উৎস-পৃথিবী(১)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/১১/২০১৩ - ২:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অদীনা চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। একা, একা, বড্ড একা লাগে তার এইসময়গুলোতে। বাইরে রোদ-ঝকমকে নিঃশব্দ দুপুর। চেয়ে থাকতে থাকতে তার মনে পড়ে অনেক, অনেক আগের এমন সব দুপুরবেলা। মনে পড়ে সেইসব দুপুরের নানা শব্দ। দুপুরজাগা রোদ্দুরের মধ্যে মিশে থাকতো সেইসব প্রিয় শব্দমালা। "হরে-এ-এ- ক মাল পাঁচসিকা"র ফেরিওয়ালা, "শিল খোটাও" ওলা, টিনালোহাওলার শব্দ। আরো থাকতো নিঃশব্দ কাগজকুড়ানি মেয়ে, যার রুখু বাদামীচুলে খেলা করতো শুকনো শীতহাওয়া।

উলের ডিজাইনের মতন গালওলা সাদা থান পরা বুড়ী, চুলগুলো পাকা, সঙ্গে কচি একটি পুঁচকে মেয়ে, সজিনা গাছের ছায়ায় মাদুর--বুড়ী আর কচি মেয়েটা পাশাপাশি শুয়ে আছে। বুড়ী গল্প করে টুয়াইয়ের, সাতভাই আর তাদের একমাত্র বোন টুয়াই। সাতভাই বাণিজ্যে যায়, টুয়াই কী করে? সত্যি তো, টুয়াই তারপরে কী করলো?

হারিয়ে গেছে শব্দেরা, ফেরিওয়ালার ম্যাজিকঝুড়ি। রুখু দুপুরে বুড়ী ফেরিওয়ালা ডাকলে ঐ ঢাকনিটা সরালেই যে ঝুড়ির ভিতর থেকে উঁকি দিতো টিপ,মালা, চুড়ি, পুতুল, খেলনা কত কী। সেই ফেরিওয়ালা একা একা একা একা মিশে গেছে কুয়াশায়। হয়তো সে এখনো কোনো দূরের গ্রহে অমনি আমকাঁঠালের ছায়ার পাশ দিয়ে হাঁক দেয় "হরে-এ-এ-এক মাল পাঁচসিকা।" গোলাপী মুখ বাচ্চারা ছুটে আসে, সঙ্গে আসে বুড়ী দিদা। এপারে মেয়েটির ঠোঁট ফুলে ওঠে, অভিমানে।

এইখানে দৃশ্য বদলে যায়। স্মৃতির পর্দায় অদীনা দেখতে পায় ভূপেনকে। ভূপেন তখন সদ্য কলেজ পাশ করা ছোকরাটি, নিজের গ্রামে ফিরে খুবই স্মৃতিকাতর। নদীর তীরে তাদের সেই সবুজ গ্রাম, তার শৈশব কৈশোরের প্রতিটা মুহূর্তের সাক্ষী। সেই গ্রাম তখন অন্য দেশ, তবু সব চেনাজানা জায়গা, অনেক চেনামুখ। ভূপেন তার পুরানো স্কুলে দেখা করতে গেল। তাকে পেয়ে পুরানো শিক্ষক খুব খুশি। কিন্তু ভুপেন থাকতে পারে না কয়েকদিনের বেশি, নতুন দেশে তার নতুন ঘরে বাপমাভাইবোন সবাই অপেক্ষা করছে। আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে বিদায় নেয়।

সব গুলিয়ে যাচ্ছে অদীনার, কেন যে গুলিয়ে যাচ্ছে কে জানে। কোথা থেকে কোথায়, কোন্‌ শুকনো দুপুর থেকে কোন্‌ নদীতীরের জল-ছলছল কাহিনিতে!

টেবিলজুড়ে রোল খুলে মেলে দেওয়া ম্যাপের দাগগুলোর উপরে হাত বোলায় অদীনা, হাতে আলাদা লাগে না তো, দাগও লাগে না, কিন্তু চোখে দেখা যায় দাগ, তেড়াবেঁকা সোজা লম্বা পাথালি লাইন আর লাইন। সীমান্ত। কাঁটাতার। কই? হাতে ফুটে গেলো? অনেকদিন আগের সূচ ফুটে যাওয়া চিহ্নে এখনো বাদামী দাগ, শুকিয়ে গেছে কবে, তবু দাগখানা রয়ে গেছে। মিছিমিছি দাগ, মিছিমিছি। টেবিল ছেড়ে সে চলে যায় খাটে, সেলাই করতে বসে ছেঁড়া কামিজ, আবার খচাং করে সূচ বেঁধে, রক্তবিন্দুটা ঠিক জ্বলজ্বলে একটা ক্ষুদ্র চুনীর মতো লাগে ল্যাম্পের নীচে। ব্যথা। আগুনলাগার মতন জ্বালাকরে আঙুলটায়, চুনীসমেত আঙুলডগা মুখে ঢুকিয়ে দেয় অদীনা।

তার মনে পড়ে ভর সন্ধেবেলা বুড়ীর মুখে শোনা গল্প, ছেড়ে আসা দেশের গল্প, নদী, মাঠ, ভাঁটফুল, পানের বরজ, বরজে বাঘ, নদীতে জোয়ারভাঁটা, খলখল করে স্রোতের জলে স্নান। কুমীরে ধরার আগেই উঠে বৌ দুটির উঠে পড়া ঘাট থেকে, পিছনে কুমীরের জল তোলপাড়, এক বৌ আরেককে কয়, "ভাগ্যে তোমার তাড়াতাড়ি ছিলো হইরার মা, না হইলে আজ কী হইতো!"

এরকম সব গল্প, ঝাঁকে ঝাঁকে চারামাছ নদীতে বর্ষায়, লোকে গোটা দলটাকে ধরে ফেলছে, ছোটো মেয়েটির কি কান্না, ওদের মায়ের কষ্ট হবে ওদের মায়ের কষ্ট হবে। জেলে জেলেনীরা শুনে হাসে, তাদের চকচকে কালো চোখে আর রোদেপোড়ামুখে সস্নেহ হাসি, পৃথিবীর সুখ ও দুঃখ তাদের চেনা, অভিঘাতগুলো পুরানো হয়ে গেছে। নতুন কুঁড়িটি এখনো চেনে না সেসব, তারা ব্যস্ত হয় না, একদিন ঠিক হয়ে যাবে সবই।

দু'খানা অদ্ভুৎ শব্দ করা মাছ সারারাত ক্যাঁকর ক্যাঁকর করছে ডুলায়, বালিকা পা টিপে টিপে ওঠে উঁকি মেরে দ্যাখে। কচ্ছপের বিরাট খোলায় রাখা জল, যেন চৌবাচ্চা, সেই জলে পা ধুয়ে ছেলেপুলে দাওয়ায় উঠলো।

নদীপারের গাঁটিতে ফিরেছে গাঁয়ের মেয়ে, নাইয়র এসেছে, সঙ্গে ছোট্টো তার বছর চারেকের মেয়েটি। বিকালে যাত্রাপালা হচ্ছে, প্রহ্লাদের গল্প। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর ছেলে প্রহলাদ। দৈত্যরাজ হরির নাম শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, এদিকে তার ছেলে প্রহলাদ দারুণ হরিভক্ত। রাজা বহু চেষ্টায় ছেলেকে বাগে আনতে না পেরে অবশেষে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছেন। বিষ খাওয়ানো, হাতী দিয়ে মাড়ানোর চেষ্টা, জলে ফেলা, আগুনে দেওয়া কিছুতেই কিছু হয় না! ভীষণ উত্তেজক গল্প,অভিনয় চলছে, চোখ বড়ো বড়ো করে কচি মেয়েটা দেখছে। যখন রাজার নির্দেশে রাজপুত্তুর প্রহ্লাদকে কাটতে গেছে সেনাপতি, মেয়েটা তখন আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠেছে,"টুনিমামাগো, দাওডা(দা টা) ধরেন।" দর্শকের মধ্যে হাসির হররা পড়ে গেল।

তারপর? সময় বয়ে যায় নদীর ধারা যেন। ছলছলে নদীটির পারের গ্রামটি থেকে দল বেঁধে মানুষ চলে যাচ্ছে, পাড়া কে পাড়া ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। জামাকাপড়ের গাঁটরি তাদের কাঁধে, শিশুদের হাত ধরা বড়োদের শিরাতোলা কেজো হাতে। কোথায় যেন কোন্‌ স্টীমার ঘাটা, কোন্‌ চেনা স্রোত ছেড়ে কোন্‌ অচেনা ঘাটের দিকে যাযাবর মানুষের দলের চলে যাওয়া।

সোনালী রূপালী মেঘালী রোদালী এমনি সব গল্প, ছিন্নমূল মানুষের দেশ খুঁজে বেড়াবার গল্প, স্বপ্নের মধ্যে নীলকন্ঠ পাখিটি ওড়ে আর ওড়ে!

গল্পের মধ্যে বারে বারে অদ্ভুত এক ঝড়ের গন্ধ এসে পড়ে, আশ্বিনের ঝড়, যেই ঝড়ে বাড়ীঘর পড়ে গেছিলো ওদের, গোটা গ্রামে একটি দুটি ছাড়া খাড়া বাড়ী ছিলো না। বাড়ীর তিনজন লোক,কাকা আর দুই দাদা নদীতে, গ্রামের আরো কত লোক নদীতে, নৌকায়, কখন ওরা ফিরবে, কি হলো ওদের,ঘাটে দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে করে দ্যাখে বৌরামায়েরামেয়েরা--- গোটা গ্রামে অজস্র গাছ উৎপাটিত, রাস্তা গাছে ভর্তি।

লোকে ধারালো দা হাতে গাছ কাটতে কাটতে পথ করে নিয়ে যাচ্ছে ঘাটে, পরদিন ঝকমকে রোদ,লোকে ভেজা সব শুকিয়ে নিচ্ছে, গ্রামের একটিমাত্র খাড়া বাড়ীটিতে,বাড়ীটি ধনীবাড়ী,পাকা দালান, সেখান থেকে সকলের জন্য খাবার দেওয়া হচ্ছে। বেলায় খবর এলো দাদারা আর কাকা ফিরছে। বাড়ীঘর পড়ে গেছে দেখে কাকার কি আফশোস, "আমি থাকলে দাঁতে কামড়াইয়া বাড়ী খাড়া রাখতাম!"

তারপরে ওরা তাদের নদীতে ঝড়ের অভিজ্ঞতার কথা বলে, কেমন একটা ছোটো সরু খাঁড়ির মধ্যে নৌকা ঢুকিয়ে খোলা নদীতে ঝড়ের হাতে পড়া থেকে বেঁচেছিলো, কেমন হাতের কাছে যা পেয়েছে যে তাই দিয়ে জল সেঁচেছে।

কাগজপত্র বের করে সবার বয়স হিসেব করা হলো, যাতে মনে থাকে ছাব্বিশ সনের ঝড়ের সময় বয়স কতো ছিলো। সার্টিফিকেট ইত্যাদির তো বালাই নেই কারুর,ঐভাবেই লোকে হিসেব রাখে। অদীনার মনে পড়ে যায় সেই মঙ্গোপার্কের আফ্রিকা ভ্রমণ, সেখানে লোকে বছরের হিসাব রাখে বড়ো বড়ো ঘটনা দিয়ে, অমুক যুদ্ধের বছর,তমুক ঝড়ের বছর। সাদা লোক আসবার বছর।

দেশকালের তুমুল দূরত্বে, নির্জন কোনো এক গ্রীষ্মসন্ধ্যার বিরল অবসরে, রক্তলাল আকাশের দিকে চেয়ে মনে হয় এই এত সাংঘাতিক যান্ত্রিক সমাজেও হয়তো ঐভাবে ছাড়া আসলে অন্য কোনোভাবেই সময়ের হিসেব রাখা যায় না। সহস্র বিস্মৃতির ঘোলা জলের একাকারতার মধ্যে হঠাৎ বিঁধে যাওয়া অন্যরকমের কিছু মোচড় না থাকলে কেমন করে আলাদা করা যায় কোন্‌টা আগে, কোন্‌টা পরে? আজ থেকে সহস্র বৎসর পরে আমাদের এই সময়কে এই বিরাট বিরাট গোটা গোটা দশ কি কুড়ি কি তিরিশ প্রজন্মকে হয়তো তারা বলবে অ্যাটম ভাঙার যুগ!!! বা অন্য কিছু! কজন মানুষের মুখ বেঁচে থাকবে ইতিহাসে,এই কোটি কোটি মানুষের মধ্যে? যার মুখ বেঁচে থাকবে সেও কি সত্যি সত্যি একটা মানুষ? অনেক মানুষের সুপারইম্পোজিশান নয়? একজন করে কি কোনোদিন থাকতে পারে?

যে আর্কিমিদিসকে আমরা চিনি ইতিহাসের ধূলা সরিয়ে, সেই বৃদ্ধ জ্ঞানী কি আসলে সত্যি সত্যি সমুদ্রতীরে বালিখেলা সেই মানুষটি? যে ইমহোটেপকে আমরা চিনি আরো আরো অনেক গভীর দূরে,ইজিপ্টের অনেক গপ্পোকথা লেজেন্ড মিথের ধূলা সরিয়ে, সে কি একটা মানুষ? যে সলোমনকে খুঁজে পাই বাইবেলে, সেও কি একজন মাত্র? যে গৌতমবুদ্ধকে পাই,সেই কি মাত্র একজন?

আফ্রিকার গ্রামের সেই সরল শিশুবৃদ্ধযুবকদের সহজ বিশ্বাসে বিস্ময়ে চমকে ওঠে অদীনা, কোথায় কতদূরের বাংলার গ্রামের বিশ্বাসের সঙ্গে তার মিল দেখে চমকে ওঠে এই অর্বাচীন অতিথিবিশ্বে, এইখানেও হয়তো অমনি বিশ্বাস ছিলো, অমনি সহজ সরল প্রকৃতিসাযুজ্যে এই কালোবাদামীপৃথুলশীর্ণেরা হয়তো মিলে ছিলো একদিন। কিন্তু কে বলবে সেসব? তারা তো আর নেই। ধবল কুয়াশার মতো মিলিয়ে গেছে কোথায়। মিলিয়ে গেছে তাঁদের স্মৃতি গল্পকথা বিশ্বাস ধর্ম ভালোবাসা ঘৃণা সব সব। একদিন ইতিহসের চক্রাবর্তে হয়তো স্বপ্নের মতো দেখা দেবে আবার, খুঁড়ে খুঁড়ে ধূলা সরিয়ে তাদের উদ্ধার করবে পুনর্জাতরা।

জলে ভেজা শ্রান্ত পথিক শ্বেতাঙ্গ লোকটি আশ্রয় পেয়েছিলো গ্রামের কালো মা ও মেয়ের কুটিরে। তারা তাঁকে শুকনো কাপড় দিয়ে,খাবার তৈরী করতে করতে গান গাইছিলো,"ঝড় বইছে বৃষ্টি পড়ছে আর বেচারা সাদা লোকটি শ্রান্ত অবশ হয়ে আমাদের উঠানের গাছতলায় বসেছে। ওর যে মা নেই, ওকে দুধ এনে দেবে কে? ওর যে স্ত্রী নেই,ওকে ময়দা পিষে দেবে কে? আহা বেচারা সাদা লোকটিকে দয়া করো।"

ঐ আদিম গ্রামের আদিবাসীরা এই প্রেমধর্ম কোথা থেকে পেলো? এমন সহজ সরল নিঃশ্বাসের মতন?

ঘূর্নীধূলির মতন এরপরে এসে পড়লো সভ্যতা,মেরে কেটে শেষ করলো সব, এ কেমন সভ্যতা? যারা মরে গেলো,তারা কি গেলোই ? এক্কেবারেই গেলো? কোথাও কি রইলো না আর? কোনো সন্ধেবেলার ভুতের গল্পে? কোনো জনারের ক্ষেতের গল্পে? কোনো উপকথায়?

কোথায় তারা? মরুপার হয়ে চলে যাচ্ছে জলের কলসী কাঁখে ঠোঁট ফোলানো গাঢ় বাদামী ঐ তরুণী,কে সে? ও ই কি ওর সবল বাদামী হাতে গড়েছিলো উচ্চশীর্ষ প্রস্তরমন্দির? ঐ কি ছিলো বিদেশী জাহাজে উঠে পড়া অ্যাডভেঞ্চারেস? ও ই নিজের হাতে নিজের শিশুদের গলা টিপে মুক্তি দিয়েছিলো? ও ই কি শরবনের মধ্যে পাওয়া অন্য বিদেশী জাতের শিশুটিকে প্রতিপালন করেছিলো যে কথা বলতে শিখে ওকে মা বলতো?

ও ই কি অমরত্বের বাসনায় নীল সাপটি তুলে নিলো উষ্ণবুকের উপরে? হৃদপিন্ডের এত কাছে যে কিছুতেই যাতে মিস না হয়ে যায় বিষ! মরুকুয়াশায় বিলীন হয়ে যাওয়া হাজার হাজার স্মৃতির মধ্য থেকে অকলঙ্ক অক্ষয় হয়ে চক্রাবর্তের মতন ফিরে ফিরে এলো সেই মন্দিরের অলীক মুহূর্ত?

ওরই চিকন শ্যামলবরণ রাজা কি একদিন হারিয়ে গেলো মরুতে? সঙ্গে হারিয়ে গেলো সব গান, সব সুর, সব আলো? ছিঁড়ে যাওয়া নদী, কুটি কুটি ভূমিখন্ড, আটকে পড়া জল, পানা শ্যাওলা, দাম দলঘাস--- সে কোথায় খুঁজে পাবে সেই প্রিয়কে আবার? কোন্‌ কলার মান্দাসে ভেসে ভেসে সে আবার যাবে কোন্‌ নেতাধোপানীর ঘাটে? যেখান থেকে পাওয়া গেল স্বর্গপথের খোঁজ? সেই পথ দিয়ে ফিরে আসে কি ভুলে যাওয়া প্রিয়তম? কিন্তু, কোথায়? কই? সে তো কবে থেকে ভেলা বেয়ে চলছেই চলছেই ! কোথাও গিয়ে তো পৌঁছায় না!

"অদীনা, অদীনা " হিন্দোল ডাকছে ওর কাঁধে হাত রেখে, সে মুখে তুললো। উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে আছে হিন্দোল, "কী হয়েছে অদীনা? কতক্ষণ ধরে ডাকছিলাম ওঘর থেকে,শুনতে পাও নি?"

অদীনা ঘোর কাটিয়ে বর্তমানে ল্যান্ড করার প্রবল চেষ্টায় অস্থির বোধ করে, কী করে হিন্দোলকে বলবে? কী করে বোঝাবে? এ কি কথায় বোঝাবার মতন কিছু? মুহূর্তে কি করে পার হয়ে আসবে এত এত সময়খন্ড,এত বিপুল দেশ, এত বিরাট ঢেউ?

হিন্দোল অদীনাকে জড়িয়ে ধরে টেনে তোলে, বলে,"চলো, যাবে না? রেডি হও নি কেন এখনো? আজকে যে বিতান-বৃতি রা নেমন্তন্ন করেছে,যাবে না? "

ভুলে যাওয়া ভাষা মনে করার মতন ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে অদীনা বলে,"হ্যাঁ হ্যাঁ, চুড়িদারটা ...একজায়গায় একটু সেলাই খুলে গেছে... ঐখানটা রিফু করছিলাম... হাতে সূচ ফুটে গেল।" হাসে অদীনা, লাল ছোটো ক্ষতবিন্দু হাতের আঙুলের ডগায়,হিন্দোল নিজের হাতে ওর হাত নিয়ে দেখে।

হিন্দোল বলে, "শাড়ী পরো না! চুড়িদার তো পরোই। আজকে শাড়ী পরো, চন্দন রঙের সিল্ক শাড়ী, জড়িপাড়, ঐটা।"

অদীনা রাজি হয়ে চলে যায়।

******

"বাতাসের পাতলা স্তর সরাতে সরাতে
বেরিয়ে পড়ে নীল নীল নীল সমুদ্র-
তারও নীচে, অনেক নীচে মাটি।

আকাশের ময়দানে নীল তুলো ফুঁড়ে,
সোনালী স্বপ্ন ঘষা দূরে
হোমা পাখি-ছানাদের পা হাঁটি হাঁটি।

মেঘ তুলো নীল হাওয়া পার হতে হতে
ম্যাজিকের দেশ জুড়ে রাত
রূপশালী ধান আর কুশ কুটিকাটি।"

শীতল ভয়ের একটা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নীচ থেকে উপরে উঠে আসে অদীনার। মনে হয় অসংখ্য আরশোলা শুঁড় নেড়ে ঘুরছে সারা মেঝে জুড়ে, উড়তে শুরু করলো, একটা, দুটো তারপরে অসংখ্য। সব ঢেকে যাচ্ছে বাদামী রঙে। আরশোলা নাকি পঙ্গপাল? পঙ্গপাল এসেছিলো একবার অদীনার ছোটোবেলা তাদের গাঁয়ে, সূর্য ঢেকে গিয়েছিল তাদের পাখায়, বিরাট মেঘের মতন এসে পড়েছিলো ক্ষেতের উপরে, সব সবুজ সাফ করে দিয়েছিল কয়েক ঘন্টায়।

স্বপ্নঘুমজল ছিঁড়ে ঘামে ভিজে উঠে পড়ে অদীনা। বসে থাকে বিছানায় উঠে, গলা শুকিয়ে কাঠ,ঘামে ভিজে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ, ঘামে রাতপোশাক সেঁটে গেছে গলায় পিঠে। স্বপ্নে ও চিৎকার করেছিলো গলা চিরে, কিন্তু একটুও শব্দ হয় নি, পাশে হিন্দোল এখনো গভীর সুষুপ্তিতে। ঐ আর্ত চিৎকারের শব্দ বাইরে এলে এই রাত্রির শান্তি ছিঁড়ে খুঁড়ে একাকার হয়ে যেতো।

কাঁচের জানলার বাইরে আকাশ, ঝিমুনো চাঁদ, হাল্কা হাওয়া, গাছের ডাল,সাদা প্যাঁচা সব একই আছে।

অদীনা চুপ করে বসে থাকে বিছানায়, নামতেও পারবে না এখন। আরেকটু ধাতস্থ না হয়ে। এখনো মনে হচ্ছে মেঝে জুড়ে কিলবিল করছে অসংখ্য আরশোলা। সেই অল্প ফাট ধরা সিমেন্টের মেঝে তাদের, সেই পুরানো বাড়ী, বারান্দার বাইরে কমলজবার ঝাড়। আরেকটু দূরে সন্ধ্যামালতী, লাল আর সাদা রঙের। একটা বুলবুলি বাসা করেছিলো সেই ঝাড়ে।

ওহ, সেতো বহুকাল আগের গল্প, তখন অদীনা সাত কি আট। কেন মেঝেটাকে বর্তমানে দেখতে পায় না অদীনা? পুরো শোবার ঘরটাই নরম গোলাপী কার্পেটে ঢাকা, হিন্দোলের এই রঙ পছন্দ বলে ওরা ঐ হাল্কা গোলাপী রঙের কাগজ নিয়ে গেছিল বাজারে, রঙ মিলিয়ে কিনেছিল। আগে এখানে হাল্কা ক্রীম রঙের কার্পেট ছিলো ঘরগুলোতে, সেই রঙও তো ভালোই লাগতো অদীনার, কিন্তু হিন্দোল ছেলেমানুষের মতন বায়না করে বললো গোলাপী করতে হবে। তাই গোলাপী।

হিন্দোলের মাথার চুলগুলোর উপরে আলতো হাত রাখে অদীনা, কী ছেলেমানুষ, কী ভালো, কী সরল ছেলেটা! অদীনার চোখে জল আসে, ও কি ঠকাচ্ছে হিন্দোলকে? কতকিছুই তো হিন্দোলকে বলেনি, এখনো বলে না। অথচ হিন্দোল ওকে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে। সত্যি কি? কতদিনই বা চেনে ও হিন্দোলকে? মাত্র বছর খানেকের প্রেমের পরেই একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলো, সেও হয়ে গেলো দু'বছর প্রায়। বিয়ে করার কথা ভাবে নি, বিয়ে তো শুধু রিচুয়াল, আসল তো মন! পরস্পরের কাছে তো শপথ করেছেই তারা।

সেই মন কি পুরোটা খুলে দেখাতে পেরেছে ও? এত জল এত জল, খুলে দিলে ভেসে যাবে হিন্দোল, ডুবে যাবে।ভয় হয় অদীনার। তাই ঐ অশ্রুসমুদ্র গোপণ করে রেখেছে বুকের ভিতরে। সঙ্গে গোপণ করেছে সব কাঁটাগুলোও। কিন্তু আজকে বড্ড কাঁদতে ইচ্ছে করছে অদীনার, সব চেপে রাখা কান্না, শৈশবের ভয় পাওয়া কান্না, প্রথম কিশোরীবেলার অভিমান, শত শত দুঃখের বুটি বুটি জল উঠে আসে, সব কিছু ভাসিয়ে দিয়ে, ডুবিয়ে দিয়ে শেষ কান্না প্রাণ ভরে কেঁদে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু হিন্দোল? ওকেও ছেড়ে যাবে?

উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে দেয় অদীনা, না না, জয় করতে হবে এই দুর্বলতা, দুর্লভ মানবজীবন, একে মাঝপথে শেষ করে দেওয়া অপরাধ, এতখানি পথ পার হয়ে এসে এখন এভাবে .... ঐ তো দুয়ারে মলিনমুখ রাজভিখারী, সেতো শুধু এসে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছু বলে না, হাতও বাড়ায় না, পাতে না অঞ্জলি, শুধু ঐ অপরূপ করুণ দু'খানা চোখ মেলে অদীনার দিকে তাকিয়ে থাকে।

অদীনা জানে, ও কী চায়।ও চায় সর্বস্বধন। ও চায় সেই স্বপ্ন যা তিলে তিলে অসহ্য বেদনার পুলকে রূপ পায়। যার কিছু থাকে সম্মুখে বাস্তবে আঁকা, কিছু থাকে অনুভবে, যার কিছুটা বোঝা যায় কিছুটা যায় না। ওকে তো কবেই অদীনা বলেছিলো পণ তার জীবনসর্বস্ব। কিন্তু সে বলেছে জীবন তুচ্ছ, সবাই দিতে পারে। হায়, আর কী আছে ওগো রাজা? আর কী তুমি চাও এই দীনহীনা ভিখারিনীর কাছে?

আকাশ জুড়ে ফুটে ওঠে সোনালী ধূমকেতু, বিশাল তার উজ্জ্বল লেজ কালো আকাশে ছড়ানো, হাল্কা লেজের মধ্য দিয়ে ওপাশের তারাদের দেখা যায়। অদীনার স্বপ্নেই শুধু আছে এই ধূমকেতু, বাস্তবে আলোক দূষণ পার হয়ে ওর চোখ সেদিন আকাশে খুঁজে পায় নি ভবঘুরে জ্যোতিষ্কটিকে। তবু সে চোখ বুজে দেখতে পায় দীর্ঘকেশ এক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন আকাশের পটভূমিতে, বাইরে নীলপ্রভ আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে শুধু সুগঠন সিলুয়েটটি দেখা যায়। মুখ দেখা যায় না, চোখ দেখা যায় না। শুধু দেখা যায় তাঁর অলক্ষ্য হাতে তারার রাখী।

হাল্কা ভয়ের সঙ্গে অচেনা সুখে কাঁপতে কাঁপতে নিজে মুখ হিন্দোলের রেশমী চুলের মধ্যে গুঁজে দেয় অদীনা। ঘুমের ঘোরে পাশ ফেরে হিন্দোল, হাত বাড়িয়ে অদীনারা গলা কোমল করে জড়িয়ে ধরে ঘুমের থেকে বেরিয়ে আসে। আস্তে করে বলে, "অদীন, কী হলো? ভয় লাগছে নাকি? আবার ভয়ের স্বপ্ন দেখেছ?"

অদীনা বলে, "না না, সেরকম কিছু না। হঠাৎ কেন জানি ঘুমে ভেঙে গেল। কেমন অসোয়াস্তি হল।"

চোখ পুরো খুলে হিন্দোল বলে, "কালকে তোমায় ডক্টর হপকিন্সের কাছে নিয়ে যাবোই। বুঝলে? আর কোনো অজুহাত শুনছি না। এখনো তোমার আরশোলা ভয় যায় নি। এটা না সারালে হবে না, শুধু শুধু রোগ পুষে রাখা কোনো কাজের কথা না। "

অদীনা কুঁকড়ে যায় হিন্দোলের হাতের নিচে, হিন্দোল তাহলে ওকে সত্যি করেই অসুস্থ মনে করে? আজকে ঘুমের মধ্যে কন্ট্রোল নেই, মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। অন্যসময় তো বলে মেডিকেল কন্ডিশন, পার্সোনালিটি ট্রেইট! আজকে জানা গেল সত্যিটা।

বুকের মধ্যেটায় তীক্ষ্ণ ব্যথা টের পায় অদীনা, দু'চোখে উষ্ণ জল ভরে ওঠে। কিন্তু সে সেই জল ঝরতে দেয় না, চোখের জল চোখের ভিতরে ফিরে দেয়। খুব সাবধানে হিন্দোলের হাত ছাড়িয়ে নিজের মাথা নিয়ে আসে নিজের বালিশের উপরে, আহ, কেন সে শুধু শুধু ওকে বিরক্ত করতে গেল! এখন তো সত্যিই আর ভয় করছে না! এখন তো মেঝেটা গোলাপী কার্পেটে মোড়াই লাগছে। তাহলে তখন কেন--

না, এই মিছিমিছি ভয়কে জয় করতেই হবে, ঠিকই বলে হিন্দোল, ভালো ভেবেই বলে। নাহ, কাল সে যাবে ডক্টর হপকিন্সের কাছে, সব খুলে বলবে।

চোখে বোজে অদীনা, আহ, শিথিল হয়ে আসছে দেহ, এখন ঘন ঘুমের আঠায় জুড়ে যাবে সব। শান্তি শান্তি শান্তি।

আধোঘুমে হিন্দোলের মুখ সে অনুভব করে সিঁথির উপরে, সে বলছে, "রাগ করলে অদীন? উঁ? রাগ করলে? আমি কিছু ভেবে বলিনি, এমনি বলেছি। অসুখ না, অসুখ কেন হবে? কিন্তু তুমি কষ্ট পাচ্ছ, তা থেকে সেরে উঠবে।"

অদীনা সায় দিয়ে বলে, "হ্যাঁ, যাবো কালকে। এখন ঘুমাই? এখন আর ভয় করছে না, এখন ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাই, হিন্দোল?"

আস্তে আস্তে হিন্দোল বিলি কেটে দেয় অদীনার মাথার রেশমী নরম চুলে। অদীনা ডুবে যেতে থাকে ঘুমের জলে। ডুবে যেতে থাকে অবর্ণনীয় সুখের অনুভূতির মধ্যেও।

******

রাত্রিশেষের হাওয়ায় কেঁপে উঠলেন রোহিতাশ্ব। বাতায়নপথে চেয়ে দেখলেন অরণ্যশীর্ষে ঢলে পড়েছে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণ চাঁদ। হেমন্ত শেষ হয়ে এলো, রিক্ত ধানক্ষেতে হু হু করে বেড়ায় হাওয়া। উৎস

রোহিতাশ্ব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁসের পালকের কলমটি নামালেন। উঠে দাঁড়ালেন, উত্তরীয়টা একটু ভালো করে জড়ালেন। বাতায়নবর্তী হয়ে দৃষ্টি মেলে দিলেন দূরে। ক্ষীণ জ্যোৎস্না আর কুয়াশা মিশে আদিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত অদ্ভুত অলীক দেখাচ্ছে। যেন অপার্থিব!

পাঁচ বছর হয়ে গেল। এইরকম এক হেমন্তে সদানীরা ছেড়ে গেছে তাকে। শ্রুতি আর স্মৃতি --এই দুই যমজ কন্যাকে রেখে। ওরা তখন তিন বছরের শিশু। কে ভেবেছিল ঐভাবে মাত্র তিনদিনের অসুখে পূর্ণযুবতী সদানীরা এই অনেক ভালোবাসার সংসার সন্তান স্বপ্ন -সব ছেড়ে চলে যাবে? এই সন্তান দুটি জখন গর্ভে এলো তখন কী তীব্র আনন্দে জ্বলজ্বলে হয়ে উঠছিল সদানীরা, এরা যখন জন্মালো তখন তাদের কী সুখ, কী অনাস্বাদিত বাৎসল্যের প্রথম অমৃত অনুভূতি! এইসব হঠাৎ করে ছেড়ে দিয়ে তাকে এত নির্মমভাবে একা করে দিয়ে চলে গেল নীরা!

রোহিতাশ্ব পাশের ঘরে ভেজানো দরজাটার দিকে তাকান, তারপরে আস্তে আস্তে সেদিকে যান, দরজা আস্তে করে ঠেলা দিতেই খুলে যায়। ঘরে ঢোকেন। মেয়ে দুটি ওদের ঠাকুমার পাশ ঘেঁষে শুয়ে আছে বিছানায়। তিনজনেই ওরা গভীর ঘুমে মগ্ন, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দোময় শব্দ শোনা যায়। ঘুমের মধ্যে শ্রুতি পাশ ফেরে, গায়ের চাদর খানিকটা সরে যায়, এলোমেলো ফুরফুরে রেশমীচুলে ঘেরা কচিমুখটি দেখা যায়, পাতলা রাঙা ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক, কচি দু'খানা দাঁত দেখা যাচ্ছে। রোহিতাশ্বের বুকের ভিতরে ছলছল করে, আস্তে করে পাশে বসে মেয়ের গায়ের চাদর ঠিক করে দেন। ঘুমের মধ্যে আদর করতে নেই, নইলে ওর কপালে একটা চুমু খেতে খুব ইচ্ছে করছিল রোহিতাশ্বের। মেয়ের কপালের থেকে চুলগুলো যত্ন করে সরিয়ে মাথায় হাত হাল্কা করে বুলিয়ে সরে এলেন তিনি। লোকে বলে শ্রুতি আর স্মৃতি ওদের মায়ের মুখ পেয়েছে, মায়ের চেহারা পেয়েছে।

রোহিতাশ্বকে নতুন স্ত্রী গ্রহণ করতে অনেকেই পরামর্শ দেন, এমনকি রোহিতাশ্বের মা ও। কিন্তু তিনি মনস্থির করতে পারেন না। হয়তো আর কিছু বছর পরে সত্যি করেই নতুন বিবাহ করতে হবে তাকে, কিন্তু এখন এই কচি মেয়ে দুটি সৎমায়ের হাতে পড়ুক, এ তিনি চান না। অনেকে বলে যে সব সৎ মা যে খারাপ হয়, তা কে বললো? কোনো কোনো সৎ মা এত ভালো হয় যে সতীনের সন্তানদের যত্ন করে নিজের সন্তানের মতন। কিন্তু রোহিতাশ্ব জানেন তেমন সৎ মা বিরল ব্যাপার।

মেয়েদের ঘর থেকে নিজের লেখার ঘরে ফিরে এলেন রোহিতাশ্ব, ফিরেই চমকে উঠে থমকে গেলেন। কুশাসনটির কাছে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবতী, আগে কখনো একে দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না তিনি। এর পোষাক ও মুখ অদৃষ্টপূর্ব। মেয়েটি শান্ত মুখে কৌতূহলী দৃষ্টি তুলে চেয়ে আছে রোহিতাশ্বের দিকে। এ কী আশ্চর্য কান্ড! জাদু নাকি অন্যকিছু? ইনি কে? কোথা থেকে এলেন? স্বর্গ থেকে আসা কোনো দেবদূতী?

রোহিতাশ্ব নিজের জায়্গায় অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, গলা শুকিয়ে আসছে তৃষ্ণা। চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। যুবতী এক পা এগিয়ে এসে খুব কষ্ট করে করে শব্দ মনে করে করে কথা বলার মতন করে বলল, "আপনি রোহিতাশ্ব, না? প্রসিদ্ধ ভিষক? বর্তমানে আয়ুর্বেদ সম্পর্কে গ্রন্থ লিখছেন? "

রোহিতাশ্ব কিছু বলতে পারলেন না, দেখলেন মেয়েটির মুখে সদানীরার মুখ জ্বলজ্বল করছে। তিনি অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন ভূমিতে।

*****

স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠে অদীনা। এই স্বপ্ন সে দেখছে বেশ কিছুদিন। ডক্টর হপকিন্সের কাছে সে গিয়েছিল হিন্দোলের সঙ্গে, ডাক্তার ভদ্রলোক আগেও ওর চিকিৎসা করেছেন। নতুন নতুন সমস্যাগুলো সব শুনে তিনি কিছু ওষুধ দিলেন আর রিল্যাক্স করার কিছু টেকনিক শেখালেন। দিনে একবার আর রাত্রে আরেকবার মনকে সম্পূর্ণ চিন্তাশূন্য করে দেহকে শিথিল করে ফেলতে হবে। এখন হিন্দোল আর অদীনার শোবার ঘর আলাদা, অদীনাকে কোনোভাবে ডিস্ট্র্যাক্ট করা চলবে না বলে ডাক্তারের পরামর্শেই হিন্দোল এই ব্যবস্থা করেছে।

দেহমন শিথিল করে মনকে চিন্তামুক্ত করার চেষ্টায় প্রথম কিছুদিন একেবারেই সাফল্য পায়নি অদীনা। যত মনকে চিন্তাশূন্য করতে যায় তত দেওয়ালির সময়ের শ্যামাপোকার মতন পিল পিল করে চিন্তাভাবনা, সুখ দুঃখের স্মৃতি সব উড়ে আসে। জটলা পাকায়, সব ঘুলিয়ে দেয়। বেশ কিছুদিনের প্রবল চেষ্টার পরে এখন অদীনা মনকে চিন্তাশূন্য করে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আর ঘুমোলে সে ধারাবাহিকভাবে রোহিতাশ্বের জীবনের ঘটনাক্রম দেখতে পায়, একদম জীবন্ত স্বপ্ন, স্পষ্ট সব দেখতে পায় সে।

ঘুম ভেঙে সে খুব অবাক হয় প্রতিবারই। কে রোহিতাশ্ব? কেন সে তাকে স্বপ্নে দেখে? গতজন্ম সে বিশ্বাস করে না সচেতনভাবে, তাই এটাকে বিগত কোনো জন্মের কথাও সে ভাবতে পারছে না। তাহলে এর ব্যখ্যা কী? হয়তো ডক্টর হপকিন্স কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। কিন্তু অদীনা ঠিক করতে পারছে না সে কীভাবে ডাক্তারকে এসব বলবে অথবা আদৌ বলবে কিনা! ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে অদীনা।

সকালে ওকে ডেকে তোলে হিন্দোল, হাতে গরম ধোঁয়াওঠা সাদা টার্কিশ তোয়ালে। অদীনার হাতে সেটা দেয় হিন্দোল, অদীনা গরম তোয়ালে মুখের উপরে হাল্কা চেপে ধরে ঘুম থেকে বেরিয়ে আসে, এই গরম ভাপটুকু আর কোমল স্পর্শটুকু ভারী আরামদায়ক। তারপরে মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে একেবারে স্নান সেরে বেরোবে অদীনা। হিন্দোলের আগেই সেসব হয়ে গেছে, সে তখন ব্রেকফাস্ট বানায়।

অদীনার ভালো লাগে এই যত্ন, আবার মাঝে মাঝে কেমন অপরাধী অপরাধী মনে হয় নিজেকে। যেন দাম না দিয়ে এত যত্ন চুরি করে নিচ্ছে সে। অদীনার এমন কী আছে যে এইভাবে জীবনপাত করে ওকে যত্ন করছে হিন্দোল? নিজের সম্পর্কে উদাসীন অদীনার চোখে পড়ে না আয়নার ভিতরের সুন্দরী যুবতীর দিকে, তার বুদ্ধিদীপ্ত জ্বলজ্বলে চোখের দিকে, সুন্দর পদ্মকলির মতন আঙুলগুলোর দিকে, রেশমের ঝর্ণার মতন একঢাল সুন্দর চুলের দিকে। আনমনে গুনগুন করতে করতে স্নান করে অদীনা, ফেনা করে সাবান মাখে, চুলে শ্যাম্পু ঘষে আস্তে আস্তে, শাওয়ারের জলধারার নিচে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ভারী আরামে ভাবতে থাকে স্বপ্নে দেখা যমজ মেয়ে দুটির কথা। আহা, মাত্র তিন বছর বয়স থেকে ওরা মা ছাড়া। কী হলো ওদের তারপরে? ঠিক যেন একটা ধারাবাহিক গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েছে অদীনা।

(চলবে)


মন্তব্য

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

মজা লাগছে। টাইম ট্রাভেল মনে হচ্ছে।

তবে প্রথম অংশে অদীনার স্মৃতির সাথে (দেশভাগ, গ্রামের স্মৃতি) অদীনার বর্তমানকে মেলাতে গিয়ে ধন্দে পড়েছি। বারবার খালি মনে হচ্ছে অদীনার বর্তমান আমাদের বর্তমান সময়ের চেয়ে অনেক দূর ভবিষ্যতে, যদিও গল্পে কোথাও এমনটি বলা নেই!

খুব আগ্রহ নিয়ে পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম, বেশী দেরী করিয়ে রাখবেন না যেন!

____________________________

তুলিরেখা এর ছবি

কমেন্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ প্রোফেসর।

অদীনার বর্তমান আর আমাদের বর্তমান একই কালে। ওই দেশভাগ, গ্রামের স্মৃতি এইসব ওর কাছে জীবন্ত হলেও সেসব ওর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না, বাবামায়ের কাছে শোনা। কিন্তু ওর মন খানিকটা অন্যরকম, একদিকে খুবই কল্পনাপ্রবণ আর সেনসিটিভ, আবার অন্যদিকে বেশ দুর্বল, সামান্যতেই অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তাই ওর কাছে কাহিনির পরতগুলো খুলে খুলে যাচ্ছে খুবই অদ্ভুত অচেনার মতন।

পরের পর্ব দিয়ে দিয়েছি আজ। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তীরন্দাজ এর ছবি

খুব সুন্দর লেখা। ভালো লাগছে, ভালো থাকবেন।

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ তীরন্দাজ। খুব ভালো লাগলো আপনার কমেন্ট পেয়ে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

বনি এর ছবি

চলুক পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ বনি, অনেক ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।