দেশবিদেশের উপকথা-জাপান

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শনি, ১৬/০৫/২০০৯ - ৪:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জাপানের সৃষ্টিকথায় আছে এইরকম গল্প: প্রথমে আকাশ আর পৃথিবী আলাদা ছিলো না, সব মিলেজুলে ছিলো। না ছিলো কোনো নিয়ম, না ছিলো কোনো শৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলার সমুদ্র থেকে প্রথমে জন্মালো অপূর্ব সুর, সমস্ত বিশৃংখলা সুন্দর সুন্দর সব নিয়মে বাঁধা পড়তে লাগলো-নৃত্যের বশে সুন্দর হলো বিদ্রোহী পরমাণু ... সেরকম আরকি।

তারপরে এলেন নারীদেবতা ইজানামী আর পুরুষদেবতা ইজানাগী। ওনারা স্বর্গের ঝুলন্ত সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো দুই রত্নময় বর্শা নিয়ে সমুদ্রটাকে খুব করে ঘেঁটে প্রথম দ্বীপ তৈরী করলেন, এই দ্বীপ হলো ওনোকোরো। তারপরে ওঁরা এই দ্বীপে এক বড়ো বাড়ী বানালেন, একটা মস্ত বড়ো একশিলা পাথরের থাম ছিলো এই বাড়ীর কেন্দ্রীয় থাম্বা। বাড়ীটাড়ী বানানো হয়ে গেলে ওনারা থাম ঘিরে ঘুরে ঘুরে মন্ত্র পড়ে পরস্পরকে বিবাহ করলেন।

প্রথম সন্তান জন্মালো-হিরুকো। সে খুব দুর্বল আর ছোট্টো। ইজানাগী আর ইজানামী খুব যত্ন করলেন, কিন্তু সে বাড়লো না বিশেষ। হতাশ হয়ে শনগাছের নৌকায় তুলে দিলেন তাকে জলে ভাসিয়ে। সেই ছেলেই হলো ধীবরদের দেবতা এবিসু।

তারপরে ইজানাগী ইজানামী আটখানি বড়ো বড়ো দ্বীপ তৈরী করলেন। এরপরে ইজানামী মায়ের কোলে একে একে জন্ম নিতে লাগলো নানা দেবতা-সমুদ্রদেব, ভূমিদেব, মরুত্দেব আর বৃষ্টিদেব। কিন্তু এরপরে অগ্নিদেবের জন্ম দিতে গিয়ে ইজানামী পুড়ে মরে গেলেন।

ইজানাগী এত রেগে গেলেন যে অগ্নিকে কেটে তিনটুকরো করে ফেললেন, আর রাগে অধীর হয়ে চললেন পাতালে, মৃত্যুলোকে, মৃতা ইজানামীর সন্ধানে।

মৃত্যুলোকের দুয়ারে গিয়ে ডাকলেন, " ইজানামী-ঈ-ঈ-ঈ, কোথায় তুই? ফিরে আয়, দ্বীপগুলো বানানো যে শেষ হয় নি আমাদের।"

ইজানামী এলেন, কিন্তু কাছে এলেন না, দূর থেকেই কইলেন, " ইজানাগী, এসেছিস তুই? বড়ো দেরী করে ফেললি রে! আমি যে এদেশের খাবার খেয়ে ফেলেছি। আর তো ফিরতে পারবো না। কিন্তু তুই তবু অপেক্ষা কর, আমি দেখি মৃত্যুদেব যদি আমায় ছেড়ে দেন। আমার দিকে তাকাস নি কিন্তু খবদ্দার।"

ইজানামী অনুমতি আনতে চললেন, ইজানাগী দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেলো দেখে আর ধৈর্য না ধরতে পেরে একটা টর্চ জ্বালিয়ে চললেন যে পথে গেছিলো ইজানামী। গিয়ে দেখেন ইজানামীর দেহাবশেষ কীটদষ্ট গলিত বিকট দুর্গন্ধযুক্ত। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ইজানাগী, দুই হাতে নাক চেপে পিছু হটে দৌড় দিলেন।

দেখে ইজানামী শক্ড,ছি ছি, এই তোর বিশ্বাস? এই তোর ভালোবাসা? এই তোর শপথ? সামান্য দেহটার নাশ দেখে তুই সইতে পারলি না?

ক্রুদ্ধ ইজানামীর নির্দেশে মৃত্যুলোকের সমস্ত প্রেতেরা পিছু ধাওয়া করলো ইজানাগীর। কিন্তু ইজানাগী দৌড়ে পালাতে পালাতে মাথা থেকে খুলে ফেলে দিলেন মুকুট--তা হয়ে গেলো আঙুরের গুচ্ছ, প্রেতেরা আঙুর খেতে থেমে গেলো খানিকক্ষণ। দৌড়ে আরো খানিক গিয়ে চিরুনী ফেলে দিলেন, হয়ে গেলো বাঁশঝাড়, আবার প্রেতেরা থামলো। ইতিমধ্যে ইজানাগী পৌঁছে গেছেন মৃত্যুলোক ও জীবনলোকের সংযোগস্থলে, ইজানামী নিজে দৌড়ে এসে ওকে প্রায় ধরে ধরে অবস্থা, একলাফ মেরে বেরিয়ে এক বিরাট পাথর টেনে পথ বন্ধ করে দিলেন ইজানাগী।

ইজানামীর চিত্কৃত শপথ পাথরে লেগে বন্ধ হয়ে গেলো-ইজানামী বলছিলো, প্রত্যেকদিন আমি হাজার মানুষ মেরে এই দেশে নিয়ে আসবো। বাইরে থেকে ইজানামী পাল্টা শপথ করলো, প্রত্যেকদিন আমি দেড় হাজার শিশু জন্মের ব্যবস্থা করবো।

সেই থেকে মৃত্যুলোকে রয়ে গেলো ইজানামী আর জীবনলোকে ফিরে এলো ইজানাগী।

এইবারে কমলালেবুর বনে এসে এক ঝর্ণায় স্নান করে সমস্ত গ্লানি ধুয়ে ফেললেন ইজানাগী- বাঁচোখ ধুলেন, জন্মালো আমাতেরাসু- সকলের প্রিয় সূর্য, জাপানে সে সূর্যদেবী। ডানচোখ ধুলেন, জন্মালো ত্সুমি-ইয়োমি, চন্দ্রদেবতা। নাক ধুলেন, জন্মালো সুসানৈয়ো-ঝড়ের দেবতা। এরকম আরো বহু দেবতা জন্মালেন।

এইসব সন্তানদের পেয়ে ইজানাগী খুব খুশী হলেন-ওদের রাজত্ব ভাগ করে দিলেন। আমাতেরাসু পেলেন দিন, ত্সুমিইয়োমি পেলেন রাত, সুসানৈয়ো পেলেন সমুদ্র।

আমাতেরাসু আর ত্সুমিইয়োমি খুশী হলেন উপহারে, কিন্তু ঝড়ের দেবতা খুশী না, রেগে কাঁদে চিত্কার করে, ঝড়ের দেবতা কিনা, ওনার চিত্কারে ঝড় শুরু হয়ে যায়। ইজানাগী রেগে গিয়ে কন," তুই ভারী বেয়াড়া ছেলে, তুই পাতালে যা।" ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হয় না।

ঝড়ের দেবতা সমুদ্রশাসন না করে কেবল এদিক ওদিক উত্পাত করে বেড়ায়, গাছ উপড়ায়, ধানের ক্ষেত নষ্ট করে, ঘরবাড়ী ভেঙে দেয়। কেউ কিছুই করতে পারে না। ইজানাগী ভাবেন কিকরে একে বশ করা যায়, কিন্তু উপায় পান না।

একদিন আমাতেরাসুর সুন্দর শুদ্ধ পবিত্র ঘরে সখীদের নিয়ে তিনি কাপড় বুনছেন, সেখানে গিয়ে হাজির সুসানৈয়া। খুব উত্পাত করলো সুসানৈয়া, তান্ডব চালিয়ে সব ভেঙেচুরে ছারখার তছনছ করে দিলো। প্রচন্ড শকড হয়ে আমাতেরাসু পালিয়ে গেলো। এক গুহায় নিজেকে বন্ধ করে রাখলো।

আমাতেরাসু হলো সূর্যদেবী, তার বিহনে সমস্ত পৃথিবীতে নেমে এলো অন্ধকার। বরফ গলে না, ফসল ফলে না, চারিদিকে ঘোর ভয় ঘনিয়ে এলো। দেবতারা সবাই শলা করলেন আমাতেরাসুকে যেমন করেই হোক বের করতে হবে। প্রচুর অনুনয় করলো দেবতারা, আমাতেরাসু অটল। সে বেরুবে না।

তখন দেবতারা ঐ গুহার বাইরে আগুন জ্বালিয়ে গানবাজনা শুরু করলেন, এক মোরগকে শিখিয়ে দিলেন সে বারে বারে ডেকে উঠলো। গুহার বাইরে এইসব শুনতে পেয়ে গুহামুখের পাথরের কাছে এসে ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে আমাতেরাসু জিগালো, "কি হচ্ছে এসব?"
এক দেবতা কইলো,"আমরা আমাতেরাসুর চেয়েও উজল এক দেবী পেয়েছি কিনা, তাই সেলিব্রেট করছি।"

আমাতেরাসু কৌতুহলী হয়ে যেই না মুখ বাড়িয়ে দেখতে গেছে ওর সামনে আয়্না ধরেছে অমনি, আয়্নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আমাতেরাসু বিহ্বল খানিকটা, সেই অবসরে ওকে হাত ধরে টেনে বাইরে এনে গুহার মুখ দিয়েছে বন্ধ করে।

তারপর থেকে আর কখনো সূর্যহীন দীর্ঘদিন কাটাতে হয় নি মানুষকে, সূর্য প্রত্যেকদিন সকালে পুবে উঁকি দিয়েছে, সোনার আলোয় ভরে গেছে দুনিয়া। ঝড়ের দেবতার হাতের নখ পায়ের নখ কেটে, দাড়ি কামিয়ে ওকে ভব্যসভ্য করা হয়েছে, তবুও আজও একটু এদিক ওদিক হলেই সে ঝড় ডেকে আনে।


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

বরাবরের মতোই দারুণ।
তবে পুরো লেখায় শক্ড শব্দটা একটু বেমানান লাগছে। মর্মাহত বা স্তম্ভিত লেখা যেতো বোধহয়।
(এই সুযোগে এট্টু মাস্তানি কইরা নিলাম।) চোখ টিপি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি
হে হে, আমি শক্ড ই রাখলাম!
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

খুব সুন্দর লাগলো পড়ে। আরো চাই বিদেশী উপকথা।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।
পাঠকের ভালো লাগাই লেখার সার্থকতা।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ভুতুম এর ছবি

লিখতে থাকুন আরো অনেক।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তানবীরা এর ছবি

ইজানামীর চিত্কৃত শপথ পাথরে লেগে বন্ধ হয়ে গেলো-ইজানামী বলছিলো, প্রত্যেকদিন আমি হাজার মানুষ মেরে এই দেশে নিয়ে আসবো।

এইটা বোধহয় ইজানাগী হবে, না ?

এখনও বাচ্চা রয়ে গেলাম, পড়তে এত্তো ভালো লাগে, তুলিদি থ্যাংকস।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

তুলিরেখা এর ছবি

না, ইজানামীই হবে।
মহিলাই তো কইলেন হাজার মেরে নিয়ে আসবেন।
ভদ্রলোক পালটা কইলেন দেড় হাজার জন্মাবার বন্দোবস্ত করবেন।

আপনার ভালো লেগেছে দেখে ভাললাগলো তানবীরাদি।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

চলুক

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি

-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।