ইমা(২)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: রবি, ২২/০২/২০১৫ - ৩:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা মানে আমি রিমা মা-বাবা আর তিন্নিমাসীরা মানে তিন্নিমাসী, অরুণমেসো আর ওদের তিনবছর বয়সী ছোট্টো মেয়ে বুবলি সবাই মিলে বেড়াতে এসেছি। তিন্নিমাসী মায়ের স্কুলের বন্ধু ছিল। মা আর তিন্নিমাসী একসঙ্গে পড়েছিল ক্লাস ফাইভ থেকে টেন অবধি।

গতকালের সন্ধ্যেবেলার কথা। বড়দের কথাবার্তার সময় সেখানে যাওয়া বারণ, তাই বসার ঘরে মা আর তিন্নিমাসী কথা বলছে শুনে আমি জল খেতে ঢুকতে গিয়েও আবজানো দরজার বাইরে থেকেই চলে আসছিলাম। কিন্তু কেন জানিনা চলে আসতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লাম। শুনলাম তিন্নিমাসী মাকে বলছে, "নমিতা, তোর রিমাটাকে নিয়ে সমস্যা হবে না, ফর্সা মেয়ে রিমা। কিন্তু ইমাটাকে নিয়ে ভুগতে হবে, ও যা কালো! যমজ মেয়েদের গায়ের রঙে এত তফাৎ হয়, আগে শুনি নি। অবশ্য পরে রঙ পরিষ্কারও হয়ে উঠতে পারে। ভালো করে কাঁচা হলুদবাটা লাগাতে পারিস তো ইমার মুখেটুখে হাতেটাতে।"

মা কী বললো শোনার জন্য আর ওখানে দাঁড়াই নি, অদ্ভুত একটা কষ্টে আর ভয়ে দম বন্ধ হয়ে যাবার মতন অবস্থা হলো, নিঃশব্দে পা টিপে টিপে চোরের মতন ওখান থেকে চলে এলাম ছাদে। ছাদে এসে যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। খোলা আকাশের নিচে খোলা হাওয়ার স্পর্শ না পেলে হয়তো দম বন্ধ হয়েই মরতাম।

চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম রিমা কোথাও আছে কিনা, রিমা ছাদে ছিল না। কেজানে কোথায় ছিল সে। আমার মনের চোখে কেবল ভেসে উঠতে লাগলো রিমার ফর্সা ফুটফুটে সুন্দর মুখটা! ঐ মুখ কী যে ভালোবাসতাম একটু আগেও! অথচ তিন্নিমাসীর কথাগুলো বিষমাখানো তীরের মতন যেই বুকের মধ্যে ফুটে গেল অমনি রিমার ফর্সা সুন্দর মুখটা আমার নিজেরই ঈর্ষায় বিকৃত হয়ে উঠতে লাগলো মনের মধ্যে। কেন আমরা এতটা আলাদা দেখতে?

আস্তে আস্তে স্মৃতি থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ভেসে আসতে লাগলো যা এতদিন সেভাবে মনেই রাখিনি। মনে পড়তে থাকে, মনে পড়ে যেতে থাকে। আর অদ্ভুত একটা অজানা আতঙ্কে আমার মনের ভিতরটা কেমন অবশ অবশ হয়ে আসে।

আমি ছোটো থেকেই বেশ দুরন্ত, এই দৌড়ে যাচ্ছি মাঠে খেলতে, এই দৌড়ে গিয়ে উঠোনের আমগাছে উঠে পড়ছি, এই চলে যাচ্ছি পুকুরের দিকে- আমাকে নিয়ে বড়রা বেশ ব্যতিব্যস্ত থাকতো।

রিমা ছোটো থেকেই শান্ত লক্ষ্মীমেয়ে। বড়রা সবাই আমায় বলতো, "ইমা, দ্যাখ তো রিমা কত লক্ষ্মী, শান্ত হয়ে চুপটি করে বসে পুতুল নিয়ে খেলছে। তুই অমন হতে পারিস না?"

আমি মাথা দুইদিকে নাড়িয়ে বলতাম "না না না, আমার পুতুল খেলতে ভালো লাগে না। আমি দৌড়োদৌড়ি খেলতে চাই। আমি গাড়ী গাড়ী খেলতে চাই। আমি গাছে উঠতে চাই, পুকুরে সাঁতার দিতে চাই।" সেই ছোটোবেলা থেকেই আমার নিজস্ব মতামত বেশ জোরালো ছিল।

আমি নানারকম দুষ্টুমী করে বেড়াতাম আর মাঝে মাঝেই বাবা অথবা মায়ের কাছে খুব শাস্তি পেতাম। শাস্তি মানে বেধড়ক পিটুনি। খুব মার খেতাম আমি। বাবা বা মা কেউ আমায় মায়াদয়া করতো না একটুও। মারধোর আর বকুনি খেয়েও নিজের মতই দুরন্তপনা করে যেতাম আমি, কেজানে একটা সময়ে হয়তো বুঝতে পেরেছিলাম শান্ত হতে চাইলেও আমি শান্ত হতে পারবো না।

রিমা চুপ করে দেখতো আর নিজেই ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। কারুকে কিছুই বলতো না কোনোদিন, কেমন যেন গুটিয়ে যেত ভেতরে ভেতরে। একদিন চুপি চুপি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল রিমা, "ইমা তুই কি তাহলে আমার নিজের বোন না? বাইরের কেউ? নইলে এমন নিষ্ঠুরভাবে মারে কেন তোকে বাবা-মা?"

আমি বলেছিলাম, "তাই তো রে রিমা! আমায় মনে হয় কোথাও থেকে কুড়িয়ে এনেছে ওরা।"

হাসতে হাসতেই বলেছিলাম, তবু কোথায় যেন কান্না ছিল ভিতরে। সেই সময় তত বুঝতে পারিনি, এখন আবার যেন বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা ঝর্ণার মুখের মতন খুলে যাচ্ছে সব।

আমাদের ঠাকুমা তখনও বেঁচে ছিলেন, তিনি মার খেয়ে মাটিতে পড়ে ফোঁপাতে থাকা ছোট্টো আমাকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে যেতেন, আমার কাটাগুলোতে মলম লাগিয়ে দিতেন।

আমার চুলে হাত বুলিয়ে কেমন মায়ালু গলায় বলতেন, "আহারে, কেমন করে মেরেছে! আর তুই কেন একটু শান্ত হোস না? কেন এত দুরন্তপনা করে বেড়াস? "
কখনো বলতেন, "আহা তুই যদি ছেলে হয়ে জন্মাতি কত ভালো হতো। তোর বাবামায়ের যে বড় ছেলের সাধ। একে তো মেয়ে তার উপরে আবার কালো! ওদের তাই তো এত রাগ।" ঠাকুমার কথাগুলোর মধ্যে কেমন দু:খ, স্নেহ আর করুণা এক হয়ে মিশে থাকতো। আরও কিছু থাকতো যা আমি বুঝতে পারতাম না।

একদিন বলেছিলাম,"ঠাম্মা, আমায় নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাও না কেন তুমি? তুমি আর আমি থাকবো, ওরা কেউ আমাদের নাগাল পাবে না। আমি তোমার সব কাজ করে দেবো ঠাম্মা, আমায় নিয়ে পালিয়ে চলো তুমি।"

সেই ঠাকুমা একা একাই পালিয়ে গেলেন। এমন জায়্গায় গেলেন যেখান থেকে আর কেউ কোনোদিন ফেরে না। আমার আর রিমার তখন আট বছর বয়স।

আস্তে আস্তে ছাদের উপরে বসে পড়লাম। মুখ তুলে চাইলাম উপরের দিকে। সন্ধ্যার আকাশে একটা একটা করে দেখা দিচ্ছিল তারা। মিটমিট করে তিরতির করে কাঁপছিল ওদের আলো।

মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায় ? কোন্‌ তারাটা ঠাকুমা? উপরের তারাটাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, "এই, তুমি কি ঠাকুমা? "

রিমা খুঁজতে এসেছিল আমায়। ছাদে বসে থাকতে দেখে কাছে এসে বলেছিল, "এই ইমা, এইভাবে একা একা ছাদে বসে আছিস কেন? নিচে কত খুঁজছি তোকে, পাই না। চল, নিচে জলখাবার খেতে ডাকছে। "

রিমার সঙ্গে নেমে এসেছিলাম নিচে। তারপরে দিব্যি স্বাভাবিকভাবে জলখাবার খেলাম সবার সঙ্গে, মায়ের কাছে হাল্কা বকুনিও খেলাম একা একা ছাদে গিয়ে বসে থাকার জন্য। কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না আমার আচরণে, অথচ আমার বুকের ভিতরটা কেমন অদ্ভুত ঠান্ডা বরফের মতন শক্ত হয়ে গিয়েছিল।

রাতের বেলা অল্প একটু খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে কেবল স্বপ্ন দেখছিলাম, অদ্ভু্ত সব স্বপ্ন।

( চলছে )


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ইমারা এমনি করেই ঈর্ষায় পোড়ে একদিন, আমরাই ওদের কোমল মনটা বিষিয়ে তুলি ধীরে ধীরে। সুন্দর লেখা। আর ‘আবজানো দরজা’, ‘ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম’ শব্দগুলো অনেক দিন পর দেখলাম চলুক

দেবদ্যুতি

তুলিরেখা এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ দেবদ্যুতি। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
আবজানো দরজা চিরকাল শুনেছি মায়ের মুখে, লেখা্য় ব্যবহার করতে ইচ্ছা হলো। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মুক্তমন এর ছবি

নিতান্তই দুঃখজনক ঘটনা৷শেষ পরিণতি দেখার অপেক্ষায় থাকব৷

তুলিরেখা এর ছবি

হুঁ, এই ধরনের ঘটনা আমাদের সমাজে আকছার ঘটছে। এই আট ন'বছরের বাচচা মেয়েরা যখন দু:খী মুখে ছড়া বলে, "ফরসা, মা-বাবার ভরসা" তখন মনে হয় আমাদের আপাত উন্নত সমাজের ভিতরে ভিতরে কোণায় কোণায় কত অন্ধকার আজও।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার ঠাকুরমা ছিল খুব ফর্সা আর দাদু ছিল খুব কালো । একদিন ঠাকুরমা কে প্রশ্ন করেছিলাম কেন এমন কালো মানুষ কে বিয়ে করেছিল? উওরে বলেছিল গুনের কোন বর্ণ নেই। খুব অবাক হয়েছিলাম এই কথা শুনে।

যাক সে কথা, এখনো ইমারা আছে প্রায় পরিবারে ও অবহেলায় বড় ও হচ্ছে।জানিনা মা বাবাদের মানষিকতাটা এই রকমই হয় কেন?একটা মেয়ে কালো হলে তার প্রতি কেমন যেন একটা অবহেলার দৃষ্টি ফেলে রাখে।

মন টা উদাসীন হয়ে গেল।

-----------
রাধাকান্ত

তুলিরেখা এর ছবি

রাধাকান্ত, একদম ঠিক, গুণের কোনো বর্ণ নেই।
কিন্তু আয়রনিটা কোথায় জানেন, দাদু কালো ঠাকুরমা ফরসা, বাবা কালো মা ফরসা এই সেট যত পাবেন ঠাকুরমা কালো দাদু ফর্সা বা মা কালো বাবা ফরসা এইরকম সেট তত পাবেন না। দ্বিতীয় দল খুব বিরল।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

ইমাকে একটু হইচই- লাফঝাঁপ করতে দেন। এমন বিষণ্নতা নিয়ে গুমোট হয়ে গেলেতো বুক ভার হয়ে আসে।

স্বয়ম

তুলিরেখা এর ছবি

ইমা হইচই লাফঝাঁপ করে আর তার জন্য মারধোর খেতে খেতেই বড় হচ্ছে তো! তুলনায় রিমা বরং শান্ত লক্ষ্মী মেয়ে, দুরন্তপনা করে না।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

তুলিরেখা আপনার কথার সাথে সহমত। যদিও বলে উপরের দিকে থুথু ছিটালে নিজের উপরে পরে । আমার দাদুটা ছিল একটা গোয়ার আমার ঠাকুরমা ঠিক ইমার মতো করেই খুব কষ্টে থাকতো।বর্তমানে ইমার মতো মেয়েদের আমার চোখে পড়ে অহরহ।ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা মনের ও সমাজের এই দৈন্যদশা কখন মিটবে?

-------------
রাধাকান্ত

তুলিরেখা এর ছবি

কী আর বলি বলেন! এই তো অবস্থা !

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

এক লহমা এর ছবি

চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তুলিরেখা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

তবে ইমাদের ছন্দ যাদের মধ্যে আছে তারা কোন কিছুকে পরোয়া করে না। এগিয়ে যায় সংকটকে উপেক্ষা করে।

----------
রাধাকান্ত

তুলিরেখা এর ছবি

হ্যাঁ, কোনো কোনো মানুষ পারে, সব বাধাবিঘ্ন উত্তীর্ণ হয়ে এগিয়ে যেতে। সেভাবে দেখতে গেলে ঐভাবে সব বাধা পার হয়ে যেতে পারে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ। বেশীরভাগ মানুষ পারে না সেভাবে, মেনে নিয়ে মানিয়ে নিয়ে থাকে। সে একরকম বোঝাপড়া করে থাকা। বলতে গেলে আমরা অনেকেই তো ওরকম বোঝপড়া করেই বেঁচে থাকি।
এই আর কী। জীবন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো হচ্ছে হাসি

মহাবিশ্বের পরিব্রাজক

অতিথি লেখক এর ছবি

বোঝাপড়া করে থাকতে গিয়ে শুধু থাকার জন্যই থাকা হয়, আসলে তখন জীবনের সৌন্দর্যবোধ হারিয়ে যায়। আপনি ঠিকই বলেছেন তুলিরেখা সব বাধা পার হয়ে যেতে পারে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ কারন সমাজের কথা বাদই দিলাম পরিবার ই সাথে থাকে না আত্মবিশ্বাস কে জন্মানোর জন্য।

-----------
রাধাকান্ত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।