প্রথম বইমেলা

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: মঙ্গল, ০৭/০৪/২০০৯ - ৮:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শহর,বাজার এইসব ছাড়িয়ে একটু একটু করে সবুজ যেখানে বাড়তে থাকতো সেইখানে ছিলো আমাদের ইস্কুল। আমাদের পাড়া ছিলো আরো বেশী সবুজের মধ্যে, বয়েজ স্কুলের পাশের রাস্তা দিয়ে পশ্চিমের দিকে হাঁটতে থাকলে একসময় এসে পড়তো জোড়া পুকুর, পাড়ে বটগাছ যার নাম তালবট, কারণ বটের মধ্যে তালগাছ, বট উঠেছে তাল জড়িয়ে, দুটো গাছই বেঁচে ছিলো দিব্যি! সেই তালবট পেরিয়ে বড়মাঠ, তারপরে আমাদের পাড়া।

আমাদের ওখানে প্রথম বইমেলা হলো ঘোর বর্ষায়, তখন আমরা সবেমাত্র উঠেছি ক্লাস নাইনে, বইমেলায় যাওয়া হবে শুনে আমাদের উত্‌সাহ দ্যাখে কে! এতদিন শুধু আমরা শুনে এসেছি কলকাতায় বইমেলা হয় শীতের শেষে, সে এক দুর্দান্ত কান্ড, কিন্তু অতি অল্প কজনে ছাড়া সেই বিরাট বিখ্যাত বইমেলা দেখার সৌভাগ্য কারুর হয়নি৷

ইস্কুল থেকে দিদিমণিরা নিয়ে চললেন আমাদের, রাস্তা জলেকাদায় ভর্তি, মেলা প্রাঙ্গন প্যাঁচপেঁচে যথারীতি, কাঠের পাটাতন পেতে পেতে চলার জায়গা করা হয়েছে কোনোরকমে, স্টলের উপরে তাঁবুর কাপড় আর নীল তেরপল দিয়ে বৃষ্টির জল আটকানোর প্রচেষ্টা৷ আমরা জলে কাদায় হেঁটে হঁটে পরম উত্‌সাহে বই দেখতে লাগলাম৷ ভোস্তকের স্টলে তখনো পাওয়া যেতো মানুষের মতো মানুষ, ইস্পাত, পাহাড় ও স্তেপের আখ্যান৷

স্টলের হাসিমুখ ভদ্রলোক কেন কে জানে আমাকে "মানুষের মতো মানুষ" কিনতে উত্সাহিত করলেন, এদিকে আমি দুখন্ড ইস্পাত নিয়ে ঝুলোঝুলি করছি৷ কিনতেই হবে৷ মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার সময় নাকি লোকে ও বই সঙ্গে নিতে চায়,কি আছে দেখতেই হবে৷ আর এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর কাছে মানুষের মত মানুষ আছে, ধলা কুকুর শামলা কান ও আছে, আছে সার্কাসের ছেলে--ওর থেকে এনে তো ওগুলো পড়তেই পারবো৷ কিন্তু এই পাভেল করচাগিনের গল্প আমার নিজের চাই, দৃষ্টি হারিয়ে হাতড়ে হাতড়ে ও কি এমন লিখেছে যে লোকে মঙ্গলগ্রহে নিতে চায়? ভদ্রলোক আমার যুক্তি মেনে নিলেন, দুখন্ড বই বেঁধে প্যাক করে দিলেন, মহানন্দে ফিরে এলাম৷

অনেক পরে, নানা লালনীলসবুজবেগুনী অভিজ্ঞতার পরে দেখেছি এই ইস্পাত, মানুষের মত মানুষ,পাহাড় ও স্তেপের আখ্যান, ধলা কুকুর--এইসব বইয়ে লক্ষ্যণীয় ভাবে অকৃত্রিমের একটা জোরালো রঙ থাকতো যেটা কিনা ইংরেজী বইয়ে খুবই মৃদু৷ সেখানে ব্যাপারটা মানুষকেন্দ্রিক, অনেক বেশী অ্যাকোয়ার্ড গুণের বর্ণনা, মানুষে-মানুষে নানা সম্পর্কের ওঠাপড়া, সংঘর্ষ ৷ তুলনায় রুশ বইগুলো শুরুই হতো এইরকম সব বর্ণনা দিয়ে, "ঠান্ডা খরশান আলোয় তখনো তারারা ভাস্বর" নিপুণ অকৃত্রিম বর্ণনায় জেগে উঠতো শীতশেষের বরফগলা বনে স্নোড্রপ ফুল, বিশাল মহীরুহসমূহ যেন প্রাসাদের মতন, ছড়ানো ডেইজির মধ্যে বসে আছে এক তরুণী, নদী থেকে স্নান করে ভিজে ডানার মতন পরশ রেখে শস্যমাড়াইয়ের জায়্গায় ফিরে আসছে তরুণী, সূর্যমুখী পুষ্ট হয়ে উঠছে আলো শুষে শুষে৷

বারে বারে ফিরে ফিরে তাই ঐ বইগুলো পড়তে ইচ্ছে করে, আমাদের সমস্ত সফিস্টিকেশনের শেকলের আড়ালে লুকিয়ে থাকে যে হৃদয়বাসী মুক্ত দিগম্বর, সে চকিতে দেখা দিয়ে যায় ঐ ঠান্ডা খরশান আলোর তারাদের মধ্যে, ঐ দিগন্তলীন মাঠে কুশবিছানায়৷

***
ডি: আসলে এটা ছিলো ইস্কুলের স্মৃতিচারণের লেখার মধ্যে এক জায়গায়, কালকে বইমেলার কথা ভাবতে ভাবতে লেখাটুকু তুলে এনে লেজামুড়োয় কয়েক লাইন জুড়ে ভাবলাম দেখি তো পাঠকেরা কি বলে! আগের কয়েক লেখা এত সব বড়ো বড়ো দিয়ে হয়তো পাঠকদের ঘাবড়ে দিয়েছি, দেখি ছোট্টো লেখা দিয়ে! বেশী ছোটো হয়ে গেলো কি?


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

লেখাটা খুব ভালো, যদিও আরেকটু বড়ো হলে আরো ভালো হতো। তা আমরা হলাম গিয়ে লোভী পাঠক, খিদে কিছুতেই মেটে না। হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ মূলত পাঠক।
বেশী বড়ো লেখা দিতে সঙ্কোচ হয়, হয়তো পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

গৌতম এর ছবি

অন্যরকম বইমেলা...
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

তুলিরেখা এর ছবি

হ্যাঁ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মাল্যবান এর ছবি

আর রুশ বইগুলোর ছবিগুলোর কথা মনে পড়ে ? বইয়ের পাতাগুলি ? বেশ ছোটবেলায় ওদের বইগুলো কিনে দেওয়া হোতো আর গোগ্রাসে গিলতুম । "সোভিয়েত দেশ" নামে একটি পত্রিকাও বাড়ীতে আসতো নিয়মিত (দেব সাহিত্য কুটিরের "শুকতারার" সাথে) । কিন্তু আমার ছোটবেলায় বইমেলা ছিলো না। কলিকাতা পুস্তকমেলার আগে "পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা" হোতো। সরকারী আয়োজনে। কিন্তু তখন বড় হয়ে গেছি । বাবা-মা বা মাস্টার দিদিমনির হাত ধরে বইমেলা দেখা হয় নি কখনও। তাই বই চেনা ,বই কেনা ঘেঁটে ঘেঁটে শিখেছি। তথাপি রুশ বইগুলি কেনার তালিকায় থাকতোই। অত কম দামে, অত বিচিত্র বিষয়, অমন পাতা, ছবি, ঝকঝকে ছাপা কে দেবে ?
মূলত পাঠকের সাথে একমত হয়ে বলি , লেখাটা বড় ছোট হয়ে গেলো । আপনার লেখা বরাবরই এতো চমৎকার ! শব্দের আলপনায় আঁকা থাকে, তাই ছোট হলে এসব স্মৃতিচারণে ছবিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। আপনার বইমেলার ছবিটি যেমন ,জলকাদায় হেঁটেই হুট করে চলে গেলেন ভোস্তকের স্টলে তারপর রুশপুস্তক বর্ণনায়। তাতে আমার স্মৃতি উস্কে উঠলো কিন্তু আপনার বইমেলাটি কোথায় , অন্যান্য স্টলের ছবি স্পষ্ট হোলো না।
লেখাটির জন্য শুভেচ্ছা।

তুলিরেখা এর ছবি

অসাধারণ সব ছবি! ওগুলো দেখেই বলে দেওয়া যেতো রুশ বই! কিসব বই ছিলো!
যেমন লেখা তেমনি ছবি! রুশ দেশের উপকথা আমরা ছোটোবেলা পড়তাম ভাগাভাগি করে, সেই ইভান,যাদুকরী ভাসিলিসা, ঝলমলে বাজ ফিনিস্ত,চলন্ত বাড়ীর বুড়ী বাবাইয়াগা, অজানি দেশের নাজানি কি-ইশ! কি সব কাহিনি! পাহাড় ও স্তেপের আখ্যান এর সেই প্রথম শিক্ষক, কিরঘিজিয়ার সেই কিশোরী মেয়েটি, মাঠে মাঠে জ্বালানী কুড়িয়ে তোলা, তারপরে প্রথম যখন ইসকুল বসলো গাঁয়ে,অথবা সেই পাহাড়ের গান, সেই গাঁয়ে ফিরে আসা ছেলেটি -অপরূপ সব গল্প! এসব বলতে গেলে নেশা ধরে যাবে, পালাই।
লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

বইমেলা ভালো জিনিস, তবে আপনাকে একটা আস্ত লেখা লিখতে হবে রুশ সাহিত্য নিয়ে। যে সব বইয়ের কথা লিখেছেন আমি তার সবগুলো পড়ি নি, কিন্তু যা পড়েছি তাতেও আপনার লেখা পড়ে নস্টালজিক হতে বাধছে না। "মালাকাইটের ঝাঁপি" আমার সবচেয়ে প্রিয় বইয়ের লিস্টে থাকবে। কেমন একটা অমোঘ ব্যাপার ছিলো ঘটনাপরম্পরায়, ছোটোবেলাতেও সেটা টের পেতাম। কোনো ছেলেভুলোনো ব্যাপার নয়, জীবনের মতোই নির্মম, যা অবধারিত তা ঘটবে, শিশুপাঠ্য ব'লে কোনো ডাইলিউশন করা হবে না। আমার ধারণা পাঠকদের সম্মান জানানোর এই পদ্ধতিটা বাচ্চারা পছন্দ করে, যদিও অধিকাংশ লেখক তাদের নেহাৎই বাচ্চা মনে করে থাকেন।

যদি লেখেন রুশ সাহিত্য নিয়ে, তাহলে "মালাকাইটের ঝাঁপি" নিয়ে বিশদে লিখবেন, আবদার জানিয়ে রাখলাম।

তুলিরেখা এর ছবি

এ বই পড়লে মনে থাকতো! আমি অন্যান্য রুশ বই নিয়ে পরে নাহয় লিখবো অল্প অল্প, কিন্তু আপনি মশাই "মালাকাইটের ঝাঁপি" খুলুন তো! কৌতুহলে মরে যাচ্ছি যে!
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

বইমেলা ভ্রমনের আনন্দটা অন্যরকম। ঘ্রানে অর্ধভোজনের স্বাদ নেয়ার মতো। হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

ঠিক বলেছেন নীড়-সন্ধানী। বইমেলার কথা শুনতেও ভালো লাগে।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সিরাত এর ছবি

হ্যাঁ, রাশিয়ান লেখকরা এভাবে শুরু করে লেখা; প্রকৃতি খুব বড় ভূমিকা প্লে করে ওদের গল্পে। মালাকাইটের ঝাপের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে!

আরেকটু সহজ করে লিখবেন? হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

চলুক

এখন আর এমন বই পাওয়া যায় না মন খারাপ

তুলিরেখা এর ছবি

ভালো ভালো জিনিস বেশীদিন থাকে না,হায়।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সুমন সুপান্থ এর ছবি

শহর,বাজার এইসব ছাড়িয়ে একটু একটু করে সবুজ যেখানে বাড়তে থাকতো সেইখানে ছিলো আমাদের ইস্কুল।

এমন বাক্য দিয়ে শুরু করা লেখা না পড়ে শেষ করা যায় ! কিন্তু যে অতৃপ্তি রইলো, তার দায় লেখকেরই তো, না কি ?

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

তুলিরেখা এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ বন্ধু।
যান, ডিসক্লেমার দিয়া দিলাম।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।