ে মৃত্পাত্রে রাখছেন৷ আলুবেগুনপোড়ার সুঘ্রাণ সন্ধ্যার বাতাসে, দুর্ভিক্ষপীড়িত ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর মন ভরিয়ে তুলছে আশায়, লাল আগুনের আভা এই বাচ্চাগুলোর আর ওদের বাপমায়ের আশামুগ্ধ চোখেমুখে খেলা করছে৷

বাচ্চারা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে,আগুন নিভু নিভু হয়ে এসেছে,স্বামীস্ত্রী কথা কইছেন চিন্তিত গলায়৷ দুজনের সব কথার মধ্যেই এই সুরটা দীর্ঘশ্বাসের মতন জড়ানো---আজকের দিন কেটে গেলো, কিন্তু তারপরে? ভদ্রলোক কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, কিন্তু বারে বারেই ইতস্তত করে থেমে যাচ্ছিলেন৷ অবশেষে বললেন কথাটা৷ উনি খাদ্রসংগ্রহে যখন হট্টে গেছিলেন তখন শুনে এসেছেন রাজা কি একটা প্রতিশ্রুতি না পালন করায় উদরী রোগে পড়েছেন, সেই রোগ থেকে মুক্তির জন্য কি যেন মানত করেছেন-একটি সুলক্ষণ শিশুকে ক্রয় করে নিজ পুত্র হিসাবে গ্রহণ করে তারপরে কি যেন করবেন৷

ভদ্রমহিলা কেন জানি শিউরে উঠে দাওয়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে থাকা ছোট্টো বাচ্চাটির কাছে গিয়ে ঘুমন্ত ওকেই কোলে তুলে নেন, অবরুদ্ধ গলায় কিযেন বলতে থাকেন৷ শুকনো চোখ সহসা জলে ভরে যায় ওঁর৷ অশনি সংকেত কি বারে বারেই এসে হাজির হয় এইসব ক্ষুদ্র দুর্বল অসহায় মানুষের সংসারে?

তারপরে ফেডেড হয়ে গেলো ছবি, চোখ পরিষ্কার হতে দেখি সেই শরতের সোনারোদ আর মেঘছায়ার লুকোচুরি খেলা আকাশের নীচে সেই শান্ত তপোবনে তরুতলের প্রস্তরাসনে সেই ক্ষুদ্র চেনা দলটি, অথচ এতক্ষণ আমার মন এখানে ছিলো না? কি দেখলাম তবে এতক্ষণ? বহুদূরের এক দুর্ভিক্ষদিনের ক্লান্ত রক্তসন্ধ্যা কেন দেখলাম?

হাসিমুখ প্রৌঢ় মানুষটি আবার আমার দিকে তাকালেন আর হাসলেন, ওর দীর্ঘ শ্বেতশ্বশ্রুর মধ্যে রোদ্দুরের ঝলমল৷ সহসা বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতন চমকে উঠলাম আমি, এতক্ষণে আমি কানেকশান দেখতে পাচ্ছি, এইসব ছিন্ন ছিন্ন আপাত সম্পর্কহীন ঘটনার মধ্যের মিল দেখতে পাচ্ছি৷ ঠিক যেন জোর হাওয়ায় কুয়াশা উড়ে যাচ্ছে, দীর্ঘ দিগন্তবিস্তৃত ল্যান্ডস্কেপ স্পষ্ট হয়ে ওঠছে, কিভাবে কাছের দূরের নদী পাহাড় মাঠ বন একই মাটির উপরে স্থাপিত রয়েছে, দেখতে পাচ্ছি৷

এই অখন্ড দেশের মতন কালকেও অবিচ্ছিন্ন সন্তত বলে দেখতে পেলাম, আমরা সুখ-দু:খময় ঘটনা-দুর্ঘটনার শিউরে শিউরে ওঠা চূড়াগুলোকে দেখতে পাই, কিন্তু এইসব চূড়া দাঁড়িয়ে আছে একই ভিত্তিভূমির উপরে৷ কুয়াশার মতন বাষ্পময় অন্ধকার আচ্ছন্ন করে রেখেছে এই যোগাযোগভূমিকে--এইকথাই গতরাত্রে বাচকণবী বলছিলেন মন্ত্রে? ভাষার জটিল প্যাঁচ আর ঝলকানিতে পথ হারিয়ে কিছুই বুঝতে পারিনি?

এই হাসিমুখ শান্ত ঋষি, আকটিলম্বিত শ্বেত শ্বশ্রু বাতাসে উড়ছে, গভীর চোখের মধ্যে হাসি ঝলমল করছে--এই ঋষি দেবরাতই সেদিনের ভয়ার্ত বালক শুন:শেপ---তাঁর কোনো চিহ্ন তো নেই এঁর মধ্যে? সংসারের আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক ত্রিতাপ এঁকে স্পর্শ করতে পারেনি, ইনি নিজ হদৃয়ে অবিচ্ছিন্ন শান্তির সমুদ্রের সন্ধান পেয়েছেন৷ কিকরে?

কোন্ দূর হেমন্তগোধূলির প্রান্ত থেকে উড়ে উড়ে আসে সাদা জারুলের ফুল-খইয়ের মতন সাদা-মৃত্যুর শ্বেতবস্ত্রের মতন সাদা-ছায়াপড়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে এক ক্ষুদ্র ভয়ার্ত শিশু-তাহলে কেন সেখানেই ফিরে ফিরে যাই আলো-অন্ধকারে ... গোলোকধাঁধার মতন,স্পাইরালের মতন ... কিছুতেই পার হয়ে যেতে কেন পারছি না?

ঋষি দেবরাত---আমাকে বলে দাও কিকরে তুমি ঐ ল্যাবিরিন্থ থেকে বেরিয়ে এলে? কোনো শব্দ লাগছে না, ভাষার ট্রান্সফর্মেশান লাগছে না, কিচ্ছু না, আমরা সরাসরি মন থেকে মনে কথা বলছি৷আমার প্রশ্ন উনি শুনতে পাচ্ছেন ওঁর মাথার মধ্যে, উনিও স্মিত উত্তর ফুটিয়ে দিচ্ছেন আমার মাথার ভিতরে৷

হেমন্তগোধূলির প্রান্ত থেকে তখনো উড়ে উড়ে আসে পাতলা সাদা পাপড়ির ছিন্ন ছিন্ন করুণ ডানা, ওরা উড়ে যেতে চেয়েছিলো নক্ষত্রের দিকে, কিন্তু হাওয়া ওদের উড়িয়ে নিয়ে গেছে অন্ধকারে, পথ ভুলে ওরা হারিয়ে গেছে, একই পথে ঘুরে চলেছে ওরা,দেশকালের মধ্যে সর্পিল হয়ে ঘুরে চলেছে৷

দেবরাত এইবারে সেই অনন্ত বৃত্তের মুখ খুলে দেবেন৷ ছাড়া পেয়ে ওরা ছুটে চলে যাবে স্কুলছুটির পরের আনন্দিত শিশুদের মতন৷
দেবরাত আমার দিকে চেয়ে আছেন, আমি ওঁর দিকে৷আমরা কথা বলছি না, কিন্তু কেজানে কি অদ্ভুত অজানা উপায়ে উনি আমার মনের মধ্যে প্রোজেক্ট করে দেখাচ্ছেন সেই ঘটনামালা, সেই দৃশ্যমালা, বারে বারে আমার স্বপ্নে ভিন্ন ভিন্নভাবে যারা এসেছে, আমি কিছুতেই যাদের একত্রে যুক্তিসিদ্ধভাবে পরম্পরা রেখে গাঁথতে পারিনি৷

"সময়ের গিঁটখোলা রাতে / আকাশের চাবি তোর হাতে / এই হাত রাখি সেই হাতে / সব নদী থাক আঁখিপাতে ... "

(শেষ)


মন্তব্য

স্নিগ্ধা এর ছবি

'সময়ের উজানে' ভাটিতে না ফেরা পর্যন্ত মন্তব্য করবো না ঠিক করেছিলাম, কিন্তু, একটা বিশেষ কারণে করতেই হচ্ছে .........

আমার গুরু টেনিদা তাঁর অপোগন্ড স্যাঙ্গাৎদের প্রায়শই 'কুরুবকের মতো বকবক' করতে বারণ করতেন। শুনতে শুনতে, কোন একবার অতিজ্ঞানী ক্যাবলা বলেই ফেলেছিলো - কুরুবক তো একধরনের ফুল! তার আগে পর্যন্ত আমিও জানতাম না যে কুরুবক একটা ফুল, এবং জানার পরেও টেনিদার বানীই আমার কাছে শিরোধার্য্য! আজকে আবার 'কুরুবকফুলের অবতংস' পড়ে
চারমূর্তিকে মনে পড়ে গেলো আর তাদের মতোই হাঁড়িচাঁচা গলায় বলতে ইচ্ছে হলো -
আপনার এই অতীত-ভবিষ্যত স্যুপটি একদম ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস হচ্ছে! চালিয়ে যান, ইয়াক ইয়াক ! চোখ টিপি

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক থ্যংক্স।
আপনি কিনা ধন্যবাদ দিতে বারণ করেন তাই থেংকু। হাসি
চলবে কি, চলে চলে শেষ হয়ে গেলো তো এই পর্বে! হাসি
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

স্নিগ্ধা এর ছবি

চলবে কি, চলে চলে শেষ হয়ে গেলো তো এই পর্বে!

হ্যাহ্‌, বলসে আপনাকে! যান, শিগগির করে আরেক পর্ব নামান ......

মূলত পাঠক এর ছবি

কাল রাতে বেড়ানো সেরে অনেক দেরিতে ফিরলেও শুতে যাবার আগে সময়ের উজানে একবার সাঁতার না কেটে ছাড়ি নি। লেখক যদি নিয়মানুবর্তী হন তো পাঠকেরও কিছু দায়িত্ব থাকে। মন্তব্য একটু সময় নিয়ে করবো বলে সকালের জন্য রেখে দিয়েছিলাম।

পড়ে তো ভালোই লাগলো, তবে এমন দ্রুত শেষ হয়ে গেলে দুঃখ হয় যে!

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।
এখানেই শেষ হতে চাইলো গল্প, আরো বাড়লে তেতো হয়ে যেতো যে!
ভালো থাকবেন।

-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অনিশ্চিত এর ছবি

পড়ছি, তবে পুরাটা শেষ না করা পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করবো না।
‌‌-------------------------------------
হাত বাঁধা, কিন্তু দড়ি মুক্ত - হায় পৃথিবী!

‌‌-------------------------------------
হাত বাঁধা, কিন্তু দড়ি মুক্ত - হায় পৃথিবী!

তুলিরেখা এর ছবি

"সময়ের উজানে" নিশ্চিতরূপেই শেষ হয়ে গেছে অনিশ্চিত।
মনে খুলে কমেন্টান! হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।