বুড়ো হাবড়া তুঁত

??? এর ছবি
লিখেছেন ??? (তারিখ: মঙ্গল, ১৭/০৭/২০০৭ - ১১:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
(২০০৬ সালের ৬ এপ্রিল কবি মুস্তফা আনোয়ারকে দেখতে পিজি যাই। কোমায় ছিলেন তিনি, আমি যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর। মুস্তফা আনোয়ার মূলধারার বাংলাসাহিত্যে হয়ত অপরিচিতই থেকে যাবেন। কিন্তু তার কাব্যগ্রন্থ "তুঁত", গদ্যগ্রন্থ "ক্ষুর" আর কাব্যনাটক "কোনো ডাকঘর নেই" যারা পড়েছেন কেবল তারাই জানবেন সাহিত্যের ইতিহাস মুর্খদের হাতে রচিত হয় কিনা। আমার লেখাটি তাঁর মারা যাওয়ার দিন সন্ধ্যায় লেখা। আমি স্রেফ মারা যাওয়ার একটা নিউজ দিতে গেছিলাম সংবাদপত্রের অফিসে, কিন্তু তাদের চাপে, তদুপরি তাকে নিয়ে ঐ মুহূর্তে লেখার কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে, আমাকেই এই অবিচুয়ারি লেখতে হল। ছাপা হয়েছিল দৈনিক সমকালের কালের খেয়ায়।)

কবি মুস্তফা আনোয়ার পিজি-র আইসিইউ-তে চুপচাপ মারা গেছেন। তিনদিন ধরেই কোমায় ছিলেন তিনি। একটা ফুসফুস পানিতে ভর্তি, তার ওপর আবার ম্যালিগন্যান্সিও ধরা পড়েছে। আজ সকাল থেকে কিছুতেই ব্লাড প্রেসার উঠানো যাচ্ছিল না। মারা যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার, ডিউটি ডাক্তারের নির্লিপ্ত গলা। আইসিইউ-র বাইরে বসে ছিলেন তার বোন। দেখে মনে হল, পিঠাপিঠি বোনই হবেন। চোখে কালি, কাকে যেন বারবার ফোনে ট্রাই করছিলেন।

এর মধ্যে এক টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক আর ক্যামেরাম্যানকে দেখে ডাক্তার রীতিমত থ। এসব কেন, কে ইনি? ডাক্তার-নার্সরা জিজ্ঞাসু। এতিমের মত প্রায়-একা পড়ে থাকে যে কোমা-নিবাসী লোকটা, তার জন্য ক্যামেরা কেন? আজকাল ক্যামেরা কি সস্তা হয়ে গেল নাকি? একজন এসে সাংবাদিককে নিরস্ত করতে চেষ্টা করলেন। বললেন, এখানে ছবি তুলতে পারমিশন লাগবে। পারমিশন নিয়ে আসেন। সাংবাদিক পোড় কম খান নাই। তিনি ক্ষান্ত দেয়ার ভাব করলেন, কিন্তু ক্যামেরা তার আপন গতিতে চলল।

হঠাৎ করেই ডিউটি নার্স আমাদের সবাইকে বাইরে যেতে বললেন। মুস্তফা ভাইয়ের বেডের চারপাশে দ্রুত পর্দা টেনে দেয়া হল। হাসপাতাল তার সবচেয়ে প্রিয়তম অকুস্থল, লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু এখন পর্দা কেন? পর্দা মানে তো যবনিকা! তখনো তো তার বুক উঠানামা করছে। স্পষ্ট দেখছি যে!

ঐ টা আর্টিফিসিয়্যাল, ডাক্তার এবার আরো ঠান্ডা। মেশিনের ইফেক্ট। কার্ডিয়্যাক ম্যাসেজ দেয়া হল এই মাত্র, ফলাফল শূন্য। "এক্সপায়ার" করার পরও এই ম্যাসেজ দিয়ে অনেককেই "ফেরত" এনেছেন, ডাক্তার জানালেন ঐশ্বরিক হাসিযোগে। প্রযুক্তি মানুষের দেখার ধরণকেও বদলে বুঝি এভাবে। নইলে এখন বুক উঠানামা-করা কবি মুস্তফা আনোয়ারকে কত না সহজে একটি মৃতদেহ বলে মানছি আমরা! মৃতের সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে, মৃত্যুর সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে!

আইসিইউ-তে মড়াকান্না বারণ। তাই ভাইয়ের শোক প্রকাশের জন্য প্রৌঢ় বোনকে ব্লকের বাইরে আসতে হল। তিনি বুকফাটা কাঁদলেন আয়শা ঝর্নার গলা-ধরে। একাই। কী সব যেন বলছিলেনও? আমি শুনতে চেষ্টা করি। বোঝা যাচ্ছে না, ভাঙা ভাঙা সব বাক্য। হয়তো তাদের পিঠাপিঠি শৈশবের ফ্রেজিং, যার ধ্বনিমূল্য আছে। হয়তো তাদের অর্থমূল্য ভাইয়ের মৃত্যুর সাথে সাথে চিরকালের জন্য হারাল। হয়তো এই ধ্বনিগুলোরও মৃত্যু ঘটবে আজ। মনে পড়ল, মুস্তফা আনোয়ার লিখেছিলেন, এতোদিন রসায়ন লেখাপড়া শিখলাম খামাখা, চল্লাম, বিদায়।

কদিন ধরে বিকাল হলেই আকাশ কাল হতে আরম্ভ করে। শামিমা বিনতে রহমান বলছিলেন, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মেঘলা আকাশের জন্য হয়ত নয়, হয়ত এই মরণটুকুর নিউজমূল্য নিয়ে বার্তাপ্রধানের সাথে ফাইট দেয়ার জন্য! লাশ কোথায় যাবে? যশোরে? যশোরে কি তুঁতগাছ আছে? যার নিচে "দুই রফিকের" জন্য অমেয় জলের ধারা খুলে দেবেন এই কবি? আমাদের এই চিরতরুণ নিভৃতিপ্রিয় বান্ধব?

নিচে নামতে নামতেই বৃষ্টি। বৃষ্টি টিপটিপ করে পড়ছে হাসপাতালে, ম্যানহোলে, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ আর স্যালাইন ব্যাগ যেখানে ফেলে দেয় সেই ডাস্টবিনে। লম্বা করিডোর দিয়ে এক রোগীকে চাকাওলা স্ট্রেচারে শুইয়ে ঠেলতে ঠেলতে লিফটে ঢোকাচ্ছে কয়েকজন। বৃষ্টি আর বাতাস মিলে হাসপাতালের মত নীরব আর দর্শনার্থীর মত উদ্বিগ্ন একটি দ্বৈততা। আমার খুব চায়ের ইচ্ছা পেল।

আলকাতরার রাতে চিত হয়ে শুয়ে থাকব কবে, এমনি-দিনে,
বৃষ্টিতে, আ! সে ঘরকাতর সিঁড়িপথ, অজগর লম্বা।

ওপরে, পিজি-র আইসিইউ-তে শেষ ঘুমে তলিয়ে গেছেন আমাদের প্রিয় কবি মুস্তফা আনোয়ার। জীবিতাবস্থায়, কী কবিতায় কী জীবনে, তরুণদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি। সাহসী আর স্বত্বাভিমানশূন্য এই কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের মত মাত্র বিশোর্ধ তরুণ কবিদের। চার দশকের কবিতাচর্চা দিয়েও যে নিভৃতিকে তিনি ভাঙেন নাই, একটি সাদামাটা মৃত্যুসংবাদ সম্বল করে আমি সেটা ভাঙার জন্য পত্রিকা অফিসে যাচ্ছি!


মন্তব্য

??? এর ছবি

ছবিটা তো দেখা যাচ্ছে না। কী করি?

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

যুক্ত করিয়া দিলাম। কবির জন্য বেদনায় ভারাক্রান্ত হইল মন।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ভালো লাগলো পড়ে।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সংগ্রহে থাকলে, তাঁর কিছু কবিতা পোষ্ট করুন ।

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

কেমিকেল আলী এর ছবি

ভাল লাগল না

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

সুমন, গত কয়েক বছরে আমাকে বেশ কয়েকটা অবিচুয়ারি লিখতে হয়েছে। আপনিও পিছিয়ে নেই দেখছি।

খুব মন খারাপ করা লেখা। মুস্তফা আনোয়ার এমন নিভৃতচারী ছিলেন যে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই তাঁর নামও শোনেনি।

তাঁর একটি অমর কীর্তির কথা স্মরণ করা উচিত। ৭১-এ যুদ্ধের সময় কামরুল হাসানের করা জান্তব ইয়াহিয়া খানের মুখ সম্বলিত বিখ্যাত পোস্টারের কথাগুলি মনে আছে? "ওরা মানুষ হত্যা করছে। আসুন আমরা পশু হত্যা করি।" লিখেছিলেন মুস্তফা আনোয়ার।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

??? এর ছবি

ধন্যবাদ মা.মু., অভি, হাসান মোরশেদ, কেমিকেল আলী এবং মুহাম্মদ জুবায়েরকে। হাসান মোরশেদ, মুস্তফা ভাইয়ের কিছু লেখা আমার বাক্স-পেটরার মধ্যে কোথাও আছে। খুঁজছি। পেলে শেয়ার করব। জুবায়ের ভাই, আপনার তথ্যের জন্য শুকরিয়া। হ্যাঁ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি, কামরুল হাসানের ছবির ক্যাপশন লিখেছিলেন এটা জানতাম না। তবে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিলেন। উনি সারাজীবন রেডিওতেই চাকরি করেছেন। এত কিছুর পরেও প্রয়াত অভিনেত্রী নাজমা আনোয়ার-এর স্বামী হিসেবেই লোকে তাকে চিনত!!

কনফুসিয়াস এর ছবি

ওনার লেখা পড়তে চাই। কেমন করে কোথায় পাই? নেটে পাওয়া যায় কোথাও?
আপনার লেখাটা... এরকম লেখায় মনে হয় 'ভাল লাগলো' কমেন্ট করা মানায় না। তবু, ভাল লাগলো।
-যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

হযবরল এর ছবি

মুস্তাফা আনোয়ারের কথাও জানলাম আজ। সকাল বেলা কাজে এসে এরকম সাবলীল লেখা পড়তে যে কত ভাল লাগে সেটা বোধকরি ধন্যবাদ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়।

??? এর ছবি

ধন্যবাদ কনফুসিয়াস এবং হযবরল। মুস্তফা আনোয়ার-এর লেখা নেট-এ পাওয়া যায় না। সম্ভবত ইমরুল হাসান তার কবিতা নিয়ে যে পোস্ট দিয়েছেন, সেটাই আন্তর্জালে মুস্তফা আনোয়ারের প্রথম প্রবেশ। তিনি বিদ্যমান পুস্তক সংস্কৃতিতে খুবই অবহেলিত একটি নাম, তার কোনো বইই কোনো রিকগনাইজড পাবলিশার বের করেনি।

এই ধরনের একটা দীর্ঘ তালিকা করা সম্ভব। জরুরিও। যারা প্রকাশকের আর লেখক-রাজনীতির দৌরাত্ম্যে আজ বিস্মৃতপ্রায়, তাদেরকে ওয়েবের এই অনন্ত কলেবরে অন্তত স্মরণ করার মাধ্যমে আমাদের কিছু পাপক্ষালন হতে পারে। আরো অনেক নিভৃতিচর্চার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া যাবে, যদি আপনাদের আগ্রহ থাকে।

ফারুক হাসান এর ছবি

সুমন ভাই,আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।
আমাদের আগ্রহ আছে, আরো অনেক নিভৃতিচর্চার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিন।
-----------------------
এই বেশ ভাল আছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।