দেখা হবে। পর্ব-৪।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: শুক্র, ২৮/০৩/২০০৮ - ২:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পর্ব-১ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পর্ব-২ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পর্ব-৩ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পর্ব-৪

"আর ইউ বিজি নাউ, ডক্‌?"
মাহমুদ কাগজপত্র থেকে মুখ তুলে তাকায়।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রনি, হাতে সদ্য প্রস্তুত কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে।
পুরো নাম রোনালড্‌ চাইল্‌ড্‌স। ডঃ রোনালড্‌ চাইল্‌ড্‌স। চার মাস আগে এসেছে এখানে কাজ করতে। সে দীর্ঘদেহী আমেরিকান, টেক্সাসের লোক তা দেখলেই বোঝা যায়। প্রথম দর্শনেই মনে হবে যেন সে জন ওয়েন অথবা ক্লিন্ট ইস্টউডের কোন কাউবয় ছবির সেট থেকে উঠে এসেছে। লাল টকটকে গায়ের রং, পরনে রং ওঠা জিনসের টাইট প্যান্ট, গায়ে চেক-কাটা লাল রঙ্গা ফানেলের শার্ট, পায়ে কোন সুদর্শন সাপের চামড়ায় তৈরী হাটু পর্যন্ত ওঠানো চোখা বুট। কোমরে তিন ইঞ্চি চওড়া বেলট, তাতে লাগানো আছে চকচকে পিতলের বিশাল বকলেস। হিসেব মতো তার মাথায় একটা চওড়া হ্যাট থাকা উচিত, কিন্তু বোধহয় ঘরের মধ্যে আছে বলে হয়তো এখন সে সেটা পরে নেই।

রনিকে দেখে বোঝার অবশ্য কোন উপায় নেই যে সে আসলে খুবই ছেলেমানুষ এবং তার এই বিশালদর্শন অবয়বের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটি কোমলহৃদয় হাসিখুশী মানুষ। সে পিএইচডি শেষ করেছে অল্প কিছুদিন আগে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো থেকে। এখন পোষ্ট ডক্টরেট করতে এসেছে মাহমুদদের ল্যাবোরেটরীতে।

"নাহ তেমন একটা না। কিছু বলবে তুমি?"
"আমার এক্সপেরিমেন্টের কিছু রেজাল্ট নিয়ে তোমার সাথে আলোচনা করতে চাচ্ছিলাম। তোমার এখন অসুবিধা থাকলে আমি নাহয় পরে আসবো।"
"না, তার কোন দরকার নেই। আমি জাস্ট একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম। তোমার সাথে কথা বলতে পারবো এখন। এসো, ভিতর এসো।"
রনির মুখে এবার বিশাল একটি হাসির উদয় হয়।
"থ্যাংক ইউ, ডক্‌। আমি আমার ল্যাব নোটবুকটা নিয়ে আসছি এক দৌড়ে। কফিটা তোমার টেবিলে রেখে গেলাম।"
রনি সত্যি সত্যি দৌড়ে চলে যায়। মাহমুদ একটু উঁকি দিয়ে দেখলো যে পুরো কাপটাই ভর্তি। তার মানে শ্রীমান রনি দীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্যেই এসেছে। কয় ঘন্টা সময় খাবে কে জানে? তাতে অবশ্য সে বিরক্ত নয়। রিসার্চ নিয়ে কথা বলতে মাহমুদের কখনো ক্লান্তি আসেনা। আর রনি আসরে লোক, তার সাথে কথা বলতে সবাইই আনন্দ পায়।

মাহমুদ নিজেও এখন পোষ্ট ডক্টরেট করছে। ক্যানাডার ঠিক মাঝখানের শহর উইনিপেগ। এখানকার ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানিটোবার জেনেটিকস ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর স্টুয়ার্ট কোহেন এর আন্ডারে কাজ করছে প্রায় দু বছর ধরে।
বায়োলজিক্যাল সায়েন্স এর এই একটা ঘাপলা আছে। পি এইচ ডি শেষ করেও আবারও পোষ্ট ডক্টরেট করতে হয় কিছুদিন। এর আগে চাকরি-বাকরির আশা করাটা অপরাধ। অন্যান্য ফিল্ডে এই সমস্যাটা নেই, তারা পি এইচ ডির থিসিসটা কোনভাবে জমা দিয়েই বেশ দিব্যি চাকরিতে ঢুকে যাচ্ছে টুক করে। এই নিয়ে খুব একটা নালিশ করেও ফায়দা নেই। বড় বড় নোবেল লরেটরাও এই পথ দিয়ে গেছেন, সেখানে বাংলাদেশের মাহমুদ হাসান তো কোন ছার।

মাহমুদ পি এইচ ডি করেছিল সেল বায়োলজির উপর ফ্লোরিডা থেকে। সেটার শেষের দিকে একদিন তার শিক্ষাগুরু ফিলিপ মারফি ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাকে নিজের অফিসে।
"তোমার থিসিস জমা দিতে আর কতদিন লাগবে?"
"মাসদুয়েকের মধ্যেই হয়ে যাবে আশা রাখি।"
"তার পরের প্ল্যানটা কি তোমার?"
"আমি তেমন সিরিয়াসলি ভাবিনি, তবে দেশেই ফিরে যাবো ভাবছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারীতেই যোগ দেব আবার।"
"নট ব্যাড। সেখানে রিসার্চ করার সুযোগ কেমন?"
"কিছু কিছু কাজ হয়, তবে এখানকার তুলনায় খুবই সামান্য।"
"এখন গিয়ে চাকরি শুরু করলে তুমি আবার কবে বাইরে আসতে পারবে?"
"চার-পাঁচ বছরের আগে না।"
"তাহলে তোমাকে একটা উপদেশ দেই। এখনি দেশে যেওনা। আরো অন্ততঃ বছর দুয়েক কাটিয়ে যাও এদিকে। তুমি এখন ইয়াং, বিয়ে-টিয়ে করোনি, ঝুট-ঝামেলা কম। কাজ শেখার এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। একবার সংসারের মধ্যে ঢুকে পড়লে কাজের গতি কমে আসবে। ভাল করে কাজ করলে দু'বছরে এখন তোমার খান দশেক আর্টিকেল পাব্লিস হবে। তুমি তো জানোই গবেষণার জগতে নাম্বার অফ পাবলিকেশনটাই সবাই দেখে। সেটা মজবুত করে তার পরে দেশে যেও, পরে তুমি যদি আবার এদিকে আসতে চাও, তখন এই পাবলিকেশনগুলো তোমার কাজে লাগবে। আমার ল্যাবে তোমার কিছুটা গবেষণার ট্রেনিং হয়েছে, আমার মনে হয় এখন তোমার মলিকুলার বায়োলজির কিছু কাজ শেখা উচিত। এখনকার দিনে এটা খুবই ইউজফুল জিনিস।"

মাহমুদ চুপ করে বসে ছিল। সে ব্যাপারটাকে এতো তলিয়ে দেখেনি। কিন্ত মারফি বাবাজী হঠাত্ করে তার ব্যাপারে এতো উত্সাহিত কেন?

"কাল আমাকে স্টু ফোন করেছিল ক্যানাডা থেকে। স্টু মানে স্টুয়ার্ট কোহেন। সে তোমার ব্যপারে বেশ ইন্টারেস্ট দেখাল। তার ওখানে একটা পোস্ট-ডক্টরেটের পজিশন খালি হয়েছে। তুমি সেখানে গেলে ভালই হবে। স্টু এখন কাজ করছে ক্যানসার জেনেটিক্স এর উপর। মলিকুলার বায়োলজি শেখার জন্য তার ল্যাব খুবই ভাল জায়গা।"

ঝোলার মধ্যে থেকে বেড়াল বেরোল এতক্ষনে!

"অবশ্য আই মাস্ট ওয়ার্ন ইউ এ্যবাউট টু থিংস। নাম্বার ওয়ান, স্টু ভয়ানক কাজপাগলা লোক এবং কিছুটা রগচটা, সেই জন্য তার কাছে লোক বেশীদিন টেকেনা। আর দু'নাম্বার জিনিসটা হচ্ছে যে সে আছে উইনিপেগ বলে একটা মাঝারি আকারের শহরে। সেখানে শীতকালে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে। তুমি গরম দেশের লোক, আমেরিকাতে এতদিন থেকেও এখনো বরফ পড়া দেখোনি ফ্লোরিডাতে থাকার কারনে। কাজেই তুমি সেই ঠান্ডার রাজ্যে গিয়ে টিকতে পারবে কিনা, সেটাও চিন্তা করে দেখো।"

শেষ পর্যন্ত তাইই হোল। পি এইচ ডি শেষ করার পর তল্পিতল্পা গুটিয়ে ক্যানাডা চলে এলো মাহমুদ। দেশে ফেরার প্ল্যানটা স্থগিত থাকলো কয়েক বছরের জন্য। মাহমুদ ভেবেছিল এতে সবচাইতে তুলিরই বেশী মন খারাপ হবে। মাহমুদের সাথে তারই বেশী খাতির। কার্যতঃ দেখা গেল, সেমনটি নয়। তুলি মহা খুশী এই সংবাদে। মাহমুদ একটু অবাক হয়েছিল। মেয়েরা চিরকালই তার কাছে দুর্বোধ্য।

টেলিফোনের তারে তার উল্লসিত কণ্ঠ শুনে মাহমুদ ফোঁড়ন কেটেছিল। " আমি কি তোদের পর হয়ে গেলাম নাকি রে? আমার দেশে আসা হবেনা শুনে তো তোর মন খারাপ করা উচিত। আমি তো ভেবেছিলাম যে অন্ততঃ তুই আমাকে দশ বার সাধাসাধি করবি ফিরবার জন্য। অন্ততঃ পক্ষে বার কয়েক কান্নাকাটি করবি।"
"তোমার মাথায় প্র্যাক্টিক্যাল বুদ্ধি-সুদ্ধি চিরকালই কম, বড়দা। তুমি এই মুহুর্তে দেশে ফিরে এলে দুটো বড় সমস্যা হবে। এক নাম্বার, মাঝে মাঝে তোমার মাধ্যমে ছোটখাট দু' চারটে বিদেশী জিনিস-টিনিস পাই, তুমি ফিরে এলে সেটা বন্ধ হবে। আর এখানে সেসব জিনিস তোমার মাস্টারীর বেতনে আমাকে কিনে দিতে পারবেনা। আমি জানি এটা একটু স্বার্থপর টাইপের কথা হয়ে গেল। মেয়েরা কসমেটিকসের ব্যাপারে একটু স্বার্থপর হয়ই।"
"আর দ্বিতীয় কারণটা কি?"
"সেটা তোমার ভালর জন্যেই। দেশে ফেরার সাথে সাথে বিয়ের পাত্র হিসেবে তোমার বাজারমূল্য একলাফে অর্ধেক হয়ে যাবে। দেশী ইউনিভার্সিটির মাস্টারের চাইতে বিদেশ-বসবাসরত পাত্রের দাম অনেক বেশী। আজকাল তো রাস্তায় বেরোলে শুধু মেয়ে খুঁজি তোমার জন্য। সেদিন গাউসিয়ায় গিয়ে দেখেছিলাম একজনকে, অলমোস্ট ফিলম স্টারের মতো দেখতে। তোমার সাথে হেভী মানাতো। আমি সাথে সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু অতিশয় দুঃখের ব্যপার যে মেয়েটা অলরেডী এনগেজড্‌। তিন সপ্তাহ পর বিয়ে, ছেলে নিউইয়র্কে থাকে। চিংড়ী মাছের ঢাকার সব সুন্দরী মেয়েগুলোও আজকাল বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশী পাত্রেরই আজকাল ভাত নেই। তার উপর যদি শোনে যে পাত্র মাস্টারী করে, তাহলে মেয়েপক্ষের লোকেরা ঝাঁটাপেটা করবে। "

"কাঁঠাল গাছেরই খোঁজ নেই, আর তুই গোঁফে তেল মেখে বসে আছিস। তোকে কে বললো যে আমি এখন বিয়ের চিন্তা করছি?"

"ওমা, আমি কি একবারও বলেছি যে তুমি বিয়ের চিন্তা করছো? তুমি তোমার রিসার্চের চিন্তাই করতে থাকো, বিয়ের চিন্তা তো করছি আমরা। যুতসই একটা মেয়ে পেলেই তোমাকে ফোন করে দেব, সাতদিনের মধ্যে বিয়ে কমপ্লিট করে ভাবীসহ তুমি কেটে পড়বে। তারপর দেখা যাবে তোমার রিসার্চের চিন্তা কোথায় যায়।"

"তোরা দেখি মহা ঝামেলায় ফেলবি আমাকে। জানা নেই, শোনা নেই, কোথথেকে কাকে ধরে এনে আমার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিবি, আর তারপর আমাকে সেই সব বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে।"

তুলি এ কথায় খুবই মজা পায়। সে হাসতে হাসতে বলে,"ভয়ে নিশ্চয়ই তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে, বড়দা। সব সময় এত পুতু পুতু করো কেন বলতো? চিন্তা করোনা, তোমার জন্য আমি বেছেবেছে ভীষন নিরীহ দেখেই একটা মেয়ে সিলেক্ট করবো, যে সাত চড়েও রা করবে না। সেই বাবুরাম সাপুড়ের কবিতার সাপের মতো, 'করেনাকো ফোঁসফাঁস, মারেনাকো ঢূস ঢাস'।"
"আর তাতে তোমার ভারী সুবিধে হবে সেই মেয়ের উপর সর্দারী করার। তোমার কুটিল প্ল্যান কি আমি বুঝিনা ভেবেছো তুলি বেগম?"
"ও বাবা, যার জন্যে চুরি করি, সেই বলে চোর। বিয়ে করার আগেই বৌ এর হয়ে আমার সাথে ঝগড়া করছো।"

ক্যানাডা যাবার সংবাদে সবচেয়ে বেশী মর্মাহত হলেন বাবা। ফোনে শুধু বললেন,"আরো পড়াশুনা করতে হবে? দেখো, তুমি যেটা ভাল মনে করো।"
মাহমুদ আশ্চর্য হয়েছিল। তার জীবন নিয়ে বাবা কোন দিনও তেমন মাথা ঘামাননি, মাহমুদের রেজাল্ট বের হলে বা বিদেশ আসবার সময়েও তার মুখে কখনো আনন্দ বা দুঃখের ছায়া পড়েনি। চিরটা কালই বাবা একাকী পথ হেঁটেছেন, সংসারের আর কারো পথের হদিশ তিনি জানবার চেষ্টা করেননি।

"আই এ্যাম ব্যাক্‌, ডক।"
রনি ফিরে এসেছে তার নোটবই নিয়ে। মাহমুদ দ্রুত হাতে তার টেবিলের কাগজপত্র সরিয়ে জায়গা করে দেয়।
"পেপার লিখছো নাকি ডক?"
"আরে না। তিন সপ্তাহ পরে একটা কনফারেনসে যাবো, তারই মাল মশলা তৈরী করছিলাম। এখনো হাতে সময় আছে, পরে করলেও হবে। তোমার সমস্যাটা শুনি এখন।"

রনি কাজ করছে অংকোজীন নিয়ে। ক্যানসার বায়োলজির বর্তমান থিওরী অনুযায়ী প্রতিটি প্রাণীকোষে হাজার হাজার জীনের মধ্যে কিছু কিছু অংকোজীন থাকে। এরা হচ্ছে দুস্কৃতিকারী জীন, এরা এ্যাকটিভ্‌ হলে নিরীহ প্রাণীকোষটি তখন রূপান্তরিত হয় ভয়াবহ ক্যানসার প্রাণীকোষে। ক্যানসার প্রাণীকোষটি তখন দ্রুত গতিতে বিভাজিত হতে থাকে এবং অতি অল্প সময়ে টিউমারের জন্ম দেয়। প্রকৃতি সমতা রক্ষার জন্য আবার একই সাথে কিছু জীনকে সৃষ্টি করেছেন অংকোজীন গুলোকে সামলে রাখার জন্য। প্রাণীকোষের শান্তিরক্ষাকারী এই জীনগোষ্ঠীকে বলে টিউমার সাপ্রেসর জীন এবং এদের কারণেই ক্যানসার এখনো মহামারী হিসেবে দেখা দেয়নি। তবে বয়েস বাড়ার সাথে সাথে এদেরও কিছু কার্যকারিতা কমে আসে এবং সেই সুযোগে অংকোজীনেরা তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
প্রথম যখন অংকোজীনদের অস্তিত্ব আবিস্কৃত হোল, তখন সারা বিজ্ঞানী মহলে আশার সঞ্চার হয়েছিল, এইবার বোধকরি ক্যানসার রোগকে দমন করা যাবে। আস্তে আস্তে দেখা গেল, ব্যাপারটি অত সহজ নয়। একে তো অংকোজীনেরা সংখ্যায় অনেক, আর তার উপর কে যে কখন কোথায় চুপি চুপি তার মরণ ছোবল হানছে, তা প্রথমে ধরতে পারাটা খুবই কঠিন। যখন ধরা পড়ে, ততদিনে তাদের ধবংসযজ্ঞের আয়োজন শেষ, তৈরী হয়ে গিয়েছে সহস্র ক্যানসারবীজ।
তবুও মানুষ হার মানেনি, গোঁয়ারের মতো ল্যাবে কাজ করে যাচ্ছে শত বিজ্ঞানী, মাইক্রোস্কোপের নীচে নিদ্রাহীন চোখে তাকিয়ে আছে রহস্যময় ছোট্ট প্রাণীকোষগুলির দিকে, জানতে চেষ্টা করছে ভয়াবহ এই রোগটির অদৃশ্য ষড়যন্ত্রীদের।
প্রস্টেট ক্যানসারের অংকোজীন গুলো এখনো ভাল করে বের করা হয়নি। রনির এলেম আছে। এই তিনমাসের মধ্যেই সে দুটো নতুন অংকোজীন বের করে ফেলেছে। খুব শিগগীরই তার আর্টিকেল নামকরা নেচার জার্নালে ছাপা হবে। সম্প্রতি সে তৃতীয় একটি অংকোজীন খুজে পেয়েছে এবং সেটার অস্তিত্ব প্রমান করার জন্য কয়েকটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিল গত সপ্তাহে। সেগুলোরই রেজাল্ট নিয়ে আলোচনা করতে এসেছে রনি।

"আই এ্যাম লিট্‌ল কনফিউজড্‌, কিছু কিছু ডাটা মিলছেনা আমার থিওরীর সাথে।"
"কি রকম?"
"থিওরী অনুযায়ী এ্যাকটিভ অংকোজীন গুলোকে পাওয়া যাবে শুধু টিউমার টিস্যুতে, রাইট? গত সাত দিনে আমি প্রায় পঞ্চাশটি নরমাল আর প্রস্টেট টিউমার টিস্যু এ্যানালাইজ করেছি। তৃতীয় অংকোজীনটিকে আমি অনেক নরমাল টিস্যুতে পাচ্ছি, আবার অনেক টিউমার টিস্যুতে পাচ্ছিনা। তাহলে কি এটা রিয়েল অংকোজীন না?"

মাহমুদ ঝুঁকে পড়ে নোটবুকের উপর। ঝকঝকে হাতের লেখায় রনি বর্ণনা করেছে তার এক্সপেরিমেন্টকে। তার পাশাপাশি সাঁটা আছে বিভিন্ন প্রকারের গ্রাফ আর ডায়াগ্রাম। মাহমুদ মনে মনে তারিফ না করে পারেনা। সে নিজেও তার কাজের এত বিস্তারিত নোট রাখেনা। রনি চুপচাপ বসে কফি খায়। মাহমুদ পড়ে চলে।

"আমি জানতাম যে এখানেই তোমাদের দুই ইডিয়েটকে পাওয়া যাবে।"
শুনশান নিস্তব্ধতার মধ্যে বাঁজখাই গলার একটি আওয়াজ শোনা যায় অকস্মাত্। ওরা দুজনাই মুখ তুলে তাকায় একই সাথে।

দরজায় দাড়িয়ে আছে প্রফেসর কোহেন। অত্যন্ত মেধাবী বিজ্ঞানী এবং সুনামধন্য শিক্ষক। দেখতে ছোটখাটো, কিন্তু ঈশ্বর সে ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছেন বাঘের মতো কণ্ঠস্বর দিয়ে। এবং একই সাথে দিয়েছেন প্রচন্ড বদমেজাজ। রেগে গেলে তার মুখের ঠিক থাকেনা, কাগজপত্র ছুঁড়ে ফেলে রীতিমত অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দেয়। তার কাছ থেকে ইডিয়েট সম্বোধন পাওয়াটা রীতিমতো ভাগ্যের ব্যপার। এটি তার আদরের ডাক।

"প্যাক ইওর থিংস, এ্যান্ড গো হোম বয়েজ।"
'‘কেন?" মাহমুদ অবাক হয়। সবে বিকেল চারটে বাজে। ছ'টা সাতটার আগে তারা কেউই ঘরে ফেরেনা সাধারণতঃ। আজ ভূতের মুখে রামনাম কেন?
"তোমাদের মতো ইডিয়েট ছাড়া এই প্রশ্ন আর কে করবে? রেডিওতে ঘোষনা করেছে যে আজ সন্ধ্যায় একটা বড় তুষারঝড় আক্রমন করবে উইনপেগ শহরকে। মিনিমাম তিন ফিট বরফ পড়ার কথা আগামী চব্বিশ ঘন্টায়। সবাই তাই আগেভাগে বাড়ী চলে যাচ্ছে। পুরো ক্যাম্পাস অলরেডী ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি নিজেও চলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পরে মনে হোল যে তোমাদের খোঁজটা করে যাই। আই এ্যাম গ্ল্যাড যে এই বুদ্ধিটা আমার মাথায় এসেছিল। আমি না এলে তোমরা দুই ইডিয়েট আজ রাতে আর ঘরে ফিরতে পারতে না। এখানেই আটকা পড়তে আটচল্লিশ ঘন্টার জন্য। তার মধ্যে যদি ইলেক্ট্রিসিটি চলে যেত, তাহলে নির্ঘাত ফ্রষ্ট বাইটের শিকার হতে। এনি ওয়ে, রান ফর ইওর লাইফ, বয়েজ।"
মাহমুদ একটু আমতা আমতা বলে বলে, "কিন্তু আমার যে একটা এক্সপেরিমেন্ট চলছে। তার রিডিং নিতে হবে সন্ধ্যে ছ'টায়।"

"-- ইওর এক্সপেরিমেন্ট। ইট ইজ আ কোশ্চেন অফ ইওর লাইফ।"
কোহেনের মুখ থেকে এবার অশ্লীল গালি বেরোয়। তার মেজাজের পারদ যথেষ্ট বেড়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে। মাহমুদ প্রেইরীর কঠিনতম ব্লিজার্ডকে সামলাতে ভয় পায়না, কিন্তূ স্টুয়ার্ট কোহেনের মেজাজকে মোকাবেলা করার মতো সাহসী না। এর পর কথা বললে ব্যাটাচ্ছেলে হয়তো মেরেই বসবে।
"স্যরি।" মাহমুদ আর কথা বাড়ায় না। টেবিলের পাশ থেকে ব্যাকপ্যাকটা তুলে ঘাড়ে নেয়।
চলে যেতে যেতে প্রফেসর কোহেন বলে," আবহাওয়ার উন্নতি না হলে কালকে কাজে আসবে না। বাসায় বসে ঘুমাবে। ইউ গাইজ আর ম্যানিয়াক, ডু ইউ নো দ্যাট?"

মাহমুদের গাড়ী নেই, সে সাধারণতঃ বাসে করেই কাজে আসে। কিন্তু আজকে বাসের আশায় বসে থাকাটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। সে একটা ট্যাক্সি নেবে ভেবেছিল, কিন্তু রনি বললো,"ডোন্ট ওয়ারী, ডক। আই উইল ড্রপ ইউ অফ।"

ক্যাম্পাসের রাস্তায় লোকজন বেশী নেই। সন্ধ্যা নেমে আসছে। গাড়ীর রেডিওতে বারবার ঘোষনা দেওয়া হচ্ছে যেন সবাই তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যায়।
"আজকে রাতে তাপমাত্রা নেমে যাবে শূন্যের চল্লিশ ডিগ্রী নীচে। তার সাথে থাকবে উত্তর মেরু থেকে ঘন্টায় সত্তুর কিলোমিটার গতিতে বয়ে আসা কঠিনতম হিমেল বাতাস। এই দুই প্রবল শক্তির মিলন ঘটবে উইনিপেগ শহরটিতে আজ রাত দশটার দিকে। বাতাসের কারণে বিদ্যুৎ চলেও যেতে পারে। অতএব সবাই যেন ঘরে কিছু খাবার, এবং ফায়ারপ্লেসের জন্য কাঠ জমা করে রাখে। কেননা অন্ততঃ দুইদিনের আগে কোন দোকানপাট খুলবে না, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত।"

উইনিপেগ বরফের শহর। বছরের প্রায় ছ' মাসই সারা শহর ঢাকা থাকে বরফের আস্তরে। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তাপমাত্রা সব সময়েই মাইনাস এর ঘরে থাকে। ঠান্ডাকে কিভাবে মোকাবেলা করতে হয় সেটা এখানকার মানুষেরা ভালই জানে। তারপরও এই রকম সতর্কবাণী প্রচার করার অর্থ একটাই হয়।

যিনি আসছেন তিনি কোন হেঁজিপেঁজি ব্লিজার্ড না।

"ডক, তুমি কি কোন দোকানে যেতে চাও কেনাকাটার জন্য? ঘরে রসদপত্র ঠিকমত আছে তো?" গাড়ী চালাতে চালাতে রনি জিজ্ঞেস করে।
মাহমুদের মাথা এই মুহুর্তে কাজ করছেনা। তার মেজাজটাই খারাপ হয়ে আছে আজকের এক্সপেরিমেন্টটা করতে না পারার জন্য। গত সাতদিন ধরে সে এটার উপরে কাজ করে আসছে, একদম শেষ বেলায় এসে সবকিছু ভন্ডুল হয়ে গেল তুষারঝড়ের কারণে। এখন আবার শুরু থেকে ধরতে হবে।
শালা ব্লিজার্ডের বাচ্চা! তুমি আর আসবার সময় পেলেনা!

"আর ইউ ওকে, ডক? আর ইউ স্কেয়ার্ড? ভয় লাগছে তোমার? আমি এক উইন্টারে ড্রাইভ করে মিনেসোটা থেকে নর্থ ড্যাকোটাতে যাচ্ছিলাম। পথে পড়েছিলাম এক ব্লিজার্ডের মধ্যে। ওফ- সে এক মর্মান্তিক অবস্থা। পুরো হাইওয়ে বরফের নীচে ঢাকা পড়লো দশ মিনিটের মধ্যে। কোনটা রাস্তা আর কোনটা মাঠ তার কিছুই বুঝবার উপায় নেই। ভাগ্যিস, কিছুক্ষন পরেই হাইওয়ে পেট্রোলের একটা পুলিশ কারের দেখা মিলেছিল। তা না হলে আমাকে আর জ্যান্ত পাওয়া যেত না সেবার।" রনি কথা বলেই চলে।

ঘরে এসে ফ্রিজটা খুলে মনটা আরো কয়েক ডিগ্রী খারাপ হয়ে গেল। সেখানে খাবার বলতে তিন দিন আগের রান্না করা ছোলার ডাল আর অল্প একটু মাংস। দুটো থেকেই একটু টক-টক গন্ধ বেরোচ্ছে। রনির প্রস্তাব অনুযায়ী একবার গ্রোসারীর দোকানে যাওয়া উচিত ছিল। আজ রাতে কপালে আর খাওয়া দাওয়া জুটবে বলে মনে হচ্ছে না। কুকি বা চিপস দিয়েই কাজ চালাতে হবে।
শালা ব্লিজার্ডের বাচ্চা!

গায়ের ভারী পার্কাটা খুলতে খুলতে নজরে এল যে টেলিফোনের এ্যানসারিং মেশিনের লাল বাতিটা দপদপ করছে। কে আবার ফোন করে মেসেজ রাখলো এই দিনে। সুইচ টিপে মেশিনটা চালিয়ে দিল মাহমুদ।

"বৈজ্ঞানিক সাহেব, আমি শামস্‌ বলছি। এই একটু আগেই রেডিওতে ব্লিজার্ডের ঘোষনা শুনলাম। আপনার কাজের জায়গাতেও ফোন করেছিলাম, সেখানে কাউকে পেলামনা । আশা করি আপনি ঝড় শুরু হবার আগেই বাসায় ফিরে আসবেন এবং আমার মেসেজটা পাবেন। আসল কথা হচ্ছে এই যে আমার হিসাব মোতাবেক এই মুহুর্তে আপনার বাসায় কোন তৈরী খাবার নেই এবং আপনি নিশ্চয়ই কোন কিছু কিনে আনার কথাটাও চিন্তা করেননি। আপনি আমার মেসেজটা পেয়েই আমাদের বাসায় চলে আসুন। রাতে আমাদের সাথে খাবেন এবং জ্বালানোর জন্য কিছু ফায়ার উড্‌স্‌ও নিয়ে যাবেন। রাতে বোধহয় কারেন্ট থাকবেনা, এগুলো দিয়ে কোনভাবে ঠেকার কাজ চালাতে পারবেন। আমরা আপনার জন্য বসে আছি, অতএব যতদ্রুত সম্ভব চলে আসুন। অবশ্য যদি কোন এক অলৌকিক ভাবে আপনার কাছে এই মুহুর্তে খাবার এবং ফায়ার উডস থাকে, তাহলে আর আসবার দরকার নেই। শুধু একটা ফোন করে আমাদের জানিয়ে দিলেই খুশী হবো। এবং একই সাথে আমার হিসেবের ভুলের জন্য এবং সেই কারণে আপনার ভাবীর কাছে বাজীতে হারার জন্য ভয়ানক দুঃখ পাবো।"

মাহমুদের চোখে পানি এলো। কিছু কিছু মানুষ অপরিসীম মমতা এবং দুরের লোককে আপন করবার এক অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে এই পৃথিবীতে আসে। শামস রব্বানী আর তার স্ত্রী সুরাইয়া সেই বিরল জনগোষ্ঠীর দুই সদস্য। তারা মাহমুদের ফ্ল্যটেরই তিনতলায় থাকেন। ভদ্রলোক চাকরি না পেয়ে এখন ট্যাক্সি চালান, মহিলা বাসায় বেবী সিটিং করেন। টানাটানির সংসার, কিন্তু হূদয়ের বিস্তৃতিতে তারা কোটিপতি।

রাতের খাওয়া এবং জমজমাট আড্ডা সেরে ঘরে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত দশটা বাজলো। বাইরে ইতিমধ্যে বরফ পড়া শুরু হয়ে গেছে জোরেশোরে। মেরুর বাতাস এখনো এসে পৌছায়নি, তবে মাঝে মাঝে দমকা ঝাপটায় দুলে উঠছে পাইন গাছের ডালপালারা।

টেলিভিশনে ঘোষনা দেওয়া হোল, উইনিপেগ এয়ারপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কবে খুলবে সেটা এইমুহুর্তে অনিশ্চিত। প্রধান হাইওয়েগুলো তো ইতিমধ্যেই বরফে ঢাকা পড়েছে। প্রেইরীর ছোট্ট শহর উইনপেগ এখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন সভ্য জগত থেকে। দুরুদুরু বুকে সে অপেক্ষা করতে থাকে।

ঝনঝন শব্দে ফোন বাজলো। মাহমুদ অবাক হয়। ফোন লাইনটা কাজ করছে এখনো?
"হ্যালো।"
"বড়দা, আমি তুলি বলছি। তুমি কেমন আছো?"
তুলির গলার স্বরটা কেমন ভেজা ভেজা শোনায়। ওরা কি তবে এর মধ্যেই ব্লিজার্ডের সংবাদ পেয়ে গেল নাকি? অসম্ভব না, আজকাল স্যাটেলাইট টিভি আর সি এন এন এর কল্যানে খবর যেতে বেশীক্ষন লাগেনা।
"আমি আছি ভালই। তোদের খবর কি? তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন? ঠান্ডা লেগেছে নাকি?"
তুলি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। "বড়দা, গতকাল রাতে আব্বার ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। আমার খুব ভয় লাগছে। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো চলে এসো।"

টেলিভিশনে পর্দায় তখন উইনিপেগ এয়ারপোর্টকে দেখাচ্ছে। গোটা রানওয়েটা তখন ফুট খানেক বরফের নীচে।

মাহমুদের হাত থেকে রিসিভার মাটিতে পড়ে গেল।

পরের পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।


মন্তব্য

উদাস এর ছবি

একেবারে গরম থাকতে থাকতে লেখাটা পড়ে ফেললাম। তরতর্ করে উপন্যাস আগাচ্ছে, থামাবেন না। বেশ ভালো লাগছে।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

মুগ্ধ হয়ে পড়ছি...চলুক
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

জাহিদ হোসেন এর ছবি

কেউ একজন থামতে বলেন না ভাই। তাহলে এই ভার ঘাড় থেকে নামাতে পারি।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

নিঝুম এর ছবি

দেরী করে পড়লাম।দারুন এগুচ্ছে।
--------------------------------------------------------
শেষ কথা যা হোলো না...বুঝে নিও নিছক কল্পনা...

---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন

debottom এর ছবি

আপনার লেখা না পড়লে অনেক কিছুই জানা হতো না । এতো ভালো খুটিনাটি সহ লেখা,
আজকে প্রথম এই সাইটে আসা আর প্রথম মোলাকাতেই ভালোবাসা,
লিখে চলুন

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আশাকরি আপনার লেখাও আমরা পড়তে পারবো শিগগীর।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।