সাইক্লোপিয়ান

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: মঙ্গল, ৩০/০৬/২০০৯ - ১০:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
শীতের সন্ধ্যা, ঝপ করে আলো কমে অন্ধকার হয়ে আসে। আর পাহাড়ী হাওয়ায় মরিচের ধার। বাগান থেকে আমরা ঘরে চলে আসি, ড্রয়িং রুমের ওম-ওম আতিথেয়তায় ভালো লাগে, বাইরে এখন বেশ বৈমাতৃক শৈত্য। সোফা টোফা দেয়ালের দিকে ঠেলে দিয়ে ঘরের মাঝখানে মস্ত এক মাদুর পেতে এষা মাঝখানে রাখলো চানাচুর-মুড়ির বাটিগুলো। বললো চা আসছে।

আমরা কলেজবেলার মতন বসে গেলাম, একটা খবরের কাগজ পেতে মুড়িচানাচুর ঢেলে ফেলা হলো, এষা এনে দিল কাঁচামরিচ। আহ, তোফা। চা ও এসে গেল, ইমন চায়ের পট নিয়ে এলো, আর গোটা সাত কাপ। কুরুড়কুরুড় করে মুড়ি চিবোতে চিবোতে আর হালকা করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমরা গল্প করতে থাকি।

" হ্যাঁ, সমন্তক, তুমি যে বলছিলে সেবারে রাজগীরে নাকি তুমি ভুতের পাল্লায় পড়েছিলে? "

" না, ঠিক পাল্লায় নয়, ভুত আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলো। ঐ তো শান্ত্বনুকে জিগ্গেস করো, সেও তো ছিল।"

শান্ত্বনু মুখ নিচু করে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল, সবার চোখ এবারে তার দিকে ঘুরে গেলো। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে শান্ত্বনু হাসলো, বললো," আসলে পরিবেশটা। ঐ পরিবেশে স্বাভাবিক জিনিসও ভুতুড়ে লাগে। ঐরকম অন্ধকার, আকাশে মেঘথমথম করছে, যেকোনো সময় বৃষ্টি আসতে পারে, রাস্তার পাশে ঝুপসি ঝুপসি দেড়শো-দুশো বছরের পুরানো সব গাছ, পথের ঠিকঠিকানা হারিয়ে আমরা দুই পর্যটক গাড়ী চালাচ্ছি তো চালাচ্ছিই , কোথায় গিয়ে আশ্রয় মিলবে জানিনা--ঐ অবস্থায় খুব কঠিন ভুত-অবিশ্বাসী ও একদু'বার রামনাম করে ফেলবে বা আয়াতুল কুরসী পড়ে ফেলবে। ধারালো দা'য়ের আগায় লবণ রেখে খেলেও নাকি ভয় কমে, তখন আমার প্রায় তাই করার কথা মনে আসছিলো, কিন্তু সেখানে দা পাবো কই? " ওর বলার ভঙ্গীতে সবাই হাসলেও শোনার জন্য কাছিয়ে এলো, এরকম ধোঁয়াধোঁয়া শীতসন্ধ্যা ভুতের গল্পের জন্য আদর্শ।

"প্রথম থেকে বলো, ভালো করে গুছিয়ে। " রোহানা আগ্রহী গলায় বলে। কথা শেষ করে হাতের চায়ের কাপ মুখের কাছে আনে চুমুক দিতে, কিন্তু চোখ থাকে শান্ত্বনুর দিকে।

শান্ত্বনু খালি চায়ের কাপ একপাশে সরিয়ে রেখে গুছিয়ে বসে,বলে," তাহলে শুরু থেকেই বলি। সেবারে পরীক্ষা-টরীক্ষা হয়ে গেছে, চাকরিতে জয়েন করতে দেরি আছে মাসখানেক তখনও, আমরা বসে বসে তাস খেলে বোর হয়ে গেছি। একে একে এদিক ওদিক করে কেটে পড়তে লাগলো সবাই, কেউ বাড়ী গেল, কেউ চাকরির শহরে আগে আগে গিয়ে উপস্থিত হলো, নাকি আগে আগে গিয়ে জায়গাবাসা ঠিকঠাক করে নেওয়া খুবই বুদ্ধিমানের কাজ। আমরা ক'জন তখনো পড়ে আছি। শেষে একদিন সমন্তক উঠলো ক্ষেপে, আমাকে বললো "চল, সাইক্লোপিয়ান ওয়াল দেখে আসি। "

আমি তো থ, ছেলেটার মাথাটা কি সত্যিই বিগড়ালো? সাইক্লোপস তো বলে সেই গ্রীক উপকথার সেই একচোখো দৈত্যদের! তাদের ওয়াল কিকরে দেখবো? কিন্তু সমন্তক বলে, "হয় চল, নয় এখানে বসে ভ্যারেন্ডা ভাজ। তুই না গেলে আমি একাই যাবো। নিজের গাড়ীতে দিব্যি ফুরফুর করে চলে যাবো, বসে বসে তুই এখানে ল্যাবেঞ্চুস খা। " সমন্তকের গাড়ী চালাবার লাইসেন্সও হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে, ওর কাকা ওকে একটা পুরানো গাড়ীও দিয়ে দিয়েছেন, নিজে নতুন একটা কিনেছেন বলে।

আরে ছেলেটার মাথাটা কি পুরোপুরি গেল নাকি? এই ভেবে আমি সামলাতে চেষ্টা করি, এইফাঁকে ইতিহাস-ভূগোলের জ্ঞানও খানিক জাহির করে বলি,"সমু, সাইক্লোপিয়ান ওয়াল তো গ্রীসে, আথেন্সের কাছে মাইকেনি না মাইসেনি বলে একজায়গায়। এখানে কাছেপিঠে সাইক্লোপিয়ান ওয়াল তুই পাইলি কই?"

সমন্তক ক্ষেপে গেছে তখন, বলে," তুই খুব জানিস। রাজগীরে আছে সাইক্লোপিয়ান ওয়াল, নাকি ছিলো চল্লিশ কিলোমিটার লম্বা, এখন আছে তার ধ্বংসাবশেষ। তাছাড়া আছে জরাসন্ধের কারাগার, আছে মনিয়ার মঠ, শোনভান্ডার--- আরো অনেক কিছু আছে। মনে রাখিস এককালে বিম্বিসারের রাজধানীও ছিলো সে জায়গা, বুদ্ধের আমলে। তুই যেতে না চাইলে তোর ব্যপার, আমি দেখতে যাবোই যাবো।"

শান্ত্বনু থেমে একমুঠো চানাচুর মুড়ি তুলে মুখে দিয়ে আয়েস করে চিবোতে শুরু করে। সমন্তক চুপচাপ খাচ্ছিলো আর শুনছিলো। গল্পের মধ্যে ডিস্টার্ব করে নি। এখন মৃদুস্বরে বললো, "শান্ত্বনু বলেছে আমি ওকে ভ্যারেন্ডা ভাজতে আর ল্যাবেঞ্চুষ খেতে বলেছিলাম, কিন্তু আমি এর কোনোটাই বলি নি।"

শান্ত্বনু তেড়িয়া " বলিস নি মানে? তুই তখন যা ক্ষেপে উঠেছিলি হুলো বেড়ালের মতন!"

আচমকা অভূতপূর্ব বিশেষণে সমন্তক কিছুটা থমকে গিয়ে গুছিয়ে শব্দ খুঁজছে, কথা কাটাকাটি শুরু হয় দেখে তাড়াতাড়ি নীপা বাধা দিলো, বললো, "আহ, ঝগড়াঝাঁটি বন্ধ। হ্যাঁ, শান্ত্বনুদা, তারপরে কি হলো?"

শান্ত্বনু বললো, "তারপরে? আর কি? পাগলকে আটকানো যাবে না বুঝে আমি সঙ্গী হয়ে গেলাম।"

"তারপরে? " আয়েষার গলা, আগ্রহে টররটরর করছে।

সমন্তক বলে, "শান্ত্বনুটাকে বলতে দিলে ব্যাটা গাজাখুঁরি বলবে। তারচেয়ে আমি বলি শোনো।"

সমস্বরে যে প্রতিবাদ উঠলো, তাতে বেগতিক দেখে সমন্তক বললো," ঠিকাছে ঠিকাছে, ও ই বলুক। কিন্তু খুব গাজাখুঁরি হলে আমি প্রোটেস্ট করবো বলে দিলাম।"

ঘরের সবার মুখ আবার শান্ত্বনুর দিকে, সে শুরু করে, " তারপরে ওয়ান ফাইন মর্নিং দু'জনে রওনা হলাম। সঙ্গে নিজেদের জামাকাপড়, কিছু খাবারদাবাড়, কয়েকটা জলভরা বোতল, একটা ফ্লাস্কে চা, রোডম্যাপ আর ক্যামেরা। সমন্তক চালাচ্ছে গাড়ী, আমি পাশে বসে দৃশ্যটিশ্য দেখছি আর রোডম্যাপটাও খুলে রেখেছি সামনে যদিও নেভিগেশানে আমি একেবারে ভাস্কো-দা-গামা। "

(চলবে)


মন্তব্য

শাহীন হাসান এর ছবি

আমরা কলেজবেলার মতন বসে গেলাম, ....

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

তুলিরেখা এর ছবি

শাহীন,
প্লীজ বুঝিয়ে বলুন। হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মণিকা রশিদ এর ছবি

ভালো লাগল।
_______
...সবটুকু বুঝতে কে চায়!

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ মণিকা।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।