নক্ষত্রের আলো।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: মঙ্গল, ০৪/০৩/২০০৮ - ১:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শিশুটি হঠাত্ কেঁদে উঠলো।
এই অকস্মাত্ কান্নায় মিরির চমক ভাঙ্গে। বইয়ের পাতা থেকে সে মুখ তুলে তাকায় শিশুটির দিকে। একটু আগেও সে চুপচাপ শুয়ে খেলছিল আপন মনে।
মিরি শিশুটিকে বুকে তুলে নিয়ে আদর করে। গালে গাল ঘষে দেহের গন্ধ নেয়। পরিচিত স্পর্শ পেয়ে শিশুটি ক্রমে শান্ত হয়ে আসে। বোঝা গেল আসলে মায়ের ছোঁয়া পাওয়ার জন্যে কেঁদেছিল সে।
মিরি অল্প হাসে, "তুমি খুব দুষ্টু হয়েছ আজকাল। শুধু আমাকে জ্বালাও।"
মায়ের মুখে হাসি দেখে শিশুটিও আহ্লাদিত হয়। এমনটিই বোধহয় তার ইচ্ছে ছিল। সে তার ছোট ছোট হাত পা নেড়ে অস্ফুট ধ্বনি করে। মিরি মুখ নেড়ে নেড়ে জিজ্ঞেস করে, "এখন হাসছো কেন আমাকে দেখে? আমি কি সার্কাসের ক্লাউন যে আমাকে দেখলেই হাসতে হবে?"
কথা বলার সাথে সাথে মিরি চোখমুখ পাকিয়ে মজার ভংগী করে। শিশুটি তা দেখে আরো মজা পায়। সে এবার খিল খিল করে হাসে।
মিরি অপার ভালবাসায় শিশুটিকে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখে। ফিস ফিস করে বলে, "তুমি আমার সোনাবাচ্চা, তুই আমার হানিবেবী।"
শিশুটি ভালবাসার এই প্রবল প্রকাশকে পছন্দ করেনা। সে রাগে ফোঁসফোঁস করতে থাকে।

শিশুটির বয়েস আটমাস। মিরির বিয়ের দুই বছরের মাথায় সে পেটে আসে। অন্তঃসত্ত্বা হবার খবরটি প্রথমে শাহেদই পেয়েছিল। সে তার কাজ থেকে ডাক্তারের অফিসে ইউরিন টেস্টের খবর নেবার জন্যে ফোন করেছিল। খবরটি জানবার পরেও সে মিরিকে বলেনি কিছুই। বিকেলে বাসায় ফিরেছিল একটা অর্কিডের মালা হাতে করে। মিরির গলায় পরিয়ে বলেছিল, "সাধ্য থাকলে ফুলের বদলে হীরের মালা নিয়ে আসতাম। এমন একটা আনন্দের দিনে মানিব্যাগটাই ঝামেলায় ফেলে দিল।"
দেশে থাকলে অন্তঃসত্ত্বা হবার সংবাদটি বড় লজ্জাদায়ক। আশপাশের মানুষেরা সংবাদ শুনে কেমন যেন মিটিমিটি হাসে। ভাবখানা যেন, তলে তলে এইসব চলছে তাহলে!
বিদেশে ব্যাপারটা তেমন নয়, এখানে গর্ভধারণের খবরটি গর্বের সাথেই প্রচার করা হয়। মিরির তাও লজ্জা লেগেছিল, ছি ছি দেশের সবাই কি ভাববে এখন।
শাহেদ তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিল,"আমার আজকে খুব আনন্দ লাগছে। তুমি কি খুশী হয়েছো?"
মিরির মুখে সেদিন কোন কথা ফোটেনি, সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। গভীর সুখে অথবা প্রগাঢ় বিষাদে তার চোখে সবসময় পানি আসে। এই স্বভাবের জন্যে মাঝেমাঝে মিরির ফোলা চোখ দেখে শাহেদ ঠিক ঠাহর করতে পারেনা যে কান্নাটি কোন অনুভূতির প্রকাশ।

দরজায় টুং টুং করে ডোরবেলটি বাজে। মিরির কানে সেই শব্দটি সংগীতের মতো মনে হয়।
দিনের এই সময়টি মিরির বড় প্রিয়। এই সময়ে শাহেদ সাধারণতঃ বাসায় ফেরে। যদিও তার পকেটে ঘরের চাবি থাকে, তবুও সে প্রতিদিন ডোরবেলটি বাজায়। এর অর্থ হছে মিরিকে গিয়ে দরজা খুলতে হবে। সে নিজে কোনদিনও চাবি দিয়ে দরজা খুলবেনা। কয়েকদিন মিরি বাথরুমে ছিল আর শাহেদকে মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। তবুও সে শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছে বারান্দায় কখন মিরি এসে দরজা খুলবে সেই আশায়।

একদিন মিরি তাকে বলেছিল, "তুমি হচ্ছো বৌ খাটানো স্বামী। নিজে একদিন দরজা খুললে কি হয়? সবসময় কি আমাকেই এসে দরজা খুলতে হবে?"
শাহেদ বলেছিল, "দরজা খুলে তোমাকেই প্রথম দেখতে চাই যে।"
"একদিন না দেখলে কি হবে?"
"মন খারাপ লাগবে।"
"এটা কোন একটা কথা হোল?"
"একদম সত্যি কথা।"

ডোরবেলটি আবার বাজে। শিশুটিকে কোলে নিয়ে মিরি দরজা খোলে। বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে শাহেদ ছাতাটি বন্ধ করার চেষ্টা করছে।
সিয়াটলের বৃষ্টির দুর্নাম আছে গোটা আমেরিকায়। অক্টোবর থেকেই মেঘেরা স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। সপ্তাহ ধরে সূর্য্যের দেখা মেলেনা। তাও বাংলাদেশের মতো মেঘ গর্জনে, বিদ্যুত্ চমকে, ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামলেও হোত। সিয়াটলের বৃষ্টি নিরামিষ প্রকৃতির, গুঁড়ি গুঁড়ি পানির বিন্দুতে কোন সৌন্দর্য্য নেই বলার মতো। বরং এই আবহাওয়ায় মানুষের ডিপ্রেশন বাড়ে।
মিরির অবশ্য মেঘলা আকাশ দেখতে ভালই লাগে। তাদের ছোট্ট এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের শোবার ঘরের জানালাটি প্রকান্ড। বিছানায় শুয়েই অনেকখানি আকাশ দেখা যায়। মাঝে মাঝে যখন বড় বড় পানির ফোঁটা পড়তে থাকে, মিরি তখন জানালার পাল্লা খুলে দেয়। বাইরে হাত বাড়িয়ে দেয় জলের স্পর্শ পাওয়ার জন্য। লম্বা করে নিঃশ্বাস নেয়। কে জানে হয়তো এই মেঘটি পেছনে ফেলে আসা দেশ থেকে উড়ে এসেছে। হয়তো দেশের গন্ধ পাওয়া যাবে বৃষ্টির মধ্যে।

শাহেদ বারকয়েক চেষ্টা করেও ছাতাটি বন্ধ করতে পারলো না। শেষে "দুত্তোর" বলে ছাতাটি মাটিতে ছুঁড়ে মারলো। ছাতাটির বয়েস হয়েছে, তার উপর এটি হালকা ফোলডিং ছাতা। এই অকস্মাত্ গলাধাক্কায় সে কঁকিয়ে ওঠে। বোঝা যায় তার আয়ু ফুরিয়েছে।

ঘরের ভিতরে এসে শাহেদ কাঁধের ব্যাগটি টেবিলে নামিয়ে রাখলো। সে আজ বেশ ভিজেছে। এই জন্যে সে একটু বিরক্ত।
মিরি লুকিয়ে হাসলো। শাহেদ সিয়াটলের বৃষ্টি দুচোখে দেখতে পারেনা। অবশ্য তাকে খুব বেশী দোষও দেওয়া যায়না।

ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরতে প্রতিদিন তাকে প্রায় আধা ঘন্টার মত হাঁটতে হয়। তার উপর ছাতা কাজ না করলে মেজাজ খারাপ হবারই কথা। একটা গাড়ী থাকলে বেচারাকে আর রোজ রোজ হাঁটতে হোতনা।

"তুমি তো দেখি একদম ভিজে গেছ। সোজা বাথরুমে চলে যাও। আমি তোমার কাপড় নিয়ে আসছি।"
"শালার ছাতাটা আজকে বোধহয় একেবারেই গেছে। খোলার সময়ে খোলেনা, বন্ধ করার সময় বন্ধ হয়না। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে। এখন আর একটা ছাতা কিনতে হবে।"
মিরি গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।

আমেরিকায় ছাত্র হবার ঝামেলা অনেক। স্কলারশিপের গোনা পয়সায় বৌ-বাচ্চা নিয়ে সংসার চালানো চাট্টিখানি ব্যাপার না। বাচ্চা ছোট হলে তার জন্যে দুধ আর ডায়াপার কিনতেই কত গুলো পয়সা বেরিয়ে যায়। একটা ছাতার দাম বেশী না, কিন্তু টানাটানির সংসারে হিসেবের বাইরে পয়সা খরচ করতে ভালো লাগে না। বিয়ের আগে মিরি কোনদিন পয়সার টানাটানি দেখেনি। এখানে সে মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে।

এখানে সব ছাত্রেরই একই অবস্থা। এদের মধ্যে কয়েকজনের স্ত্রীরা লুকিয়ে একটা-দুটো বেবী সিটিং করে। তাতে পয়সার একটু সাশ্রয় হয়। মিরিও করতে চেয়েছিল। শাহেদ রাজী হয়নি।
"তোমার এখানে কাজ করবার অনুমতি নেই, মিরি। বেআইনি অল্প কয়টা পয়সার জন্য দুশ্চিন্তায় আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে।"
"এখানে অনেকেই তো করছে। তাদেরতো কিছু হছেনা। আমি করলেই দোষ।"
শাহেদ ম্লান হেসে বলেছিল,"সবাই করলেই একটা বে আইনি জিনিস জায়েজ হয়ে যায় না। আমি জানি পয়সার টানাটানি করে সংসার চালাতে হয় তোমাকে। কিন্তু জেনেশুনে কিভাবে আইন ভাঙি বলো? তার চেয়ে বরং সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিছি।"
এই কথা বলার পরেই সে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখে ঘনঘন সিগারেট খায় বারান্দায় পায়চারী করতে করতে। প্রসংগ ওখানেই শেষ।

"খুব খিদে লেগেছে আজকে। তুমি ভাত চড়িয়ে দাও। আমি একেবারে গোসল করে আসছি।"
শাহেদ দ্রুতপায়ে বাথরুমের দিকে চলে যায়। কোলের মধ্যে শিশুটি এতক্ষন চুপ করে গুটিসুটি মেরে ছিল। বাবাকে সে সব সময়ই বড় বড় চোখ মেলে দেখে।
মিরি শিশুটিকে লিভিং রুমের কার্পেটে নামিয়ে রাখে। তারপর ভাত রান্নার আয়োজন করে দ্রুত হাতে।
বাথরুমের দরজা অল্প খুলে শাহেদ মাথা বের করে। তার চুল থেকে পানি পড়ছে টপটপ করে। বোঝা যাছে যে সে গোসল করতে করতে বার হয়ে এসেছে।
সে উঁচু গলায় বললো,"মিরি, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। কাল রাতে আমি নাঈমকে আমাদের এখানে খেতে বলেছি।"

----XXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXX----

শাহেদ সাধারণতঃ সকাল ন'টার দিকে বেরিয়ে যায়। তার ক্লাশ থাকেনা আজকাল। এখন সে তার পিএইচডির রিসার্চ নিয়েই বেশী ব্যস্ত। মাঝে মাঝে তাকে ছুটির দিনেও কাজ করতে হয়।
আজ শুক্রবার, সপ্তাহের শেষদিন। সবারই মুখে একটা হাসি হাসি ভাব থাকে, উইক এন্ড আসছে।
সকালে নাস্তা শেষ করে কফি খেতে খেতে শাহেদ আড়মোড়া ভাঙ্গে। মিরি সকালে দেরী করে খায় বলে শাহেদ একা একাই নাস্তা খায়।
"আজকে কি রান্না করবে মিরি বেগম?"
মিরি সিংকে প্লেট ধুচ্ছিল। সে মাথা ঘুরিয়ে বললো," দেখি ফ্রিজে কি আছে।"
"গতবার নাঈম তোমার লাউ-চিংড়ি খেয়ে খুব প্রশংসা করেছিল। ওটা করতে পারো আজকে।"
"সেবার তো তাড়াতাড়ি করে যা হাতের কাছে ছিল, তাইই রান্না করেছিলাম। আজকে তো আর সেটা করলে হবেনা। আজকে ভাবছি পোলাও-কোর্মা জাতীয় কিছু একটা করবো।"
ভাল খাবারের কথায় শাহেদের মুখটা আলোকিত হয়ে ওঠে। আমেরিকায় খাবার-দাবারের দামটা বেশ সস্তা। খুব কম পয়সাতেই ভাল ভাল মোগলাই খাবার তৈরী করে ফেলা যায়। বাংলাদেশে বসে তা খেতে গেলে অনেক পয়সা লাগে।
কিন্তু এই আনন্দের আড়ালে একটি কষ্টের ব্যাপারও আছে। গোটা রান্নাটাই নিজের হাতে সামলাতে হয়। কোটা-বাছা থেকে শুরু করে মসলা বাটা, ধোয়াধুয়ি, মোছামুছি সব। দেশের মত কাজের লোকের বিলাসিতা এখানে নেই। কষ্ট হলেও মিরির খারাপ লাগেনা। সবাই যখন তৃপ্তি করে খায়, তখন ভালই লাগে।

"এতো অতি আনন্দের কথা সুন্দরী। এই সুন্দর হাতের পোলাও-কোর্মা না জানি কত সুস্বাদু হবে।"
মিরি হাসে। "তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে না খাইয়ে রাখছি। পোলাও-কোর্মা খাওয়াইনি কোনদিন। যাও- এখন ভাগো। আমার কাজ আছে অনেক। তোমার সন্তানের ঘুম ভাংলে খবর আছে। তিনি আবার অতিশয় অ্যাটেনশন প্রিয়।"
শাহেদ উঠে পড়ে। "তোমার অসুবিধার কারণ হবোনা সুন্দরী। আমি এই মুহুর্তেই প্রস্থান করছি। সান্ধ্যক্ষনে আবার দেখা হবে প্রিয়ে।"

মিরির বাবা সিরাজুদ্দিন সাহেব ভোজনরসিক ছিলেন। খাবারের টেবিলে ভাল ভাল খাবার না থাকলে তার মুখ বাংলার পাঁচের মত হয়ে যেত। আবার যেদিন পছন্দের খাবার থাকতো, সেদিন তিনি বড় আয়েশ করে টেবিলে বসতেন। দুপাশে দুই মেয়েকে বসাতেন। তাদের প্লেটে তুলে দিতেন মাংসের বড় টুকরো অথবা মাছের বড় পেটি।
মা জাহানারা বেগম হাঁহাঁ করে উঠতেন, "একি! সব ভাল ভাল জিনিসই তো তুমি ওদেরকে দিয়ে দিচ্ছ।"
সিরাজুদ্দিন সাহেব উঁচু গলায় হাসতেন। "ভাল ভাল জিনিস খাওয়ার অভিজ্ঞতা না হলে ওরা তো ভাল রান্না শিখবে না কোনদিন। শেষে পরের ঘরে যেয়ে তোমার বদনাম হবে যে তুমি ওদের ভাল রান্না শেখাওনি। আগে জিভটাকে তৈরী করে নেই, পরে সেই জিভের জন্যেই ওদেরকে বাধ্য হয়ে ভাল রান্না শিখতে হবে।"
"ওরা আবার রান্না শিখবে? কুটোটা পর্যন্ত নাড়তে চায়না, ওরা করবে রান্না।"
"সময় হলে সবই হবে মিরির মা। আমার মিরি মায়ের রান্না খেয়ে সবাই একদম অবাক হয়ে যাবে।"

মিরির বিয়ের সময়ে সিরাজুদ্দিন সাহেব কেমন যেন বোকা বোকা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যেন ভাল করে ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি যে বিয়ে মানে মেয়ে ঘর ছেড়ে চলে যাবে। তাও কিনা সাত সমদ্দুর পাড়ি দিয়ে দুরের দেশ আমেরিকায়! বিদায় নেবার সময় তিনি কোন কথা বলতে পারেননি। শুধু শাহেদের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। কিছু বোধহয় বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কোন ভাষা খুঁজে পাননি।
শাহেদের মনে আছে ব্যাপারটা। সে মাঝে মাঝেই ডাঁট মারে। "তুমি আমাকে পাত্তা না দিলে কি হবে, আমি আমার শ্বশুরের সবচেয়ে প্রিয় জামাই।"

ভাল কোন কিছু রান্না করবার সময় প্রতিবারই বাবার কথা মনে পড়ে। মিরি রান্না শিখেছে আমেরিকাতে আসবার পর। এখানে আসবার পর প্রথম কয়েকদিন শাহেদই তাকে রান্না করে খাইয়েছে। মিরিকে বিয়ে করার আগে সে দু বছর একা ছিল আমেরিকাতে এবং সে কারণে কয়েকটা ডিশ রান্না করা শিখেছিল। কিন্তু তার রান্না বেশ খারাপ আর উদ্ভট প্রকৃতির। একেতো দেশ, বাবা-মা ছেড়ে আসার দুঃখ, তার উপর বাজে খাবার। প্রাণ বাঁচানোর জন্যেই দু'দিন পরেই মিরি রান্নাঘরে ঢুকতে বাধ্য হয়েছিল। প্রথম দিন সে রান্না করেছিল সিদ্ধ ডিমের তরকারী। তাই খেয়ে শাহেদের কি আনন্দ। খাওয়া শেষ করে "আল্লাহ্‌ তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন" বলে হাত তুলে দোয়াও করেছিল।

মিরি এখন বোঝে বাবা ঠিকই বলেছিলেন। ভাল রাঁধুনী হওয়ার জন্য সর্বপ্রথমে ভাল জিভ দরকার। মিরির রান্না এখন প্রথম শ্রেনীর, সিয়াটলের বাঙালী মহলে তার রান্নার রীতিমত সুখ্যাতি আছে।
সিরাজুদ্দিন সাহেব দেখলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হতেন। নিশ্চয়ই স্ত্রীকে ডেকে বলতেন,"দ্যাখো, দ্যাখো, মিরির মা। কি আমি বলেছিলাম না যে আমার মিরি মায়ের রান্নার খুব সুনাম হবে। আমার ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটা আজকে দ্যাখো কি সুন্দর করে সংসার করছে। কার মেয়ে দেখতে হবে তো।"

মিরির আমেরিকায় আসবার চার বছর হয়ে গেল প্রায়। এরমধ্যে আর দেশে যাওয়া হয়নি। সবসময়ই বাবা মায়ের কথা, ছোট বোন বুড়ির কথা মনে হয়। সিরাজুদ্দিন সাহেব কি এখনো গভীর রাতে বারান্দায় বসে উত্তর আকাশে তাকিয়ে প্রিয় নক্ষত্র দেখেন? মা কি প্রতিদিন দুপুর বেলায় জানালার পাশে বসে আগের মতোন "গল্পগুচ্ছ" পড়েন? বুড়ি কত বড় হয়েছে? সে কি দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে? মিরির প্লেনে ওঠার দিন তাকে এয়ারপোর্টে আনা হয়নি খুব কাঁদবে বলে। মিরির চোখ ভিজে আসে।

ফ্রাইপ্যান থেকে ধোঁয়া উঠছে। মিরির চমক ভাংলো। শামীকাবাব ভাজার জন্য চুলোয় তেল গরম করতে দিয়েছিল সে। সেই তেল থেকে ধোঁয়া উঠছে। লক্ষন খারাপ। এর মানে তেল বেশী গরম করে হয়ে গেছে, এখন ভাজতে গেলে কাবাবগুলো সব পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে। আঁচলে চোখ মুছে মিরি চুলোর আঁচ কমিয়ে দিল।

এখন দুপুর একটা বাজে। বাইরের দিকে তাকালে বোঝার উপায় নেই। সিয়াটলের মেঘলা আকাশে সূর্য্য বন্দী হয়ে আছে। অনেকটা মিরির মতোনই। এমনিভাবে বিষন্নতার মাঝে দিনটি কেটে যায়।
মিরির দম বন্ধ হয়ে আসে।

এমনিভাবেই কি তার জীবনটিও কেটে যাবে? আবার কবে বাবা-মায়ের সাথে দেখা হবে? প্লেনের ভাড়া অনেক। মিরি লুকিয়ে কিছু পয়সা জমাতে চেষ্টা করে। এই কাজটিতে সে বেশী অভ্যস্ত না। দুই মাস জমানোর পর তৃতীয় মাসে বাজেট ঘাটতি হয়। সঞ্চয়ের ঝাঁপি মুহুর্তে ফাঁকা হয়ে যায় সে ঘাটতি মেটাতে।

সারা দিনের মধ্যে দুপুর বেলাটি মিরির নিজের সময়। এই সময়টিতে তার শিশুটি ঘুমায়। মিরিও তার মায়ের মতো বইয়ের পাতায় চোখ বুলায়। তার এই স্বভাবের কথা জেনে শাহেদ একদিন তাকে সাথে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়েছিল। মিরি আগে কোনদিন কোন লাইব্রেরীতে যায়নি। সে অবাক হয়ে দেখছিল বিশাল হলঘরে হাজার হাজার বই। তার মধ্যে চার-পাঁচ সেলফ ভর্তি বাংলা বইও সাজানো আছে।
সেদিনটি বড় আনন্দের ছিল। তিনটি মোটা মোটা বই নিয়ে ঘরে ফিরবার সময় তার হাসিমুখ দেখে শাহেদ ঠাট্টা করেছিল,"এবার কি আর আমার কথা থাকবে তোমার?"

দেশের লোকেরা পয়সা আর সময়ের অভাবে কত সুন্দর সুন্দর বই পড়তে পারেনা। এখানে বিনা পয়সাতেই কত ভাল ভাল বই পাওয়া যায় লাইব্রেরীতে। প্রতিদিন দুপুরে বই পড়বার সময়ে মনে হয়, আহা - যদি মাকে এই লাইব্রেরীটিতে নেওয়া যেত। মায়ের নিশ্চয়ই খুশীতে কথা বন্ধ হয়ে যেত। মিরির বই পড়তে পড়তে দেশের কথা মনে পড়ে।

একদিন একটি বর্ষনমুখর দুপুরে সে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা পড়লো,
"যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অংগুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো।
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অংগুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো।"

সেদিন মিরি সারা দুপুর কেঁদেছিল। কেমন করে কবিরা মানুষের মনের গভীরতম দুঃখটিকে এমন সুন্দর করে বলতে পারেন? তিনিও কি এমনই একটি বিদেশী জানালার পাশে বসে কেঁদেছিলেন মিরির মতো? তিনিও কি ভেবেছিলেন প্রবাসের বাতায়নে যে আকাশের টুকরোটি ধরা দেয় সেই আকাশটি কোনভাবেই দেশের মতো নয়।

চুলোর উপরে চাপানো পাত্রে তেলের আঁচ কমে এসেছে। মিরি শামীকাবাব বানানোর প্রস্তুতি নেয়। আজকে সে রীতিমত রাজকীয় রান্নার আয়োজন করেছে। এতটা না করলেও পারতো। নাঈম খুব মারাত্মক ভোজনরসিক না, আর তার উপর সে ব্যাচেলর মানুষ। তার কাছে যে কোন রান্নাই খুব সমাদর পায়। আসলে মিরির নিজেরও কয়েকদিন থেকে একটু ভাল খাবার খেতে ইচ্ছে করছিল। শাহেদ এইসব ব্যাপারে খুব উদাসীন, মিরির কাছে কোন কিছু স্পেশাল রান্নার আবদার করেনি। মিরি বোঝে যে শাহেদের ভিতরে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। মিরির একাকীত্বের জন্য সে নিজেকে দায়ী করে।

আজকে রান্নার ঝামেলায় আর বই পড়া হয়নি তার। এখন সে পড়ছে মির্চা এলিয়াদের "লা নুই বেঙ্গলী"র বাংলা অনুবাদ। এর কাউন্টারপার্ট মৈত্রেয়ী দেবীর "ন হন্যতে" তার আগেই পড়া আছে। একই প্রেম কাহিনীর দুই পক্ষের বর্ণনা। মিরির কাছে "ন হন্যতে" টাই বেশী ভাল লেগেছিল। একটি ছোট্ট সংস্কৃত শ্লোক আছে বইটির প্রথমে। মিরি নিঃশব্দে উচারন করে,
"অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে"।

এর অর্থ মনে নেই মিরির। নিশ্চয়ই সুন্দর কিছু একটা হবে।

শিশুটির জেগে ওঠার সময় হয়ে এলো প্রায়। সে আজকাল মায়ের বড় ন্যাওটা হয়েছে। চোখের সামনে মিরিকে না দেখলে সে গাল ফুলিয়ে কেঁদে ওঠে। রান্না করতে করতে মিরি নিজের মনে হাসে। শিশুটির মুখের মধ্যে সিরাজুদ্দীন সাহেবের কিছুটা আদল আছে। তাকে মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে নিয়ে মিরি মনে মনে বলে,"বাবা, তুমি আমাকে দূরে পাঠালেও আমি ঠিকই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি।"
শিশুটি বলাই বাহুল্য এই আদরের কারণ বোঝেনা। সে প্রতিবারের মতোই রাগে ফোঁস ফোঁস করে।

শিশুটি উঠে পড়ার আগেই যতটা সম্ভব রান্না শেষ করে ফেলতে হবে। মিরি দ্রুত হাতে পোলাওয়ের চাল ধোয়, বেরেস্তার জন্যে পেঁয়াজ কুচোয়। তাতে শেষ রক্ষা হয়না অবশ্য। একটু পরেই শোবার ঘর থেকে শিশুটির তীক্ষ্ন গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।

------XXXXXXXXXXXXXXXXXXXXXX-----

মিরি ভেবেছিল নাঈম সাতটার দিকে আসবে। কিন্তু সে আর শাহেদ একই সাথে এলো বিকেল পাঁচটার সময়ে। দোষ শাহেদেরই, সেইই নাঈমকে ধরে নিয়ে এসেছে।
"এটাকে সাথে করে না নিয়ে আসলে ও হয়তো ভুলেই যেত যে আজকে ওর আমাদের সাথে খাবার কথা। দেখা যেত যে ও হয়তো ভেন্ডিং মেশিনের ফ্রোজেন পিত্জা চিবোচ্ছে ঘরে বসে।"

নাঈমের সাথে শাহেদের পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়বার সময়ে। দুজনের বিষয় আলাদা। নাঈম পড়েছে ইকোনমিক্স আর শাহেদের সাবজেক্ট ফিজিক্স। সিয়াটলে আসবার পর দুজনের ঘনিষ্টতা বেড়েছে বেশী।
কিন্তু তার পরেও নাঈম খুব একটা আসেনা এ বাসায়। কারণ একটাই, নাঈম ব্যাচেলর। বৌ না থাকার কারণে ব্যাচেলরদের সাথে বিবাহিতদের পারিবারিক লেভেলে খুব বেশী ঘনিষ্টতা হয়না। দুজন পুরুষ যখন কথা বলে, তখন মহিলাটি একা একা বসে কি করবে? মিরি মাঝে মাঝে ওদের আলোচনায় যোগ দেয়, কিন্তু ওরা বেশীর ভাগ সময় কথা বলে রাজনীতি আর বাংলাদেশের দুরবস্থা নিয়ে।
মিরির ভাল লাগেনা এই নিয়ে কথা বলতে। মিরি তখন শোবার ঘরে চলে যায়। শিশুটির সাথে খেলা করে।

"তুই কি হাত মুখ ধুবি এখন? তাহলে সোজা বাথরুমে চলে যা। আমি তাহলে চায়ের পানি বসাই।"
শাহেদের এই প্রশ্নে নাঈম একটু ইতস্তত করে। "গোসল করতে পারলে ভাল হোত।"
শাহেদ শোবার ঘর থেকে লুঙ্গী-তোয়ালে নিয়ে আসে। "এই নে। এটা হছে গেস্ট লুঙ্গী, আমাদের সব গেস্টরাই এই লুঙ্গী ব্যবহার করে থাকে। বাথরুমে একটা হলুদ রঙ্গের টুথব্রাশ আছে, ওটা ব্যবহার করতে পারিস। ওটা গেস্ট টুথব্রাশ, সব গেস্টরাই ওই টুথব্রাশ ইউজ করে।"
নাঈম এই কথায় গলা ফাটিয়ে হাসে।"অনেকদিন পর ফজলুল হক হলের জোকটা শুনলাম রে।"
শাহেদ হাসেনা, সে সিরিয়াস গলায় বলে,"এটা কোন জোক না। এটা সত্যিই আমাদের গেস্ট লুঙ্গী।"
নাঈম হাসতে হাসতে বাথরুমে চলে গেল। মিরি শাহেদকে বলে,"তোমার এই কথার মানে কি? গেস্ট লুঙ্গী, গেস্ট টুথব্রাশ, এইসব কি কথা?"
শাহেদ হাসে। "এটা নিয়ে লম্বা একটা গল্প আছে, তোমাকে পরে বলবো। শুনলে হাসতে হাসতে তোমার পেট ফেটে যাবে।"

ডিনার শেষ করতে করতে রাত আটটা বাজলো। খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে নাঈম সোফায় ধপ করে বসে পড়ে। "আজকের খাওয়াটা ভীষন জমকালো ধরনের হয়েছে। এখন এই পেটে সহ্য হলে হয়।"
মিরি তৃতীয় দফা চায়ের আয়োজন করছিল। "আপনার একটা বৌ দরকার নাঈম ভাই। একা একা তো অনেকদিন হোল।"
এই কথাটি নাঈমকে বোধহয় প্রায়ই শুনতে হয়। সে একটা মারফতী মার্কা হাসি হাসে। এই জাতীয় হাসির কোন মানে হয়না। প্রশ্নকারীরা তাদের ইচ্ছেমত অর্থ করে নেয়।

শাহেদের কোলে শিশুটি শান্ত হয়ে বসে আছে। এই দৃশ্যটি মিরির সব সময়ই বড় ভাল লাগে। এই সময়টিতে শিশুটি আশ্চর্য্য রকম চুপচাপ থাকে। মাঝে মাঝে শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে দেখে সে।
"তোর সাথে একটা কথা ছিল শাহেদ।" নাঈম চোখ বন্ধ করে কথা বলে।
"কি কথা?"
"তুই কি একটা জিনিস খেয়াল করেছিস যে দেশে আজকাল ভাল বই-টই একদম বের হছেনা?"
শাহেদ হাসে। "আদার ব্যাপারীর কাছে জাহাজের গল্প করছিস কেন? বইয়ের কথা বলবি মিরিকে। আমি বইয়ের কি জানি?"
"আমি গল্প-উপন্যাসের কথা বলছি না গাধা। এগুলো তো চিরকালই থাকবে। আমি বলছি ভাল বইয়ের কথা।"
"কি রকম বইয়ের কথা বলছিস তুই?"
"এই যেমন ধর বিজ্ঞানের বই বা বায়োগ্রাফী। তোর মনে আছে আমাদের ছেলেবেলায় কত সুন্দর সুন্দর বাচ্চাদের বই বেরোত, পত্রিকা বেরোত। তাতে কত জানার বিষয় থাকতো। এখনকার বাচারা কি ওই ধরনের কোন বই পায়? বা বড়দের পড়বার মত ভাল বই এমন কিই বা বেরোচ্ছে?"
"তোর এই ব্যাপার নিয়ে এত মাথাব্যথার কারণটা কি?"
"আমাদের মত লোকদের উচিত বই লেখা।"
শাহেদ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। "তোর কথাটা আমি পুরো বুঝতে পারলাম না। তুই কি আমাকে বই লিখতে বলছিস?"
"হ্যাঁ, আমার মনে হয় যে আমরা যারা শিক্ষিত, আমাদের উচিত আমাদের জ্ঞানকে বই আকারে বার করা।"
"তুই কি আমার সাথে ঠাট্টা করছিস?"
নাঈম সোজা হয়ে বসে। "নাহ্‌, আমি মোটেও ঠাট্টা করছি না। আমি মনে করি, যে আমরা নতুন যদি কিছু শিখে থাকি, তাহলে সেটা নিয়ে আমাদের লেখা উচিত্। তাতে দেশের কিছু লোকে হলেও পড়তে পারবে।"
"আমি কি নিয়ে বই লিখবো?"
"তুই ফিজিক্স এর লোক। নতুন যা বার হয়েছে, তাদের কিছু একটা নিয়ে লেখ। যেমন সেদিন আমি খবরের কাগজে পড়ছিলাম যে এখন স্ট্রিং থিওরী নিয়ে নাকি তোরা খুব নাচানাচি করছিস। সেটা নিয়েই লেখ তাহলে। আমাদের মত লে-ম্যান দের জন্য সাদামাটা করে লেখ যেন পড়ে বুঝতে পারি।"
"হুঁ, আর তুই কি নিয়ে লিখবি তাহলে?"
"চার-পাঁচ বছর আগে জ্যাক মেন্ডেলসন বলে একজন নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন অর্থনীতিতে। পুরস্কার নেবার সময় একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি তৃতীয় বিশ্বের উন্নতির উপর। অসম্ভব সুন্দর অনেক কথা বলেছিলেন তিনি। সেই বক্তৃতাটা বাংলায় অনুবাদ করবো ভাবছি। আমাদের দেশের দু একজন উপকৃত হলেও ভাল লাগবে।"
"হঠাত্ তোর মাথায় এই চিন্তা এলো কেন?"
"ক'দিন আগে আমি নিউটনের উপর একটা বই পড়ছিলাম। নিউটন একবার বলেছিলেন, "If I have seen further than most men, it is because I stood on the shoulders of giants"। মানুষের একটা বিশেষত্ব কি জানিস? সেটা হচ্ছে যে সে তার অর্জিত জ্ঞানকে পরের জেনারেশনকে দিয়ে যায়। নতুন জেনারেশন তার উপর ভিত্তি করে জ্ঞানকে আরো সামনে নিয়ে যায়। এভাবেই আজকে আমরা এখানে এসেছি। সেটা না হলে প্রত্যেক জেনারেশনকে আলাদা আলাদা করে আগুন আবিষ্কার করতে হোত।"
"দ্যাট্‌স ট্রু।"
"আজকাল বাংলায় এসব জ্ঞানের বই খুব কম লেখা হচ্ছে। যা কিছু আছে তা ইংরেজীতে। সেগুলো পড়ছে কারা? বড়লোকের বাচ্চারা, যারা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়ছে। তুই, আমি কিন্তু ওইরকম ঘর থেকেই এসেছি। আমাদের উচিত আমাদের পরের প্রজন্মের জন্য কিছু একটা করে যাওয়া। তুই তো বিয়ে করেছিস, বাচ্চা হয়েছে, এইসব কথা তুই আমার চেয়ে ভাল বুঝবি।"
"হুঁম।"
"মনে রাখিস আমাদের সন্তানদেরকে সব ব্যাপারে সবকিছু জানিয়ে যাওয়া আমাদের কর্তব্য।"

মিরি পাশের ঘরে শিশুটিকে ঘুম পাড়াছিল। আজকে শিশুটি অতিথীকে দেখে ঘুমাতে চাইছে না। মিরি আধশোয়া হয়ে তাকে বুকের কাছে টেনে নেয়।
শিশুটি সন্দেহের চোখে মায়ের দিকে তাকায়। সে মায়ের আদরের ভংগীটি পছন্দ করেনা। সে আপত্তি তোলে,"অ্যাঁও!"
মিরি হেসে ফেলে।
নাঈমের গলার স্বর শোনা যায় আবার,"তুই ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দ্যাখ। আমরা যদি কাজটা না করি তাহলে করবার মতো আর কেউ নেই। কে জানে হয়তো তোর লেখা পড়েই জন্ম নেবে ভবিষ্যতের সত্যেন বোস, জগদীশ চন্দ্র। আমাদের সমস্ত জ্ঞানের উপর আমাদের পরের প্রজন্মের দাবী আছে।"

রাত নিঝুম। গোটা সিয়াটল শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু মিরির ঘুম আসেনি। সে বিছানায় এপাশ ওপাশ করেছে অনেকক্ষন। একসময় সে বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
আকাশ এখন পরিষ্কার। কোন চাঁদের আলো নেই, হয়তো ডুবে গেছে আগে। বা হয়তো এখনো ওঠেনি। চাঁদের অবর্তমানে আকাশে এখন নক্ষত্রদের মেলা।

সিরাজুদ্দিন সাহেব মাঝে মাঝে তাদেরকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে আকাশের তারা দেখাতেন। এই সময়টাতে তিনি একটু অন্যমনস্ক হয়ে যেতেন। চোখেমুখে এক ধরনের ঘোর নেমে আসতো। উত্তর আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখাতেন ধ্রুবতারাটিকে।
"এই তারাটি হাজার বছর ধরে এই একই জায়গায় দেখা দেয় বলে এর নাম ধ্রুবতারা। আগেকার আমলের নাবিকদের দিক নির্নয়ের কাজে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।"
ছোট বোন বুড়ি এই সময়ে "খুব ঘুম পাচ্ছে" বলে কেটে পড়তো। তার কাছে তারা দেখার চাইতে অংক কষাও নাকি ভাল। মিরি বাবার কাছটিতে গুটিসুটি মেরে বসতো।
"ও বাবা, আমাকে সাত ঋষির তারাটা দেখাও না।"
সিরাজুদ্দিন সাহেব মৃদু হাসতেন। এই মেয়েটি স্বভাবে তার মতো হয়েছে।
"দেখাচ্ছি মা। ওই দ্যাখ, ধ্রুবতারার একটু উপরে তাকিয়ে দ্যাখ। ওখানে সাতটি তারা মিলে তৈরী করেছে এক বিশাল প্রশ্নচিহ্ন।
প্রকৃতি মানুষের কাছে সব সময়েই অমনি একটি প্রশ্নচিহ্ন। প্রাচীন ভারতীয়রা বলতো, সাতজন ঋষি মৃত্যুর পর আকাশে তারা হয়ে ফুটেছেন। এদের নাম কি জানিস? এরা হচ্ছেন মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু আর বশিষ্ঠ। তারপর ওই দিকে দ্যাখ, ওই উজ্জ্বল নক্ষত্রমন্ডলীর নাম কি জানিস? একে বলে উত্তর ফাল্গুনী, আর তার বাম দিকে আছেন মৃগশিরা। আর একটু উপরে ডান দিকে তাকালে ওই একগুচ্ছ তারার নাম আর্দ্রা।"

তারাদের নামগুলো ভারী সুন্দর। রোহিণী, ভরিণি, কৃত্তিকা, অশ্বিনী, বিশাখা, চিত্রা, মঘা। মিরি মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে কথা শুনতো। কত তারা আছে আকাশে?
সিরাজুদ্দিন সাহেবের আঙ্গুল আকাশের এমাথা থেকে ওমাথায় হেঁটে বেড়ায়। সবশেষে তিনি নির্দেশ করেন একটি লালচে রঙ্গের তারার দিকে।
"এই তারাটির নাম স্বাতী। আমার সবচেয়ে প্রিয় নক্ষত্র। কেন জানিস? একটা খুব সুন্দর গল্প আছে এই তারাটিকে নিয়ে। গল্পটি হোল, যখন বর্ষাকালে আকাশে স্বাতী নক্ষত্র ওঠে, তখন পানির নীচ থেকে উপরে উঠে আসে সহস্র ঝিনুক। ডালা খুলে তারা প্রতীক্ষা করে একটি জলবিন্দুর। এই সময়ে বৃষ্টির জলে মিশে থাকে স্বাতী নক্ষত্রের আলো। সেই বৃষ্টির ফোঁটা যদি কোন ঝিনুকের ভিতরে যায়, তবে তা থেকে তৈরী হয় একটি মুক্তো। স্বাতী নক্ষত্রের আলোর কারণে মুক্তোটি হয় নিখুঁত। আকাশের হাজার নক্ষত্রের ভিতরে এই একটি তারাই কেবল তার আলোকে দান করে পৃথিবীর মানুষের জন্যে।"

জানালা দিয়ে মিরি স্বাতীকে খুঁজলো আকাশে। সহস্র তারার ভিড়ে সিয়াটলের আকাশে স্বাতী নক্ষত্রকে খুঁজে পাওয়া যায়না। আজকের বৃষ্টি কি তবে নিস্ফলা? তাহলে হাজার ঝিনুকের প্রতীক্ষা ব্যর্থ হয়ে যাবে।

আস্তে আস্তে মিরি ফিরে এলো বিছানার পাশে। শাহেদ নাক ডেকে ঘুমাছে। বিছানার পাশে ছোট্ট ক্রিবের ভিতর শিশুটিও গভীর ঘুমে মগ্ন। ক্ষুদে হাতটি দিয়ে সে তার কান চেপে ধরে আছে।
মিরি অল্প হাসলো দৃশ্যটি দেখে। ক্রিবের পাশে দাড়িয়ে খুব সাবধানে সে শিশুটিকে কোলে তুলে নিলো। মায়ের শরীরের গন্ধ পেয়ে শিশুটি জেগে ওঠে। চোখ বড় বড় করে সে মাকে দেখে আর গাল ভরে হাসে।

মিরি শিশুটিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,"আমি তোমাকে আজ একটা দেশের গল্প বলবো। তুমি কি সে গল্পটি শুনতে চাও?"
শিশুটি এই রহস্যময় আলো আঁধারী পরিবেশে বেশ মজা পায়। সে আনন্দে চোখ মিট মিট করে।
মিরি কথা বলে চলে,"এখান থেকে বহুদুরের একটা দেশ। ভারী সুন্দর সেই দেশ, যে একবার সে দেশ দেখেছে সে আর কোনদিন ভুলতে পারেনা। সেই দেশের আকাশ, বাতাস, পানি, গাছপালা, সব কিছু সুন্দর। কিন্তু সবচেয়ে বেশী সুন্দর হছে সেই দেশের মানুষগুলো। তাদের গায়ে জামা নেই, পায়ে জুতো নেই, পেটে ভাত নেই, রোদের তাপে তাদের মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে। তবুও তারা খুব সুন্দর। অনেক কষ্ট বুকে নিয়েও তারা হেসে ওঠে, ধনুকের মত শরীর বাঁকা করে গুন টানতে টানতে তারা গান গায়, আকাশে একটি চিলকে উড়তে দেখে তারা কবিতা লেখে। সেই দেশের একটা কবিতা শুনবে তুমি?"

মিরির চোখ অশ্রুজলে ভরে আসে। কান্নায় তার গলা আটকে যায়, তবুও মন্ত্রোচারনের মত সে আবৃত্তি করে,
"আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।"

মিরির চোখের অশ্রুকণা চিকচিক করতে থাকে মৃদু আলোতে। স্বাতী নক্ষত্রের আলো। শিশুটি অপার বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

(রচনাটি উত্তর আমেরিকা থেকে প্রকাশিত একটি বাংলা পত্রিকায় আগে ছাপা হয়েছিল।)


মন্তব্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আপনার 'দেবদাস'-এর তুলনায় এই গল্পটি বেশ মলিন লাগলো। প্রধানত ঘটনা বিন্যাসের কারণে। সবকিছুই খুব প্রেডিক্টেবল, শুধু শেষের দিকে এই কয়েকটি সুন্দর বাক্য ছাড়া:

এখান থেকে বহুদুরের একটা দেশ। ভারী সুন্দর সেই দেশ, যে একবার সে দেশ দেখেছে সে আর কোনদিন ভুলতে পারেনা। সেই দেশের আকাশ, বাতাস, পানি, গাছপালা, সব কিছু সুন্দর। কিন্তু সবচেয়ে বেশী সুন্দর হছে সেই দেশের মানুষগুলো। তাদের গায়ে জামা নেই, পায়ে জুতো নেই, পেটে ভাত নেই, রোদের তাপে তাদের মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে। তবুও তারা খুব সুন্দর। অনেক কষ্ট বুকে নিয়েও তারা হেসে ওঠে, ধনুকের মত শরীর বাঁকা করে গুন টানতে টানতে তারা গান গায়, আকাশে একটি চিলকে উড়তে দেখে তারা কবিতা লেখে। ...

খুব রূঢ় সমালোচনা হলো কি? আপনার আগের লেখা পড়ে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে যে আপনি এর চেয়ে ভালো লেখার সামর্থ্য রাখেন। তাই স্পষ্ট করে বলা। ভুল বুঝবেন না আশা করি।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার সাথে একমত।
এই লেখাটি প্রায় চার বছরের পুরনো এবং আমি নিজেও খুব একটা খুশী নই লেখাটি নিয়ে। তবে সম্প্রতি আপনার একটি লেখা পড়ে (যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সবকিছু বলে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে) এই গল্পটি পোস্ট করতে ইচ্ছে হোল।
আমার উপর আপনার প্রত্যাশার কথা জেনে খুশী হলাম (এবং একই সাথে ঘাবড়ে গেলাম)।
ভাল থাকুন।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ঘাবড়াবেন কেন? লিখে যান।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

টিটো রহমান এর ছবি

উদ্ধৃতি
এখান থেকে বহুদুরের একটা দেশ। ভারী সুন্দর সেই দেশ, যে একবার সে দেশ দেখেছে সে আর কোনদিন ভুলতে পারেনা। সেই দেশের আকাশ, বাতাস, পানি, গাছপালা, সব কিছু সুন্দর। কিন্তু সবচেয়ে বেশী সুন্দর হছে সেই দেশের মানুষগুলো। তাদের গায়ে জামা নেই, পায়ে জুতো নেই, পেটে ভাত নেই, রোদের তাপে তাদের মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে। তবুও তারা খুব সুন্দর। অনেক কষ্ট বুকে নিয়েও তারা হেসে ওঠে, ধনুকের মত শরীর বাঁকা করে গুন টানতে টানতে তারা গান গায়, আকাশে একটি চিলকে উড়তে দেখে তারা কবিতা লেখে। ...

দেশে থেকেও পানি এল চোখে

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনার মন্তব্যটি পড়ে আমারও।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

অতিথি লেখক এর ছবি

দেশে যেতে ইচ্ছে করছে আপনার এই গল্প পড়ে। আরো কিছু ইচ্ছাও করেছে যেমন ধরেন মিরির মত একটা বউ হলে মন্দ হয়না।
----উলুম্বুশ

জাহিদ হোসেন এর ছবি

ভাই উলুম্বুশ- আপনার ইচ্ছাপূরণ হোক, এই কামনা করছি।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

অনন্দিতা এর ছবি

আকাশের হাজার নক্ষত্রের ভিতরে এই একটি তারাই কেবল তার আলোকে দান করে পৃথিবীর মানুষের জন্যে।"

পড়তে পড়তে খুব আনমনা হয়ে গেলাম।
চমৎকার।

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আমার স-ব-ই আছে মোটামুটি। শুধু হারগিলে দেশের মাটি-মানুষ ছাড়া।
... ...
হাহাকারটা চেপেই রাখি।
কিন্তু মাঝে মাঝে সেগুলো চরের মতোন জেগে ওঠে। আমাকে অশ্রুসজল করে আবার ডুবে যায়।

চোখ ভিজিয়ে দিলেন আবারও।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আশাকরি খুব বেশী মন খারাপ হয়নি আপনার।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

দ্রোহী এর ছবি

জুবায়ের ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বলতে হচ্ছে গল্পটা তেমন ভালো লাগেনি, দেবদাস পড়ার পর এটা তেমন জমেনি। শুধুমাত্র মিরির গল্পের সেই দেশটিতে যেতে খুব ইচ্ছা করছে। কয়েকটি দিনের জন্য হলেও যদি যাওয়া যেত............................. :(।


কি মাঝি? ডরাইলা?

জাহিদ হোসেন এর ছবি

বিদেশ জিনিসটি সব খানেই এক। উনিশ-বিশ আর কি। যদি সেখানে যাবার প্রবল ইচ্ছে থাকে, তবে নিশ্চয়ই যাওয়া হবে একদিন।
আর "দেবদাস" দেখি আমার অন্য লেখাগুলোর বাজার খারাপ করে দিচ্ছে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

আপনার দেবদাস লেখাটার ঠিক পড়েই পড়লাম, আমি তুলনা করার কোন কারণ খুজে পেলাম না। মনের মাঝে দাগ কেটে গেল লেখাটা। অনেক কথা মাথায় এসেছিল, কিন্তু থাক নাহয় পরে কোন একদিন বলা যাবে সেসব কথা, অনেকদিন আপনার নতুন কোন লেখা দেখিনা!

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

তিথীডোর এর ছবি

আচ্ছা, ইউএসএ থাকেন এমন কোন সচলের সঙ্গেই কি জাহিদ হোসেনের কোনরকম যোগাযোগ নেই?
এই ভদ্রলোকের লেখা বড্ড মিস করি।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।