একুশে উদযাপন, একুশে বাণিজ্যঃ রুচির শেষ কোথায়, কোথায় কুরুচির শুরু

ইয়ামেন এর ছবি
লিখেছেন ইয়ামেন [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২০/০২/২০১৭ - ১২:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যখন পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলাম, তখন আমরা বাঙালী শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর একুশেকে কেন্দ্র করে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। আমাদের বাংলাদেশী ছাত্র সংগঠনের বাৎসরিক কর্যক্রমের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হতো সেটাই, ভার্সিটির বড় অডিটোরিয়াম ভাড়া করে এবং সবার জন্য উন্মুক্ত করে। যতদুর জানি আজও পার্ডুতে এটা অব্যাহত আছে। এখনকার কথা জানি না, তবে আমাদের সময় অনুষ্ঠানটার মৌলিক কাঠামো ছিল অনেকটা এরকমঃ শুরু মহান একুশের প্রেক্ষাপট, তাৎপর্য এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে স্লাইডশো/ভিডিও-সহ বিবরণ, এর পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেখানে বাংলা ভাষায় গান, নাচ, নাটক পরিবেশন। পরের দিকে আমরা অন্যান্য দেশের সংগঠনদেরও অংশগ্রহন করতে আমন্ত্রন জানাতাম, তাদের নিজস্ব ভাষায় কিছু পরিবেশন করার জন্য একটা আলাদা অংশ বরাদ্দ থাকতো। এটা করা হতো কারন 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া পর মহান একুশে শুধু আমাদের একার নয়, এই দিবসটি এখন সার্বজনীন।

তবে এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করতে গিয়ে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হতো না, এমনটা না। একবার এক সিনিওর ভাবী দাবী করে বসলেন যে 'একুশে'র ভাবগাম্ভীর্য সবই নষ্ট হয়ে যায় এমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করলে, এসব করা উচিৎ না। ইন ফ্যাক্ট, এর রেশ ধরে উনি আমাদের আয়োজিত সব অনুষ্ঠানই বয়কট করে বসলেন, আমি থাকা পর্যন্ত আর কোন ইভেন্টে তাকে দেখি নাই (জানি না এখনও তিনি সেই রাগ ধরে রেখেছেন কিনা)। উনার কথার যৌক্তিকতা কিছুটা ছিল। একুশে যে 'শহীদ দিবস', ভাষা-শহীদদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার ছিনিয়ে এনেছিলাম পাকিস্তানী শাসকদের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে, সেটা কোন পরিস্থিতেই ভোলা উচিৎ নয়। তাই দিনটি উদযাপন করতে হলে শ্রদ্ধা এবং রুচির ভিতরে থেকেই করতে হবে। আমরা সেসবের ভিতরে থেকেই আমাদের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটার আয়োজন করার চেষ্টা করতাম। তবে যদি কেউ মনে করেন যে শহীদ দিবসে কোন প্রকার উদযাপন না করে কেবল ভাবগাম্ভীর্যের সাথে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা-শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া আর কিছু করাটা অবমাননাকর, তাহলে সেই মতেরও যৌক্তিকতা আছে।

এই ভূমিকা টানার পিছনে কারন হলো গত কয়েক বছর ধরে এই 'রুচি এবং শ্রদ্ধা বজায় করে একুশে পালন' করার সীমাটা প্রিয় মাতৃভূমিতে বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মনে হয়। এর সাথে ব্যবসায়িক একটা সম্পর্ক আছে। যেমন আরও অনেক দিবসের মত একুশের জন্যও একটা নির্দিষ্ট বেশভূষার প্রচলন হয়ে গেছে। মূলত সাদা/কালো রঙের ফতুয়া, পাঞ্জাবী, কামিজ, শাড়ী, আরও বেশী আধুনিক হতে চাইলে সাদা-কালো টি-শার্ট, সাথে বর্ণমালার কিছু অক্ষর। এমন একটা প্রচলন হয়ে গেলে এটা স্বাভাবিক যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানরা চাইবে সেই দিবসকে পুঁজি করে নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে। সেটাতে হয়তো দোষের কিছু নেই। কিন্তু আবার সেই একই কথা, দোষটা এসে যায় যখন যেই দিবসটাকে ঘিরে ব্যবসা করতে চাইছেন, সেই দিবসের তাৎপর্যের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার বিষয়ে নুন্যতম বিবেচনাবোধের প্রয়োগ না করা। কিছু উদহারন নীচে দেই, এসবই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পাওয়া, আপনারা নিজেরাও হয়তো দেখে থাকবেনঃ

শহীদ দিবসকে ব্যবহার করে যখন প্রসাধনী বিক্রয়, তারিখটিকে পুঁজি করে যখন 'বিশেষ ছাড়' দিয়ে বাণিজ্য করার চেষ্টা চালানো হয়, তখন যে জিনিসটা রুচি থেকে কুরুচির দিকে চলে যাচ্ছে, সেটা বুঝা কঠিন কিছু না। শুধু এই না, চলুন মোবাইল ফোন নির্মাতা স্যামসাং এর একুশে-ভিত্তিক টিভি বিজ্ঞাপনটা দেখা যাক। এখানে একুশের ঠিক কোন বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে (একমাত্র প্রথম দিকে কিছু ছেলেমেয়ে কয়েকটা বর্ণমালায় রঙ লাগাচ্ছে, সেটা ছাড়া)? একুশে মানে কি রঙ এর উৎসব? না একুশে মানে সবার শেষে সবাই মিলে শহীদ মিনারের চত্বরে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে সবাই মিলে সেলফি তোলা? একই ধারায় এই বিজ্ঞাপনটাও দেখা যাক। আকিজ সিরামিক 'সবচেয়ে সুন্দর বর্ণ' বের করার প্রচারনা শুরু করেছে, সেটার জন্য কোন ওয়েবসাইটে গিয়ে ভোট দিতে হবে তারও নাম দেয়া আছে। মনে হয় না ভাষাসৈনিকরা 'সবচেয়ে সুন্দর বর্ণ' কোনটা হবে সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, কারন মাতৃভাষা মানে সেই ভাষার বর্ণমালার সবগুলো বর্ণই খুব প্রিয় হবার কথা।

একুশেতে কিভাবে সাজবেন, কি খাবার দিয়ে একুশ উপলক্ষে 'অতিথি আপ্যায়ন' (!) করবেন, সেসব নিয়েও আজকাল বাণিজ্যের শেষ নেই। গত কয়েক বছরে দেশের খবরের কাগজগুলোর 'জীবনচর্চা' পাতাতে একুশে নিয়ে ফিচারগুলো থেকে কিছু উদহারনঃ

এসব দেখলে আসলে বাক্যহারা হওয়া ছাড়া আর কিছু হতে পারা যায় না। একুশে-তে যে শোক প্রকাশ করার একটা ব্যাপার আছে, সে বিষয়ে যে এই দুই উদহারনের লেখক-দ্বয় অবগত নন, তেমনটা না কিন্তু। দ্বিতীয় ছবিতে দেখুন, চকোলেট স্পঞ্জ কেক এ এক জোড়া চোখ আছে, সেই চোখ থেকে যে অশ্রু ঝরছে সেটা বুঝানো হয়েছে লাল রঙের কোন এক প্রকার 'ড্রিজল দিয়ে'। শহীদের রক্তের দাগ বুঝানোর জন্য কেকটার গায়ে এখানে সেখানে লাল লাল ছোপও দেয়া হয়েছে। এমন একটা কেক যে শহীদ দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে জানা সুস্থ মস্তিষ্কের কোন মানুষ খেতে পারে, সেটা এই ফিচারের লেখক শাহনাজ ইসলাম কিভাবে ভাবলেন, আমার জানা নেই। প্রথম ছবিটাতেও যাই, সেখানে একুশের সাজের সাথে 'শোক প্রকাশের' বিষয়ে 'রূপ বিশেষজ্ঞ' ফারনাজ আলম বলছেনঃ

এ দিনটি একটি বিশেষ দিন, শোক প্রকাশের দিন। ভাষা শহীদদের স্মরণ করতে মডেলকে সাজিয়েছি অভিনব আঙ্গিকে। মাথার হ্যাটটি ঢেকে দিয়েছে চোখকে। যেন বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি শির নত করেছে শহীদদের প্রতি ভালোবাসায়। ... এদিন এমনভাবে সাজবেন যেন শোকের আবহ প্রকাশ পায়। ... শোকের প্রতীক হিসেবে চোখে লাগান কালো আইশ্যাডো। তার উপর আইভ্রোর ঠিক নীচে সিলভার হাইলাইটার দিন। আইভ্রো আঁকুন গ্রে অ্যান্ড ব্ল্যাক শেডে। চিকন করে আইলাইনারের রেখা আঁকুন চোখে। চোখে পাতার নীচে দিন কালো কাজল। কালো রঙের মাশকারা লাগান চোখের পাপড়িতে। ঠোঁটের চারপাশে গাড়ো গোলাপি লিপলাইনার দিয়ে আউটলাইন করুন। গোলাপি রঙে সাজান ঠোঁটজোড়া।

উদযাপন (celebration), এবং উৎসব (festival), এক জিনিস নয়। আমার কাছে সব উৎসব এক প্রকার উদযাপন, কিন্তু সব উদযাপন উৎসবমুখর পরিবেশে করাটা, বা তা ব্যবহার করে নির্বোধের মত বাণিজ্য করাটা রুচির মধ্যে পড়ে না। আমরা ঈদ, দুর্গা পূজা, বড়দিন, পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, বিজয় দিবস, এসব উদযাপন করতে গিয়ে উৎসব করতে পারি। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি এমনই একটা দিন যে তার সাথে 'উৎসবমুখর পরিবেশ' কথাটা কিন্তু যায় না। একটা উদহারন দেইঃ আপনি প্রভাত ফেরীতে শামিল হয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে বন্ধুদের সাথে ছবি তুলতে পারেন। জিনিসটা এখনও 'রুচির' মধ্যেই আছে। কিন্তু সেই ছবি যখন সামাজিক গণমাধ্যমে 'Celebrating Ekushe!! XOXO' শিরোনামে শেয়ার দিবেন, তখন সেটা যে কুরুচিপুর্ণ হয়ে যাচ্ছে, সেটুকু বুঝার বিবেকবুদ্ধি তো থাকা উচিৎ। একইভাবে দিনটির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং নিজের ভাষা/সংস্কৃতি তুলে ধরতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা কিংবা গানের আসর, এসবে তো খারাপ কিছু নেই। নিজের শেকড়ের প্রতি গর্ববোধ থেকে এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতেই পারে, ঠিক যেমনটি একসময় পার্ডুতে আমরা করতাম। কিন্তু আবারও, রুচির শেষ এবং কুরুচির শুরুটা চলে আসে তখনই যখন একুশের উদযাপনটাকে আরও দশটা আনন্দমুখর রঙবেরঙে উৎসবের সাথে মিলিয়ে ফেলে সকল ভাষাসৈনিকদের অবমাননা করে ফেলি। যেমনটি এই অসম্ভব দৃষ্টিকটু ক্ষেত্রে করে ফেলা হয়েছেঃ

একুশ মানে মাথা নত না করা। আমার কাছে একুশ আরও মানে দিনটির তাৎপর্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা, এর সাথে যে আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙ্গিয়ে আছে সেটা মনে রাখা, এবং বিবেক বুদ্ধি দিয়ে যথাযথ শ্রদ্ধা এবং রুচির সাথে দিনটি উদযাপন করা। সবকিছুকে উৎসবমুখর এবং অতিরিক্ত রকমের বাণিজ্যিক করে ফেলতে গিয়ে আমরা যেন এসব ভুলে না যাই।

সকল ভাষাসৈনিকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। মহান একুশের চেতনা জাগ্রত হোক প্রতিটি বাঙালীর অন্তরে।


মন্তব্য

সাইফুল ইসলাম এর ছবি

অসাধারণ লিখেছেন । আপনি একটা দিবস বা উৎসবকে তখনই ঠিকভাবে পালন করতে পারবেন যখন সেই দিবসটির তাৎপর্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকবে । দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের সেটাই তো নাই । তাহলে আপনি সেই মানুষগুলোর কাছ থেকে যথাযথ আচরণ আশা করে কিভাবে?

ইয়ামেন এর ছবি

আশা যে একদিন মানুষ ভুল বুঝে শিখবে। হয়তো মিছে আশা, তাও আশা করে যাই। হাসি

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...

মন মাঝি এর ছবি

উদযাপন (celebration), এবং উৎসব (festival), এক জিনিস নয়। আমার কাছে সব উৎসব এক প্রকার উদযাপন, কিন্তু সব উদযাপন উৎসবমুখর পরিবেশে করাটা.... রুচির মধ্যে পড়ে না। আমরা ঈদ, দুর্গা পূজা, বড়দিন, পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, বিজয় দিবস, এসব উদযাপন করতে গিয়ে উৎসব করতে পারি। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি এমনই একটা দিন যে তার সাথে 'উৎসবমুখর পরিবেশ' কথাটা কিন্তু যায় না।

আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না ইয়ামেন ভাই। বায়ান্নর ভাষা সৈনিকরা আমাদের ভাষা / সংস্কৃতি / গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন - ব্যক্তিগত গরিমার জন্য করেননি, কেউ তাদের ভবিষ্যতকালে স্মরণ করবে বা এটাকে তাদের মৃত্যুদিবস হিসেবে পালন করবে, প্রভাতফেরী / মিলাদ মাহফিল করে এটাকে শোক দিবস বানিয়ে ফেলবে বলে বোধ করি করেননি। বরং যে জিনিষের তারা তাদের লড়াইটা করেছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই জিনিসটাই, অর্থাৎ - আমাদের অবরূদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতিই - এদেশের মানুষ মুক্ত পরিবেশে স্বাধীন ভাবে সগর্বে, সদম্ভে, সশব্দে, সানন্দে, সোচ্ছাসে, সোল্লাসে - এক কথায় উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপন করবে - এটাই বোধহয় চাইতেন। এতেই বোধহয় তাঁরা সবচেয়ে বেশি সুখী, সফল, সার্থক ও চরিতার্থ বোধ করতেন। আমাদের শোক-শোক ভাব করে দেওয়া ফুলের তোড়াতে নিজেদের মরণোত্তর ইগো-চরিতার্থ করাতে নয়। ওটা ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত মৃত্যুতে আত্নীয়স্বজনদের কাছ থেকে কাঙ্খিত হতে পারে, বৃহত্তর লক্ষ্য / আদর্শের জন্য লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হওয়া সৈনিকের কাছে তাঁর ব্যক্তিস্মৃতিতে শোকপালন নয়, বরং ঐ লক্ষ্য / আদর্শের উদযাপনটাই বেশি কাঙ্ক্ষিত হওয়া স্বাভাবিক। কি সেই লক্ষ্য / আদর্শ তাঁদের? ভাষা / সংস্কৃতি। আর এই ভাষা বা সংস্কৃতি কোন একটি সুনির্দিষ্ট দিনে উদযাপন করতে হলে নাচ-গান-লেখা-আবৃত্তি-চিত্র-চলচ্চিত্র প্রদর্শণী ইত্যাদি "রঙবেরঙের" উৎসব-অনুষ্ঠানের চেয়ে ভালো করে আর কিভাবে পালন করা যেতে পারে?

তাই, প্রভাতফেরী ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যক্তি-স্মরনমূলক ভাবগম্ভীর কর্মকাণ্ড শেষ করে বাকি দিনটা নিজস্ব ভাষা/সংস্কৃতি-ভিত্তিক "উৎসবমুখর পরিবেশে" উদযাপন করাটা আমার কাছে সুন্দর, স্বাভাবিক এবং অত্যন্ত যথোপযুক্ত বলেই মনে হয়। এই রকম উদযাপন ভাষা শহিদদের আত্নত্যাগের অবদান এবং তাঁদের বিজয় ও সাফল্য সবচেয়ে ভালোভাবে ঘোষণা করে। ঐ দিনটির জন্য এটাই বোধহয় তাঁদের প্রতি আমাদের সেরা শ্রদ্ধার্ঘ্য হবে!
========================================

আপনার লেখাতে এমবেড করা পোস্টারের ছবির কন্টেন্টে তাই আমি আপত্তিকর তেমন কিছু দেখি না, ডিজাইন বা প্রেজেন্টেশনটা খুব উন্নত রুচির মনে হয়নি যদিও। মূল বক্তব্য বা থীমকে ছাপিয়ে ব্যক্তি নায়ক-গায়কদের ছবি এত প্রমিনেন্টলি এসেছে যে মনে হচ্ছে সস্তা ঢাকাই সিনেমা বা রাজনৈতিক সমাবেশের পোস্টার হয়ে গেছে। সম্ভবত কোন নিম্নমানের কমার্শিয়াল আর্টিস্টের করা একটা পোস্টারের এই ডিজাইনগত সামান্য ব্যপারটা ছাড়া মূল বিষয়ে আমিতো এই মুহূর্তে বড় কোন আপত্তির কিছু দেখতে পাচ্ছি না এতে।

****************************************

ইয়ামেন এর ছবি

মন মাঝি ভাই, ধন্যবাদ মন্তব্যর জন্য। আমি কিন্তু আপনার সাথে একমত। আপনি দেখবেন প্রথমেই আমার নিজের প্রবাসে পড়াশোনা করার সময়কার উদহারন তুলে ধরেছি, আমি নিজেও কিন্তু বিশ্বাস করি যে একুশের ফেব্রুয়ারির শুরু প্রভাত ফেরী এবং যথাযথ গুরুগাম্ভীর্যের সাথে শুরু করে পরে নিজের মাতৃভাষা এবং সংস্কৃতি তুলে ধরতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি দিয়ে উদযাপন করতে সমস্যা দেখি না। অনেকে সেসবেও আপত্তি করেন (পার্ডুর সে ভাবী দ্রষ্টব্য), তাদের চিন্তাধারার প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে, তবে আমি মনে করি দিবসটির তাৎপর্য বজায় রেখেই উদযাপন করা সম্ভব।
আসলে উৎসবমুখর পরিবেশের বিরোধিতা করছি, বলতে বুঝাতে চেয়েছি একুশের মানে-টা যাতে না হারিয়ে যায়। আপনি পোস্টারটার কথা বলছেন, আমি কিন্তু পোস্টারটার ডিজাইন এবং থিমের কথাই বলতে চেয়েছি, এবং এর সাথে 'একুশ উৎসব' নামটার ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। এ ছাড়া কন্টেন্ট নিয়ে আমি নিজেও আপত্তি দেখি না। আলোচনা সভা, সঙ্গীত প্রতিযোগিতা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, সবই তো চমৎকার উদ্যোগ আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি তুলে ধরার জন্য! কিন্তু পোস্টারটা দেখলে কেউ যে এটার সাথে একুশের কোন সম্পর্ক আছে তা একমাত্র নামটা না দেখলে বুঝবে না। একুশ কথাটা বাদ দিয়ে আপনি এখানে 'পৌষ', 'বৈশাখী', 'ফাল্গুন' যে কোন কিছু বসিয়ে দিন, তাও বেমানান লাগবে না। একুশের বৈশিষ্ট্য, তাৎপর্য এখান থেকে হারিয়ে গেছে। এটাই বলতে চেয়েছিলাম। আশা করি বুঝাতে পারেছি। হাসি

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...

মন মাঝি এর ছবি

চলুক

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

একটু ভাবা যাক কীভাবে একুশে উদ্‌যাপন করলে তার ভাবগাম্ভীর্য এবং মর্যাদা বজায় থাকে। একুশের তিনটি দিক আছে — এক, এটা শহীদ দিবস বা ভাষা শহীদ দিবস। দুই, এটা বাঙালীর জাতীয় জীবনের গৌরবের দিন, কারণ এই দিনের ত্যাগের মাধ্যমে বাঙালী তার ভাষার ন্যায্য অধিকার আদায় করেছিল এবং তার পথ ধরে নানা আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তিন, বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারা দুনিয়ায় যেসব মানুষের মাতৃভাষা আজও তার যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি তাদের জন্য অধিকার আদায়ের প্রত্যয় ব্যক্ত করার দিবস, লড়াই করার দিবস।

এই তিনটি বিষয়কে ধারণ করা এই দিবসটি পালন করার মধ্যে সামান্য জটিলতা থাকতে পারে, তবে বিবেক ও বোধ খাটালে সেটা কঠিন কিছু আর থাকে না।

শহীদ দিবস উদ্‌যাপনের জন্য ভোরে প্রভাতফেরী করে একুশের গান গাইতে গাইতে সবাই শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পার্ঘ্য দেবেন। এই আচারটি এখন প্রতিষ্ঠিত এবং এই দিনের অবিচ্ছেদ্য ও আবশ্যিক অংশ। যারা ঢাকায় থাকেন তাদের কেউ কেউ আজিমপুরে শহীদদের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য দেন বা প্রার্থনা করেন। ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা আজিমপুরে যেতে পারেন না তাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই শহীদদের জন্য প্রার্থনা করেন। বিশ্বাস নির্বিশেষে কেউ কেউ এইদিনে দরিদ্রদের অন্নদান করেন। শহীদ দিবস উপলক্ষে হাতের লেখা, বাংলা বানান ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা; আবৃত্তি, সঙ্গীত ও নাটক মঞ্চায়ন এসবও হয়ে থাকে। চিত্র-কবিতা-গান-নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচনে সাধারণ বোধ খাটালেই সেটা আর বেমানান বা আপত্তিকর ঠেকার কথা না। এই আচারগুলো শহীদ দিবসের ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদার সাথে মানানসই।

বাঙালীর জাতীয় জীবনের গৌরবের দিন বিবেচনায় এই দিনে ইতিহাসভিত্তিক চিত্র প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা যায়। এই আয়োজনগুলোর কোনটাই শহীদ দিবসের মর্যাদা হানিকর নয়।

বিশ্বের অন্য দেশের কথা ছাড়ুন, খোদ বাংলাদেশ পঞ্চাশের অধিক ভাষার মানুষের দেশ। সুতরাং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষার মানুষ যদি তাদের ভাষায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা বা শোভাযাত্রা বের করেন তাহলে সেটা শহীদ দিবসের মর্যাদা হানিকর হয় না। একইভাবে সারা বিশ্বের মানুষ এই দিন যদি নিজ নিজ মাতৃভাষা ভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন তাহলে সেটা শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদর্শন হয়।

শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে কেউ যদি সাদা-কালো পোশাক পরতে চান তাহলে সেটা আপত্তির কিছু নয়, যেমন রঙিন পোশাক পরাও আপত্তিকর নয়। এই দিনে কে কেমন সাজগোজ করবেন সেটা তার ব্যক্তিগত পছন্দ ও রুচির ওপর নির্ভর করে। তবে এই দিনের জন্য বিশেষ সাজ দিয়ে শোক প্রকাশের পরামর্শ যারা দেয় তাদেরকে অন্তত আমার কাছে বিবেকসম্পন্ন বলে মনে হয় না।

এই দিনে কেউ পান্তাভাত খাবেন নাকি কাচ্চি বিরিয়ানী খাবেন সেটা যার যার ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর নির্ভর করে। তবে তিনটি বিবেচনার কোনটাতেই এই দিনটি ভোজউৎসব নয়। যে অনুষ্ঠানে একই সাথে অনেক জাতির মানুষ অংশ নিয়ে থাকেন সেখানে প্রত্যেকে যার যার ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রদর্শন বা আপ্যায়নের জন্য রাখতে পারেন, তবে সেটা নিজ জাতির সংস্কৃতিকে প্রদর্শনের উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে ভালো হয়। এই দিনের জন্য বিশেষ ডিশ বানিয়ে শোক প্রকাশের চেষ্টা শুধু অরুচিকর নয়, বিবমিষাকর। আমি জানি না কুলখানি/চেহলাম/শ্রাদ্ধ/পিণ্ডদান/মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এইসব রন্ধনশিল্পীরা কবরের আকৃতির বা চিতার আকৃতির বা খাটিয়ার আকৃতির বা কাফনমোড়ানো মৃতদেহের আকৃতির কেক বানানোর পরামর্শ দেবে কিনা।

এই বৈশ্যযুগে কেউ কেউ পিতৃপুরুষের অস্থি নিয়েও ব্যবসা করে। এখানে উপলক্ষটি কী, ইতিহাস কী, উদ্‌যাপনের ঐতিহ্য কী তার কিছুই তারা বিবেচনা করে না। শুধু লক্ষ করে কীকরে আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে বোকা বানিয়ে টাকা হাতানো যায় — সেটা প্রভাতফেরীতে যাওয়া মানুষকে জোর করে ধরে গায়ে-মুখে আলপনা আঁকিয়ে পয়সা হাতানোর দল হোক আর একুশ উপলক্ষে দামী রেস্টুরেন্টে বিশেষ বুফে লাঞ্চের মুলা (সাথে র্যাঁফেল ড্র) দিয়ে টাকা হাতানোর দল হোক। অবশ্য শুধু এদেরকে দোষ দেয়া যায় না। চাহিদা আছে বলে বাজারে যোগান হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করা হয় বটে, তবে তার দায় মস্তিষ্কহীন, বিবেকহীন ভোক্তার ওপরেও বর্তায়।

রুচি-অরুচি-কুরুচির পার্থক্যের সীমারেখা টানাটা খুব কঠিন কিছু নয়। নূন্যতম শিক্ষার সাথে বোধ আর বিবেক যোগ করলেই চলে। তবে ব্যাপার হচ্ছে কি, সারা দুনিয়ার সব দেশেই কিছু মূঢ়, মনুষ্যসদৃশ অথচ মনুষ্যেতর জীব বাস করে; বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।

ইয়ামেন এর ছবি

"রুচি-অরুচি-কুরুচির পার্থক্যের সীমারেখা টানাটা খুব কঠিন কিছু নয়। নূন্যতম শিক্ষার সাথে বোধ আর বিবেক যোগ করলেই চলে। তবে ব্যাপার হচ্ছে কি, সারা দুনিয়ার সব দেশেই কিছু মূঢ়, মনুষ্যসদৃশ অথচ মনুষ্যেতর জীব বাস করে; বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।"

সেটাই আসল কথা, এবং কঠিন বাস্তব। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...

হিমু এর ছবি

বাংলাদেশের মানুষের জীবন আগের চেয়ে অনেক বেশি হেকটিক, সম্ভবত যানজটের কারণে। শহিদ দিবসের মতো ছুটির দিন পেলেও মানুষ সেটা পালন (অবজার্ভ) করার চেয়ে উদযাপন (সেলিব্রেট) করার দিকে বেশি আগ্রহী থাকে। ব্যবসায়ীরাও এটা নিয়ে দাঁও মারতে চান, কিন্তু যে উদাহরণগুলো আপনি দিলেন, সেগুলো চোখের সামনে চলে আসে তাদের পরিমিতিবোধের অভাবে।

শহিদ দিবসে সারাদিন ছলোছলো চোখ নিয়ে লোকে আর বসে থাকবে না, কারণ মাতৃভাষাকে দ্বিতীয় সারিতে ঠেলে দেওয়ার দৃশ্যে যে অপমান-গ্লানি-ক্রোধ-হতাশা একুশে ফেব্রুয়ারির সাথে বিজড়িত, সেটা স্বাধীন দেশে বসে বাঙালিরা কেউ অনুভব করে না। তারা এ দিনটাকে যে যেভাবে পারে, ব্যবহার করে।

এটা যদি কেউ অনুচিত বলে মনে করেন, তাহলে এমন কোনো আয়োজনের প্রবর্তন করতে হবে, যেটা এসব থেকে উত্তরণের পথ দেখাবে। নইলে মানুষ যে যার কল্পনাশক্তি আর সাধ্যমাফিক পথ খুঁজে বের করে যা করার করবে।

একুশে ফেব্রুয়ারিতে যদি ব্যবসা করতেই হয়, তাহলে শোলার অক্ষর কেটে বানানো টুপি বিক্রি শুরু হোক। একটা দিন পথে পথে ছেলেমেয়েবুড়োবুড়ি সবাই মাথায় নিজ নিজ নামের আদ্যাক্ষর বা যে কোনো অক্ষরের টুপি পরে সারা পথ বাংলা বর্ণে রাঙিয়ে দিচ্ছেন, এ দৃশ্যটা দেখতে ইচ্ছা করছে।

ইয়ামেন এর ছবি

"একুশে ফেব্রুয়ারিতে যদি ব্যবসা করতেই হয়, তাহলে শোলার অক্ষর কেটে বানানো টুপি বিক্রি শুরু হোক। একটা দিন পথে পথে ছেলেমেয়েবুড়োবুড়ি সবাই মাথায় নিজ নিজ নামের আদ্যাক্ষর বা যে কোনো অক্ষরের টুপি পরে সারা পথ বাংলা বর্ণে রাঙিয়ে দিচ্ছেন, এ দৃশ্যটা দেখতে ইচ্ছা করছে।"

কি চমৎকার আইডিয়া হিমু ভাই। তবে কি না এসবে 'পিনিক' নাই। এর থেকে আসেন ডি জে পার্টি করি, ব্রো! হাসি

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ছোট বেলায় কিছুদিন সৈয়দপুরে থাকা হয়েছিল, বিহারী অধ্যুষিত শহর। একদিন দেখলাম ছোট্ট সেই শহরে সাজ সাজ রব পড়ে গেল, রাস্তায় নানা পণ্য সাজিয়ে মেলা বসে গেল। কী বিষয়? জানা গেল মহররম উপলক্ষে সেই বিশেষ অবস্থা। চারিদিকে একটা উৎসব উৎসব ভাব। কয়েকদিন ধরে ড্রিম ড্রিম ঢোলের বাদ্যের সাথে বর্ণিল তাজিয়া মিছিল, সেই সাথে লাঠি, রড, তলোয়ার, ছুরি, চাকুর নানা কসরত, জিমনাস্টিক, খাওয়া দাওয়া। ফলে বেশ কিছু বছর ধরে আমার ধারনা ছিল মহররম হল বিহারীদের একটা উৎসব পর্ব।
আশুরার মধ্যে উৎসবের কোন উপলক্ষ থাকার কারন নাই, তবুও মানুষ তাকে উৎসবের বিষয় করে তুলেছে। একুশের মধ্যে শোকের পাশাপাশি উৎসবের উপলক্ষও আছে। শঙ্কাটা সেখানেই।

সোহেল ইমাম এর ছবি

ভালো লিখেছেন ইয়ামেন ভাই। নিজেদের গৌরবটা এইভাবে যেন চটুল উৎসবের কাছে মাথা নত না করে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সংগ্রহটার দরকার ছিল চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।