ইস্কুলবেলার গল্প(৩০)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: রবি, ২৫/০৫/২০১৪ - ৩:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোট্টোবেলার বন্ধুত্বের স্মৃতি ভারী মধুর। দুনিয়ার নানা জটিলতা তখনও জানা থাকে না বলে প্রথম বন্ধুত্বগুলো একেবারে অমলীন, শরতের শিশিরবিন্দুর মতন টলটলে, নির্মল। ঠিক যেন সবুজ পাতার উপরে মুক্তোবিন্দুর মতন জমে আছে, নতুন ওঠা সূর্য ঝলমল করছে তার ছোট্টো দেহে।

ছোটোবেলার বন্ধুবিদায়ের স্মৃতিও ভারী করুণ। অনেকে ভাবেন ছোটোরা বুঝি ভালোবাসা ব্যাপারটা সেভাবে বোঝে না, আরেকটু বড়ো হয়ে কৈশোরে পৌঁছে তবে বুঝতে পারে। কিন্তু তা নয়। অদ্ভুত অসহায় ভালোবাসায় ভরা থাকে ছোটোদের মন, তাই বন্ধুজনকে হারানোর বেদনা ছোটোরা যেমন করে বোঝে, তেমন আর কেউ বোঝে না। বড় হয়ে উঠলে ডাইনে বামে নানা ফ্যাক্টর জানা হয়ে যায়, তখনকার বন্ধুত্বে নানারকম টানাপড়েন, ব্যক্তিস্বার্থ ইত্যাদি এসে পড়ে অনিবার্যভাবে, কিন্তু একদম শিশুবেলার ভালোবাসা একেবারে বিশুদ্ধ।

কিন্ডারগার্টেন ক্লাসের স্মৃতি মনে করতে করতে মনে পড়ছে দুটো নাম-রাজদীপ আর মধুছন্দা। এই দুই বন্ধু কেজি -টুতে উঠেই বিদায় নিয়ে চলে গেল, ওদের বাবারা চাকরিতে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন কিনা, তাই ওদেরও চলে যেতে হলো।

আজকে স্মৃতির সমুদ্রের শত শত হাত জলের তলে ডুবে দেখি সেই শিশুবেলার মুখ দুটো, টুলটুলে সুন্দর দুটো মুখ, মধুছন্দা আর রাজদীপ। সেই যে কেজি-টু থেকে ওরা চলে যাচ্ছে, সেইটাই শেষ দেখা, আর দেখা হয় নি। কেজানে এখন কোথায় ওরা। এখন দেখলে আর হয়তো চিনতে পারবো না, সেদিনের শিশুরা আজ পূর্ণবয়স্ক মানুষ, কতই হয়তো বদলে গিয়েছে তাদের মুখ, চোখ, কপাল, চিবুক, মুখের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারিকুরি যা দেখে মানুষকে আলাদা আলাদা করে চেনা যায়, সেই সবকিছু । কিন্তু তবু কি কোথাও সেই অমলীন শিশুমুখের কিছুই নেই? সেই বিস্ময়ভরা শিশুচোখের কিছু? নিশ্চয় কিছু আছে, সব মানুষের মধ্যেই তো শৈশবের সেই "আমি" টা লুকিয়ে থাকে বিশুদ্ধ বিস্ময় নিয়ে।

কেজি ওয়ানের সময়ের মধুছন্দাকে মনে পড়ে, ওর নামটা জানার পর আমাদের কেমন অবাক-খুশি, ওরকম নাম আগে তো শুনিনি! তারপরে আরেকদিনের কথা মনে পড়ে, দীপাঞ্জন হাসতে হাসতে জয়াকে বলছে, মধু খাবি? জয়া বলছে হ্যাঁ। দীপাঞ্জন বলছে, ছন্দা খাবি? জয়া একটু থমকে ভাবছে ছন্দা খাওয়া যায় কিনা। তারপরে হয়তো ভাবলো ওটা চপ বা বেগুনীর মতন কিছু, মাথা হেলিয়ে বললো হ্যাঁ। দীপাঞ্জন হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে বললো তাহলে তো মধুছন্দাকেই খেয়ে নিবি!

সেই মুহূর্তে মধুছন্দা এসে হাজির ওদের সামনে, বললো, কী বলছিস রে তোরা?

আহ, টুকরো একটা মিষ্টি ছবির মতন ফিরে এলো ঘটনাটা। কেজানে মধুছন্দার মনে আছে কিনা, অথবা জয়া বা দীপাঞ্জনের মনে আছে কিনা। ওদেরও তো ক্লাস ফোরের পরে আর দেখিনি, ওরা আমি যে হাইস্কুলে গিয়েছিলাম সেখানে তো পড়েনি! অন্য স্কুলে পড়তো।

আর রাজদীপকেও মনে পড়ছে, গোটা গোটা মুক্তোর মতন হাতের লেখা ছিল রাজদীপের। অসাধারণ সুন্দর সেই হাতের লেখা। কেজি টুয়ের দিদিমণি একেবারে মুগ্ধ ছিলেন ঐ সুন্দর হাতের লেখা দেখে। ও যখন বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে তখন দিদিমণি আরেক সহকর্মীর কাছে দুঃখপ্রকাশ করছিলেন, আহা আমাদের ভালো হাতের লেখার ছাত্রই চলে যাচ্ছে।

এই যে ছোট্টোবেলার শেষ দেখাগুলো, মনের অনেক অনেক পরতের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল, আজ ইস্কুলবেলার কথা লিখতে লিখতে মনে পড়ছে সব, মনে হচ্ছে যেন গতকালের কথা। অথচ এতদিন নিজেরই কোনো ধারণা ছিল না এইসব স্মৃতি যে আছে সেই সম্পর্কে। ঠিক যেন সেই গানের মতন, "ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি/ মিলনের উৎসবে তায় ফিরায়ে দিও আনি।" হয়তো ছোটোবেলার সেই বিদায় নিয়ে দূরে চলে যাওয়া বন্ধুরা কোনোদিন ফিরে আসবে উজ্জ্বল হাসিমুখে, খুশিভরা চোখে কোনো মিলনের উৎসবের আলোকোজ্জ্বল লগ্নে।

এক বন্ধু কিন্তু ফিরে এসেছিল স্কুলজীবনেই। চন্দ্রিমা। ক্লাস ওয়ানে বিদায় নিয়ে সে চলে গিয়েছিল অনেক দূরের কোনো রাজ্যে, সেখানে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন ওর বাবা। সেইখানে নাকি ভারী সুন্দর এক জলপ্রপাত ছিল, মার্বেল পাথরের উপরে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে জলধারা, ধাক্কা খেয়ে চূর্ণ চূর্ণ জলকণা ধোঁয়ার মতন উপরে উঠে আসে। সেই বিখ্যাত জলপ্রপাতের কথা পরে আমরা ভূগোলে পড়েছি।

ক্লাস সিক্সে ফিরে এসে চন্দ্রিমা ভর্তি হয়েছিল আমাদেরই হাইস্কুলে, আমাদেরই সেকশনে। খুব অবাক খুশি হয়েছিলাম আমরা, পুরনো প্রাইমারি স্কুলের অনেকেই তখন আমরা ঐ হাইস্কুলে পড়তাম। চন্দ্রিমার ফিরে আসা খুব আনন্দের ছিল আমাদের কাছে, অপ্রত্যাশিত খুশির। দুই ক্লাসের মাঝের অবসরে অথবা টিফিনের ছুটিতে আমরা প্রায়ই ওর কাছে সেই দূর রাজ্যের গল্প শুনতাম, সেখানের স্কুল কেমন ছিল, মানুষজন কেমন ছিল, মাঠঘাটরাস্তাবনজঙ্গল কেমন ছিল-সেসব শুনতাম খুব আগ্রহ নিয়ে। যেন এক রূপকথার রাজ্য থেকে অভিযান সেরে ফিরেছে আমাদের বন্ধু।

(চলবে)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল।
চলুক
সোহেল লেহস

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সোহেল লেহস। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

এক লহমা এর ছবি

চলুক হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তুলিরেখা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটি পড়ে সেই ছোট্ট বেলার অনেক স্মৃতিই মনে পরে গেল। ধন্যবাদ আপনাকে আবার ফিরিয়ে নেবার জন্য সেই সুন্দর দিনগুলোতে।
-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তাহসিন রেজা এর ছবি

ইস্কুলবেলার গল্প আমার খুব প্রিয় হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

তুলিরেখা এর ছবি

শুনে অনেক ভালো লাগলো তাহসীন রেজা। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে নিজের ইস্কুলবেলার গল্প মনে পড়ে গেল।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

তুলিরেখা এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার মতন করে আরও অনেকেই বলেন যে ওঁদেরও মনে পড়ে নিজেদের ইস্কুলবেলা, শুনে ভালো লাগে। এই সামান্য লেখার এই তো সার্থকতা!

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।